গাজায় যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের পর ৪ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে: জাতিস
Published: 8th, April 2025 GMT
জাতিসংঘ জানিয়েছে, ইসরায়েল সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভঙ্গ করার পর থেকে গাজা উপত্যকায় প্রায় ৪ লাখ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। বেসামরিক মানুষদের নিরাপত্তার জন্য কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
সোমবার (৭ এপ্রিল) জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “আমাদের মানবিক সহকর্মীরা জানিয়েছেন, গাজা জুড়ে ইসরায়েলি হামলা অব্যাহতভাবে অব্যাহত রয়েছে, যার ফলে প্রতিদিন ব্যাপক বেসামরিক হতাহতের ঘটনা ঘটছে।”
ডুজারিক বলেন, “গাজায় শিশুসহ অনেক মানুষ নিহত, আহত এবং সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হচ্ছেন।”
আরো পড়ুন:
আইসিসির গ্রেপ্তার এড়িয়ে যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রে গেলেন নেতানিয়াহু
ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি বর্বরতা, দেশজুড়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ
তিনি আরো বলেন, “গাজা জুড়ে বেঁচে থাকাদের বারবার বাস্তুচ্যুত করা হচ্ছে এবং এমন একটি সঙ্কুচিত স্থানে বসবাসে বাধ্য করা হচ্ছে যেখানে তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা অসম্ভব।”
“সামগ্রিকভাবে, আমরা ধারণা করছি যে, যুদ্ধবিরতি ভেঙে যাওয়ার পর থেকে প্রায় ৪ লাখ মানুষ আবারও বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এটি গাজার সমস্ত ফিলিস্তিনির ১৮ শতাংশ।” তিনি বলেন।
ডুজারিক জোর দিয়ে আরো বলেন, “তাদের নিরাপত্তা ও বেঁচে থাকার জন্য কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি- দখলদার শক্তি হিসেবে ইসরায়েলের ওপর একটি দায়িত্ব বর্তায়।”
তিনি সতর্ক করে বলেন, “গাজায় মানবিক সাহায্য প্রচেষ্টা ভেঙে পড়ছে।” তিনি বলেন, “গাজার মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য মানবিক পণ্য ও সরঞ্জাম সরবরাহে সীমান্ত ক্রসিংগুলো অবিলম্বে পুনরায় চালু না করা হলে আমরা এটি বেশি দিন ধরে রাখতে পারব না।”
জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক সমন্বয় অফিসের উদ্ধৃতি দিয়ে ডুজারিক জানান, গাজায় মানবিক সহায়তার প্রবেশাধিকার ইসরায়েল প্রত্যাখান করেছে।
ভিডিওতে ধরা পড়া স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর ইসরায়েলের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে ডুজারিক বলেন, “জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ভিডিওটি সম্পর্কে খুব সচেতন এবং আমি মনে করি যারা এটি দেখেছেন তাদের মতো, এই ছবিগুলো দেখে তিনিও দেখে হতবাক।”
তিনি ‘যা ঘটেছে তার স্বাধীন, স্বচ্ছ এবং কার্যকর তদন্ত’ করার জন্য জাতিসংঘের আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
গাজায় পোলিও টিকা সম্পর্কে ডুজারিক বলেন, “এক মাসেরও বেশি সময় ধরে গাজায় কোনো টিকা, খাবার, জ্বালানির কোনো সরবরাহ পাওয়া যায়নি।”
গত ১৮ মার্চ ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজায় নতুন করে প্রাণঘাতী হামলা চালায় এবং এরপর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৩ হাজার ৪০০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন। জানুয়ারিতে সম্পাদিত যুদ্ধবিরতি ও বন্দী বিনিময় চুক্তি ভঙ্গ করে ইসরায়েল গাজায় নতুন করে হামলা চালাচ্ছে।
গত সপ্তাহে, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু গাজায় হামলা আরো বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, কারণ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা চলছে।
২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলি নৃশংস হামলায় এ পর্যন্ত ৫০ হাজার ৭০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু।
ঢাকা/ফিরোজ
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ইসর য় ল র জন য ইসর য
এছাড়াও পড়ুন:
এবার রমজানে নিত্যপণ্যের বাজার যে কারণে নিয়ন্ত্রণে ছিল
আমাদের দেশে অতীত অভিজ্ঞতা মিশ্র হওয়ার কারণে রমজান মাসে বাজার পরিস্থিতি নিয়ে ভোক্তারা সর্বদা উদ্বেগে থাকেন। এই মাসে কিছু ভোগ্যপণ্যের বাড়তি চাহিদার কারণে সরবরাহ ব্যবস্থাপনা নিয়ে নানা ধরনের শঙ্কা উঁকি দেয়। তবে এবারের রমজানে এমনটা ঘটেনি। রমজানের শেষ দিকে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত জরিপে দেখা যায়, প্রায় ৯৫ শতাংশ মানুষ রমজানে বাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সন্তুষ্ট। (এবার রোজায় দ্রব্যমূল্যে সন্তুষ্ট ৯৫ শতাংশ মানুষ, কালবেলা, ২৯ মার্চ ২০২৫)
২.রমজান মাসের স্পর্শকাতর পণ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে খেজুর, ডাল, ছোলা, তেল, চিনি, তাজা ফল, চাল, সবজি, পেঁয়াজ, ডিম, মাছ ও মাংস। মোটাদাগে, দু–একটি ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছাড়া রমজান মাসজুড়ে এসব পণ্যের সার্বিক সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি সাধারণ মানুষের প্রত্যাশাকে পূরণ করেছে।
এই পরিস্থিতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এই বছরের রমজানে নিত্যপণ্যের দাম পূর্ববর্তী রমজানের তুলনায় অনেক ক্ষেত্রে কমেছে। যেমন এ বছর ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ কম দামে মানুষ খেজুর কিনতে পেরেছেন। ইরাক থেকে আমদানি করা সাধারণ মানের জাহিদি খেজুর (যা মোট খেজুর আমদানির প্রায় অর্ধেক) প্রতি কেজি ১৬৫ টাকার স্থলে ১১৫ টাকায় এবং কার্টনে ২৬০ টাকার স্থলে ১৬৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
ডিমের দাম প্রতি ডজন ১২০ টাকায় নেমেছে (প্রতি পিস ১০ টাকা), যা একসময় ১৯০ টাকায় উঠেছিল; ছোলা ও ডাল ৫ থেকে ৩৫ শতাংশ কমেছে। চিনি গত বছর বিক্রি হয়েছে ১৪৫ টাকা, যা এবার হয়েছে ১২০ টাকা; কেজিতে কমেছে প্রায় ২৫ টাকা। গত বছর আলু ও টমেটো ছিল ৩৫ ও ৬০ টাকা, যা এবার হয়েছে যথাক্রমে ২২ ও ২০ টাকা। সবজির দামও ছিল নিম্নমুখী। রমজানকেন্দ্রিক অধিকাংশ খাদ্যপণ্যের ওপর সার্বিক মূল্যস্ফীতির চাপের তেমন কোনো নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ করা যায়নি।
৩.রমজানে ভোজ্যতেলের বাজার প্রথম দিকে কিছুটা অস্বাভাবিক থাকলেও পরে তা ঠিক হয়ে যায়। এই ভোজ্যতেল (সয়াবিন ও পাম) প্রায় শতভাগ আমদানিনির্ভর। আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দামের উর্ধ্বমুখী প্রবণতার কারণে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে সরকার কর্তৃক শুল্কছাড় এবং স্থানীয় বাজারে মূল্য সমন্বয়ের কারণে স্থানীয় বাজার স্থিতিশীলই থাকার ছিল। তবে গত বছরের তুলনায় প্রায় ৩৫ শতাংশ আমদানি বেশি হলেও সয়াবিনের উৎস দেশ ব্রাজিল থেকে অনেকটা প্রাকৃতিক কারণে বিলম্বে জাহাজীকরণ হয়েছিল। এর ফলে তা দেশে পৌঁছাতে সময় লেগেছে।
এই বিলম্বজনিত কারণে একশ্রেণির ব্যবসায়ী অসাধুতার আশ্রয় নিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে সরকারের নিবিড় তদারকিতে তা নিয়ন্ত্রণে আসে। ১০ রমজানের পর থেকে ক্রেতাদের নির্ধারিত মূল্যে তেল কিনতে আর অসুবিধা হয়নি।
আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন ও পাম তেলের দাম গত কয়েক মাসে ‘অস্বাভাববিক’ ছিল। তা সত্ত্বেও ট্যারিফ কমিশনের পর্যবেক্ষণ অনুসারে সরকার স্থানীয় বাজারে এর দাম বাড়তে দেয়নি। রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ১ অক্টোবর ক্রুড সয়াবিনের মূল্য ছিল ৯৮০ ডলার। আর ক্রুড পাম অয়েলের মূল্য ছিল ১ হাজার ৫০ ডলার। ওই বছরের ১ ডিসেম্বরে মূল্য দাঁড়ায় যথাক্রমে ১ হাজার ৭০ ডলার ও ১ হাজার ২৩০ ডলার। পরবর্তী সময়ে সয়াবিন ১ হাজার ১৪০ ও পামের দাম উঠেছিল ১ হাজার ২৫২ ডলার। ভোজ্যতেলের এই ঊর্ধ্বগতির উত্তাপ যাতে স্থানীয় বাজারে না আসে, সে জন্য সরকার তিন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
প্রথমত, আমদানিস্থলে শুল্ক–কর ১৫ শতাংশ থেকে প্রথমে ১০ শতাংশ এবং পরে তা ৩১ মার্চ পর্যন্ত ৫ শতাংশ নামিয়ে আনা হয়। এরপর যথাযথ মূল্য সমন্বয়ের স্বার্থে স্থানীয় বাজারে প্রতি লিটার ১৬৭ টাকা থেকে ১৭৫ (এক কেজি বোতল) আর খোলা তেল ১৪৭ থেকে ১৫৫ টাকায় উন্নীত করার অনুমোদন দেওয়া হয়।
দ্বিতীয়ত, বাজারে ভোজ্যতেলে বৈচিত্র্য আনার জন্য ক্যানোলা ও সানফ্লাওয়ার তেল আমদানিতে উচ্চ শুল্কহার (প্রায় ৫৮ শতাংশ) কমিয়ে সয়াবিন ও পাম তেলের মতো ৫ শতাংশে আনা হয়। এর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ঊর্ধ্বমুখী সয়াবিন ও পাম তেলের ওপর নির্ভরতা কমানো।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হচ্ছে, দেশে উৎপাদিত রপ্তানিনির্ভর রাইস ব্র্যান তেলকে স্থানীয় বাজারে যুক্ত করা। এত দিন অধিকাংশ ক্রুড রাইস ব্র্যান পার্শ্ববর্তী দেশে রপ্তানি হয়ে যেত। ২০১৯ সালে রাইস ব্র্যানের রপ্তানি নিরুৎসাহিত করতে শুধু রাইস ব্র্যানের ওপর ২৫ শতাংশ রপ্তানি শুল্ক আরোপ করা হয়; কিন্তু অপরোশোধিত ও পরিশোধিত তেলে কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। এই সুযোগে দেশে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও অপরিশোধিত রাইস ব্র্যান তেল পার্শ্ববর্তী দেশে চলে যেত।
ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে রাইস ব্র্যানের পাশাপাশি অরিশোধিত ও পরিশোধিত তেলের ওপর অনুরূপ ২৫ শতাংশ রপ্তানি শুল্ক আরোপ করা হয় এবং শর্তসাপেক্ষে রপ্তানিযোগ্য পণ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এতে প্রায় তিন লাখ মেট্রিক টন রাইস ব্র্যান তেল (যা অধিকতর স্বাস্থ্যসম্মত হিসেবে বিবেচিত) স্থানীয় বাজারে নতুনভাবে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি এই দেশীয় পণ্যটি সরবরাহের ফলে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার সমমূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করে সয়াবিন ও পাম তেলের বিকল্প পণ্য হিসেবে সংযোজন হয়েছে। রমজানের বাজারে এই রাইস ব্র্যান তেলের সরবরাহও বৃদ্ধি পেয়েছে।
দেশে আচমকা বন্যায় আমনের উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হওয়ায় চালের ক্ষেত্রে ভিন্ন ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে ১২-১৫ লাখ মেট্রিক টন চাল ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে। এ ক্ষেত্রেও ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশের আলোকে ঘাটতির বিপরীতে সরকার চাল আমদানি উৎসাহিত করার জন্য এর ওপর প্রযোজ্য ৬৩ শতাংশ শুল্ক–কর মাত্র ৩ শতাংশে (এআইটি) নামিয়ে আনা হয়।
এই ঘাটতি পূরণে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে পর্যাপ্ত এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খোলা হয়। এরই মধ্যে অধিকাংশ চাল দেশে এসেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম বাড়তি হওয়ায় আমদানি করা এই চালের দাম দেশেও কিছুটা বেড়েছে। তা সত্ত্বেও সাধারণ মানের চাল (স্বর্ণা) প্রতি কেজি ৫৫-৫৬ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়, যা রমজানের আগে আরও বেশি ছিল। উন্নত মানের চালের (বালাম, পাইজাম, নাজিরশাইল ইত্যাদি) দামও কিছুটা বাড়তি ছিল। তবে সামনে বোরো ধান আসার সঙ্গে সঙ্গে এই পরিস্থিতি দ্রুত উন্নত হবে, এমনটা আশা করা যায়।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সরকার কর্তৃক সময়োচিত উদ্যোগে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অনেকটাই স্বাভাবিক ছিল। চালের পরিপূরক হিসেবে আটা ও ময়দার দাম গত রমজানের তুলনায় কম (কেজিতে ৭ থেকে ১০ টাকা) ছিল। ফলে চালের বিকল্প হিসেবে আটা ও ময়দার দামে সাধারণ মানুষ সন্তুষ্ট থেকেছে।
ট্যারিফ কমিশন ও অন্যান্য সংস্থার পণ্য সরবরাহ সংক্রান্ত মাঠপর্যায়ের জরিপে এর সত্যতা পাওয়া গেছে। ফলে পণ্যমূল্যের সঙ্গে বাড়তি খরচের চাপও কমেছে। বাজারসংশ্লিষ্ট সংঘবদ্ধ অপরাধ হ্রাস পাওয়ায় তা পণ্য সরবরাহের শৃঙ্খল স্বাভাবিক রাখতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে।৪.রমজানে দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতার পেছনে কয়েকটি বিষয় ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে। প্রথমত, এবার রমজানের প্রায় ছয় মাস আগে থেকে প্রস্তুতি চলেছে। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনসহ বাণিজ্য, খাদ্য, কৃষি, মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয় (এনবিআর) সমন্বিতভাবে কাজ করেছে। এ জন্য সম্ভাব্য সব নীতিগত সাহায্য ও সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে।
ট্যারিফ কমিশন প্রতিটি পণ্য নিয়ে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে তাদের পর্যবেক্ষণ তৈরি করেছে। ডিম, পেঁয়াজ, আলু, চাল, তেল, চিনি, খেজুর, তাজা ফলসহ অন্যান্য খাদ্যপণ্যের চাহিদা ও সরবরাহ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে জোরালো সুপারিশ করে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সার্বিক ও দূরদর্শী নেতৃত্ব দিয়েছে।
দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, এবারের ভোক্তাদের আচরণেও ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে। বাজার পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, অধিকাংশ ভোক্তা এবার ‘প্যানিক বায়িং’(প্রয়োজনের অতিরিক্ত কেনাকাটা) থেকে বিরত থেকেছেন; যার যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকুই কিনেছেন। এতে সরবরাহের ওপর তেমন বাড়তি চাপ দেখা যায়নি। লেবুর কথা ধরা যাক; কোনো কোনো স্থানে লেবু প্রথম দিকে ১০০ টাকায় হালি বিক্রি হলেও সাধারণ ভোক্তারা তা কেনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েননি। পরে এই লেবুর দাম ৩০-৪০ টাকায় নেমে আসে।
অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রেও ভোক্তারা স্বাভাবিক আচরণ করেছেন। ভোজ্যতেলের কিছুটা সংকট থাকলেও অধিকাংশকে সংযত আচরণ করতে দেখা গেছে। বাজার তদারকির প্রতিবেদন অনুযায়ী সরকারি সংস্থাগুলোর তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার ফলে আবার সেই সংকট কেটেও যায়। সরকারি এসব পদক্ষেপে জনমনে একধরনের আস্থাও দেখা গেছে।
আরও পড়ুনইন্টেরিমের রোজা-ঈদ এবং ‘মধু মধু মধু...’৩১ মার্চ ২০২৫তৃতীয়ত, এবারের রমজানকেন্দ্রিক পণ্য সরবরাহে নতুন নতুন ব্যবসায়ীরা যুক্ত হয়েছেন। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, আগের রমজানে নিত্যপণ্য আমদানিকারকের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৬৫; এবার তা বেড়ে হয়েছে ৪৯৯। ফলে পণ্য আমদানির ওজনে বেড়েছে ৩৪ শতাংশ, যার পরিমাণ ৩৫ লাখ ৫৪ হাজার টন; মূল্যের হিসাবে ৫১ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১৯৬ কোটি ডলার।
নতুনদের সংযুক্ত হওয়া ও বিপুল আমদানির নেপথ্যের অন্যতম কারণ ছিল, সরকারের পূর্বপ্রস্তুতি এবং এর অংশ হিসেবে অনেকগুলো নিত্যপণ্যের শুল্ক–কর ও শুল্কায়ন মূল্য যৌক্তিকীকরণ করা। রমজান শুরুর অনেক আগে এ কাজ করায় এসব ব্যবসায়ী উৎসাহী হন। এতে চাহিদার তুলনায় পণ্যের সরবরাহে পর্যাপ্ততা দেখা যায়।
চতুর্থত, বাজারে সিন্ডিকেট বা চাঁদাবাজির দীর্ঘদিনের যে অভিযোগ ছিল, তা এবারে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে ছিল। বলা যায়, সাম্প্রতিক পটপরিবর্তনের আগে এসবের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল, তারা অনেকটা আড়ালে ছিল। এর সঙ্গে অবৈধ মজুতদারি, ঘুষ ও দুর্নীতির মাত্রাও কমেছে।
ট্যারিফ কমিশন ও অন্যান্য সংস্থার পণ্য সরবরাহ সংক্রান্ত মাঠপর্যায়ের জরিপে এর সত্যতা পাওয়া গেছে। ফলে পণ্যমূল্যের সঙ্গে বাড়তি খরচের চাপও কমেছে। বাজারসংশ্লিষ্ট সংঘবদ্ধ অপরাধ হ্রাস পাওয়ায় তা পণ্য সরবরাহের শৃঙ্খল স্বাভাবিক রাখতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। সার্বিকভাবে, এ কাজে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ট্যারিফ কমিশন, প্রতিযোগিতা কমিশন, টিসিবি, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসন নিবিড় তদারকি করেছে।
অন্যদিকে অনেক ব্যবসায়ী ও ব্যবসায়ী সংগঠনও এবারে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। ব্যবসার মূল চালিকাশক্তি মুনাফা হওয়ায় যেকোনো পরিস্থিতি বা সংকটকে কাজে লাগিয়ে কেউ কেউ অস্বাভাবিক মুনাফার পথ খোঁজেন। তবে এ বিষয়ে সরকারের দায়িত্ব হলো, প্রতিযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করা, যাতে ভোক্তাসাধারণ ন্যায্যমূল্যে পছন্দের পণ্যটি ক্রয় করতে পারেন। সরকারি সংস্থাগুলো এবারে এ কাজটি অনেকাংশে করতে পেরেছে। ট্যারিফ কমিশনসহ অন্য সংস্থাগুলো ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠক করে তাদের প্রকৃত সমস্যা চিহ্নিত করে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে।
৫.রমজানে জনমনের এই স্বস্তি পরবর্তী সময়ে ধরে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সব সংস্থার যে রকম সুষ্ঠু সমন্বয় ছিল, তেমনটা অব্যাহত রাখা দরকার; কোথাও ছন্দপতন ঘটলে সময়মতো ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে হবে। নিত্যপণ্যের বাজারে কোনটির মৌসুমি প্রভাব রয়েছে। এর জন্য পর্যাপ্ত মজুতখানাসহ নানা ধরনের অবকাঠামো তৈরি ও উদ্যোগ নেওয়া এবং তা বাস্তবায়নে নীতিসহায়তা ও সমর্থন দিতে হবে।
বন্দরে পণ্য খালাসে বিলম্ব রোধ, শুল্কায়ন প্রক্রিয়ায় মিথ্যা ঘোষণা ও চোরাচালান প্রতিরোধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেওয়া, সময়ে সময়ে ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশ আমলে নিয়ে শুল্ক–কর ও শুল্কায়ন মূল্য যৌক্তিকীকরণ করা, প্রতিযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করতে ট্যারিফ পলিসি ২০২৩ সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা এবং নিবিড়ভাবে বাজার মনিটরিং করাসহ কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। এবার রমজানের অভিজ্ঞতায় জনমনে প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছে। প্রত্যাশা পূরণ করা এখন সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও সংগঠনগুলোর দায়িত্ব।
ড. মইনুল খান চেয়ারম্যান (সচিব), বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন