মূল্যস্ফীতি নিয়ে সন্তুষ্ট আইএমএফ, ঋণের কিস্তি ছাড়ের আশা
Published: 8th, April 2025 GMT
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধিদল মঙ্গলবার (৮ এপ্রিল) বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করেছে। তারা বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি ও মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। আইএমএফের নির্দেশনার আলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক বর্তমানে রিজার্ভ গণনা করায় তারা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। ফলে, আইএমএফের ঋণের পরবর্তী কিস্তি ছাড় হবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আইএমএফের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক শেষে এসব তথ্য জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো.
তিনি জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকে মূল্যস্ফীতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে আইএমএফের প্রতিনিধিদল। আগামী জুন নাগাদ মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৫ শতাংশের নিচে নেমে আসবে বলে আভাস দিয়েছেন তারা। তবে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে না। সরকারের সবগুলো সংস্থা যখন একসঙ্গে কাজ করে, তখনই তা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয় বলে জানিয়েছে আইএমএফের প্রতিনিধিদল।
আরিফ হোসেন খান বলেন, তারল্য সংকটে থাকা ১১টি ব্যাংকের মধ্যে ৬টি ব্যাংকের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। এখন আর তাদের তারল্য সহায়তা লাগবে না। তবে, পাঁচটি ব্যাংক এখনো দুর্বল অবস্থায় আছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে চলমান ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ কর্মসূচির আওতায় চতুর্থ কিস্তিতে ২৩৯ কোটি ডলার পাবে বাংলাদেশ। এ অর্থ ছাড়ের আগে শর্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনায় গত ৬ এপ্রিল থেকে ঢাকায় অবস্থান করছে আইএমএফের প্রতিনিধিদল। তারা অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে বৈঠক করেছে। এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আজ বৈঠক হলো।
১৭ এপ্রিল পর্যন্ত বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের সঙ্গে বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলন করবে আইএমএফের প্রতিনিধিদল।
ঢাকা/এনএফ/রফিক
উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে যা ভাবছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
কথা ছিল, এপ্রিলের ১ তারিখ বাংলাদেশ ব্যাংক তার নতুন ঋণবিন্যাস নীতি চালু করবে। এখন শোনা যাচ্ছে, ব্যাংকিং খাতের নাজুকতা ও ভঙ্গুরতার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে এ কার্যক্রম নিয়ে পুনঃআলোচনা করবে। এ নতুন নীতি অনুসারে, কোনো ঋণ যদি তিন মাস পরেও অপরিশোধিত থাকে, তাহলে সে ঋণকে খেলাপি বলে ঘোষণা করা হবে। এর আগে এ সময়সীমা ছিল ছয় মাস। খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এই নতুন নীতি বৈশ্বিক ‘তৃতীয় ব্যাসেল ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা’র সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ আইএমএফের কাছ থেকে ৪০৭ কোটি ডলারের যে ঋণ পেয়েছে, তার শর্ত হিসেবে বাংলাদেশ প্রাথমিকভাবে এই নতুন ঋণবিন্যাস নীতি বাস্তবায়নে সম্মত হয়েছিল।
তৃতীয় ব্যাসেল ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রণ বাস্তবায়নের বিলম্বীকরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একা নয়; যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও এ ব্যাপারে অতিরিক্ত সময় চেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ২০২৫ সালের জুলাই মাস থেকে তিন বছরের উত্তরণ সময়কালসহ এ বাস্তবায়ন শুরু করবে। তাদের মধ্যম আয়তনের ব্যাংকগুলো যাতে চাপের মুখে না পড়ে, সে জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন ব্যাসেল কাঠামোর বাস্তবায়ন বিলম্বিত করবে। এ সবকিছুর ফলে পুনঃআলোচনার জন্য বাংলাদেশের অবস্থান হয়তো জোরদার হবে।
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ খেলাপি ঋণ মোট বিতরণকৃত ঋণের ২০ শতাংশ ছিল। এক বছর আগের অনুপাত ছিল ৮ শতাংশ। গত এক বছরে বাংলাদেশের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ লাখ কোটি টাকা বেড়ে গিয়েছে। এর ফলে ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩.৬ লাখ কোটি টাকায় এসে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রাক্কলন অনুসারে, বাংলাদেশের খেলাপি ঋণ মোট বিতরণকৃত ঋণের ৩০ শতাংশ হতে পারে এবং অনপেক্ষভাবে এ ঋণের পরিমাণ ৫ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর দুর্বলতা, ক্রমাগত অদক্ষতা, অর্থ এবং পুঁজি পাচারের মতো অবৈধ অর্থপ্রবাহের কারণে দেশে খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে।
খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংককে নতুন ঋণবিন্যাস নীতি বাস্তবায়নে বেগ পেতে হবে। খেলাপি ঋণের সংজ্ঞার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যদি বৈশ্বিক মানে ফিরে যায়, তাহলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেড়ে যেতে পারে; যাতে আইএমএফের শর্ত মানা দুষ্কর হতে পারে। আইএমএফের শর্ত হচ্ছে, ২০২৬ সাল নাগাদ রাষ্ট্রীয় ঋণদাতাদের ক্ষেত্রে মোট বিতরণকৃত ঋণে খেলাপি ঋণের অনুপাত হতে হবে ১০ শতাংশ এবং বেসরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রে এই অনুপাতকে হতে হবে ৫ শতাংশ। বিষয়টি আইএমএফের বাংলাদেশকে দেয় ঋণের তৃতীয় কিস্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত, যার পূর্বনির্ধারিত বিতরণ তারিখ ছিল ৫ ফেব্রুয়ারি। কোনো ব্যাখ্যা ভিন্নই সে তারিখ স্থগিত করা হয়েছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের সম্পদের গুণগত মান কমে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের ব্যাংকিং খাতের ভবিষ্যৎ অবস্থা বিষয়ে মুডিস তার মূল্যায়ন কমিয়ে নিচে নামিয়ে এনেছে। আরও কঠিন ঋণবিন্যাস নীতি দেশের আর্থিক খাতের দেয় অবস্থাকে জটিল করে তুলবে। দেশের অর্থনৈতিক শ্লথতা এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপটে আরও বেশিসংখ্যক বাংলাদেশি উদ্যোক্তা সময়সীমার মধ্যে ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হবেন।
খেলাপি ঋণ নির্ধারণের জন্য বাংলাদেশ ২০১২ সালে খেলাপি ঋণ নির্ণয়ের বৈশ্বিক মানদণ্ড গ্রহণ করেছিল। সেই মানদণ্ড অনুসারে ঋণগ্রহীতা যদি তিন মাস পরে ঋণ পরিশোধে অপারগ হন, তাহলে সে ঋণকে খেলাপি ঋণ বলে চিহ্নিত করা হবে। কিন্তু ২০১৯ সালে সেই মানদণ্ডকে শিথিল করে সংশ্লিষ্ট সময়সীমা তিন মাস থেকে ছয় মাস করা হয়েছিল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতাদের ঋণ পরিশোধের জন্য ৯ মাস সময় দেওয়া হতো। তারও আগে, ২০১২ সালের ‘ঋণের সময়কাল পুনর্নির্ধারণ নীতি’র কারণে ঋণখেলাপিরা তাদের নিজ নিজ ঋণ মোট তিনবার পুনর্বিন্যস্ত করতে পারতেন, যার কারণে কুসম্পদের পরিমাণ লুকিয়ে রাখা যেত।
এসব বিচ্যুতির বিভিন্ন কারণ ছিল। কিন্তু সবচেয়ে বড় কারণ ছিল রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে গুটিকয়েক স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীকে অবৈধ সুবিধা দেওয়া। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এসব গোষ্ঠী ব্যাংকগুলোকে ব্যবহার করেছে তাদের ব্যক্তিগত কোষাগারের মতো। তারা নানাভাবে অর্থনৈতিক বিধি-নিষেধের শৃঙ্খলা ভেঙে ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে জাঁকিয়ে বসেছিল, ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কাঠামো নিয়ন্ত্রণ করে অর্থ আত্মসাতের পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করেছিল। যে ব্যবস্থায় না ছিল কোনো দৃশ্যমানতা কিংবা দায়বদ্ধতা। এমন প্রক্রিয়ার ফল হয়েছিল দুটো– এক. কোটি কোটি টাকার ঋণ গ্রহণ করে তা পরিশোধ না করা এবং দুই. খেলাপি সেসব অর্থ ও সম্পদ বিভিন্ন অবৈধ উপায়ে বিদেশে পাচার করা।
সন্দেহ নেই, এসব বিচ্যুতির কারণে বিশাল অঙ্কের ঋণখেলাপ কাগজে-কলমে এড়ানো গেছে, কিন্তু এর কারণে চূড়ান্তভাবে দেশের আর্থিক কুশল বিঘ্নিত হয়েছে। এতে গত দশকে ১০টি ব্যাংক একদম ভেঙে পড়ার দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। সেই সঙ্গে হাজার হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এ ধরনের শিথিলতা সত্ত্বেও বৈশ্বিক ঋণ মূল্যায়ন সংস্থাগুলো তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশের আর্থিক খাতের মান কমায়নি। কিন্তু খেলাপি ঋণ দ্রুত বেড়ে যাওয়া এবং সেই সঙ্গে নীতিমালার আসন্ন কঠিন বাস্তবায়নের কারণে আগামীতে আরও মান কমার আশঙ্কা রয়েছে।
আইএমএফের সঙ্গে আলোচনার যে প্রস্তুতি বাংলাদেশ ব্যাংক নিচ্ছে, তার ফল দেশের আর্থিক খাতের ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর বিধিবিধান এবং দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা একটি বড় বিষয় হয়ে দেখা দেবে।
সেলিম জাহান: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি