আবারও আমরা চরম গরমের মৌসুমে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। এখনই সেটি বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে। এসপিএআইয়ের বৈশ্বিক খরা মনিটরিংয়ের একটা ওয়েবসাইট রয়েছে। ওই ওয়েবসাইটে যদি ঢোকেন, বাংলাদেশের অবস্থান দেখলে দেখবেন ‘লাল’ হয়ে আছে। আমাদের আবহাওয়াবিদেরা কি এ নিয়ে পূর্বাভাস দিয়েছেন?

অন্তর্বর্তী সরকারে বন ও পরিবেশ উপদেষ্টা হিসেবে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান দায়িত্ব নেওয়ার পর সবাই বেশ আনন্দিত হয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, এবার নতুন কিছু দেখতে পাবো। হ্যাঁ! আগের অনেক পরিবেশ ‘অবান্ধব’ প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিবেশদূষণে সরকারের দায় কিছুটা কমেছে; কিন্তু পরিবেশ রক্ষায় যথেষ্ট উদ্যোগ এখনো দেখা যাচ্ছে না। হয়তো সামনে আমরা কিছু দেখতে পাব।

জ্বালানি ও বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় বরং এ ক্ষেত্রে বেশ সচেষ্ট। তারা সৌরবিদ্যুৎ নিয়ে অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রের টেন্ডার করছেন। নতুন নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালার খসড়া করেছে। এ ছাড়া সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার যাতে ভালো মতো হয়, সেই ব্যাপারে তাঁরা চেষ্টা করছেন; কিন্তু সুফল আসতে তো আরও অনেক সময় লাগবে।

ঢাকাসহ সারা দেশে পানির স্তর যে অস্বাভাবিকভাবে নেমে যাচ্ছে, তা রোধে কি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে? ঢাকায় যেখানে ১৯৯৬ সালে পানির স্তর ২৫ মিটার নিচে ছিল, তা এখন চলে এসেছে ৭৫ মিটারে। একটি শহরের ১৫ শতাংশ জলাশয় থাকা উচিত। আর ঢাকায় আছে মাত্র ২ দশমিক ৯ শতাংশ। পানির স্তর নেমে যাওয়া নিয়ে গুগলে সার্চ করলে এর অনেক খবর পাওয়া যাবে। এটা শুধু সুপেয় পানির অভাবের বিষয় নয়; ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ হলে দেশকে আরও ভঙ্গুর করে ফেলবে। কোনো চেষ্টা কি করা হচ্ছে ঠেকানোর?

গত বছর তীব্র গরমের সময় হাইপ উঠেছিল গাছ লাগানোর। আমরা শুনেছিলাম, তৎকালীন চিফ হিট অফিসার নাকি ৫০ হাজার গাছ লাগিয়েছিলেন। সেই গাছগুলা এখন কোথায় কেউ বলতে পারবেন? গাছ লাগানোর ব্যাপারে সামনের বর্ষার আগেই সমন্বিত পরিকল্পনা দরকার। মানুষ এই সরকারকে সাহায্য করতে প্রস্তুত। উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে।

এ দেশে ৫০ বছরে হারিয়ে গেছে ৫২০টি নদী। নদীগুলো উদ্ধারের কোনো চিন্তা কি সরকারের আছে? সরকার তো এখন্র জাতিসংঘের পানিপ্রবাহ কনভেনশনে স্বাক্ষরই করেনি। দায়িত্ব গ্রহণের তিন মাসের মধ্যে সেটি হওয়া দরকার ছিল।

এবার প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরে মানুষের বহুল প্রত্যাশিত তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে স্বাক্ষর হয়নি। এদিকে জিয়াউর রহমানের সময়ে পরিকল্পনা করা গঙ্গা ব্যারাজ, ভারতের বাধার জন্য টেন্ডারে যেতে পারেনি, সেটি নিয়েও কোনো কথা হচ্ছে না। এমনকি বিএনপিও যেন সেটি বেমালুম ভুলে গেছে। বাংলাদেশের মতো প্রতিবেশী পাওয়া আসলে যেকোনো দেশের জন্যই সৌভাগ্যের বিষয়। নদী পুনঃখনন এবং খাল উদ্ধারের জন্য মেগা পরিকল্পনাও দেখা যাচ্ছে না। বর্ষাকালে আমরা পানি কীভাবে ধরে রাখব? আমরা জানি, এই সরকারের মেয়াদ বেশি দিন হয়নি। কিন্তু এই সরকার পথ দেখিয়ে গেলে পরের সরকার অনেক কিছু বন্ধ করতে পারবে না।

প্রধান উপদেষ্টা চীনের কাছে ৫০ বছরের জন্য নদী পরিকল্পনা চেয়েছেন; কিন্তু আমাদের ২০১৮ সালে নেদারল্যান্ডসের সহযোগিতায় ডেল্টা পরিকল্পনা ২১০০ এবং ২০২০ সালে জাপানের সহযোগিতায় নদী ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্ট পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। তাহলে নতুন করে একই কাজ আবার কেন? প্রধান উপদেষ্টাকে এ তথ্য দেওয়ার দায়িত্ব কার?

গত বছর তীব্র গরমের সময় হাইপ উঠেছিল গাছ লাগানোর। আমরা শুনেছিলাম, তৎকালীন চিফ হিট অফিসার নাকি ৫০ হাজার গাছ লাগিয়েছিলেন। সেই গাছগুলা এখন কোথায় কেউ বলতে পারবেন? গাছ লাগানোর ব্যাপারে সামনের বর্ষার আগেই সমন্বিত পরিকল্পনা দরকার। মানুষ এই সরকারকে সাহায্য করতে প্রস্তুত। উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে।

বিশ্বে বনভূমি দখলের শীর্ষে আছে বাংলাদেশ। সারা দেশে দখল করা বনভূমি ২ লাখ ৫৭ হাজার একর। এই বনভূমি উদ্ধারে কি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে? এই বনভূমিগুলো উদ্ধার করে গাছ লাগালেই তো দেশ অনেকখানি আগের সৌন্দর্য ফিরে পায়। এদিকে প্রতিবছর আবাদি জমি কমছে ৩৮ হাজার একর করে। ভারতে আবাদি জমি সংরক্ষণ আইন আছে, আমাদের দেশে কেন করা হচ্ছে না?

পরিবেশ উপদেষ্টা বলেছেন, এই দেশের বায়ুদূষণের ৩০ শতাংশের জন্য দায়ী ভারত। এটা গবেষণা দিয়ে প্রমাণিত; কিন্তু বাকি ৭০ শতাংশের জন্য আপনাদের প্রচেষ্টা আমরা দেখতে চাই। ঢাকায় মিথেন গ্যাসের পরিমাণ অত্যধিক বেশি। যার ফলে গরমও বেশি। এর কারণ হিসেবে মাতুয়াইলের ময়লার ডিপোর কথা বলা হয়। এ ছাড়া গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ ২০২১ সালে বণিক বার্তায় প্রকাশিত একটি লেখায় দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন—ঢাকায় মিথেন গ্যাস আধিক্যের একটি বড় কারণ হতে পারে গ্যাসের লাইনের লিকেজ। কিন্তু এ ব্যাপারটি এখনো কেউ আমলে নিয়েছেন বলে জানি না।

আমাদের করণীয় কী? আপনারা সবাই ‘থ্রি আর’-এর কথা শুনেছেন (রিডিউস, রিইউজ ও রিসাইকেল)। আমাদের সবার আগে পানির অপচয় কমাতে হবে। বিটিভির ইত্যাদি বহু আগে একটি ক্লিপ বানিয়েছিল— কীভাবে পানির অপচয় কমানো যায়, সে রকম প্রচারণা দরকার। পরিবেশ নিয়ে মিডিয়া প্রচারণা নেই বললেই চলে। এই দেশে ‘গ্রে ওয়াটার রিসাইকেল’ সিস্টেম চলে এসেছে। যার মাধ্যমে খুব অল্প খরচে আমরা বাসাবাড়ির ৮৫ শতাংশ পানি রিসাইকেল করে আবার ব্যবহার করতে পারি। দেশেই উৎপাদিত হচ্ছে এখন। এ ব্যাপারে সরকারের প্রচারণা দরকার। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের এসি ২৫ ডিগ্রিতে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত ভালো একটি সিদ্ধান্ত।

সারা বিশ্বই অতিরিক্ত তাপপ্রবাহের সমস্যায় ভুগছে। আর আসছে নতুন নতুন টেকনোলজি; কিন্তু আমাদের দেশে মানুষদের মধ্যে এর প্রচারণা নেই। দরকার সরকারি পর্যায়ে প্রচারণা এবং ট্যাক্সের সুবিধা দেওয়া। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার একা দাবদাহ ঠেকাতে পারবে না; কিন্তু সবাইকে নিয়ে করার দায়িত্বও সরকারের।

দেশে পরিবেশ প্রকৌশল এবং বিজ্ঞান থেকে পাস করা অনেকে আছেন। তাঁদের ব্যবহার করতে হবে। সরকারি বিশেষজ্ঞের সঙ্গে বেসরকারি খাতের বিশেষজ্ঞ, একাডেমিশিয়ান এবং প্রকৌশলীদের সমন্বয়ে একটি পরিবেশসংক্রান্ত দীর্ঘ পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নই একমাত্র আমাদের ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করতে পারে।

সুবাইল বিন আলম টেকসই উন্নয়নবিষয়ক কলামিস্ট।

ইমেইল: [email protected]

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: এই সরক র প রস ত ত সরক র র ব যবহ র উপদ ষ ট র জন য আম দ র পর ব শ দরক র বনভ ম

এছাড়াও পড়ুন:

শিক্ষার্থীদের আর বঞ্চিত রাখা না হোক

দীর্ঘ ২৮ বছর পরে ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচন হলো। তারপর ছয় বছর পেরিয়ে গেল। তবুও নতুন করে ডাকসু নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করা যায়নি। বাংলাদেশে ১৯৯০ সালের পরে সংসদীয় গণতন্ত্র এলেও দ্বিদলীয় ব্যবস্থায় বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ছাত্রছাত্রী। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণ করে রাখার জন্য দীর্ঘদিন ছাত্র সংসদের আলাপ সম্পূর্ণ বন্ধ করে রেখেছে। এ কারণে ১৯৯০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত একবারের জন্য ডাকসু নির্বাচন সম্ভব হয়নি। 

২০১৮ সালে হাইকোর্টের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ বাধ্য হয়ে ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচন আয়োজন করে। এ নির্বাচন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলে দিয়েছিল এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চার নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছিল। ডাকসুর মাধ্যমে উঠে আসা নেতৃত্বই ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। 
বিশ্বের গণতান্ত্রিকভাবে অগ্রসর দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় দেশগুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব দেশ 
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণমূলক রাজনীতিকে উৎসাহিত করে। এতে দক্ষ ও গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব গড়ে ওঠে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ছাত্র সংসদ নির্বাচন চালু থাকলে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের ভিত্তি শক্তিশালী হতো এবং গণতান্ত্রিক চর্চা আরও সুসংহত হতে পারত। 

ছাত্র সংসদ নির্বাচন এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম, যেখানে শিক্ষার্থীরা প্রথম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গণতন্ত্র চর্চার সুযোগ পান। যদি নিয়মিত ডাকসু এবং অন্যান্য ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো, তাহলে বাংলাদেশের প্রতিটি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিনিয়ত তরুণ নেতৃত্বকে দেখতে পেতাম। যারা ভবিষ্যতে জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারতেন। 
বাংলাদেশের রাজনীতির একটি নেতিবাচক দিক পরিবারতন্ত্র। বিভিন্ন জায়গায় একটি পরিবার, দুই পরিবার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। সে জায়গাগুলোতে নতুন যারা রাজনীতি করতে আগ্রহী কিংবা যোগ্য নেতৃত্বের উঠে আসার সুযোগ দলের মধ্যে থাকে না। পরিবারের বাইরে গিয়ে এটি করতে পারে শুধু ছাত্র সংসদ নির্বাচন। 
বাংলাদেশে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের আধিপত্যের দৃষ্টিভঙ্গি যেমন রয়েছে, তেমনি ভীতিও রয়েছে। যদি ভীতি থাকে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে ক্যাম্পাসে সহিংসতা হতে পারে, তাহলে সেই একই যুক্তিতে তো জাতীয় নির্বাচনও বন্ধ রাখা উচিত। কারণ জাতীয় নির্বাচনেও সংঘাত, সহিংসতা ও অস্থিরতা দেখা যায়। বাস্তবে জাতীয় নির্বাচন কখনোই বন্ধ থাকে না। শুধু ছাত্রদের ওপর একটা দায় দেওয়া হয় এবং তাদের যোগ্য নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়।

বর্তমানে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নারী-পুরুষ শিক্ষার্থীর অনুপাত প্রায় সমান। সংখ্যায় সমতা থাকলেও নারীরা যদি রাজনৈতিকভাবে নেতৃত্বের জায়গায় আসতে না পারেন, তাহলে ভবিষ্যতে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গঠন করা সম্ভব হবে না। বাস্তবতা হলো, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো এখনও নারীর জন্য কার্যকর কোনো সিস্টেম প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি এবং তাদের জন্য নিরাপদ রাজনৈতিক পরিবেশও আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। এই পরিস্থিতিতে নারীর রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্বে অংশগ্রহণের অন্যতম কার্যকর মাধ্যম হতে পারে ছাত্র সংসদ নির্বাচন।

যদি নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়, তাহলে বিভিন্ন ছাত্রী হল থেকে যোগ্য নেত্রীরা নির্বাচিত হয়ে আসতে পারবেন এবং ক্যাম্পাসেও নারী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। এটি নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ আরও সুসংহত করবে এবং রাজনীতিতে তাদের অবস্থান শক্তিশালী করবে। ফলে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে নারী নেতৃত্বের বিকাশ ও নারীর ক্ষমতায়ন আরও কার্যকরভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা যদি মাঠে না নামতেন, তাহলে আন্দোলন সফল করা কঠিন হয়ে যেত। তবে আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও পরবর্তী সময়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ তৈরি হয়নি। এর মূল কারণ হলো, গত ৩০ বছরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এমনভাবে গড়ে তোলা হয়েছে, যেখানে রাজনীতিমুক্ত রাখার ধারণা প্রতিষ্ঠিত করে কর্তৃপক্ষের একক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা হয়েছে।

অনেকেই যুক্তি দেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রাজনীতিমুক্ত রাখা উচিত। অক্সফোর্ড, হার্ভার্ডসহ বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়। আমাদের দেশে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনিয়মিত হওয়ার কারণে কর্তৃপক্ষ নির্বিচারে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারে। যদি প্রতিবছর নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা বাধ্যতামূলক হয় এবং এটি না করাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়, তাহলে পরিবর্তন সম্ভব। এ জন্য প্রয়োজন একটি আইনি কাঠামো, যেখানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন না দিলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহির আওতায় আনা হবে। এ ধরনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব বিকাশের পথ উন্মুক্ত হবে।

আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা তুলনামূলকভাবে সহজ হতে পারে। যেহেতু ছাত্র সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় ও প্যানেলভিত্তিক, তাই এখানে বাইরের অনুপ্রবেশের সুযোগ নেই। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোর হওয়ায় অবৈধ শিক্ষার্থী বা অস্ত্র নিয়ে প্রবেশের আশঙ্কা নেই। ফলে শিক্ষার্থীরা উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বিঘ্নে নির্বাচন আয়োজন করতে পারবেন।

যদিও ছাত্র সংসদ নির্বাচনে বিভিন্ন সংস্কারের কথা এসেছে, তবে সংস্কারের প্রক্রিয়া একটি সুষ্ঠু পদ্ধতিতে সম্পন্ন হওয়া উচিত। সংস্কারের নামে নির্বাচন সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা কাম্য নয়। বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মব সৃষ্টি হওয়া, ছাত্রদের কথা বলার কোনো প্ল্যাটফর্ম না থাকা এবং ছাত্র রাজনীতির নামে অরাজনীতি তৈরি হওয়া একটি বড় সমস্যা তৈরি করেছে। বর্তমানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন না থাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নামে-বেনামে বিভিন্ন সংগঠন তৈরি হচ্ছে, যা শিক্ষার্থীদের বিপথে চালিত করতে পারে। 
বিদ্যমান ব্যবস্থায় যদি ছাত্রনেতা হতে হয় তাহলে তাঁকে যে কোনো একজন ভাইকে মেইনটেইন করতে হয়। ভাইকে মেইনটেইন করতে গিয়ে পড়াশোনায় সময় দিতে পারেন না, ক্লাস করতে পারেন না, পরীক্ষা দিতে পারেন না, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পৃক্ততা থাকে না। 
যদি ছাত্র সংসদ নির্বাচন থাকে তাহলে একজন শিক্ষার্থী নেতা হওয়ার জন্য ছাত্রছাত্রীর কাছে যাবেন, তাদের জন্য কাজ করবেন, পড়াশোনা করবেন, ইতিবাচক কাজে এগিয়ে থাকবেন। যদি ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হয়, তবে পুরোনো রাজনৈতিক সিস্টেম, পুরোনো রাজনীতির ইকোসিস্টেম কখনও পাল্টাবে না এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা তাদের একাডেমিক কাজ এবং দক্ষতা উন্নয়নের দিকে মনোনিবেশ করতে পারবেন না। 

শিক্ষার্থীদের যদি গণতান্ত্রিক চর্চার সুযোগ না দেওয়া হয়, তবে তারা রাষ্ট্রীয় লেভেলে গণতন্ত্রের চর্চা করতে সক্ষম হবেন না। ছাত্র সংসদ নির্বাচন এমন একটি মাধ্যম, যা শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক শিক্ষা দেয়। এখানে তারা বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে সহনশীল আচরণ করতে শেখেন, ছাত্রদের কল্যাণের জন্য কাজ করে ভোট পেতে শেখেন এবং গণতন্ত্রের যে প্র্যাকটিস থাকে, সেটি তারা এখানে করতে পারেন। এই অভিজ্ঞতা তাদের ভবিষ্যতে সংসদে বা অন্যান্য রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কাজে আসবে এবং এর মাধ্যমে গণতন্ত্রের স্থায়িত্ব নিশ্চিত হবে– যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনার ক্ষেত্রে সাহায্য করবে।
সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন এই বছরের মধ্যে না করা গেলে আগামীর রাজনীতি সংকটের মধ্য দিয়ে যাবে। এই সংকট তৈরি হলে বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলকে দায় নিতে হবে। তাই সরকার এবং সব রাজনৈতিক দলকে একসঙ্গে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে ঐকমত্য হতে হবে এবং নির্বাচন নিয়মিত করার জন্য কমিটমেন্ট করতে হবে। 

আকরাম হুসাইন: তরুণ উদ্যোক্তা, সাবেক ছাত্রনেতা ও যুগ্ম সদস্য সচিব, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)

সম্পর্কিত নিবন্ধ