‘হিন্দু সম্প্রদায়ের ভাইয়েরা আপনারা দোকান খোলেন, বাড়িতে থাকেন। যাঁর যা পেশা, সেই অনুযায়ী কাজকর্ম করেন। ভয়ের কিছু নাই। আতঙ্কিত হবেন না।’

আজ মঙ্গলবার সকালে দিনাজপুর সদর উপজেলার বনতাড়া গ্রামে মসজিদের মাইক থেকে এমন ঘোষণা আসছিল। ঘোষণার পরেও বনতাড়া গ্রামে ছিল সুনসান নীরবতা। আতঙ্ক কাটছিল না পাড়ার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের। অবশেষে বেলা ১১টার দিকে পাড়ায় সশরীর আসেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, মসজিদের ইমাম, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা। হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের শতাধিক নারী-পুরুষের উপস্থিতিতে দেওয়া হয় সম্প্রীতির বার্তা।

দিনাজপুরে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.

)-কে নিয়ে ফেসবুকে কটূক্তির অভিযোগে এক তরুণের গ্রেপ্তারের দাবি ঘিরে গত মঙ্গলবার থেকে বনতাড়া এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছিল। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই দফায় মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে, থানায় মামলা হয়েছে, এক শিক্ষক গ্রেপ্তার হয়েছেন। দেড় শতাধিক হিন্দু পরিবারের অনেকেই এলাকাও ছেড়েছেন। অবশেষে সাত দিন পরে এল সম্প্রীতির বার্তা।

যে তরুণের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ঢাকার একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। যে আইডি দিয়ে তিনি কটূক্তিমূলক মন্তব্য করেছেন বলে অভিযোগ, সেটি ফেসবুকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কটূক্তির অভিযোগটি প্রথম যে আইডি থেকে ছড়ানো হয়েছে, সেটির ব্যবহারকারী সম্পর্কে কোনো তথ্য বা ছবি ওই আইডিতে নেই।

আজ সকালে অভিযুক্ত তরুণের মা গ্রামের বাড়িতে বসে প্রথম আলোকে বলেন, ২৮ মার্চ ঈদের ছুটিতে তাঁর ছেলে বাড়িতে এসেছিলেন। ঈদের পর তিনি স্ত্রীসহ শ্বশুরবাড়িতে যান। এ ঘটনার পর থেকে ছেলের সঙ্গে তাঁদের আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। এমনকি ওই দিন থেকে তাঁর স্বামীও বাড়িতে নেই। তিনি বলেন, ‘হামার ছেলে অপরাধ করছে, আমি ছেলের পক্ষ হইয়ে সবার কাছোত মাফ চাওছি। আমাদের জন্য গ্রামবাসী সবারে অন্যায় অত্যাচার, ভয়তে বাড়িত থাকতে পারছে না। মেলাজন আপদ-বিপদে আছে। তে আমার ছেলে অপরাধ করছে আমাদেরকে শাস্তি দেন, জনগণ কেনে শাস্তি পাবে? হাঁরা হাত-পা ধরিয়া ক্ষমা চাই।’

স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জালিয়াপড়া, ক্ষত্রিয়পাড়া, বালুপাড়া, মুদিপাড়া, গিলাবাড়ি মিলে বনতাড়া গ্রাম। বসবাস সাড়ে সাত শ পরিবারের। এর মধ্যে দুই শতাধিক হিন্দু পরিবার। পাড়ার প্রায় মধ্যভাগে ১২ থেকে ১৪টি দোকান আছে। এর মধ্যে একটি সেলুনসহ ছয়টি দোকান হিন্দুদের। ১১ জন হিন্দু ইজিবাইক–চালক আছেন এখানে। জেলে পেশায় আছেন ১৫-২০ জন। অন্যরা কৃষিশ্রমিকসহ বিভিন্ন পেশায় আছেন। ঘটনার পর থেকে এক সপ্তাহ ধরে তাঁরা ইজিবাইক চালানো ও দোকানপাট বন্ধ রেখেছিলেন। এমনকি কোনো কাজকর্মেও বের হননি। অর্ধাহার, অনাহার ও আতঙ্কে দিন কেটেছে তাঁদের। সর্বশেষ ৬ এপ্রিল অভিযুক্ত তরুণের মন্তব্যে সমর্থন জানানোর অভিযোগে বনতাড়া স্কুলের একজন শিক্ষককে পুলিশ গ্রেপ্তার করলে আতঙ্ক আরও বেড়ে যায়। এর পর থেকে গ্রামের অন্তত ১০ জন যুবক আতঙ্কে বাড়ি ছেড়েছেন।

আরও পড়ুনদিনাজপুরে মহানবী (সা.)–কে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ, তরুণের গ্রেপ্তার দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ০৬ এপ্রিল ২০২৫

জালিয়াপাড়া জেলে সমিতির নেতা মানিক চন্দ্র দাস (৫০) প্রথম আলোকে বলেন, ‘একজনের অপরাধে সবারে ভোগান্তি হলো। এই গ্রামে হিন্দু-মুসলমান আমরা দীর্ঘদিন ধরে মিলেমিশে আছি। কারও সঙ্গে কোনো ঝগড়া–বিবাদ নাই। ঘটনার দিন বিকেলে স্থানীয় যুবকেরা আমাদেরকে দোকানপাট বন্ধ করতে বলেছেন। বাড়ি থেকে বের হতে নিষেধ করেছেন। কেউ যেন কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করতে পারে এ জন্য। এই কয়েক দিন কষ্ট হয়েছে, তবে আজকে সবাই বসে আমরা মিল হয়ে গেছি। ওই ছেলের (অভিযুক্ত তরুণ) শাস্তি হউক। কাজটা সে ঠিক করেনি।’

স্থানীয় হরিসভা মন্দিরের সভাপতি মনো দাস (৪৫) বলেন, ‘আমাদের হরিসভা ছিল। বিশৃঙ্খলা এড়াতে আমরা নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে সেটাও বন্ধ করেছি।’

মঙ্গলবার সকালে বনতাড়া গ্রামে কথা হয় স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) শহিদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এই কয়েক দিন তাদের (হিন্দুদের) দোকানপাট বন্ধ ছিল, এটা ঠিক। কাজকর্মে বের হতে পারেনি, এটাও ঠিক। তবে গ্রামে যেন কোনো হামলা কিংবা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়, এসব বিবেচনায় স্থানীয় যুবকেরাই বন্ধ রাখতে বলেছিল। মূলত নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই এটা করা হয়েছে। একজনের দোষে তো সবাই দোষী হতে পারে না। তবে আজকে আমরা সবাইকে নিয়ে বসেছি। অভিযুক্ত তরুণের পরিবারসহ অন্যদের সামান্য খাদ্যসামগ্রী ও আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তাদেরকে আশ্বস্ত করা হয়েছে। আর কোনো সমস্যা হবে না।’

বোচাগঞ্জে এক তরুণ গ্রেপ্তার

এদিকে দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ উপজেলায় ইসলাম ধর্ম ও মুসলমানদের নিয়ে কটাক্ষ করে ফেসবুকে আপত্তিকর মন্তব্যের অভিযোগে এক তরুণকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আজ সকাল সাড়ে আটটার দিকে বীরগঞ্জ উপজেলা বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে তাঁকে আটক করা হয়।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সোমবার ফিলিস্তিন বিষয়ে এক ব্যক্তির দেওয়া পোস্টে কটূক্তিমূলক মন্তব্য করেন ওই তরুণ। এটি দ্রুত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ক্ষুব্ধ হন স্থানীয় লোকজন। স্থানীয়দের একটি দল ওই তরুণের বাড়ির সামনে অবস্থান নেয়। তাঁর শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করেন। পরে বোচাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মারুফ হাসান ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে অভিযুক্তকে আইনের আওতায় আনার আশ্বাস দেন। এরপর মঙ্গলবার সকালে তাঁকে আটক করে বোচাগঞ্জ থানায় নিয়ে আসে পুলিশ।

বোচাগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদ হাসান বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্টে হজরত মুহাম্মদ (সা.)–কে নিয়ে কটূক্তিমূলক কমেন্ট করায় এলাকাবাসী বিক্ষোভ করেন। এক ব্যক্তি এ বিষয়ে বোচাগঞ্জ থানায় একটি মামলাও করেন। আজ সকালে অভিযুক্তকে বীরগঞ্জ থানার বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং বিকেলে তাঁকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আম দ র পর ব র আতঙ ক উপজ ল

এছাড়াও পড়ুন:

জীবনে বহু কিছু করার পর ‘ধৈর্য-সহ্যে’ কপাল খুলছে গোলাম রসুলের

সবে সন্ধ্যা নেমেছে শহরের বুকে। খুলনা নগরের সেন্ট যোসেফ উচ্চবিদ্যালয়ের সামনের ফুটপাতে ছোট একটা দোকানের সামনে বেশ ভিড়। অর্ডার দিয়ে কেউ টুলে বসে আছেন, কেউ আবার প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন। বিক্রেতা দুজনের চার হাত যেন চলছে সমানতালে। একজন ছোট ছোট ফুচকা বানাচ্ছেন, তো আরেকজন ভেলপুরির প্লেট সাজাচ্ছেন। আবার কখনো একজন পেঁয়াজ–শসা কুচি করে নিচ্ছেন আর আরেকজন বিল রাখা বা টিস্যু এগিয়ে দেওয়ায় ব্যস্ত।

নগরের আহসান আহমেদ রোডের সেন্ট যোসেফ উচ্চবিদ্যালয়ের সামনের একটি ছোট ফুচকা ও ভেলপুরির ভ্রাম্যমাণ দোকানের চিত্র এটি। দোকানের নামটাও বেশ অন্য রকম। ‘ধৈর্য-সহ্য ছোট ফুচকা ও ভেলপুরি স্টোর’। দোকানটি চালান গোলাম রসুল নামের একজন। বিকেল ৪টা থেকে রাত ৯টা-১০টা পর্যন্ত চলে এই ভ্রাম্যমাণ দোকান। এই দোকানের ছোট ফুচকা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

গোলাম রসুলের বাড়ি বাগেরহাটের মোল্লাহাট উপজেলার কুলিয়া ইউনিয়নের পুরাতন ঘোষগাতী গ্রামে। সাত ভাই–বোনের সংসারে রসুলের বড় ভাই ভাজাপোড়া খাবারের ব্যবসা করতেন। বুঝতে শেখার পর থেকেই তাই এতেই হাতেখড়ি হয় রসুলের। তবে তাতে ঠিক পোষাচ্ছিল না। তাই বছর ৩০ আগে কিছু করার আশায় খুলনা শহরে আসেন গোলাম রসুল। তবে এই শহরে পুরোপুরি থিতু হতে পারেননি। নানা টানাপোড়েনে কখনো খুলনা, কখনো মোল্লাহাট, আবার কখনো ঢাকায় কেটেছে তাঁর সময়। ৪৮ বছরের এই জীবনে নানা রকম কাজ করেছেন। ব্যবসাও করেছেন অনেক কিছুর। তবে সেসব ব্যবসায় কেবল লোকসানই হয়েছে তাঁর। অবশেষে ‘ছোট ফুচকায়’ তাঁর কপাল খুলেছে।

কাজের ব্যস্ততার মধ্যেই কথা হয় গোলাম রসুলের সঙ্গে। রসুল বলেন, ‘আগে রিকশা চালাইছি। নানা রকম ব্যবসাও করছি। গ্রাম থেকে কিনে মাওয়া ফেরিঘাট আর ঢাকায় ডাব বেচছি। ওই ব্যবসায় অনেক মার খাইছি। মানুষ টাকা দেয় নাই। এখনো ৬০-৭০ হাজার টাকা পাব। ডাব ব্যবসায় মার খেয়ে দুই বছর আগে আবারও খুলনা শহরে আসি কিছু করা যায় কী না সেই জন্যি।’ খুলনা এসে আবারও রিকশার প্যাডেল ঘোরাতে থাকেন রসুল একই সঙ্গে মাথায় ঘুরতে থাকে চিন্তা। এরপর শীতের পিঠা বিক্রি শুরু করেন। শীত শেষ হতে আবারও অনিশ্চয়তা। এখন কী হবে!

গোলাম রসুল বলেন, ‘গরম চলে আসল, কী করব বুঝে পাচ্ছিলাম না। পরে খুলনার ৭ নম্বর ঘাট থেকে কিনে ভেলপুরি বেচছি। কিন্তু এতে হচ্ছিল না। এরপর চিন্তা করলাম আনকমন কিছু করা যায় কি না। গত বছরের কোরবানির ঈদের পর থেকে শুরু করি ছোট ফুচকা বিক্রি।’

দোকানটি চালান গোলাম রসুল নামের একজন। বিকেল ৪টা থেকে রাত ৯টা-১০টা পর্যন্ত চলে এই ভ্রাম্যমাণ দোকান

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গাজার জন্য সমব্যথী নারী
  • তৃণমূলের একজন কর্মীকেও হারাতে দেয়া যাবে না : রিয়াদ চৌধুরী
  • শেখ হাসিনার সন্ধান চেয়ে পাগলা মসজিদের দানবাক্সে চিঠি
  • কক্সবাজারের মেয়েটি
  • নড়াইলে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের সংঘর্ষে একজন নিহত
  • আত্মপ্রকাশ করল নতুন দল গণতান্ত্রিক নাগরিক শক্তি
  • ওল্ড ইজ গোল্ড, আবেগতাড়িত ভক্ত-অনুরাগীরা
  • আইভিএফ পদ্ধতিতে সন্তান জন্মদানের পর মা-বাবা জানলেন ভ্রূণটি অন্যের ছিল
  • বিলাসপুরে কারা–কীভাবে–কোথায় ককটেল বানান, কত টাকা পান
  • জীবনে বহু কিছু করার পর ‘ধৈর্য-সহ্যে’ কপাল খুলছে গোলাম রসুলের