পণ্য রপ্তানিতে বাড়তি শুল্ক থেকে রেহাই পেতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বড় আকারে আমদানি বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া তরল প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি আমদানিতে কয়েক বছর মেয়াদে চুক্তি করতে চেয়েছে। প্রধান প্রধান পণ্যে শুল্ক অর্ধেক করারও অঙ্গীকার দেওয়া হয়েছে। এসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্ক তিন মাস স্থগিতের জন্য প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অনুরোধ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। অন্যদিকে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধিকে আমদানি বাড়ানোর পাশাপাশি শুল্ক কমানো, অশুল্ক বাধা পুরোপুরি দূর করাসহ বিভিন্ন উপায়ে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোক্তাদের গাড়ি নির্মাণ কারখানা স্থাপনের প্রস্তাবও দিয়েছেন।  

গতকাল সোমবার প্রধান উপদেষ্টা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চিঠি দিয়েছেন বলে তাঁর প্রেস উইং নিশ্চিত করেছে। চিঠিতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে ট্রাম্প ঘোষিত এজেন্ডাকে সম্পূর্ণভাবে সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা জানিয়েছেন, পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে বাংলাদেশ এ বিষয়ে সব কার্যক্রম শেষ করবে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর দেশের সঙ্গে বহির্বিশ্বের বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে গত ২ এপ্রিল নির্বাহী আদেশে বিভিন্ন দেশের ওপর নতুন শুল্ক আরোপ করেন। ট্রাম্পের আদেশ অনুযায়ী ৯ এপ্রিল থেকে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যেসব পণ্য ঢুকবে, তার ওপর বিদ্যমান শুল্কহারের সঙ্গে অতিরিক্ত ৩৭ শতাংশ যোগ হবে। বাংলাদেশের পণ্যের প্রায় ৯০ ভাগ তৈরি পোশাক, যেখানে আগে থেকে ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ শুল্ক রয়েছে। এতে করে মোট শুল্ক দাঁড়াবে ৫০ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের মধ্যে এ নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা বিমসটেক সম্মেলন থেকে ফিরে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে জরুরি বৈঠকের পর ট্রাম্পকে চিঠি দিলেন।

বাংলাদেশ গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে ৮৪০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। আর সে দেশ থেকে আমদানি করে ২২০ কোটি ডলারের পণ্য। বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ৬২০ কোটি ডলার। ট্রাম্পের মূল লক্ষ্য বাণিজ্য ঘাটতি থেকে বাণিজ্য উদ্বৃত্তে যাওয়া। বাণিজ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে গেলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি ব্যাপকভাবে বাড়াতে হবে। বাংলাদেশ সেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। 
প্রধান উপদেষ্টা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বলেছেন, ‘আপনার অভিষেকের পরপরই আমি আমার হাই রিপ্রেজেন্টেটিভকে পাঠিয়ে ১৭ কোটি মানুষের দ্রুত বর্ধনশীল বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানোর আগ্রহ দেখিয়েছি। আমরাই এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণকারী প্রথম দেশ। আমরাই প্রথম দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের এলএনজি আমদানিতে কয়েক বছরের চুক্তিতে সই করতে যাচ্ছি। আপনি এলএনজি রপ্তানির ওপর স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের পর থেকেই বাংলাদেশ এ বিষয়ে সহযোগিতা সম্প্রসারণে কাজ করছে।’

অধ্যাপক ইউনূস চিঠিতে উল্লেখ করেন, “আমাদের কার্যক্রমের প্রধান বিষয় হবে কৃষিপণ্য বিশেষ করে তুলা, গম, ভুট্টা ও সয়াবিন আমদানি উল্লেখযোগ্য অঙ্কে বাড়ানো; যা যুক্তরাষ্ট্রের কৃষকদের আয় ও জীবিকার ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। যুক্তরাষ্ট্রের তুলা আমদানি বাড়ানোর গতি বাড়াতে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা পণ্য রাখতে একটি আলাদা ‘বন্ডেড ওয়্যারহাউস’ চালুর কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।” অধ্যাপক ইউনূসের চিঠিতে জানানো হয়েছে, বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনকে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) সঙ্গে বিস্তারিত কার্যক্রম জানানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। 
চিঠিতে জানানো হয়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ পণ্যে শুল্ক সর্বনিম্ন। তুলা, গম, ভুট্টা ও সয়াবিনে এবং লোহার স্ক্র্যাপেও বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত সুবিধা অব্যাহত রাখতে চায়। এ ছাড়া গ্যাস টারবাইন, সেমিকন্ডাক্টর এবং মেডিকেল ইকুইপমেন্টসহ প্রধান প্রধান পণ্যে শুল্ক ৫০ শতাংশ কমানোর জন্য কাজ করছে। এ ছাড়া অশুল্ক বাধা দূর করা হবে। নির্দিষ্ট কিছু পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা, প্যাকেজিং যৌক্তিকীকরণ, লেবেলিং এবং সনদের প্রয়োজনীয়তা তুলে দেওয়া হচ্ছে এবং কাস্টমস প্রক্রিয়া সহজ করা হচ্ছে। 

চিঠিতে আরও জানানো হয়, বাংলাদেশ ইতোমধ্যে দেশে মার্কিন ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান স্টারলিংক চালুর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে। এর ফলে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও প্রতিরক্ষা খাতসহ বিভিন্ন উচ্চ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যের নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। চিঠির শেষে বলা হয়েছে, পরবর্তী তিন মাসের মধ্যেই চলমান এবং পরিকল্পিত সব কার্যক্রম শেষ হবে। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে গুরুত্বপূর্ণ এসব কাজ শেষ করতে এজন্য প্রয়োজনীয় সময় দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে। 

বাণিজ্য উপদেষ্টার চিঠিতে যা আছে 
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি (ইউএসটিআর) অ্যাম্বাসাডর জামিসন গ্রিয়ারকে লেখা চিঠিতে বলেছেন, বাংলাদেশ সরকার শুল্ক কমানো এবং সব ধরনের অশুল্ক বাধা দূর করার উপায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। এ ছাড়া সরকার দুই দেশের জন্য সহায়ক সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে আমদানি নীতি সংশোধন, কাস্টমস প্রক্রিয়া সহজ করা, মেধা সম্পদ অধিকার কার্যকর করা ইত্যাদি। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের এলএনজি সরবরাহকারীদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি এবং সে দেশের গাড়ি নির্মাতাদের এ খাতে কারখানা স্থাপনের সুযোগ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। স্বাস্থ্য ও অন্যান্য সেবা খাতেও যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ পেতে আগ্রহী বাংলাদেশ। 
বাণিজ্য উপদেষ্টা চিঠিতে আরও বলেন, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে গড় শুল্ক ৬ শতাংশ। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের তুলার অন্যতম বৃহৎ আমদানিকারক। তবে বাংলাদেশের পণ্যে যুক্তরাষ্ট্র আগে থেকেই উচ্চ শুল্ক আরোপ করে রেখেছে। নতুন শুল্ক আরোপের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের যে কোনো বাণিজ্য বাধা দূর করতে আলোচনা ও সংলাপে আগ্রহী। 

বাণিজ্য উপদেষ্টা গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, বাণিজ্য সহায়ক বিভিন্ন ধরনের অশুল্ক বাধা তুলে দেওয়া হচ্ছে। মোট বাণিজ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশই হয় তুলা, সয়াবিন, লোহার স্ক্র্যাপ এবং জ্বালানি তেল– এই চার পণ্যে। এর বাইরে আর কী কী পণ্যে বাধা দূর করলে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বাড়বে, তা নির্ণয় করার চেষ্টা করা হচ্ছে। 

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে ১৯০টি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়া হয়। আগামীতে এটি আরও কতটুকু বাড়ানো যায় সে বিষয়টি দেখা হচ্ছে। যেহেতু বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণ করছে, তাই স্বাভাবিকভাবেই এ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। তাই অনেক পণ্যের শুল্ক সহজ হবে। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো চিঠিতে তিনি বলেছেন, আরও ১০০ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনাধীন। 
এলএনজি আমদানির চিত্র

২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশে এলএনজি আমদানি শুরু হয়। সমুদ্রে ভাসমান এলএনজি দুই টার্মিনালের (এফএসআরইউ) মাধ্যমে বছরে ১১৫টি এলএনজি কার্গো হ্যান্ডলিং করার সক্ষমতা রয়েছে বাংলাদেশের। এর মধ্যে ৫৬টি কার্গো আসছে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায়। কাতার থেকে আসে ৪০টি এবং ওমান থেকে ১৬টি। খোলা বাজার থেকে ২৪টি কার্গো আমদানি করা হয়। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত এলএনজি আমদানি করা হয়েছে ৪৫৪ কার্গো।  দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় কাতার থেকে ২৫৪ কার্গো, ওকিউ ট্রেডিং লিমিটেড ওমান থেকে ১১৮ কার্গো এবং স্পট মার্কেট থেকে ৮২ কার্গো আমদানি করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (ইআইএ) প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৯ সাল থেকে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের এলএনজি কিনছে। ওই বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ প্রথম ৩ হাজার ৪১৯ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। পরের বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে এলএনজি আমদানির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১০ হাজার ৬৬০ মিলিয়ন ঘনফুটে। ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা হয় ৩৭ হাজার ৭৩৫ মিলিয়ন ঘনফুট। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর ২০২২ সালে বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম রেকর্ড পরিমাণ বাড়ে। ফলে বিশ্বের খোলা বাজার থেকে এলএনজি আমদানি কমিয়ে দেয় বাংলাদেশ। যে কারণে ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এলএনজি আমদানির পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ১২ হাজার ৬৬৩ মিলিয়ন ঘনফুট। এর পরের দুই বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে এলএনজি আমদানি আবার বেড়েছে। ২০২৩ সালে বিশ্ববাজারে আবারও এলএনজির দাম কমতে শুরু করলে স্পট মার্কেট থেকে কেনা বাড়ায় বাংলাদেশ। ওই বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে মোট ২৪ হাজার ১৪৬ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আসে দেশে।
ইআইএর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ২৬ হাজার ১১০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আনা হয় যুক্তরাষ্ট্র থে‌কে। ২০১৮-১৯ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত ছয় বছরে মোট ৫৭ দশমিক ৮২ মিলিয়ন ঘনমিটার এলএনজি আমদানি করা হয়। এতে ব্যয় হয়েছে মোট ১ লাখ ৬৪ হাজার ২৭৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এ ছয় বছরে ২৬ হাজার ২১৫ কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে এ খাতে। বাকি ১ লাখ ৩৮ হাজার ৬০ কোটি টাকা ব্যয় মেটানো হয়েছে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে।

 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আমদ ন শ ল কম ক ত স ব ধ ব ণ জ য উপদ ষ ট র এলএনজ পর ম ণ র জন য দ র কর আমদ ন

এছাড়াও পড়ুন:

বিদ্যুৎ খাতে সরবরাহ বাড়ায় শিল্পে গ্যাস–সংকট 

গ্রীষ্ম মৌসুমে বিদ্যুৎ চাহিদা সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকে। চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা না গেলে লোডশেডিং দিতে হয়। এবার লোডশেডিং সীমিত রাখার চেষ্টা করছে সরকার। তাই বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত রাখতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে। এই উৎপাদন ধরে রাখতে বিদ্যুৎ খাতে বাড়ানো হয়েছে গ্যাস সরবরাহ। কমানো হয়েছে শিল্প ও আবাসিক খাতের সরবরাহ।

বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) সূত্র বলছে, দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ পেলে মোটামুটি চাহিদা মেটানো যায়। রেশনিং করে (এক খাতে কমিয়ে, আরেক খাতে বাড়ানো) পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়। এখন সরবরাহ হচ্ছে ২৭০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে ১০৫ কোটি ঘনফুট যাচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয়। বিদ্যুৎ খাত এখন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাচ্ছে। তাই আবাসিক ও শিল্প গ্রাহকের গ্যাস–সংকট বেড়েছে।

বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে। এতে কিছুটা ঘাটতি তৈরি হয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যে দেশীয় গ্যাস উৎপাদন কিছুটা বাড়তে পারে। আর এলএনজি আমদানিও বাড়ানোর চিন্তা করা হচ্ছে।পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) মো. রফিকুল ইসলাম

বৃহত্তম গ্যাস বিতরণ সংস্থা তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন ঢাকা, গাজীপুর, ময়মনসিংহ ও নারায়ণগঞ্জ এলাকায় গ্যাস সরবরাহ করে। এ কোম্পানির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁদের দিনে চাহিদা ১৯০ কোটি ঘনফুট। এখন সরবরাহ পাচ্ছেন ১৫২ থেকে ১৫৩ কোটি ঘনফুট। এমন সরবরাহের সময় তাঁরা বিদ্যুৎ খাতে সর্বোচ্চ ২৩ কোটি ঘনফুট দিতে পারতেন। এখন দিতে হচ্ছে ৩৬ থেকে ৩৭ কোটি ঘনফুট। এতে শিল্প ও আবাসিক খাতে ১৩ থেকে ১৪ কোটি ঘনফুটের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। স্বাভাবিক সময়েও শিল্পে গ্যাসের ঘাটতি থাকে। এখন এটি আরও বেড়েছে।

পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) মো. রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে। এতে কিছুটা ঘাটতি তৈরি হয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যে দেশীয় গ্যাস উৎপাদন কিছুটা বাড়তে পারে। আর এলএনজি আমদানিও বাড়ানোর চিন্তা করা হচ্ছে।

দেশে একসময় দিনে ২৭০ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হতো। ২০১৮ সালে উৎপাদন কমতে থাকলে এলএনজি আমদানি শুরু হয়। উৎপাদন কমে এখন ১৮৪ কোটি ঘনফুটে নেমে এসেছে। আগের চেয়ে এলএনজি আমদানি বাড়ানো হলেও তা পর্যাপ্ত নয়। আমদানি করা এলএনজি থেকে দিনে সরবরাহ করা হচ্ছে ৮০ থেকে ৮৫ কোটি ঘনফুট।

পেট্রোবাংলার একজন কর্মকর্তা বলেন, প্রতি ইউনিট গ্যাস বিক্রি করে পেট্রোবাংলা পায় ২২ টাকা ৮৭ পয়সা। তাদের এখন খরচ হচ্ছে গড়ে ২৭ টাকার বেশি। যদিও শিল্পে প্রতি ইউনিট গ্যাস বিক্রি হয় ৩০ টাকায়। কিন্তু বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের দাম ১৪ টাকা ৭৫ পয়সা। শিল্প গ্রাহকেরা বাড়তি দাম দিলেও গ্যাস সরবরাহে বিদ্যুৎ খাতকে অগ্রাধিকার দিতে হচ্ছে। চাহিদামতো সরবরাহ করতে হলে আরও দুই কার্গো এলএনজি জাহাজ বাড়তি আমদানি করতে হবে। এতে পেট্রোবাংলার লোকসান বাড়বে। কিন্তু পিডিবি যদি ২৭ টাকা করে দাম দেয়, তাহলে আরও কার্গো আনা যাবে।

ঢাকার পাশের দুই জেলা নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর মূলত শিল্প এলাকা হিসেবে পরিচিত। রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকের অধিকাংশ কারখানা এখানে। গ্যাসের অভাবে দীর্ঘদিন ধরে কারখানাগুলোতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। দুই সপ্তাহ ধরে গ্যাস–সংকট আরও বেড়েছে। গাজীপুর তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপক (সঞ্চালন ও বিতরণ) মো. রেদওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, গাজীপুরে গ্যাসের চাহিদা এখন ৬০ কোটি ঘনফুট, পাওয়া যাচ্ছে ৩৫ কোটি ঘনফুট।

দেশে একসময় দিনে ২৭০ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হতো। ২০১৮ সালে উৎপাদন কমতে থাকলে এলএনজি আমদানি শুরু হয়। উৎপাদন কমে এখন ১৮৪ কোটি ঘনফুটে নেমে এসেছে। আগের চেয়ে এলএনজি আমদানি বাড়ানো হলেও তা পর্যাপ্ত নয়।

শিল্প পুলিশের তথ্যমতে, গাজীপুর জেলায় মোট কারখানার সংখ্যা ২ হাজার ১৭৬। এর মধ্যে পোশাক কারখানা রয়েছে ১ হাজার ১৮৭টি। লাইসেন্সবিহীন কারখানাসহ সব মিলিয়ে পাঁচ হাজারের মতো ছোট-বড় কারখানা রয়েছে। বেশির ভাগই গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল।

গাজীপুরের মৌচাক এলাকার সাদমা গ্রুপের পরিচালক সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, কারখানা চালাতে গ্যাসের চাপ ১০ থেকে ১৫ পিএসআই (প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে চাপ) থাকতে হয়। ১৫ দিন ধরে ২ থেকে ৩ পিএসআইয়ের বেশি গ্যাসের চাপ পাওয়া যায়নি। এতে আমাদের উৎপাদন ৩০ থেকে ৪০ ভাগ কমে গেছে।

তিতাস গ্যাস নারায়ণগঞ্জ অফিসের উপমহাব্যবস্থাপক মামুনার রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, সরবরাহ কম থাকায় অনেক জায়গায় শিল্প ও আবাসিক গ্রাহক গ্যাস কম পাচ্ছেন।

জ্বালানি সরবরাহে ঘাটতি ব্যবস্থাপনা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক বিবেচনায় রাখতে হয়। গ্যাস সরবরাহে ভারসাম্য আনতে গিয়ে বেশি হারে এলএনজি আমদানির দিকে যাওয়া যাবে না। দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে জোর দিতে হবে। সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার বিসিক শিল্পনগরীতে এম এস ডাইং প্রিন্টিং অ্যান্ড ফিনিশিং লিমিটেডের উৎপাদন ক্ষমতা ৪০ টন। উৎপাদন নেমেছে ১০ টনে। গ্যাসের চাপস্বল্পতার কারণে ব্যবসায়িক ক্ষতির বিষয়টি জানিয়ে ২৩ এপ্রিল তিতাসকে চিঠি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। গতকাল রোববার দুপুরে প্রতিষ্ঠানটিতে গিয়ে দেখা যায়, বয়লার মেশিন বন্ধ, গ্যাসের চাপ শূন্য পিএসআই। বিসিকের অপর প্রতিষ্ঠান ফেয়ার অ্যাপারেলস লিমিটেডে সকাল থেকে উৎপাদন বন্ধ। শ্রমিকেরা বসে অলস সময় কাটাচ্ছেন।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, জ্বালানি সরবরাহে ঘাটতি ব্যবস্থাপনা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক বিবেচনায় রাখতে হয়। গ্যাস সরবরাহে ভারসাম্য আনতে গিয়ে বেশি হারে এলএনজি আমদানির দিকে যাওয়া যাবে না। দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে জোর দিতে হবে। 

[তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রতিনিধি, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ]

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বিদ্যুৎ খাতে সরবরাহ বাড়ায় শিল্পে গ্যাস–সংকট 
  • লোডশেডিং হবে শহরেও, সহনীয় মাত্রায় রাখার চেষ্টা চলছে: বিদ্যুৎ উপদেষ্টা
  • লোডশেডিং সীমিত রাখার চেষ্টা করা হবে: জ্বালানি উপদেষ্টা
  • লোডশেডিং সহনীয় মাত্রায় থাকবে: বিদ্যুৎ উপদেষ্টা