দেশের অন্যতম শোবিজ তারকা ও মডেল পিয়া জান্নাতুল। তিনি আইন পেশায়ও আছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি বেশ জনপ্রিয়। ফেসবুকে তাঁর অনুসারীসংখ্যা ১৭ লাখ। ইনস্টাগ্রামে ১১ লাখ।

পিয়া নিজের মডেলিং জীবনের পাশাপাশি নানা সময় সামাজিক ও আইনি পরামর্শমূলক পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেন। তবে চলতি বছর তাঁকে অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপনের প্রচারণা চালাতে দেখা গেছে। গত ১ জানুয়ারি থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি ১২টি অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপনের প্রচারণা চালিয়েছেন নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে।

শুধু পিয়া নন, চিত্রনায়িকা শবনম বুবলী, অভিনয়শিল্পী সামিরা খান মাহিও অনলাইন জুয়ার প্রচারণা চালিয়েছেন। দেশের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানও আছেন এই তালিকায়।

বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় টি-টোয়েন্টি লিগ আইপিএলের (ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ) নতুন মৌসুম শুরু হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের এই টুর্নামেন্ট চলবে দুই মাসব্যাপী। আইপিএলের এবারের আসরে বাংলাদেশের কোনো ক্রিকেটার নেই। তবে আইপিএলের নিয়ে অনলাইন জুয়ার প্রচারণা সমানে চলছে বাংলাদেশে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে অনলাইন জুয়া বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি গবেষণায় উঠে এসেছে। বিশেষ করে ক্রিকেটের আসর আইপিএল ও বিপিএল (বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ) চলাকালে তা আরও বেড়ে যায়।

গত ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারির বিপিএলের পাশাপাশি চলমান আইপিএলের সময় একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, গুগলে বাংলাদেশে অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপন চলছে অবাধে। বাংলাদেশের শীর্ষ তারকারা অর্থের বিনিময়ে এসব বিজ্ঞাপনের প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন।

বিষয়টি নিয়ে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব প্রথম আলোকে বলেন, প্রস্তাবিত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে সাইবার স্পেসের (পরিসর) জুয়াকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। চলতি সপ্তাহে যদি অধ্যাদেশটি উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন পায়, তাহলে এই অপরাধে জড়িত ব্যক্তিরা আইনের আওতায় আসবেন।

তারকারা ধরাছোঁয়ার বাইরে

জুয়া খেলা ও প্রচারণার অভিযোগে বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যবস্থা নেওয়ার খবর সামনে এসেছে। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিন ইউটিউবারকে জুয়ার প্রচারণার অভিযোগে পুলিশ স্বপ্রণোদিত হয়ে মামলা করে গ্রেপ্তার করেছিল। তবে জুয়ার প্রচারণার চালিয়েও দেশের শীর্ষ তারকারা সব সময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কোনো সংস্থাকে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।

মডেল পিয়া বিপিএলের গত আসরে অনলাইন জুয়ার প্রচারণা চালিয়েছেন। এ ছাড়া আইপিএলের চলমান আসরে তিনি অনলাইন জুয়ার প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

পিয়ার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ ঘেঁটে দেখা যায়, তিনি চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ‘বাবু ৮৮’ ও ‘ভাগ্য’ নামের দুটি অনলাইন জুয়ার প্রতিষ্ঠানের ১২টি প্রচারণা চালিয়েছেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পিয়া কোনো কথা বলবেন না বলে প্রথম আলোকে জানান।

চিত্রনায়িকা শবনম বুবলী নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে চলতি বছর ‘মেগা ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড’ নামের একটি জুয়ার প্রতিষ্ঠানের ৩টি বিজ্ঞাপন প্রচার করেছেন। এ ব্যাপারে জানতে বুবলীকে তাঁর মুঠোফোন নম্বরে কল করে ও খুদেবার্তা পাঠিয়ে সাড়া পাওয়া যায়নি।

অভিনয়শিল্পী সামিরা খান মাহি নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে চলতি বছর ‘বাবু ৮৮’ নামের জুয়ার ২টি প্রচারণা চালিয়েছেন। এ বিষয়ে তাঁর কাছে জানতে চেয়ে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

এ ছাড়া অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়া, অপু বিশ্বাস, মাহিয়া মাহিসহ দেশের শীর্ষ অনেক তারকা বিভিন্ন সময় অনলাইন জুয়ার প্রচারণা চালিয়েছেন।

ক্রিকেট ঘিরে অনলাইন জুয়ার প্রচার-প্রচারণায় ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের নাম একাধিকবার এসেছে। ১ কোটি ৬০ লাখ অনুসারী থাকা নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে গত ২২ মার্চ সাকিব ‘ওয়ানএক্সবেট’ নামের অনলাইন জুয়ার প্রচারণা চালান। এর আগে ২০২২ সালে ‘বেটউইনার’ নামের একটি অনলাইন জুয়ার প্রতিষ্ঠানের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বেটউইনার নিউজের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন তিনি।

এ ছাড়া ভারতে বেটিং অ্যাপ (অনলাইনে বাজি ধরার অ্যাপ) কেলেঙ্কারির তদন্তে সাকিবের বোন জান্নাতুল হাসানের নাম আসে। গত বছরের মার্চে ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ‘১১ উইকেটডটকম’ নামের একটি বেটিং অ্যাপে সাকিবের বোন বিনিয়োগ করেছেন।

সাকিব বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। অনলাইন জুয়ার প্রচারণা নিয়ে বক্তব্য জানার জন্য তাঁকে হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠানো হলে তিনি সাড়া দেননি।

অনলাইন জুয়ার বাজার কত টাকার

বাংলাদেশে অনলাইন জুয়ার বাজার কত টাকার, তার সঠিক হিসাব নেই। তবে দেশের কত মানুষ অনলাইন জুয়ার সঙ্গে জড়িত, তার একটি আনুমানিক হিসাব গত বছরের ২৪ জুন দিয়েছিলেন তৎকালীন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। তখন তিনি বলেছিলেন, দেশের প্রায় ৫০ লাখ মানুষ অনলাইন জুয়ার সঙ্গে জড়িত।

অন্যদিকে গত বছরের ২০ জুন ভারতের সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডেতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশটিতে অবৈধ অনলাইন বাজির বাজার বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলারের মতো অর্থ সংগ্রহ করে।

২০২৪ সালের ১৩ মে ভারতের সংবাদমাধ্যম মিন্ট প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশটির পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট ১৮৬৭ অনুযায়ী, জুয়া নিষিদ্ধ। তারপরও দেশটিতে অনলাইনে জুয়ার প্রচারণাসহ অন্যান্য কর্মকাণ্ড থেমে নেই। ভারতে জুয়ার বাজার বছরে ৩ বিলিয়ন ডলারের সমান হবে। বিশ্বে অনলাইন গেমিং বাজারে চীনের পরে রয়েছে ভারত। আইপিএল ও নির্বাচনের সময় ভারতে অনলাইন জুয়ার প্রসার ঘটে।

তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে বাংলাদেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইট লিমিটেডের (ডিআরএল) তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ ডিসমিসল্যাবের অনলাইনে জুয়ার বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা নিয়ে কয়েকটি প্রতিবেদন আছে।

আরও পড়ুনজুয়ার বিজ্ঞাপন দেখা যায়, এমন ওয়েবসাইট ব্লকের নির্দেশ১১ জুলাই ২০২৩

২০২৪ সালের এপ্রিলে ‘নীতি লঙ্ঘন: বাংলাদেশিদের লক্ষ্য করে মেটার প্ল্যাটফর্মে হাজার হাজার জুয়ার বিজ্ঞাপন’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ফেসবুকের মূল এই প্রতিষ্ঠানের (মেটা) প্ল্যাটফর্মগুলোতে বছরে জুয়ার বিজ্ঞাপনে ব্যয় আনুমানিক ১৫ কোটি টাকা। তবে প্রকৃত ব্যয় আরও বেশি হতে পারে।

অনলাইন জুয়ার উৎস সম্পর্কে ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ক্রিকেট-সংশ্লিষ্ট জুয়ার প্রতিষ্ঠানের ভারতীয় নাম দেখে সেগুলোকে সে দেশ থেকে আসা বলে মনে হয়। বিশেষ করে তাদের ক্রিকেটের অন্যতম বড় আসর আইপিএলের সময়ে অনলাইন জুয়া বেড়ে যায়। তবে জুয়ার সাইট বা অ্যাপ ভারত ছাড়া অন্য দেশেও হোস্ট করা থাকতে পারে।

শক্ত আইন ও তদারকি নেই

ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের প্রসারে অনলাইন জুয়া খেলার ধরন পাল্টে গেছে। এখন অনলাইন জুয়ার বেশির ভাগই মুঠোফোনে খেলা হয়। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও অনলাইন জুয়ার বড় বাজার গড়ে উঠছে।

বাংলাদেশে জুয়া নিষিদ্ধ। দেশে জুয়া দমনে আইন (পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট ১৮৬৭) আছে। কিন্তু আইনটি অস্পষ্ট।

আরও পড়ুনদেশে অনলাইন জুয়ার বাজার বড় হচ্ছে, নেই আইনি পদক্ষেপ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

অন্যদিকে বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কিন্তু কী ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে, তার সুস্পষ্ট উল্লেখ নেই।

ইন্টারনেট যুগের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে বিশেষ করে অনলাইন জুয়া প্রতিরোধে স্পষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। তবে ২০২৩ সালের ১১ জুলাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও টেলিভিশন, বিশেষ করে খেলার চ্যানেলসহ ডিজিটাল ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে অনলাইন বাজি ও জুয়ার বিজ্ঞাপন বন্ধে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে যেসব আর্থিক পরিষেবার মাধ্যমে বেটিং ওয়েবসাইটের অর্থ আদান-প্রদান হয়, সেগুলোর গেটওয়ে ও চ্যানেল বন্ধের নির্দেশনা দেওয়া হয়।

আরও পড়ুনদেশে জুয়া দমনে আইন থাকলেও তা অস্পষ্ট০২ অক্টোবর ২০১৯

১৮৬৭ সালের ‘পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট ১৮৬৭’ রহিত করে ‘জুয়া প্রতিরোধ আইন, ২০২৩’ প্রণয়ন উদ্যোগের অংশ হিসেবে একটি খসড়া করেছিল বিগত সরকার। এই খসড়ায় অনলাইন জুয়া নিয়ে আলাদা করে বলা আছে।

প্রস্তাবিত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে সাইবার স্পেসে জুয়া খেলা সম্পর্কে বলা হয়েছে, কেউ যদি জুয়ার কোনো পোর্টাল, অ্যাপ বা ডিভাইস তৈরি বা পরিচালনা করে, খেলায় অংশগ্রহণ করে, উৎসাহ প্রদান করে বা বিজ্ঞাপনে অংশগ্রহণ করে, তবে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এ অপরাধের জন্য ২ বছরের কারাদণ্ড বা ২০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হবে।

গুগল-ফেসবুক নিজস্ব নীতি মানছে না

ডিসমিসল্যাবের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মেটার (ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান) অনলাইন জুয়া ও গেমিং বিজ্ঞাপন নীতিমালায় বলা আছে, বিজ্ঞাপনদাতাদের এ ধরনের প্রচার-প্রচারণার আগে অবশ্যই একটি ফরম পূরণ করতে হবে। যেসব দেশ মেটার তালিকাভুক্ত, সেসব দেশকে লক্ষ্য করে বিজ্ঞাপন দেওয়া যাবে।

কিন্তু মেটার অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপনের জন্য অনুমোদিত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ নেই। ডিসমিসল্যাব বলছে, অনলাইন জুয়ার এসব বিজ্ঞাপনদাতা তাদের বিজ্ঞাপনের ধরন অস্পষ্ট করে বা মেটার শনাক্তকরণ পদ্ধতি এড়িয়ে জুয়ার প্রচারণা চালাচ্ছে।

আরও পড়ুনঅনলাইন জুয়া বন্ধে ব্যবস্থা নেবে কে?১৫ জুলাই ২০২৩

আরেক টেক জায়ান্ট গুগলও এ ক্ষেত্রে নিজস্ব নীতির তোয়াক্কা করছে না। ডিসমিসল্যাবের আরেকটি গবেষণায় এ নিয়ে বলা হয়েছে, গুগল কিছু নির্দিষ্ট দেশে জুয়ার বিজ্ঞাপন দেখানোর অনুমতি দেয়। কিন্তু বাংলাদেশ এসব দেশের তালিকায় নেই। কিন্তু এরপরও জুয়ার সাইটগুলো বাংলাদেশকে লক্ষ্য করে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে।

অনলাইন জুয়ার প্রকাশ্য প্রচারণায় তারকাদের অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে ডিজিটালি রাইট-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘জুয়া নিয়ে আইনে এখনো গ্রে এরিয়া (অস্পষ্টতা) রয়েছে। প্রস্তাবিত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ হলে জুয়ার বিষয়ে জবাবদিহি আসবে বলে আশা করা যায়।’

আরও পড়ুনঅনলাইন জুয়ার বিস্তারে টিআইবির উদ্বেগ০৯ মে ২০২৪আরও পড়ুনক্রিকেট নিয়ে অনলাইনে জুয়া, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসহ গ্রেপ্তার ৪: র‌্যাব২৪ অক্টোবর ২০২৩.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র ভ র ফ য় ড ফ সব ক প জ ন জ র ভ র ফ য় ড ফ সব ক প রথম আল ক র ব যবস থ ব শ ষ কর র জন য প এল র বছর র র একট অপর ধ গ রহণ

এছাড়াও পড়ুন:

প্রকল্প বন্ধ, কাজও নেই দুর্ভোগে দরিদ্র শ্রমিকরা

অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান প্রকল্পের (ইজিপিপি) কাজ হঠাৎ করে স্থগিত হওয়ায় দুর্ভোগে রয়েছেন দেওয়ানগঞ্জের ২ হাজার ৮৫৩ শ্রমিক। একই সঙ্গে বন্ধ রয়েছে প্রকল্পের আওতাধীন গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার কাজ।
উপজেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায় ৫৩টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। এতে আর্থিক সুবিধা পায় ২ হাজার ৮৫৩ জন অতিদরিদ্র এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয় আটটি ইউনিয়নের। যার মধ্যে ডাংধরা ইউনিয়নে ৯টি প্রকল্পে ৪৭৫ জন, চরআমখাওয়া ইউনিয়নে ৯টি প্রকল্পে ৪৬৩ জন, পাররামরামপুর ইউনিয়নে ৫টি প্রকল্পে ৪৪৮ জন, হাতিভাঙ্গা ইউনিয়নে ৬টি প্রকল্পে ২৪৩ জন, বাহাদুরাবাদ ইউনিয়নে ৯টি প্রকল্পে ৪৮৬ জন, চিকাজানী ইউনিয়নে ৫টি প্রকল্পে ২৯৭ জন, চুকাইবাড়ী ইউনিয়নে ৫টি প্রকল্পে ১৭২ জন এবং সদর ইউনিয়নে ৫টি প্রকল্পে ২৬৯ জন অতিদরিদ্র শ্রমিক কাজ করেন।

তারা একটি পর্বে ৪০ দিন মেয়াদে প্রতিদিন ৪০০ টাকা হারে মজুরি পান। সেই হিসাবে প্রত্যেক শ্রমিক ৪০ দিনে মজরি পান ১৬ হাজার টাকা। একটি পর্বে ৪০ দিন মেয়াদে ২ হাজার ৮৫৩ জন শ্রমিক ৪ কোটি ৫৬ লাখ ৪৮ হাজার টাকার সুবিধা ভোগ করেন। এই প্রকল্প অতিদরিদ্র পরিবারে আর্থিক সহায়তা প্রদান ও গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার নামে দুটি উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এসে হঠাৎ চলমান প্রকল্পটির দুটি পর্ব স্থগিত হয়ে যায়। এতে বিপাকে পড়েন প্রকল্পের আওতাধীন ২ হাজার ৮৫৩ জন অতিদরিদ্র শ্রমিক। বন্ধ হয়ে যায় বন্যায় বিধ্বস্ত গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার কাজ।
প্রকল্পের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রথম পর্বে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪০ দিন এবং দ্বিতীয় পর্বে মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ৪০ দিন; অর্থাৎ একই অর্থবছরে প্রত্যেক শ্রমিক ৮০ দিন কাজ করে মজুরি পেয়েছেন ৩২ হাজার টাকা। এ টাকা তাদের জীবনযাত্রাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেকারত্বে ভুগছেন অনেকে।
একাধিক ইউপি সদস্য ও চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেওয়ানগঞ্জ নিচু অঞ্চল। প্রতিবছর বন্যায় এখানকার রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
প্রকল্পের সুবিধাভোগী বাহাদুরাবাদ ইউনিয়নের পোল্যাকান্দি নামাপাড়া গ্রামের কাপাসী বেগম। তিনি বলেন, ‘কয়েক বছর থেকে ৪০ দিনের প্রকল্পে মাটি কাটার কাজ করছি। অভাবী সংসার, দ্রব্যমূল্য বাড়তি। এই বাজারে স্বামীর একার আয়ে সংসার চালানো কঠিন। ওই প্রকল্পের কাজ করে সংসারের অভাব কিছুটা দূর হয়েছিল। কিন্তু প্রকল্পটি স্থগিত হয়ে যাওয়াতে আমরা দুশ্চিন্তায় আছি। আমাদের মতো অতিদরিদ্র পরিাবরের অভাবের কথা চিন্তা করে প্রকল্পটি চালু করা জরুরি।’

চিকাজানী ইউনিয়নের পূর্ব কাজলাপাড়া আদর্শ গ্রামের হাসেন আলী জানান, কয়েক বছর ধরে ৪০ দিনের প্রকল্পে কাজ করছেন তিনি। ওই টাকায় সংসার বেশ ভালোই চলছিল। হঠাৎ করে প্রকল্পটি স্থগিত হওয়ায় মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা হয়েছে। পরিবার নিয়ে অতিকষ্টে দিন পার করতে হচ্ছে।
চরআমখাওয়া ইউপি সদস্য বাবুল আকতারের ভাষ্য, গ্রামীণ অবকাঠানো সংস্কার ও অতিদরিদ্রদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ইজিপিপি প্রকল্পের গুরুত্ব অপরিসীম। এই প্রকল্পের মাধ্যমে একদিকে অতিদরিদ্র পরিবারে আর্থিক সহায়তা দেওয়া যায়, অন্যদিকে গ্রামের কাঁচা সড়ক সংস্কার করা যায়। কিন্তু প্রকল্পটি স্থগিত হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন তাঁর মতো জনপ্রতিনিধিরা। কারণ প্রতিদিন তাদের কাছে দৌড়ঝাঁপ করছেন সুবিধাভোগীরা। সব দিক বিবেচনায় প্রকল্পটি আবার চালু করা প্রয়োজন।
পাররামরামপুর ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম মিয়া জানান, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তাঁর ইউনিয়নে ইজিপিপির আওতায় ৫টি প্রকল্পে ৪৪৮ জন অতিদরিদ্র শ্রমিক কাজ করেছেন। তাদের পরিবারে এই প্রকল্পে অর্জিত অর্থ বিরাট মাত্রায় প্রভাব ফেলেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রকল্পটি স্থগিত হওয়ায় অতিদরিদ্র শ্রমিকদের পরিবারে নেমে এসেছে দৈন্যদশা। এছাড়া বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন কাঁচা সড়ক রয়েছে সংস্কারহীন। ওইসব সড়ক মেরামতের জন্য ইউনিয়ন পরিষদে সরকারি কোনো তহবিল নেই। সবদিক বিবেচনায় প্রকল্পটি আবার চালু করা প্রয়োজন।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) খবিরুজ্জামান খান বলেন, ‘অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান প্রকল্পটি (ইজিপিপি) কেন স্থগিত রয়েছে, তা জানি না। এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা পাইনি। তবে প্রকল্পটি চালুর নির্দেশনা পেলে গ্রামীণ জীবনমান উন্নয়নে কাজ শুরু করা হবে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ