বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বাংলাদেশ কী করছে, তা নয় বরং এ দেশে বিনিয়োগ করতে বিদেশিরা কী চান– তা জেনে সহযোগিতার বার্তা দিতে বিনিয়োগ সম্মেলন শুরু হয়েছে। বদলে যাওয়া বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়াতে এর আয়োজক বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। 

শুধু পাঁচতারকা হোটেলের সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সম্মেলনে অংশ নিতে আসা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিশেষ বিমান ফ্লাইটে সম্মেলনের প্রথম দিনই চট্টগ্রামের কোরিয়ান ইপিজেড এবং মিরসরাই জাতীয় ইকোনমিক জোন পরিদর্শনে নিয়ে যায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ-বেজা। বিনিয়োগকারীদের এ দলে যুক্তরাষ্ট্র, কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডস, চীন, ভারতসহ প্রায় ৫০টি দেশের  পাশাপাশি দেশীয় বিনিয়োগকারীরাও অংশ নিচ্ছেন। 

দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে জমির মালিকানা নিয়ে জটিলতা কোরিয়ান ইপিজেডের উদ্যোক্তাদের সমস্যা অন্তর্বর্তী সরকার মাত্র দুই মাসে কীভাবে সমাধান করেছে, সেই  গল্প কোরিয়ান উদ্যোক্তার মুখ থেকেই শুনলেন তারা। মিরসরাই ইকোনমিক জোনে গিয়ে তারা দেখেছেন, সরকার কী ধরনের সুযোগ-সুবিধা এরই মধ্যে করে রেখেছে। 
সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে আজ মঙ্গলবার নারায়ণগঞ্জে জাপান স্পেশাল ইকোনমিক জোন (এসইজেড) পরিদর্শনে যাবেন এই বিদেশিরা। সেখানে জাপানিদের কাছ থেকেই বাংলাদেশে বিনিয়োগ অভিজ্ঞতার কথা শুনবেন তারা।
বড় অঙ্কের বিনিয়োগে আগ্রহী বিদেশিরা যখন ঢাকার বাইরে সরেজমিন অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিদর্শনে, তখন ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে দেশি-বিদেশি তরুণ স্টার্টআপ উদ্যোক্তারা সম্মেলন করে তাদের চাহিদা জানিয়েছেন, খুঁজেছেন সমাধানের পথ। দিনব্যাপী আয়োজনে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা, সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ  সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা অংশ নিয়েছিলেন।

প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা ইতিবাচক
প্রথম দিনে সকালে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় কেইপিজেড ঘুরে দেখেছেন প্রায় ৬০ জন বিদেশি। বিকেলে তারা চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে জাতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘুরে দেখেন। 
পরিদর্শন শেষে বিনিয়োগকারীদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন কেইপিজেড ও ইয়ংওয়ান করপোরেশনের চেয়ারম্যান কিহাক সাং। তিনি বলেন, এখানে জমি ও অন্যান্য অবকাঠামো প্রস্তুত। বিনিয়োগে কোনো ঝামেলা নেই। 

ব্যবসায়িক সনদসহ যাবতীয় বিনিয়োগ সেবা পাওয়া যাবে দ্রুত। বিনিয়োগবান্ধব অনেক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে এই ইজেডে। তিনি বলেন, ব্যবসায়িক সনদ নেওয়ার ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা অনেক কমেছে। বিগত সরকারের সময়ে বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে অনেক কথা বললেও বাস্তবে উদ্যোগ ছিল কম। বর্তমান সরকার নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। দ্রুততম সময়ে ব্যবসায়িক সনদসহ সব সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে।
চীনের বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মেগা রিচ ইন্ডাস্ট্রিয়াল লিমিটেডের ম্যানেজিং পার্টনার কেভিন উ সমকালকে বলেন, নতুন  সরকার বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করার উদ্যোগ নিচ্ছে। চীনের বিনিয়োগকারীদের অনেক বিনিয়োগ আছে বাংলাদেশে। আরও অনেকেই বিনিয়োগ করতে চান। তবে  সম্মেলনে কী সুবিধা ঘোষণা করবে বাংলাদেশ– সেটিও দেখার অপেক্ষায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা।
ভারতের হায়দরাবাদের  কাপিতি ওভারসিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুরেস কাপিতি বলেন, বাংলাদেশে কমপ্লায়েন্ট ব্যাটারি রিসাইক্লিং প্ল্যান্টের জন্য অংশীদার ব্যবসায়ী খুঁজতে তিনি এসেছেন। নেদারল্যান্ডস থেকে আসা এক বিনিয়োগকারী জানিয়েছেন, তাঁর কৃষি খাতে ব্যবসা রয়েছে। উপযুক্ত ব্যবসায়িক পরিবেশ ও প্রয়োজনীয় সেবা নিশ্চিত হলে তাঁর প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ আছে।
কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এখানে বিভিন্ন কারখানায় ৩০ হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে, যাদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ নারীকর্মী। এই ইজেডে ইতোমধ্যে ৭০ কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ করা হয়েছে। বিশেষ করে টেক্সটাইল, গার্মেন্ট, গার্মেন্ট অ্যাক্সেসরিজ পণ্য, জুতা এবং আইটি পরিষেবা খাতে। অর্থনৈতিক অঞ্চলটি চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কর্ণফুলী টানেল হয়ে ১৫ মিনিটের দূরত্বে আনোয়ারায় কর্ণফুলী নদীর তীরে অবস্থিত। ২ হাজার ৪৯২ একর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই পরিবেশবান্ধব এলাকা দেশের একমাত্র বেসরকারি মালিকানাধীন রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল।
বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সরেজমিন চট্টগ্রামের মিরসরাই জাতীয় অর্থনৈতিক জোন পরিদর্শন শেষে প্রকল্প পরিচালক মাহমুদ ফারুক বলেন, এই অর্থনৈতিক জোনে বিনিয়োগকারীদের সব ধরনের ইউটিলিটির সুযোগ রাখা হয়েছে। শিল্পের জন্য পানির কোনো সমস্যা হবে না। ফেনীর মহুরী ও মেঘনা নদী থেকে সরবরাহ করে পানির সমস্যা সমাধান করা হবে।
বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে বিভিন্ন দেশ ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে। তাই এখানে কী সুবিধা পাওয়া যাবে, কী সমস্যা আছে– তা সরাসরি দেখাতে আপনাদের আনা হয়েছে। আমলাতান্ত্রিক কোনো জটিলতায় যেন পড়তে না হয়, সে জন্য সরাসরি ইজেড দেখানো হয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টার উপপ্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বলেন, এর আগেও বাংলাদেশে বিনিয়োগ সম্মেলনে হয়েছে। তবে পাঁচতারকা হোটেলে অনুষ্ঠিত হওয়া সেসব সম্মেলন সেমিনার এবং প্রেজেন্টেশন দিয়েই শেষ করা হয়েছে। এবারই প্রথম বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সরাসরি ইজেড দেখানো হয়েছে। এতে বিনিয়োগ করলে কী সুবিধা পাবেন, কী অসুবিধা হবে– তা তারা বুঝতে পেরেছেন।
বেজা জানিয়েছে, এনএসইজেড দেশের অন্যতম উচ্চাকাঙ্ক্ষী উন্নয়ন উদ্যোগ। এটি দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরের তীরে কৌশলগতভাবে অবস্থিত, যেখানে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, চট্টগ্রাম বন্দর ও বিমানবন্দরের মতো পরিবহন রুট রয়েছে। চট্টগ্রামের মিরসরাই ও সীতাকুণ্ড এবং ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলার নিয়ে ৩৩ হাজার ৮০০ একর নিয়ে গঠিত এই অর্থনৈতিক অঞ্চল। ইতোমধ্যে এখানে ১১টি কারখানা উৎপাদন শুরু করেছে এবং ২৮টি শিল্প নির্মাণাধীন রয়েছে। এখন পর্যন্ত এখানে প্রায় ১৯ বিলিয়ন ডলার মূল্যের স্থানীয় এবং বিদেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব আকর্ষণ করেছে। এ পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছে প্রায় ১৫৫ প্রতিষ্ঠান। ভবিষ্যতে ৫০০টি শিল্প স্থাপনের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।

প্রথা ভাঙতে চান বিডা চেয়ারম্যান
বিদেশি বিনিয়োগকারীরাই বাংলাদেশের শুভেচ্ছা দূত হবেন। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্টে বিডা কোন নীতিতে কাজ করছে– তা জানাতে গিয়ে এমনটাই বললেন সংস্থাটির নির্বাহী চেয়ারম্যান  আশিক মাহমুদ বিন হারুন। গতকাল বিনিয়োগ সম্মেলনের প্রথম দিনে রাজধানীর হোটেলে মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এ কথা বলেন তিনি।
তিনি বলেন, বিদেশিদের এ দেশে বিনিয়োগে এমন ‘কমফোর্ট’ দিতে চাই, যা দেখে তারাই অন্য বিদেশিদের কাছে বাংলাদেশের বিনিয়োগ দূত হিসেবে কাজ করবেন। কোরিয়ান ইপিজেডের দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময়ের জমিসংক্রান্ত জটিলতার সমাধান মাত্র দুই মাসে করে দেওয়ায় এই ইপিজেডের উদ্যোক্তা নিজে উদ্যোগী হয়ে ৩১ জন কোরিয়ান বিনিয়োগকারীকে এবারের বিনিয়োগ সম্মেলনে এনেছেন বলে জানান তিনি।

বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, ব্যবসা করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এখনও সমস্যা আছে। বিশেষ করে নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য ট্রেড লাইসেন্স পাওয়াসহ সরকারি লালফিতার দৌরাত্ম্য বেশি। প্রতিবছর ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করতে গিয়ে সিটি করপোরেশন অফিসে দৌড়াতে হয়। এমন অনেক সমস্যা আছে। এসব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি।
আশিক মাহমুদ বলেন, আমরা কী করছি, তা বড় কথা নয়, বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে কী চান, কী সমস্যায় পড়ছেন– তা শুনতে চাই। আগত অতিথিরা সরেজমিন দেখছেন, সেখানে তাদের জন্য কী কী সুযোগ-সুবিধা আছে। বাংলাদেশে এরই মধ্যে যেসব বিদেশি বিনিয়োগ করেছেন, তাদের মুখ থেকে এ দেশে তাদের বিনিয়োগ অভিজ্ঞতা ও সমস্যার কথা শুনেছেন। 

 


 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব ন য় গ করত ব ন য় গ কর প রথম দ ন ব যবস য় ক ম রসর ই র জন য সমস য সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

সাকিব–বুবলী–পিয়াসহ তারকাদের অনলাইন জুয়ার প্রচারণা

দেশের অন্যতম শোবিজ তারকা ও মডেল পিয়া জান্নাতুল। তিনি আইন পেশায়ও আছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি বেশ জনপ্রিয়। ফেসবুকে তাঁর অনুসারীসংখ্যা ১৭ লাখ। ইনস্টাগ্রামে ১১ লাখ।

পিয়া নিজের মডেলিং জীবনের পাশাপাশি নানা সময় সামাজিক ও আইনি পরামর্শমূলক পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেন। তবে চলতি বছর তাঁকে অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপনের প্রচারণা চালাতে দেখা গেছে। গত ১ জানুয়ারি থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি ১২টি অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপনের প্রচারণা চালিয়েছেন নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে।

শুধু পিয়া নন, চিত্রনায়িকা শবনম বুবলী, অভিনয়শিল্পী সামিরা খান মাহিও অনলাইন জুয়ার প্রচারণা চালিয়েছেন। দেশের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানও আছেন এই তালিকায়।

বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় টি-টোয়েন্টি লিগ আইপিএলের (ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ) নতুন মৌসুম শুরু হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের এই টুর্নামেন্ট চলবে দুই মাসব্যাপী। আইপিএলের এবারের আসরে বাংলাদেশের কোনো ক্রিকেটার নেই। তবে আইপিএলের নিয়ে অনলাইন জুয়ার প্রচারণা সমানে চলছে বাংলাদেশে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে অনলাইন জুয়া বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি গবেষণায় উঠে এসেছে। বিশেষ করে ক্রিকেটের আসর আইপিএল ও বিপিএল (বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ) চলাকালে তা আরও বেড়ে যায়।

গত ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারির বিপিএলের পাশাপাশি চলমান আইপিএলের সময় একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, গুগলে বাংলাদেশে অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপন চলছে অবাধে। বাংলাদেশের শীর্ষ তারকারা অর্থের বিনিময়ে এসব বিজ্ঞাপনের প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন।

বিষয়টি নিয়ে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব প্রথম আলোকে বলেন, প্রস্তাবিত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে সাইবার স্পেসের (পরিসর) জুয়াকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। চলতি সপ্তাহে যদি অধ্যাদেশটি উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন পায়, তাহলে এই অপরাধে জড়িত ব্যক্তিরা আইনের আওতায় আসবেন।

তারকারা ধরাছোঁয়ার বাইরে

জুয়া খেলা ও প্রচারণার অভিযোগে বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যবস্থা নেওয়ার খবর সামনে এসেছে। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিন ইউটিউবারকে জুয়ার প্রচারণার অভিযোগে পুলিশ স্বপ্রণোদিত হয়ে মামলা করে গ্রেপ্তার করেছিল। তবে জুয়ার প্রচারণার চালিয়েও দেশের শীর্ষ তারকারা সব সময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কোনো সংস্থাকে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।

মডেল পিয়া বিপিএলের গত আসরে অনলাইন জুয়ার প্রচারণা চালিয়েছেন। এ ছাড়া আইপিএলের চলমান আসরে তিনি অনলাইন জুয়ার প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

পিয়ার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ ঘেঁটে দেখা যায়, তিনি চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ‘বাবু ৮৮’ ও ‘ভাগ্য’ নামের দুটি অনলাইন জুয়ার প্রতিষ্ঠানের ১২টি প্রচারণা চালিয়েছেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পিয়া কোনো কথা বলবেন না বলে প্রথম আলোকে জানান।

চিত্রনায়িকা শবনম বুবলী নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে চলতি বছর ‘মেগা ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড’ নামের একটি জুয়ার প্রতিষ্ঠানের ৩টি বিজ্ঞাপন প্রচার করেছেন। এ ব্যাপারে জানতে বুবলীকে তাঁর মুঠোফোন নম্বরে কল করে ও খুদেবার্তা পাঠিয়ে সাড়া পাওয়া যায়নি।

অভিনয়শিল্পী সামিরা খান মাহি নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে চলতি বছর ‘বাবু ৮৮’ নামের জুয়ার ২টি প্রচারণা চালিয়েছেন। এ বিষয়ে তাঁর কাছে জানতে চেয়ে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

এ ছাড়া অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়া, অপু বিশ্বাস, মাহিয়া মাহিসহ দেশের শীর্ষ অনেক তারকা বিভিন্ন সময় অনলাইন জুয়ার প্রচারণা চালিয়েছেন।

ক্রিকেট ঘিরে অনলাইন জুয়ার প্রচার-প্রচারণায় ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের নাম একাধিকবার এসেছে। ১ কোটি ৬০ লাখ অনুসারী থাকা নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে গত ২২ মার্চ সাকিব ‘ওয়ানএক্সবেট’ নামের অনলাইন জুয়ার প্রচারণা চালান। এর আগে ২০২২ সালে ‘বেটউইনার’ নামের একটি অনলাইন জুয়ার প্রতিষ্ঠানের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বেটউইনার নিউজের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন তিনি।

এ ছাড়া ভারতে বেটিং অ্যাপ (অনলাইনে বাজি ধরার অ্যাপ) কেলেঙ্কারির তদন্তে সাকিবের বোন জান্নাতুল হাসানের নাম আসে। গত বছরের মার্চে ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ‘১১ উইকেটডটকম’ নামের একটি বেটিং অ্যাপে সাকিবের বোন বিনিয়োগ করেছেন।

সাকিব বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। অনলাইন জুয়ার প্রচারণা নিয়ে বক্তব্য জানার জন্য তাঁকে হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠানো হলে তিনি সাড়া দেননি।

অনলাইন জুয়ার বাজার কত টাকার

বাংলাদেশে অনলাইন জুয়ার বাজার কত টাকার, তার সঠিক হিসাব নেই। তবে দেশের কত মানুষ অনলাইন জুয়ার সঙ্গে জড়িত, তার একটি আনুমানিক হিসাব গত বছরের ২৪ জুন দিয়েছিলেন তৎকালীন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। তখন তিনি বলেছিলেন, দেশের প্রায় ৫০ লাখ মানুষ অনলাইন জুয়ার সঙ্গে জড়িত।

অন্যদিকে গত বছরের ২০ জুন ভারতের সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডেতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশটিতে অবৈধ অনলাইন বাজির বাজার বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলারের মতো অর্থ সংগ্রহ করে।

২০২৪ সালের ১৩ মে ভারতের সংবাদমাধ্যম মিন্ট প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশটির পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট ১৮৬৭ অনুযায়ী, জুয়া নিষিদ্ধ। তারপরও দেশটিতে অনলাইনে জুয়ার প্রচারণাসহ অন্যান্য কর্মকাণ্ড থেমে নেই। ভারতে জুয়ার বাজার বছরে ৩ বিলিয়ন ডলারের সমান হবে। বিশ্বে অনলাইন গেমিং বাজারে চীনের পরে রয়েছে ভারত। আইপিএল ও নির্বাচনের সময় ভারতে অনলাইন জুয়ার প্রসার ঘটে।

তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে বাংলাদেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইট লিমিটেডের (ডিআরএল) তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ ডিসমিসল্যাবের অনলাইনে জুয়ার বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা নিয়ে কয়েকটি প্রতিবেদন আছে।

আরও পড়ুনজুয়ার বিজ্ঞাপন দেখা যায়, এমন ওয়েবসাইট ব্লকের নির্দেশ১১ জুলাই ২০২৩

২০২৪ সালের এপ্রিলে ‘নীতি লঙ্ঘন: বাংলাদেশিদের লক্ষ্য করে মেটার প্ল্যাটফর্মে হাজার হাজার জুয়ার বিজ্ঞাপন’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ফেসবুকের মূল এই প্রতিষ্ঠানের (মেটা) প্ল্যাটফর্মগুলোতে বছরে জুয়ার বিজ্ঞাপনে ব্যয় আনুমানিক ১৫ কোটি টাকা। তবে প্রকৃত ব্যয় আরও বেশি হতে পারে।

অনলাইন জুয়ার উৎস সম্পর্কে ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ক্রিকেট-সংশ্লিষ্ট জুয়ার প্রতিষ্ঠানের ভারতীয় নাম দেখে সেগুলোকে সে দেশ থেকে আসা বলে মনে হয়। বিশেষ করে তাদের ক্রিকেটের অন্যতম বড় আসর আইপিএলের সময়ে অনলাইন জুয়া বেড়ে যায়। তবে জুয়ার সাইট বা অ্যাপ ভারত ছাড়া অন্য দেশেও হোস্ট করা থাকতে পারে।

শক্ত আইন ও তদারকি নেই

ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের প্রসারে অনলাইন জুয়া খেলার ধরন পাল্টে গেছে। এখন অনলাইন জুয়ার বেশির ভাগই মুঠোফোনে খেলা হয়। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও অনলাইন জুয়ার বড় বাজার গড়ে উঠছে।

বাংলাদেশে জুয়া নিষিদ্ধ। দেশে জুয়া দমনে আইন (পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট ১৮৬৭) আছে। কিন্তু আইনটি অস্পষ্ট।

আরও পড়ুনদেশে অনলাইন জুয়ার বাজার বড় হচ্ছে, নেই আইনি পদক্ষেপ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

অন্যদিকে বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কিন্তু কী ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে, তার সুস্পষ্ট উল্লেখ নেই।

ইন্টারনেট যুগের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে বিশেষ করে অনলাইন জুয়া প্রতিরোধে স্পষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। তবে ২০২৩ সালের ১১ জুলাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও টেলিভিশন, বিশেষ করে খেলার চ্যানেলসহ ডিজিটাল ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে অনলাইন বাজি ও জুয়ার বিজ্ঞাপন বন্ধে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে যেসব আর্থিক পরিষেবার মাধ্যমে বেটিং ওয়েবসাইটের অর্থ আদান-প্রদান হয়, সেগুলোর গেটওয়ে ও চ্যানেল বন্ধের নির্দেশনা দেওয়া হয়।

আরও পড়ুনদেশে জুয়া দমনে আইন থাকলেও তা অস্পষ্ট০২ অক্টোবর ২০১৯

১৮৬৭ সালের ‘পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট ১৮৬৭’ রহিত করে ‘জুয়া প্রতিরোধ আইন, ২০২৩’ প্রণয়ন উদ্যোগের অংশ হিসেবে একটি খসড়া করেছিল বিগত সরকার। এই খসড়ায় অনলাইন জুয়া নিয়ে আলাদা করে বলা আছে।

প্রস্তাবিত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে সাইবার স্পেসে জুয়া খেলা সম্পর্কে বলা হয়েছে, কেউ যদি জুয়ার কোনো পোর্টাল, অ্যাপ বা ডিভাইস তৈরি বা পরিচালনা করে, খেলায় অংশগ্রহণ করে, উৎসাহ প্রদান করে বা বিজ্ঞাপনে অংশগ্রহণ করে, তবে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এ অপরাধের জন্য ২ বছরের কারাদণ্ড বা ২০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হবে।

গুগল-ফেসবুক নিজস্ব নীতি মানছে না

ডিসমিসল্যাবের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মেটার (ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান) অনলাইন জুয়া ও গেমিং বিজ্ঞাপন নীতিমালায় বলা আছে, বিজ্ঞাপনদাতাদের এ ধরনের প্রচার-প্রচারণার আগে অবশ্যই একটি ফরম পূরণ করতে হবে। যেসব দেশ মেটার তালিকাভুক্ত, সেসব দেশকে লক্ষ্য করে বিজ্ঞাপন দেওয়া যাবে।

কিন্তু মেটার অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপনের জন্য অনুমোদিত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ নেই। ডিসমিসল্যাব বলছে, অনলাইন জুয়ার এসব বিজ্ঞাপনদাতা তাদের বিজ্ঞাপনের ধরন অস্পষ্ট করে বা মেটার শনাক্তকরণ পদ্ধতি এড়িয়ে জুয়ার প্রচারণা চালাচ্ছে।

আরও পড়ুনঅনলাইন জুয়া বন্ধে ব্যবস্থা নেবে কে?১৫ জুলাই ২০২৩

আরেক টেক জায়ান্ট গুগলও এ ক্ষেত্রে নিজস্ব নীতির তোয়াক্কা করছে না। ডিসমিসল্যাবের আরেকটি গবেষণায় এ নিয়ে বলা হয়েছে, গুগল কিছু নির্দিষ্ট দেশে জুয়ার বিজ্ঞাপন দেখানোর অনুমতি দেয়। কিন্তু বাংলাদেশ এসব দেশের তালিকায় নেই। কিন্তু এরপরও জুয়ার সাইটগুলো বাংলাদেশকে লক্ষ্য করে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে।

অনলাইন জুয়ার প্রকাশ্য প্রচারণায় তারকাদের অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে ডিজিটালি রাইট-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘জুয়া নিয়ে আইনে এখনো গ্রে এরিয়া (অস্পষ্টতা) রয়েছে। প্রস্তাবিত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ হলে জুয়ার বিষয়ে জবাবদিহি আসবে বলে আশা করা যায়।’

আরও পড়ুনঅনলাইন জুয়ার বিস্তারে টিআইবির উদ্বেগ০৯ মে ২০২৪আরও পড়ুনক্রিকেট নিয়ে অনলাইনে জুয়া, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসহ গ্রেপ্তার ৪: র‌্যাব২৪ অক্টোবর ২০২৩

সম্পর্কিত নিবন্ধ