শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারীকরণে দীর্ঘসূত্রতা!
Published: 8th, April 2025 GMT
কলেজ ও মাধ্যমিক স্কুল মিলে ২০১৬ সাল থেকে উপজেলা স্তরের অন্তত সাড়ে ৬০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারীকরণ প্রক্রিয়ায় আনা হয়। অনেক প্রতিষ্ঠান ‘কাঠখড় পুড়িয়ে’ দীর্ঘদিনে শিক্ষক-কর্মচারীদের পদায়নসহ যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম হলেও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান নানা কারণ ও অজুহাতে এখনও অনেক পিছে পড়ে রয়েছে।
মন্ত্রণালয়-দপ্তর-বিভাগ; এ টেবিল-ও টেবিল; বড় কর্তা-মাঝারি কর্তা-ছোট কর্তা– সবার মন রক্ষা করা কঠিন হলেও তা করার জন্য সাধ্যানুসারে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
২০১৬ সালে শুরু হওয়া প্রক্রিয়াটি ৮-৯ বছরেও সম্পন্ন করা গেল না! তাহলে কী লাভ হলো এমন সরকারীকরণে? এ দীর্ঘ সময়ে সরকারীকরণের কোনো সুবিধা না পেয়েই অনেকে অবসরে চলে গেছেন। মৃত্যুও হয়েছে অনেকের।
অনেক প্রতিষ্ঠানে এক বা দেড়-দুই বছর আগে অর্ধেক সংখ্যক (প্রতিষ্ঠানভেদে কম-বেশি হতে পারে) শিক্ষক-কর্মচারীর পদায়ন হয়েছে, বাকিগুলো ঝুলন্ত।
না সরকারি-না বেসরকারি অবস্থায় তাদের রীতিমতো গলদ্ঘর্ম হতে হচ্ছে।
পদায়নকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সংশ্লিষ্টদের মাঝে ভিন্ন রকমের বৈষম্য তৈরি হয়েছে। এ নিয়ে সাধারণ শিক্ষক-কর্মচারীদের মাঝে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার শেষ নেই। জীবনপ্রদীপ নিভে যাওয়া কিংবা অবসরে গিয়েও শিক্ষক-কর্মচারীরা ‘ম্যানেজ সংস্কৃতি’ থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। এ যেন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সঙ্গে বসবাস! তা ছাড়া এটি যে কতটা মানসিক পীড়ার কারণ, তা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য কারও পক্ষে অনুমান করা কঠিন।
সেই ২০১৬ সাল থেকে শুরু হওয়া পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজে কতবার যে মূল সনদপত্র এবং প্রয়োজনীয় সুপারিশ ও নথিপত্র নিয়ে যাওয়া হয়েছে, এর কোনো হিসাব নেই। শিক্ষকরা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত; আমার মতো অনেকে অবসরে গেছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কারও রেহাই নেই। ফটোকপি আর ফটোকপি। চরম অস্বস্তিকর এক ব্যাপার।
একটি দপ্তরে (তা না হলে দুই জায়গায়) মূল সনদ ও নথিপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন হলে বাকিগুলোতে শিক্ষক-কর্মচারী কিংবা প্রতিষ্ঠানকে না ডেকে ‘আন্তঃদাপ্তরিক যোগাযোগ’-এর মাধ্যমে তা সম্পন্ন করা উচিত ছিল।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা যে বলতে গেলে ভেঙে পড়ার উপক্রম, এর একটি বড় কারণ অপরিকল্পিতভাবে এবং দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় বিপুলসংখ্যক প্রতিষ্ঠানের সরকারীকরণ।
সরকারি হওয়া তিন-সাড়ে তিনশ কলেজের মধ্যে কমপক্ষে দুইশ কলেজে নিয়মিত অধ্যক্ষ নেই। কোনোটি তিন বছর, কোনোটি আবার পাঁচ-সাত বছর, এমনকি আট-দশ বছর ধরে অধ্যক্ষশূন্য। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের ভারে কলেজগুলো বলতে গেলে ন্যুব্জ। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিয়োগ নিয়ে কলেজগুলোয় চলা ভিন্ন রকমের খেলা এখনও শেষ হয়নি। অবসরে গেছেন কিংবা মৃত্যু হয়েছে, এমন শিক্ষকের স্থলে গত সাত-আট বছরে বিষয়ভিত্তিক কোনো শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
দীর্ঘদিন অধ্যক্ষহীন সরকারি হওয়া কোনো কোনো কলেজে শিক্ষা ক্যাডার থেকে অধ্যক্ষ নিয়োগ দিলেও মাত্র দুই-চার মাস কিংবা বড়জোর এক বছরের মধ্যেই তিনি বদলি হয়ে অন্যত্র চলে গেছেন– এমন উদাহরণ এক-দুটি নয়, অনেক। এক কথায়, প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষা লাটে উঠতে বড় বেশি বাকি বলে মনে হয় না।
সবচেয়ে ভয়াবহ ও দুর্ভাবনার বিষয় হলো, সংশ্লিষ্টদের উপেক্ষা ও অবহেলা। এভাবেই পার হয়েছে অন্তত আটটি বছর। এ নিয়ে ভালো কোনো আলোচনা নেই। দেশে এখন রাজনীতি, নির্বাচন আর গদি ছাড়া যেন আর কোনো বিষয়ই নেই আলোচনার।
মেঘে মেঘে বেলা অনেক হয়ে গেছে। শুধু হাজার হাজার শিক্ষক-কর্মচারী নন, তাদের পরিবার ও নিকটজনও এ নিয়ে স্বস্তিতে নেই। দীর্ঘমেয়াদি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও বিড়ম্বনার নিরসন না হলে এমন সরকারীকরণের সার্থকতা কোথায়?
বিমল সরকার: কলাম লেখক, অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষক
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ন সরক র করণ
এছাড়াও পড়ুন:
এখনও পুরনো যেসব রীতিতে চৈত্রসংক্রান্তি পালন করেন রংপুরের মানুষ
রংপুরের গ্রামাঞ্চলের মানুষ পহেলা বৈশাখে এখনও পুরনো দিনের রীতি অনুসরণ করে চলেন। দেশের সব জায়গায় আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও পুরনো সেই রেওয়াজ তারা এখনও লালন করেন। বাংলা বছরের শেষ দিনটিকে বলা হয় চৈত্রসংক্রান্তি। শাস্ত্র অনুসারে এই দিনে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস প্রভৃতিকে পূণ্যকর্ম বলে মনে করা হয়।
গৃহস্থের মঙ্গল কামনায় নেচে নেচে গান: চৈত্রসংক্রান্তিকে ঘিরে সন্ন্যাসীরা বাদ্যের তালে তালে নেচে নেচে দেবদেবীর প্রতিকৃতি (পাট) মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়ান। তাঁরা যে বাড়িতে যান, সেই বাড়ির গৃহিণী পরিষ্কার পিঁড়ি বা জলচৌকি পেতে দেন। এরপর তাঁরা ওই পিঁড়ি বা জলচৌকির ওপর পাট নামান। এই সময় গৃহস্থের মঙ্গল কামনায় নেচে নেচে গান পরিবেশন করেন সন্ন্যাসীরা। গান শেষে সন্ন্যাসীদের চাল, সবজি কিংবা টাকা উপঢৌকন দেন গৃহিণীরা। সংগৃহীত অর্থে, বাংলার সংস্কৃতি নতুন প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দিতে চৈত্রসংক্রান্তি উৎসব ও চড়ক মেলার আয়োজন করা হয়।
চৈত্রসংক্রান্তির সকালে তিতা জাতীয় খাবার: পুরনো রীতি অনুয়ায়ী; রংপুরের গ্রামাঞ্চলের লোকজন চৈত্রসংক্রান্তির সকালে তিতা জাতীয় (ভাটির পাতার রস, জাত নিমের পাতার রস, নীলতাতের রস) খাবার খান। তাদের বিশ্বাস, এতে সারাবছর শরীরে কোনো রোগ-বালাই হবে না। এছাড়া মূলত খেসারি, মসুর, ছোলা জাতীয় কলাই ভেজে চিবিয়ে খাওয়া হয়। বিষয়টি মূলত দাঁতকে শক্তিশালী করার জন্য।
সামাজিক সম্প্রীতি সৃষ্টিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে গ্রামীণ মেলা: চৈত্রসংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখে রংপুরের বিভিন্ন এলাকায় মেলার আয়োজন অনেক পুরনো রীতি। বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোকসংস্কৃতির অন্যতম উপাদান হলো মেলা। গ্রামীণ সমাজ জীবনের পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে মেলার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল একসময়। মেলাকে কেন্দ্র করে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। আশপাশের কয়েক গ্রামের মানুষ আসে মেলায়। সামাজিক সম্প্রীতি সৃষ্টির ক্ষেত্রে এই পারস্পরিক যোগাযোগ ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। স্থানীয় কারুশিল্পীদের উৎপাদিত পণ্য এবং কৃষিপণ্যই থাকে গ্রামীণ মেলার মূল বেচাকেনার জিনিস। বাঁশ, বেত, পাট, শোলা, ধাতব, মৃৎ, চামড়া, তন্তুজাত হরেক রকমের কারুপণ্য ও বাচ্চাদের খেলনার বিপুল সমাবেশ গ্রামীণ মেলাকে বর্ণাঢ্য করে তোলে। এর পাশাপাশি থাকে খাজা, গজা, মওয়া এসব খাদ্যসামগ্রীর সমাবেশ। থাকে নাগরদোলা, পুতুলনাচ, গাজির গান, যাত্রাপালা, সার্কাস, লাঠিখেলাসহ হরেক রকমের আয়োজন।
হালখাতায় মন্ডা-মিঠাইসহ হরেক খাবারের আয়োজন: নবাব মুর্শিদ কুলি খান পয়লা বৈশাখে ‘পুণ্যাহ’ উৎসব চালু করেন। তখন কিছুটা জাতীয় পুঁজির বিকাশ ঘটায় ব্যবসা-বাণিজ্যের একটি উন্নত অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছিল। এই ব্যবসায়ীরাই পুণ্যাহর আনুষঙ্গিক অনুষ্ঠান হিসেবে ‘হালখাতা’ উৎসব চালু করেন। বাংলার অর্থনীতি ছিল কৃষিনির্ভর। ফলে কৃষকের হাতে নগদ অর্থের জোগান শুধু ফসল কাটার সময়েই আসত। তাই বাধ্য হয়ে তাঁরা দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিস ব্যবসায়ী বা দোকানিদের কাছ থেকে বাকিতে কিনতে বাধ্য হতেন। নতুন বছরের প্রথম দিনে হালখাতা উৎসবে বকেয়া অর্থের পুরোটা বা আংশিক পরিশোধ করে হালখাতা বা নতুন খাতায় নাম লেখা হতো। তার মধ্যে অবশ্য আনন্দের উপকরণও ছিল। হালখাতা উপলক্ষে খাওয়া-দাওয়া বিশেষ করে মিষ্টান্ন বিতরণের রেওয়াজ ছিল। সেই রীতি অনুসরণ করে রংপুর অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা পহেলা বৈশাখে বাড়ি কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হালখাতার আয়োজন করেন। অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিতদের আপ্যায়নে বাড়িতে তৈরি করা হয় মন্ডা-মিঠাইসহ হরেক রকম খাবারের জিনিস।
ঝগড়াঝাটি বা কারও সঙ্গে লেনদেন না করার প্রথা: আর পহেলা বৈশাখে ভালো খাবার, ভালো কাপড় পরিধান, ঝগড়াঝাটি না করা, কারও সঙ্গে লেনদেন না করাসহ বিভিন্ন নিয়ম মেনে চলার প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছে। এতে করে আগামী বছরজুড়ে ভালো থাকা যাবে-এই বিশ্বাস থেকেই পহেলা বৈশাখে রংপুর অঞ্চলের মানুষজন এসব পুরনো রীতিনীতি মেনে চলেন।
বর্ষবরণে চলছে প্রস্তুতি: রংপুরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পহেলা বৈশাখ বাংলা বর্ষবরণে চলছে প্রস্তুতি। এতে থাকছে বৈশাখী শোভাযাত্রা, বিভিন্ন প্রতিযোগিতা, গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।