আমরা কি ব্যর্থ সমাজের দিকে এগিয়ে চলেছি?
Published: 8th, April 2025 GMT
আমরা প্রায়ই ব্যর্থ রাষ্ট্রের কথা বলি; শুনিও। কিন্তু কখনও ব্যর্থ সমাজের কথা বলি না। আসলে রাষ্ট্র ব্যর্থ হয় না; ব্যর্থ হয় সমাজ। সমাজ ব্যর্থ হলেই রাষ্ট্রের ব্যর্থতা অনিবার্য হয়ে ওঠে। কারণ, রাষ্ট্র হলো ব্যবস্থাপনা কাঠামো মাত্র, যার মূল নিহিত সমাজের মাঝেই। আজকের পৃথিবীতে যেসব রাষ্ট্রকে আমরা ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করি, সেগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যাবে, ওসব দেশে সমাজের ব্যর্থতার পথ ধরেই রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছে।
প্রশ্ন হলো, সমাজ কখন ব্যর্থ হয়? তার লক্ষণগুলোই বা কী? শত বছরেরও বেশি আগে জগদ্বিখ্যাত রাশিয়ান লেখক আন্তন চেখভ ব্যর্থ সমাজের প্রকৃতি সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘ব্যর্থ সমাজে মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞানে জেগে ওঠে না। সে জেগে ওঠে স্লোগানে। এখানে পাঠাগার কম থাকে। উপাসনালয় বেশি থাকে। যেউপাসনালয়গুলো আবার সপ্তাহের ছয় দিনই খালি পড়ে থাকে। ব্যর্থ সমাজে প্রত্যেক চিন্তাশীল মানুষের বিপরীতে হাজার হাজার বোকা থাকে এবং প্রতিটি সচেতন শব্দের বিপরীতে থাকে হাজার হাজার পচনশীল শব্দ। তারা সমস্যার ওপরে ভেসে বেড়ায়; গভীরে প্রবেশ করতে পারে না। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হয় সর্বদা নির্বোধ। সমাজের অতি তুচ্ছ বিষয়গুলো নিয়ে মানুষ আলোচনায় মেতে থাকে। মূল বিষয়গুলো হারিয়ে যায়। সমস্যা সমাধানের চেয়ে একে অন্যের ওপর প্রতিনিয়ত দোষ চাপাতে থাকে।’
চেখভের কথাগুলোকে কেউ যদি আজকের বাংলাদেশের সমাজের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে গিয়ে শিউরে ওঠেন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এ দেশে জ্ঞানের চর্চা এখন বোকাদের বিষয়; সস্তা জনতোষণবাদী স্লোগানে মুখরিত চারদিক; সমস্যার গভীরে যেতে অনীহা– সবই মিলে যায়। তাহলে আসলেই কি আমরা একটি ব্যর্থ সমাজের দিকে এগিয়ে চলেছি?
২.
আমরা যা জানি, তার চেয়ে অনেক বেশি জানি না। ধর্ম, ইতিহাস, রাজনীতি– সর্বক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য। এই না-জানা কোনো অপরাধ নয়। কিন্তু এটি যখন অজ্ঞতার পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তখনই তা হয়ে ওঠে ভয়ংকর। আমরা প্রায়ই বলে থাকি, জ্ঞানই শক্তি। কিন্তু জ্ঞানহীনতা বা অজ্ঞতারও যে শক্তি আছে, তা আমরা কখনও অনুধাবন করতে পারি না। হতে পারে তা নেতিবাচক শক্তি। কিন্তু এই শক্তি ক্রমে আমাদের সমাজকে দখল করে নিচ্ছে; ক্যান্সার যেমন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে, ঠিক তেমনি। আমরা টের পাচ্ছি না।
না-জানা আমাদের জানতে আগ্রহী করে তোলে; অজ্ঞতা জানার সব আগ্রহকে টুঁটি চেপে যুক্তির দরজা রুদ্ধ করে দেয়। পরিবর্তে জন্ম দেয় অন্ধবিশ্বাস। বিপরীত বিশ্বাসকে যুক্তি দিয়ে মোকাবিলা করা যায়; অন্ধবিশ্বাসকে তা করা যায় না। এই অন্ধবিশ্বাসের কারণে মানুষ মানুষকে মারতে পারে, নিজেও মরতে পারে। আসলে অজ্ঞতা মানুষের চিন্তন প্রক্রিয়াকেই মেরে ফেলে। ফলে সে নতুন কোনো চিন্তা করতে পারে না; প্রশ্নও করতে পারে না। অথচ জ্ঞানের প্রথম শর্ত হলো প্রশ্ন করতে শেখা। জ্ঞানহীনতায় আচ্ছন্ন একজন মানুষ কিছু একটা জানার আগেই বিশ্বাসের কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে। বিশ্বাসের কাছে নিজেকে নিঃশর্ত সঁপে দেওয়া মানুষ নতুন কিছু গ্রহণ করতে পারে না। বরং বিরুদ্ধ বিশ্বাসের মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হায়েনার মতো। এমনই ঘটে চলেছে আমাদের সমাজে।
৩.
আমাদের দেশে ধর্ম থেকে শুরু করে রাজনীতি, ইতিহাস– সর্বক্ষেত্রে এখন অন্ধবিশ্বাসের রাজত্ব। যুক্তির কথা বললেই তেড়ে আসে সবাই। মানুষ ধার্মিক হচ্ছে; কিন্তু ধর্মগ্রন্থ পড়ে না, ধর্মের ইতিহাসও পড়ে না। পরিবর্তে ফেসবুক, ইউটিউব আর মাহফিলের ওয়াজ শুনে ধর্মকে জানে। ইতিহাসের ক্ষেত্রেও তাই। আজকাল কেউ ইতিহাসের বই পড়ে না। নেতাদের চটকদার বক্তৃতা ও ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকেই ইতিহাসকে জানে। এখন তো আর যাত্রাপালা হয় না। যখন হতো, তখন যাত্রাপালার কাহিনিকে ইতিহাস হিসেবে মেনে নিত এ দেশের মানুষ। এভাবে সর্বব্যাপী অজ্ঞতা আমাদের গ্রাস করছে আর দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে সেই কঠিন প্রশ্নের মুখে, আমরা কি ক্রমেই ব্যর্থ সমাজের দিকে এগিয়ে চলেছি?
৪.
স্বাধীনতা পেয়েছি ৫৪ বছর হয়ে গেছে। এই সময়ে বেশ ক’বার সরকার পরিবর্তন হয়েছে। সর্বশেষ ২০২৪ সালে অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের আওয়ামী শাসনের অবসান ঘটেছে। ক্ষমতা গ্রহণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকার ক্ষমতা নিয়েই অনেক বিষয়ে সংস্কারের ঘোষণা দিয়েছে। এসব নিয়ে মাঝেমধ্যে আলাপ-আলোচনাও হচ্ছে। কিন্তু যেসব বিষয়ের সঙ্গে সমাজের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক; যেসব বিষয়কে ভিত্তি করে সমাজ এগিয়ে যায়, সেসব নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। ফলে চেখভের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমাজ থেকে ক্রমেই আমরা এক জ্ঞানহীনতা তথা অজ্ঞতার সমাজের দিকে ধাবিত হচ্ছি।
পাকিস্তানের ২৪ বছর পশ্চিমা শাসকরা এ দেশে অজ্ঞতার চাষ করেছে। তবে সেটা বেশি হয়েছে রাষ্ট্রিক পর্যায়ে; সমাজের নিচের দিকে তা সেভাবে প্রভাব ফেলতে পারেনি; যদিও ব্রিটিশ শাসনের আদলে তারা এই দেশে একটি প্রজন্ম গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। মনে করা হয়েছিল, স্বাধীনতার পর সেই চাষ বন্ধ হবে। কিন্তু তা হয়নি। চাষের দায়িত্ব দক্ষ কৃষকের হাতে পড়েনি; পড়েছে পুঁজির মালিক বুর্জোয়াদের হাতে। পাকিস্তানিদের চেয়েও দ্বিগুণ উৎসাহে এরা অজ্ঞতার চাষ করেছে। ফলে গত ৫৪ বছর এ দেশে জ্ঞানের পরিবর্তে অজ্ঞতার চাষই হয়েছে বেশি, যার ফসল এখন সর্বত্রই দৃশ্যমান। চাকচিক্যময় অন্ধকারে ঢেকে গেছে দেশ, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব এসে পড়ছে শিক্ষার ক্ষেত্রে।
গত কয়েক দশকে দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এক শ্রেণির মানুষের সন্তান লাখ লাখ টাকা খরচ করে ওইসব বিদ্যাপীঠে পড়াশোনা করছে। কিন্তু যে দেশের জনসংখ্যার ৮০ শতাংশের বেশি গ্রামে বাস করে, সে দেশের গ্রামীণ শিক্ষার অবস্থা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছে বলে মনে হয় না। ব্যক্তিগত অনুসন্ধানে জেনেছি, আমার জেলায় গ্রামীণ প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে গত কয়েক বছরে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৬০ শতাংশে নেমে এসেছে। জ্যামিতিক হারে বাড়ছে কওমি মাদ্রাসার ছাত্র। অন্যদিকে গ্রামে থেকেও যারা কিছু লেখাপড়া শিখেছেন, তাদের প্রায় সবাই জেলা শহর কিংবা নিদেন পক্ষে উপজেলা শহরে এসে আস্তানা গাড়ছেন। ফলে ৮০ শতাংশ জনসংখ্যা অধ্যুষিত গ্রামগুলোর শক্তিকাঠামো পুরোপুরি চলে গেছে বা চলে যাচ্ছে শিক্ষাহীন অন্ধবিশ্বাসীদের হাতে। ফলে ক্রমেই অজ্ঞতার মেঘ ঢেকে দিচ্ছে যুক্তির আকাশ।
চারদিকে আজ নৈতিক মূল্যবোধের সংকট। ধর্ষণ, খুন, মব-সন্ত্রাস সমাজকে গ্রাস করে রেখেছে। নির্মল আনন্দ আর বিনোদনও অজ্ঞতার শিকার। এই তো সম্প্রতি কাপাসিয়ায় নাটক বন্ধ করে দেওয়া
হয়েছিল; সমাজ নষ্ট হয়ে যাওয়ার অজুহাতে। এর আগে গত নভেম্বরে ঠুনকো অজুহাতে জাতীয় শিল্পকলা একাডেমিতে নাটক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
ঠিক এমনটিই ঘটেছে আফগানিস্তানে। ২০২১ সালে দেশটিতে তালেবানরা দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার তিন সপ্তাহের মাঝে সব ধরনের বিনোদন, এমনকি সংগীতকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অন্তত দু’জন শিল্পীকে পিটিয়ে খুন করেছে। আমরাও কি তবে সে পথেই হাঁটছি? যদি তা-ই হয়; ব্যাধিটা সমাজ থেকে রাষ্ট্রে ছড়াতে বেশি সময় লাগবে না।
মোশতাক আহমেদ: কলাম লেখক; অবসরপ্রাপ্ত পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স অফিসার, জাতিসংঘ
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
শিক্ষার্থীদের আর বঞ্চিত রাখা না হোক
দীর্ঘ ২৮ বছর পরে ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচন হলো। তারপর ছয় বছর পেরিয়ে গেল। তবুও নতুন করে ডাকসু নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করা যায়নি। বাংলাদেশে ১৯৯০ সালের পরে সংসদীয় গণতন্ত্র এলেও দ্বিদলীয় ব্যবস্থায় বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ছাত্রছাত্রী। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণ করে রাখার জন্য দীর্ঘদিন ছাত্র সংসদের আলাপ সম্পূর্ণ বন্ধ করে রেখেছে। এ কারণে ১৯৯০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত একবারের জন্য ডাকসু নির্বাচন সম্ভব হয়নি।
২০১৮ সালে হাইকোর্টের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ বাধ্য হয়ে ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচন আয়োজন করে। এ নির্বাচন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলে দিয়েছিল এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চার নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছিল। ডাকসুর মাধ্যমে উঠে আসা নেতৃত্বই ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
বিশ্বের গণতান্ত্রিকভাবে অগ্রসর দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় দেশগুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব দেশ
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণমূলক রাজনীতিকে উৎসাহিত করে। এতে দক্ষ ও গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব গড়ে ওঠে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ছাত্র সংসদ নির্বাচন চালু থাকলে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের ভিত্তি শক্তিশালী হতো এবং গণতান্ত্রিক চর্চা আরও সুসংহত হতে পারত।
ছাত্র সংসদ নির্বাচন এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম, যেখানে শিক্ষার্থীরা প্রথম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গণতন্ত্র চর্চার সুযোগ পান। যদি নিয়মিত ডাকসু এবং অন্যান্য ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো, তাহলে বাংলাদেশের প্রতিটি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিনিয়ত তরুণ নেতৃত্বকে দেখতে পেতাম। যারা ভবিষ্যতে জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারতেন।
বাংলাদেশের রাজনীতির একটি নেতিবাচক দিক পরিবারতন্ত্র। বিভিন্ন জায়গায় একটি পরিবার, দুই পরিবার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। সে জায়গাগুলোতে নতুন যারা রাজনীতি করতে আগ্রহী কিংবা যোগ্য নেতৃত্বের উঠে আসার সুযোগ দলের মধ্যে থাকে না। পরিবারের বাইরে গিয়ে এটি করতে পারে শুধু ছাত্র সংসদ নির্বাচন।
বাংলাদেশে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের আধিপত্যের দৃষ্টিভঙ্গি যেমন রয়েছে, তেমনি ভীতিও রয়েছে। যদি ভীতি থাকে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে ক্যাম্পাসে সহিংসতা হতে পারে, তাহলে সেই একই যুক্তিতে তো জাতীয় নির্বাচনও বন্ধ রাখা উচিত। কারণ জাতীয় নির্বাচনেও সংঘাত, সহিংসতা ও অস্থিরতা দেখা যায়। বাস্তবে জাতীয় নির্বাচন কখনোই বন্ধ থাকে না। শুধু ছাত্রদের ওপর একটা দায় দেওয়া হয় এবং তাদের যোগ্য নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়।
বর্তমানে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নারী-পুরুষ শিক্ষার্থীর অনুপাত প্রায় সমান। সংখ্যায় সমতা থাকলেও নারীরা যদি রাজনৈতিকভাবে নেতৃত্বের জায়গায় আসতে না পারেন, তাহলে ভবিষ্যতে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গঠন করা সম্ভব হবে না। বাস্তবতা হলো, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো এখনও নারীর জন্য কার্যকর কোনো সিস্টেম প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি এবং তাদের জন্য নিরাপদ রাজনৈতিক পরিবেশও আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। এই পরিস্থিতিতে নারীর রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্বে অংশগ্রহণের অন্যতম কার্যকর মাধ্যম হতে পারে ছাত্র সংসদ নির্বাচন।
যদি নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়, তাহলে বিভিন্ন ছাত্রী হল থেকে যোগ্য নেত্রীরা নির্বাচিত হয়ে আসতে পারবেন এবং ক্যাম্পাসেও নারী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। এটি নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ আরও সুসংহত করবে এবং রাজনীতিতে তাদের অবস্থান শক্তিশালী করবে। ফলে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে নারী নেতৃত্বের বিকাশ ও নারীর ক্ষমতায়ন আরও কার্যকরভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা যদি মাঠে না নামতেন, তাহলে আন্দোলন সফল করা কঠিন হয়ে যেত। তবে আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও পরবর্তী সময়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ তৈরি হয়নি। এর মূল কারণ হলো, গত ৩০ বছরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এমনভাবে গড়ে তোলা হয়েছে, যেখানে রাজনীতিমুক্ত রাখার ধারণা প্রতিষ্ঠিত করে কর্তৃপক্ষের একক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা হয়েছে।
অনেকেই যুক্তি দেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রাজনীতিমুক্ত রাখা উচিত। অক্সফোর্ড, হার্ভার্ডসহ বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়। আমাদের দেশে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনিয়মিত হওয়ার কারণে কর্তৃপক্ষ নির্বিচারে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারে। যদি প্রতিবছর নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা বাধ্যতামূলক হয় এবং এটি না করাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়, তাহলে পরিবর্তন সম্ভব। এ জন্য প্রয়োজন একটি আইনি কাঠামো, যেখানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন না দিলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহির আওতায় আনা হবে। এ ধরনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব বিকাশের পথ উন্মুক্ত হবে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা তুলনামূলকভাবে সহজ হতে পারে। যেহেতু ছাত্র সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় ও প্যানেলভিত্তিক, তাই এখানে বাইরের অনুপ্রবেশের সুযোগ নেই। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোর হওয়ায় অবৈধ শিক্ষার্থী বা অস্ত্র নিয়ে প্রবেশের আশঙ্কা নেই। ফলে শিক্ষার্থীরা উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বিঘ্নে নির্বাচন আয়োজন করতে পারবেন।
যদিও ছাত্র সংসদ নির্বাচনে বিভিন্ন সংস্কারের কথা এসেছে, তবে সংস্কারের প্রক্রিয়া একটি সুষ্ঠু পদ্ধতিতে সম্পন্ন হওয়া উচিত। সংস্কারের নামে নির্বাচন সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা কাম্য নয়। বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মব সৃষ্টি হওয়া, ছাত্রদের কথা বলার কোনো প্ল্যাটফর্ম না থাকা এবং ছাত্র রাজনীতির নামে অরাজনীতি তৈরি হওয়া একটি বড় সমস্যা তৈরি করেছে। বর্তমানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন না থাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নামে-বেনামে বিভিন্ন সংগঠন তৈরি হচ্ছে, যা শিক্ষার্থীদের বিপথে চালিত করতে পারে।
বিদ্যমান ব্যবস্থায় যদি ছাত্রনেতা হতে হয় তাহলে তাঁকে যে কোনো একজন ভাইকে মেইনটেইন করতে হয়। ভাইকে মেইনটেইন করতে গিয়ে পড়াশোনায় সময় দিতে পারেন না, ক্লাস করতে পারেন না, পরীক্ষা দিতে পারেন না, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পৃক্ততা থাকে না।
যদি ছাত্র সংসদ নির্বাচন থাকে তাহলে একজন শিক্ষার্থী নেতা হওয়ার জন্য ছাত্রছাত্রীর কাছে যাবেন, তাদের জন্য কাজ করবেন, পড়াশোনা করবেন, ইতিবাচক কাজে এগিয়ে থাকবেন। যদি ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হয়, তবে পুরোনো রাজনৈতিক সিস্টেম, পুরোনো রাজনীতির ইকোসিস্টেম কখনও পাল্টাবে না এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা তাদের একাডেমিক কাজ এবং দক্ষতা উন্নয়নের দিকে মনোনিবেশ করতে পারবেন না।
শিক্ষার্থীদের যদি গণতান্ত্রিক চর্চার সুযোগ না দেওয়া হয়, তবে তারা রাষ্ট্রীয় লেভেলে গণতন্ত্রের চর্চা করতে সক্ষম হবেন না। ছাত্র সংসদ নির্বাচন এমন একটি মাধ্যম, যা শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক শিক্ষা দেয়। এখানে তারা বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে সহনশীল আচরণ করতে শেখেন, ছাত্রদের কল্যাণের জন্য কাজ করে ভোট পেতে শেখেন এবং গণতন্ত্রের যে প্র্যাকটিস থাকে, সেটি তারা এখানে করতে পারেন। এই অভিজ্ঞতা তাদের ভবিষ্যতে সংসদে বা অন্যান্য রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কাজে আসবে এবং এর মাধ্যমে গণতন্ত্রের স্থায়িত্ব নিশ্চিত হবে– যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনার ক্ষেত্রে সাহায্য করবে।
সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন এই বছরের মধ্যে না করা গেলে আগামীর রাজনীতি সংকটের মধ্য দিয়ে যাবে। এই সংকট তৈরি হলে বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলকে দায় নিতে হবে। তাই সরকার এবং সব রাজনৈতিক দলকে একসঙ্গে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে ঐকমত্য হতে হবে এবং নির্বাচন নিয়মিত করার জন্য কমিটমেন্ট করতে হবে।
আকরাম হুসাইন: তরুণ উদ্যোক্তা, সাবেক ছাত্রনেতা ও যুগ্ম সদস্য সচিব, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)