ইসরায়েল হত্যা করে, মিথ্যা বলে, আর পশ্চিমা মিডিয়া তা বিশ্বাস করে
Published: 8th, April 2025 GMT
ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ও সিভিল ডিফেন্সের ১৫ জন সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। তাঁরা যোদ্ধা ছিলেন না। সন্ত্রাসীও ছিলেন না। তাঁদের কাছে কোনো রকেট বা অস্ত্র ছিল না। তাঁরা ছিলেন ত্রাণকর্মী, মানবতার সেবক। যখন যেখানে বোমা ফেলা হচ্ছিল, সেখানেই তাঁরা আহতদের সাহায্য করতে ছুটে গিয়েছিলেন। তাঁরা নিজের জীবন বাজি রেখে অন্যদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন।
এর আগে গত ২৩ মার্চ গাজার দক্ষিণে রাফা এলাকায় ইসরায়েলি বাহিনী একটি অ্যাম্বুলেন্স ও জরুরি সেবার গাড়ির বহরকে লক্ষ্য করে হামলা চালায়। এতে আটজন রেড ক্রিসেন্টের কর্মী, ছয়জন ফিলিস্তিনি সিভিল ডিফেন্সের কর্মী এবং একজন জাতিসংঘের কর্মী নিহত হন। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী দাবি করেছিল, এই গাড়িগুলো ছিল অপরিচিত। সন্দেহ করা হয়েছিল, গাড়ির মধ্যে যোদ্ধারা ছিলেন, কিন্তু এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ছিল।
রিফাত রাদওয়ান নামে নিহত চিকিৎসাকর্মীদের একজনের মোবাইল ফোন থেকে পাওয়া ফুটেজে দেখা যায়, গাড়িগুলোতে স্পষ্টভাবে লালবাতি জ্বলছিল; সেগুলো চিহ্নিত অ্যাম্বুলেন্স ছিল এবং কোথাও কোনো অস্ত্র দেখা যায়নি। তারপর শুরু হয় ইসরায়েলি বাহিনীর প্রচণ্ড গুলি।
পরে রিফাতের মরদেহ আরও ১৩ জনের সঙ্গে একটি গণকবরে পাওয়া যায়। তাঁদের কয়েকজনের দেহে সরাসরি হত্যার চিহ্ন ছিল—মাথা বা বুকে গুলি লেগেছিল। কারও কারও হাত বাঁধা অবস্থায় ছিলেন।
মৃত্যুর পরও তাঁদের প্রমাণ দিতে হলো যে তাঁরা ত্রাণকর্মী ছিলেন।
তারপরও পশ্চিমা গণমাধ্যমের বড় অংশ প্রথমেই ইসরায়েলের কথাই প্রচার করল, ‘ইসরায়েল বলছে…’, ‘আইডিএফ দাবি করছে…’, ‘একজন সামরিক সূত্র জানিয়েছে…।’ এসব কৌশলে সাজানো বাক্য যেন রেড ক্রিসেন্টের রক্তমাখা ইউনিফর্মের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়। যেন তারা সত্যের চেয়ে বেশি ‘সত্য’।
এটা নতুন কিছু নয়। এটা একবারের ভুলও নয়।
এটাই একটা সিস্টেম।
এখানে ফিলিস্তিনিদের শুধু বেঁচে থাকাই অপরাধের মতো মনে করা হয়। আমাদের অস্তিত্বকেও সন্দেহের চোখে দেখা হয়—প্রথমে সবাইকে বোঝাতে হয় যে আমরা কোনো হুমকি নই, আমাদের জীবনও মূল্যবান, তারপর হয়তো কেউ আমাদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করবে। এটাই হচ্ছে মানবতা হারানোর আসল রূপ।
আমি গাজায় জন্মেছি, সেখানেই বড় হয়েছি। আমি জানি, রেড ক্রিসেন্টের ইউনিফর্মের অর্থ কী। এর মানে হলো, সব শেষ হয়ে গেলেও আশার একটা আলো আছে। এর মানে হলো, কেউ আসছে সাহায্য করতে—লড়াই করতে বা হত্যা করতে নয়, জীবন বাঁচাতে। এর মানে হলো, ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও কারও কাছে জীবন এখনো মূল্যবান।
বিশ্বকে এখনই ফিলিস্তিনিদের প্রমাণ করতে বাধ্য করা বন্ধ করতে হবে যে তাঁরা মানুষ। আমরা মিথ্যা বলি আর আমাদের হত্যাকারীরা সত্য বলে—এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ফিলিস্তিনিদের মধ্যে যাঁরা শুধু ফেরেশতা, শুধু তাঁদের জন্য শোক প্রকাশ করা যাবে, এই ভাষ্যকে আর প্রচার করতে দেওয়া যাবে না।আমি এটাও জানি, সেই আশাকে হারালে কেমন লাগে। সেখানে চিকিৎসাকর্মীদের প্রথমে হত্যা করা হয়, তারপর তাঁদের সম্মান নষ্ট করা হয়। তাঁদের সততা নিয়ে বিতর্ক তোলা হয় আর তাঁদের সহকর্মীরা গণকবর খুঁড়ে মরদেহ উদ্ধার করেন। তাঁদের সন্দেহের চোখে দেখা হয়, তারপর ভুলে যাওয়া হয়।
মানবতা হারানো শুধু কথার কথা নয়, এটা শুধু গণমাধ্যমের কাঠামো বা রাজনৈতিক ভাষার সমস্যা নয়। এটা হত্যা করে। মুছে ফেলে। এটা পুরো জাতিগোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পরও বিশ্বকে চোখ ফিরিয়ে নিতে বলে। এটা আমাদের বলে দেয়: তোমার জীবন ততটা মূল্যবান নয়; তোমার শোক সত্যি কি না, তা আমরা যাচাই না করা পর্যন্ত শোক বলে বিবেচিত হতে পারে না; তোমার মৃত্যু দুঃখজনক কি না, তা আমাদের ছাড়পত্রের ওপর নির্ভরশীল।
এ কারণেই এই ১৫ জন চিকিৎসাকর্মী ও উদ্ধারকর্মীর মৃত্যু এত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটি শুধু একটি হত্যাকাণ্ডের গল্প নয়। এটি সেই অবিশ্বাসের প্রক্রিয়ার গল্প, যা প্রতিবার ফিলিস্তিনিরা নিহত হলে উঠে আসে। এটি সেই বাস্তবতা, যেখানে আমাদের নিজেদেরই ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ হতে হয়, নিজেদের আইনি লড়াই চালাতে হয়, নিজেদের প্রচারের কাজ করতে হয় এবং সবকিছুর সঙ্গে মরদেহের জন্য শোকও করতে হয়।
এই বোঝা আর কাউকে বইতে হয় না। যখন কোনো পশ্চিমা সাংবাদিক নিহত হন, তাঁদের সম্মান জানানো হয়। যখন কোনো ইসরায়েলি নাগরিক মারা যান, তখন তাঁদের নাম আর ছবি বিশ্বজুড়ে স্ক্রিনে ভেসে ওঠে। কিন্তু যখন কোনো ফিলিস্তিনি মারা যান, তখন তাঁর পরিবারের প্রথম কাজ হয় প্রমাণ করা, যে তিনি সন্ত্রাসী ছিলেন না।
আমাদের সব সময় দোষী ধরে নেওয়া হয়, যতক্ষণ না নির্দোষ প্রমাণিত হই। অনেক সময় সেটা প্রমাণ করাও সম্ভব হয় না।
অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, পশ্চিমা গণমাধ্যমে ইসরায়েলের কথা বেশি গুরুত্ব পায়, কিন্তু ফিলিস্তিনিদের কথা গুরুত্ব দেওয়া হয় কম। ইসরায়েল যদি কোনো দাবি করে, তা যাচাই-বাছাই ছাড়াই বিশ্বাস করা হয়; কিন্তু ফিলিস্তিনিরা কিছু বললে তা সন্দেহের চোখে দেখা হয়। এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যেন তাঁদের দুঃখ-কষ্ট, কান্না বা শোক তাঁদের কথাকে অবিশ্বাস্য বা অতিরঞ্জিত করে তোলে; অর্থাৎ ফিলিস্তিনিরা যা বলছেন, তা সত্য হলেও তাঁদের যন্ত্রণা দেখিয়ে তাঁরা বেশি বলছেন বা বাড়িয়ে বলছেন—এমন ধারণা তৈরি করা হয়।
এই গণমাধ্যমের ধারা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোকেও প্রভাবিত করে—অস্ত্র বিক্রি থেকে শুরু করে কূটনৈতিক দায়মুক্তি, আন্তর্জাতিক মঞ্চে নীরবতা থেকে জাতিসংঘে ভেটো দেওয়া পর্যন্ত। সবকিছু একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। ফিলিস্তিনিদের পুরোপুরি মানুষ বলে যেহেতু গণ্য করা হয় না, সেহেতু তাদের হত্যাকারীদেরও পুরোপুরি দায়ী করা হয় না।
এর মানসিক চাপও ভয়াবহ। আমরা শুধু শোক করি না; আমাদের শোকের স্বীকৃতির জন্যও লড়তে হয়। আমরা শুধু আমাদের মৃত ব্যক্তিদের দাফন করি না; তাঁদের মৃত্যু স্বীকার করানোর জন্যও সংগ্রাম করি। আমরা এমন এক মানসিক চাপে বাস করি, যা কোনো সম্প্রদায়ের সহ্য করা উচিত নয়। আমাদের প্রতিনিয়ত প্রমাণ করতে হয় যে আমরা তা নই, যা বিশ্ব আমাদের ভেবে নিয়েছে।
এই ১৫ জন চিকিৎসাকর্মী ও উদ্ধারকর্মী ছিলেন সত্যিকারের নায়ক। তাঁরা বিপদের দিকে ছুটে গিয়েছিলেন। তাঁরা তাঁদের জনগণের সেবা করেছিলেন। তাঁরা জীবনের পবিত্রতায় বিশ্বাস করতেন। তাঁদের স্মৃতি সম্মানের যোগ্য। অথচ তাঁদের গল্পও একটি বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্বকে এখনই ফিলিস্তিনিদের প্রমাণ করতে বাধ্য করা বন্ধ করতে হবে যে তাঁরা মানুষ। আমরা মিথ্যা বলি আর আমাদের হত্যাকারীরা সত্য বলে—এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ফিলিস্তিনিদের মধ্যে যাঁরা শুধু ফেরেশতা, শুধু তাঁদের জন্য শোক প্রকাশ করা যাবে, এই ভাষ্যকে আর প্রচার করতে দেওয়া যাবে না।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া
ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
আহমেদ নাজার একজন ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নাট্যকার।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আম দ র দ র জন র জন য ব স কর এর ম ন প রথম ত রপর
এছাড়াও পড়ুন:
ছিনতাইকারী টান দেয় ভ্যানিটি ব্যাগ, নারীকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় প্রাইভেটকার
রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীতে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক নারী। তার হাতে ভ্যানিটি ব্যাগ এবং পাশেই ছিল একটি ট্রলি ব্যাগ। হঠাৎ সাদা রঙের একটি প্রাইভেটকার তার সামনে আসে এবং চলন্ত অবস্থায় জানালা দিয়ে ভ্যানিটি ব্যাগটি নেওয়ার চেষ্টা করে। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে পড়ে যান ওই নারী। ব্যাগের সঙ্গে তাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকে চলন্ত প্রাইভেটকারে থাকা ছিনতাইকারীরা।
রবিবার (২৭ এপ্রিল) সকাল থেকে এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শনিবার সকালে রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীর গ্রিনল্যান্ড টাওয়ারের সামনে ঘটনাটি ঘটে। এ ঘটনায় ওই নারী প্রাণে বেঁচে ফিরলেও গুরুতর আঘাত পেয়েছেন।
ভিডিওটিতে দেখা গেছে, গাড়িটি ওই নারীর সামনে আসার পরপরই ভেতর থেকে একজন ব্যাগটি টান দেয়। মুহূর্তের মধ্যেই ওই নারীকে গাড়িটির সঙ্গে টেনে নিয়ে যেতে দেখা যায়। এ সময় ট্রলি ব্যাগটি ঘটনাস্থলে থেকে যায়। পরে আশপাশে থাকা তিন ব্যক্তিকে দৌড়ে ঘটনাস্থলে আসতে দেখা যায়।
আরো পড়ুন:
গণমাধ্যমে নারীর নেতিবাচক উপস্থাপন বন্ধের সুপারিশ
প্রথমবার সরকারপ্রধানের রাষ্ট্রীয় সফরসঙ্গী হচ্ছেন নারী ক্রীড়াবিদরা
এর মধ্যে একজন ট্রলি ব্যাগটির সামনে দাঁড়ান। বাকি দুজন ওই নারীর দিকে এগিয়ে যান। ৫০ সেকেন্ডের মাথায় ওই নারীকে আবার ঘটনাস্থলে এসে দাঁড়িয়ে উপস্থিত চার ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়। এ সময় ভুক্তভোগী নারী অন্যদেরকে হাতের কনুইয়ে আঘাতের চিহ্ন দেখাচ্ছিলেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা অঞ্চলের সহকারী কমিশনার (এসি) মো. আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, “সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সিদ্ধেশ্বরীর এ ঘটনার একটি ভিডিও ফুটেজ নজরে এসেছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। এ ঘটনায় এখনো কোনো মামলা হয়নি। তবে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।”
ঢাকা/এমআর/এসবি