ভারতে হিন্দুত্ববাদী টোটাল কন্ট্রোলের নবতম অধ্যায়
Published: 8th, April 2025 GMT
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং একবার বলেছিলেন, অধিকাংশ প্রদেশেই মুসলমান সমাজের নেতৃত্ব দিচ্ছেন হিন্দুরা। মুসলমানদের মধ্য থেকে কেন বড় মাপের নেতা উঠে আসছেন না, তা ভেবে দেখা দরকার। উত্তর প্রদেশের উদাহরণ দিয়ে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং বলেছিলেন, এই রাজ্যের মুসলমানদের অবিসংবাদিত নেতা এখন মুলায়ম সিং যাদব। হেমবতীনন্দন বহুগুণা ও বীরবাহাদুর সিংকেও মুসলমানরা আঁকড়ে ধরেছিলেন। কারণ, তাঁরা দাঙ্গা হতে দিতেন না।
এখন দাবি, নরেন্দ্র মোদিই মুসলমান সমাজের সবচেয়ে বড় হিতাকাঙ্ক্ষী। মুসলমানদের ভালোমন্দের ‘দায় ও দায়িত্ব’ নাকি তাঁরই। গাঁক গাঁক করে সেই প্রচার চলছে। নিরন্তর। যেমন তিন তালাক নিষিদ্ধ করে মোদিই মুসলমান নারীর মুক্তি ও কল্যাণের দরজা খুলে দিয়েছেন! পশ্চাৎপদ ‘পসমন্দা’ মুসলমানদের এগিয়ে আসতে সাহায্য করছেন! ওয়াক্ফ আইনও সংশোধন করা হয়েছে গরিব ও সাধারণ মুসলমানদের হিতে! ওয়াক্ফর অধীন বিপুল ভূসম্পত্তি ঠিকভাবে কাজে লাগালে বছরে কম করে হলেও ১২ হাজার কোটি রুপি আদায় হবে, যা গরিব মুসলমানদের কল্যাণে খরচ হতে পারে। ২০ বছর আগে সাচার কমিটির রিপোর্ট এই হিসাব দিয়েছিল। সরকারের দাবি, ওই টাকায় মুসলমানদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের ভাবনা একমাত্র মোদিই ভাবলেন।
অর্থাৎ মোদিই ভারতীয় মুসলমানদের মসিহা। সংসদের দুই কক্ষে ওয়াক্ফ বিল পাস করার সময় ঢাকঢোল পিটিয়ে এই ন্যারেটিভই খাড়া করা হয়েছে।
অথচ দেশের মুসলমান সমাজ ও বিরোধী মহল এই সরকারি তত্ত্ব বিলকুল খারিজ করে দিয়েছে। কিন্তু গণতন্ত্র যুক্তিতে চলে না। চলে গরিষ্ঠের মতে। শাসককুল সেই জোরেই সংসদে বিল-বৈতরণি পেরিয়েছে। কিন্তু তা করতে গিয়ে তারা বহুবিভক্ত বিরোধীদের জোটবদ্ধ করে দিয়েছে। ছন্নছাড়া ‘ইন্ডিয়া’ জোট পরস্পরকে আঁকড়ে ধরেছে ওয়াক্ফ বিলকে কেন্দ্র করে। হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে পড়েছে। কত দিন জোটবদ্ধ থাকবে, তা অবশ্য পরের কথা।
জোটবদ্ধতার ছবি বিল নিয়ে ভোটাভুটির সময় যেমন ছিল, বিল পাস হওয়ার পরও তেমনই রয়েছে। একে একে সবাই দ্বারস্থ হচ্ছে সুপ্রিম কোর্টের। কংগ্রেসের মহম্মদ জাভেদ ও এআইএমআইএমের আসাউদ্দিন ওয়েইসি আলাদাভাবে মামলা করেছেন। দুজনেই বিল নিয়ে গঠিত যৌথ সংসদীয় কমিটির (জেপিসি) সদস্য ছিলেন। মামলা করেছেন আম আদমি পার্টির (আপ) নেতা আমানুল্লা খানও। মামলা আরও হবে; যদিও কবে এই বিতর্কের আইনি অবসান ঘটবে, বিচারপতিরাই তা জানেন।
এতকাল ওয়াক্ফ-সংক্রান্ত যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারী ছিল মুসলমান সমাজ। সেই অধিকারে ভাগ বসানোর কাজটা নতুন আইন করে দিয়েছে স্রেফ গরিষ্ঠতার জোরে। তা করতে গিয়ে লঙ্ঘিত হয়েছে মুসলমানদের জন্য সংবিধানপ্রদত্ত মৌলিক অধিকার। এই দাবি বিল নিয়ে আলোচনার সময় জেপিসিতেও বিরোধীরা তুলেছিলেন। কিন্তু যে কমিটির চেয়ারম্যান বিজেপির, ৩১ জন সদস্যের মধ্যে ২০ জন শাসক দলের, সেখানে বিরোধী মত গুরুত্ব পাবে, তা-ও এই জমানায়, ভাবাই বাতুলতা। বিরোধীরা বিলে ৪৪টি সংশোধনী জমা দিয়েছিলেন। একটাও গ্রাহ্য হয়নি। সরকারপক্ষ থেকে জমা পড়েছিল ২৬টি। ১৪টি সংশোধনী গৃহীত হয় এবং দুই কক্ষে বিলটি পাস হয়।
নতুন হুজুগ ‘ইউপিএসসি জিহাদ’! মুসলমানরা নাকি শিক্ষিত ও সংগঠিত হচ্ছেন আমলাশাহির দখল নিতে! ভারতের একমাত্র মুসলমানপ্রধান রাজ্য জম্মু-কাশ্মীরের চরিত্র বদল ও দ্বিখণ্ডীকরণের কারণও হিন্দু আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা। নতুন ওয়াক্ফ আইন এই উগ্র হিন্দুত্ববাদী টোটাল কন্ট্রোলেরই আরেক অধ্যায়।প্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালামের মতো দৃঢ়তা বর্তমান রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু দেখাবেন, সেই বৃথা আশা বিরোধীরা করেননি। বিনা বাক্যেই রাষ্ট্রপতি সই করেছেন ‘ইউনিফায়েড ওয়াক্ফ ম্যানেজমেন্ট, এমপাওয়ারমেন্ট, এফিশিয়েন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিল’-এ। এখন তা আইন।
কিন্তু তা করতে গিয়ে লঙ্ঘিত হলো সংবিধানের ১৪তম অনুচ্ছেদ, যা সমতার অধিকার নিশ্চিত করেছে। ২৫তম অনুচ্ছেদ দিয়েছে ধর্মাচরণের স্বাধীনতা। ২৬তম অনুচ্ছেদ ধর্মীয় বিষয় পরিচালনার স্বাধীনতা দিয়েছে। ২৯তম অনুচ্ছেদ সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করেছে। ৩০তম অনুচ্ছেদ দিয়েছে সংখ্যালঘুদের সম্পত্তির অধিকার। প্রতিটিই লঙ্ঘিত হলো।
এই মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ২৬তম অনুচ্ছেদ, যা সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় ও দাতব্য বিষয়ে সংস্থা গড়া ও তার ব্যবস্থাপনার অধিকার দিয়েছে। সেই সংস্থা বা সংগঠনের জন্য স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি কেনা বা গ্রহণের অধিকারও দেওয়া হয়েছে। আর দেওয়া হয়েছে তা পরিচালনার দায়িত্ব। এই আইন মুসলমানদের এতগুলো মৌলিক অধিকার হরণ করলেও সরকার দ্বিধাহীন চিত্তে এগিয়ে গেছে থোড়াই কেয়ার করে।
ফলে ফুটে উঠেছে বৈষম্য। শুধু মৌলিক অধিকার হরণ নয়, এই আইন কেন্দ্রীয় ও রাজ্য স্তরে ওয়াক্ফ কাউন্সিল ও বোর্ড গঠনের সময় ভিন্ন ধর্মের এমপি, বিচারপতি ও বিশিষ্টজনদের অন্তর্ভুক্ত করার অধিকারও সরকারকে দিয়েছে। এই অধিকার অন্য কোনো ধর্মীয় সংস্থায় নেই। হিন্দুদের ধর্মীয় ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানে অহিন্দুদের কোনো ভূমিকাই নেই। খ্রিষ্টান, শিখ বা বৌদ্ধধর্মেও ভিনধর্মীদের ভূমিকা নেই।
এই বিতর্ক চলাকালে অন্ধ্র প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু এমন প্রস্তাবও দিয়েছেন, তিরুপতি দেবস্থানের পরিচালনায় কোনো অহিন্দুকে চাকরি দেওয়া উচিত নয়। ব্যতিক্রম শুধু মুসলমানদের ওয়াক্ফ বোর্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে। যদিও সরকারের দাবি, এটা নাকি ধর্ম পরিচালনায় হস্তক্ষেপ নয়।
সরকার কেন ওয়াক্ফ দখলে এতটা উন্মুখ? প্রশ্নটির উত্তর রয়েছে সারা দেশে ওয়াক্ফর অধীন থাকা সম্পত্তির বহরে। রেল ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পর ভারতে সবচেয়ে বেশি স্থাবর সম্পত্তির মালিক ওয়াক্ফ বোর্ড। আনুমানিক ৯ লাখ ৪০ হাজার একর জায়গাজুড়ে ৮ লাখ ৭০ হাজার সম্পত্তি রয়েছে তাদের হাতে। অভিযোগ, বিজেপি সরকার এই বিপুল সম্পত্তির দখল ও পরিচালন ভার হাতে নিতে উৎসুক। তাই বোর্ডে অমুসলিমদের রাখা হয়েছে। দান করা সম্পত্তির চরিত্র নির্ধারণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জেলা শাসককে। কে মুসলমান, কে নন, তা নির্ধারণের মানদণ্ডও ঠিক করে দেওয়া হয়েছে এই আইনে। বলা হয়েছে, মুসলমান তিনিই, যিনি ৫ বছর ইসলাম পালন করছেন। ওয়াক্ফে দানের অধিকার থাকবে তাঁরই।
বিজেপির দাবি, এই আইন মুসলমান নারীদের স্বার্থ রক্ষা করছে। কাউন্সিল ও বোর্ডে মুসলমানদের মধ্যে দুজন নারী সদস্য রাখা বাধ্যতামূলক। বলা হয়েছে, ওয়াক্ফে দান করার আগে সম্পত্তিতে বিধবা, বিবাহবিচ্ছিন্ন নারী ও অনাথদের প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। স্বচ্ছতার স্বার্থে ওয়াক্ফে দান করার ছয় মাসের মধ্যে সম্পত্তির বিবরণ কেন্দ্রীয় পোর্টালে নথিভুক্ত করতে হবে।
যেভাবে ওয়াক্ফে সরকারের কর্তৃত্ব কায়েম হয়েছে, সেভাবে সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতি নিয়োগেও সরকার অংশীদার হতে আগ্রহী। সুপ্রিম কোর্টের আপত্তিতে এখনো সফল হয়নি। পাল্টা আঘাতে নির্বাচন কমিশনারদের নিযুক্তি কমিটি থেকে সরকার সরিয়ে দিয়েছে প্রধান বিচারপতিকে। কেন্দ্রশাসিত রাজ্যের উপরাজ্যপালের ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়েছে নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীর চেয়েও বেশি। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং আতিশি মারলেনাকে প্রতি পদে বাধা দিয়েছেন অনির্বাচিত উপরাজ্যপাল। তেমনই সংঘাতের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে জম্মু-কাশ্মীরেও। কংগ্রেসের এক নেতার কথায়, মোদির বিজেপিতে ইকুইটির কোনো ভাগ নেই। তারা শতভাগ ইকুইটির দাবিদার। টোটাল কন্ট্রোলে বিশ্বাসী।
সেই কন্ট্রোল পেতে মুসলমান সমাজকে বশ করা জরুরি। প্রয়োজনে ভয় দেখিয়েও। জীবন ও সম্পত্তিহানির ভয় দেখাচ্ছে বুলডোজার নীতি। ধর্মস্থান আইনের তোয়াক্কা না করে দাবি উঠছে মসজিদ খোঁড়ার। এনআরসি, সিএএ, অভিন্ন দেওয়ানি বিধির একমাত্র লক্ষ্য মুসলমানদের কোণঠাসা করা। ‘লাভ জিহাদের’ মোকাবিলা করছে নীতি পুলিশ। আসাম ও ঝাড়খন্ডে জিগির উঠেছে ‘ল্যান্ড জিহাদের’। মুসলমানরা নাকি জবরদস্তি করে হিন্দুদের জমি লিখিয়ে নিচ্ছেন।
নতুন হুজুগ ‘ইউপিএসসি জিহাদ’! মুসলমানরা নাকি শিক্ষিত ও সংগঠিত হচ্ছেন আমলাশাহির দখল নিতে! ভারতের একমাত্র মুসলমানপ্রধান রাজ্য জম্মু-কাশ্মীরের চরিত্র বদল ও দ্বিখণ্ডীকরণের কারণও হিন্দু আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা। নতুন ওয়াক্ফ আইন এই উগ্র হিন্দুত্ববাদী টোটাল কন্ট্রোলেরই আরেক অধ্যায়।
● সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র ম সলম ন অন চ ছ দ একম ত র ব চ রপত ও সরক র র সময়
এছাড়াও পড়ুন:
কৃষ্ণাকে ছাড়াই ভুটান গেলেন ৫ নারী ফুটবলার
সাবিনা খাতুন, ঋতুপর্ণা চাকমা, মনিকা চাকমা ও মাতসুশিমা সুমাইয়ার পর ভুটানের ফুটবল লিগে খেলতে গেলেন আরও পাঁচ নারী ফুটবলার। আজ সকালে তাঁরা থিম্পুর উদ্দেশে দেশ ছেড়েছেন।
এই পাঁচজন হলেন সানজিদা আক্তার, মারিয়া মান্দা, শামসুন্নাহার সিনিয়র, মাসুরা পারভীন ও রুপনা চাকমা। তাঁদের সঙ্গে ভুটান যাওয়ার কথা থাকলেও ওয়ার্ক পারমিট হাতে না পাওয়ায় অপেক্ষা বাড়ল কৃষ্ণা রানীর। বাফুফে সূত্রে আজ এমনটাই জানা গেছে।
আরও পড়ুনভুটানের লিগে খেলতে যাচ্ছেন কৃষ্ণা–সানজিদাসহ আরও চার ফুটবলার০৮ এপ্রিল ২০২৫৬ এপ্রিল ভুটান যাওয়া সাবিনা, ঋতুপর্ণা, সুমাইয়া ও মনিকা খেলবেন ভুটানের ক্লাব পারো এফসির হয়ে। ট্রান্সপোর্ট ইউনাইটেডের জার্সিতে মাঠে দেখা যাবে ডিফেন্ডার মাসুরা ও গোলকিপার রুপনাকে। ফরোয়ার্ড কৃষ্ণার একই দলের হয়ে খেলার কথা রয়েছে। আর থিম্পু সিটির হয়ে খেলবেন সানজিদা, মারিয়া ও শামসুন্নাহার।
বিদেশি ক্লাবের হয়ে খেলার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের নারী ফুটবলারদের নতুন নয়। এর আগে মালদ্বীপ ও ভারতের ঘরোয়া নারী লিগে খেলেছেন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক সাবিনা খাতুন। কলকাতা ইস্ট বেঙ্গলের জার্সিতে মাঠে নামার সুযোগ হয়েছে সানজিদা আক্তারের।
আরও পড়ুনঅনুশীলনে ফিরেও দুশ্চিন্তায় বিদ্রোহীরা০৮ এপ্রিল ২০২৫এরপর গত বছরের আগস্টে ভুটানের ক্লাব রয়্যাল থিম্পু কলেজ এফসির হয়ে খেলতে যান বাংলাদেশের চার ফুটবলার সাবিনা, ঋতুপর্ণা, মারিয়া মান্দা ও মনিকা। তখন এএফসি উইমেন্স চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলার জন্য তাঁদের নিয়েছিল ভুটানের ক্লাবটি।
১৫ এপ্রিল ভুটানের নারী লিগ শুরু হওয়ার কথা। এই লিগ প্রায় ছয় মাস চলে। ভুটানের লিগ চলাকালে এই খেলোয়াড়েরা জাতীয় দলের ক্যাম্পে ডাক পেলে তাঁরা ঢাকায় ফিরে আসবেন।