বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বাংলাদেশ কী করছে, তা নয় বরং এ দেশে বিনিয়োগ করতে বিদেশিরা কী চান– তা জেনে সহযোগিতার বার্তা দিতে বিনিয়োগ সম্মেলন শুরু হয়েছে। বদলে যাওয়া বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়াতে এর আয়োজক বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। 

শুধু পাঁচতারকা হোটেলের সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সম্মেলনে অংশ নিতে আসা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিশেষ বিমান ফ্লাইটে সম্মেলনের প্রথম দিনই চট্টগ্রামের কোরিয়ান ইপিজেড এবং মিরসরাই জাতীয় ইকোনমিক জোন পরিদর্শনে নিয়ে যায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ-বেজা। বিনিয়োগকারীদের এ দলে যুক্তরাষ্ট্র, কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডস, চীন, ভারতসহ প্রায় ৫০টি দেশের  পাশাপাশি দেশীয় বিনিয়োগকারীরাও অংশ নিচ্ছেন। 

দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে জমির মালিকানা নিয়ে জটিলতা কোরিয়ান ইপিজেডের উদ্যোক্তাদের সমস্যা অন্তর্বর্তী সরকার মাত্র দুই মাসে কীভাবে সমাধান করেছে, সেই  গল্প কোরিয়ান উদ্যোক্তার মুখ থেকেই শুনলেন তারা। মিরসরাই ইকোনমিক জোনে গিয়ে তারা দেখেছেন, সরকার কী ধরনের সুযোগ-সুবিধা এরই মধ্যে করে রেখেছে। 
সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে আজ মঙ্গলবার নারায়ণগঞ্জে জাপান স্পেশাল ইকোনমিক জোন (এসইজেড) পরিদর্শনে যাবেন এই বিদেশিরা। সেখানে জাপানিদের কাছ থেকেই বাংলাদেশে বিনিয়োগ অভিজ্ঞতার কথা শুনবেন তারা।
বড় অঙ্কের বিনিয়োগে আগ্রহী বিদেশিরা যখন ঢাকার বাইরে সরেজমিন অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিদর্শনে, তখন ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে দেশি-বিদেশি তরুণ স্টার্টআপ উদ্যোক্তারা সম্মেলন করে তাদের চাহিদা জানিয়েছেন, খুঁজেছেন সমাধানের পথ। দিনব্যাপী আয়োজনে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা, সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ  সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা অংশ নিয়েছিলেন।

প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা ইতিবাচক
প্রথম দিনে সকালে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় কেইপিজেড ঘুরে দেখেছেন প্রায় ৬০ জন বিদেশি। বিকেলে তারা চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে জাতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘুরে দেখেন। 
পরিদর্শন শেষে বিনিয়োগকারীদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন কেইপিজেড ও ইয়ংওয়ান করপোরেশনের চেয়ারম্যান কিহাক সাং। তিনি বলেন, এখানে জমি ও অন্যান্য অবকাঠামো প্রস্তুত। বিনিয়োগে কোনো ঝামেলা নেই। 

ব্যবসায়িক সনদসহ যাবতীয় বিনিয়োগ সেবা পাওয়া যাবে দ্রুত। বিনিয়োগবান্ধব অনেক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে এই ইজেডে। তিনি বলেন, ব্যবসায়িক সনদ নেওয়ার ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা অনেক কমেছে। বিগত সরকারের সময়ে বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে অনেক কথা বললেও বাস্তবে উদ্যোগ ছিল কম। বর্তমান সরকার নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। দ্রুততম সময়ে ব্যবসায়িক সনদসহ সব সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে।
চীনের বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মেগা রিচ ইন্ডাস্ট্রিয়াল লিমিটেডের ম্যানেজিং পার্টনার কেভিন উ সমকালকে বলেন, নতুন  সরকার বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করার উদ্যোগ নিচ্ছে। চীনের বিনিয়োগকারীদের অনেক বিনিয়োগ আছে বাংলাদেশে। আরও অনেকেই বিনিয়োগ করতে চান। তবে  সম্মেলনে কী সুবিধা ঘোষণা করবে বাংলাদেশ– সেটিও দেখার অপেক্ষায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা।
ভারতের হায়দরাবাদের  কাপিতি ওভারসিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুরেস কাপিতি বলেন, বাংলাদেশে কমপ্লায়েন্ট ব্যাটারি রিসাইক্লিং প্ল্যান্টের জন্য অংশীদার ব্যবসায়ী খুঁজতে তিনি এসেছেন। নেদারল্যান্ডস থেকে আসা এক বিনিয়োগকারী জানিয়েছেন, তাঁর কৃষি খাতে ব্যবসা রয়েছে। উপযুক্ত ব্যবসায়িক পরিবেশ ও প্রয়োজনীয় সেবা নিশ্চিত হলে তাঁর প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ আছে।
কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এখানে বিভিন্ন কারখানায় ৩০ হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে, যাদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ নারীকর্মী। এই ইজেডে ইতোমধ্যে ৭০ কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ করা হয়েছে। বিশেষ করে টেক্সটাইল, গার্মেন্ট, গার্মেন্ট অ্যাক্সেসরিজ পণ্য, জুতা এবং আইটি পরিষেবা খাতে। অর্থনৈতিক অঞ্চলটি চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কর্ণফুলী টানেল হয়ে ১৫ মিনিটের দূরত্বে আনোয়ারায় কর্ণফুলী নদীর তীরে অবস্থিত। ২ হাজার ৪৯২ একর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই পরিবেশবান্ধব এলাকা দেশের একমাত্র বেসরকারি মালিকানাধীন রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল।
বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সরেজমিন চট্টগ্রামের মিরসরাই জাতীয় অর্থনৈতিক জোন পরিদর্শন শেষে প্রকল্প পরিচালক মাহমুদ ফারুক বলেন, এই অর্থনৈতিক জোনে বিনিয়োগকারীদের সব ধরনের ইউটিলিটির সুযোগ রাখা হয়েছে। শিল্পের জন্য পানির কোনো সমস্যা হবে না। ফেনীর মহুরী ও মেঘনা নদী থেকে সরবরাহ করে পানির সমস্যা সমাধান করা হবে।
বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে বিভিন্ন দেশ ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে। তাই এখানে কী সুবিধা পাওয়া যাবে, কী সমস্যা আছে– তা সরাসরি দেখাতে আপনাদের আনা হয়েছে। আমলাতান্ত্রিক কোনো জটিলতায় যেন পড়তে না হয়, সে জন্য সরাসরি ইজেড দেখানো হয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টার উপপ্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বলেন, এর আগেও বাংলাদেশে বিনিয়োগ সম্মেলনে হয়েছে। তবে পাঁচতারকা হোটেলে অনুষ্ঠিত হওয়া সেসব সম্মেলন সেমিনার এবং প্রেজেন্টেশন দিয়েই শেষ করা হয়েছে। এবারই প্রথম বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সরাসরি ইজেড দেখানো হয়েছে। এতে বিনিয়োগ করলে কী সুবিধা পাবেন, কী অসুবিধা হবে– তা তারা বুঝতে পেরেছেন।
বেজা জানিয়েছে, এনএসইজেড দেশের অন্যতম উচ্চাকাঙ্ক্ষী উন্নয়ন উদ্যোগ। এটি দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরের তীরে কৌশলগতভাবে অবস্থিত, যেখানে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, চট্টগ্রাম বন্দর ও বিমানবন্দরের মতো পরিবহন রুট রয়েছে। চট্টগ্রামের মিরসরাই ও সীতাকুণ্ড এবং ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলার নিয়ে ৩৩ হাজার ৮০০ একর নিয়ে গঠিত এই অর্থনৈতিক অঞ্চল। ইতোমধ্যে এখানে ১১টি কারখানা উৎপাদন শুরু করেছে এবং ২৮টি শিল্প নির্মাণাধীন রয়েছে। এখন পর্যন্ত এখানে প্রায় ১৯ বিলিয়ন ডলার মূল্যের স্থানীয় এবং বিদেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব আকর্ষণ করেছে। এ পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছে প্রায় ১৫৫ প্রতিষ্ঠান। ভবিষ্যতে ৫০০টি শিল্প স্থাপনের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।

প্রথা ভাঙতে চান বিডা চেয়ারম্যান
বিদেশি বিনিয়োগকারীরাই বাংলাদেশের শুভেচ্ছা দূত হবেন। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্টে বিডা কোন নীতিতে কাজ করছে– তা জানাতে গিয়ে এমনটাই বললেন সংস্থাটির নির্বাহী চেয়ারম্যান  আশিক মাহমুদ বিন হারুন। গতকাল বিনিয়োগ সম্মেলনের প্রথম দিনে রাজধানীর হোটেলে মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এ কথা বলেন তিনি।
তিনি বলেন, বিদেশিদের এ দেশে বিনিয়োগে এমন ‘কমফোর্ট’ দিতে চাই, যা দেখে তারাই অন্য বিদেশিদের কাছে বাংলাদেশের বিনিয়োগ দূত হিসেবে কাজ করবেন। কোরিয়ান ইপিজেডের দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময়ের জমিসংক্রান্ত জটিলতার সমাধান মাত্র দুই মাসে করে দেওয়ায় এই ইপিজেডের উদ্যোক্তা নিজে উদ্যোগী হয়ে ৩১ জন কোরিয়ান বিনিয়োগকারীকে এবারের বিনিয়োগ সম্মেলনে এনেছেন বলে জানান তিনি।

বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, ব্যবসা করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এখনও সমস্যা আছে। বিশেষ করে নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য ট্রেড লাইসেন্স পাওয়াসহ সরকারি লালফিতার দৌরাত্ম্য বেশি। প্রতিবছর ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করতে গিয়ে সিটি করপোরেশন অফিসে দৌড়াতে হয়। এমন অনেক সমস্যা আছে। এসব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি।
আশিক মাহমুদ বলেন, আমরা কী করছি, তা বড় কথা নয়, বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে কী চান, কী সমস্যায় পড়ছেন– তা শুনতে চাই। আগত অতিথিরা সরেজমিন দেখছেন, সেখানে তাদের জন্য কী কী সুযোগ-সুবিধা আছে। বাংলাদেশে এরই মধ্যে যেসব বিদেশি বিনিয়োগ করেছেন, তাদের মুখ থেকে এ দেশে তাদের বিনিয়োগ অভিজ্ঞতা ও সমস্যার কথা শুনেছেন। 

 


 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব ন য় গ করত ব ন য় গ কর প রথম দ ন ব যবস য় ক ম রসর ই র জন য সমস য সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

২০ দিনে বরখাস্তের সুযোগ, বিশেষ বিধান পর্যালোচনা হচ্ছে

সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ, ১৯৭৯ পুনরায় কার্যকর করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এই আইনে সরকারি চাকরিজীবীদের ২০ দিনের মধ্যে চাকরিচ্যুতিসহ তিন ধরনের শাস্তি দেওয়া যাবে। শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা আদালতের কাছেও প্রতিকার চাইতে পারবেন না।  

সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল হওয়ায় জিয়াউর রহমান সরকারের আমলে জারি করা এই অধ্যাদেশ রহিত হয়ে যায়। তবে ২০১৮ সালে সরকারি চাকরি আইন জারি হওয়ার আগ পর্যন্ত ‘কতিপয় অধ্যাদেশ কার্যকরকরণ আইন, ২০১৩’ দ্বারা এ অধ্যাদেশটি বহাল রাখা হয়।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এখন অধ্যাদেশটি পর্যালোচনা করছে। এটি পুরোপুরি রাখা হবে, নাকি এর কিছু বিধান সরকারি চাকরি আইনের সঙ্গে যুক্ত করা হবে– তা নিয়ে এখন কাজ চলছে।   
এই বিশেষ বিধানকে সংশ্লিষ্ট অন্য সব আইনের ওপর প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, সরকারি কর্মচারীর চাকরির শর্তাবলি সম্পর্কিত অন্যান্য আইন, বিধিমালা বা প্রবিধিমালায় যা-ই থাকুক না কেন, এই অধ্যাদেশ কার্যকর হবে। 

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও আইনজ্ঞরা বলছেন, এটি বিশেষ সময়ে, বিশেষ পরিস্থিতিতে করা একটি খারাপ আইন। কোনো দক্ষ ও দায়িত্বশীল সরকারের এমন আইনের চর্চা করা উচিত না।    
এই বিশেষ বিধানে চার ধরনের অপরাধ ও তিন ধরনের শাস্তির কথা বলা আছে। অপরাধগুলো হলো– কোনো সরকারি কর্মচারী এমন কোনো কাজ করতে পারবেন না যাতে অন্য কর্মচারীদের মধ্যে অনানুগত্য তৈরি হয় বা শৃঙ্খলা ব্যাহত হয় বা কাজে বাধার সৃষ্টি হয়। দ্বিতীয়ত, অন্যদের সঙ্গে সংঘবদ্ধভাবে বা আলাদাভাবে ছুটি ব্যতীত বা কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া কাজে অনুপস্থিত থাকেন বা কর্তব্য কাজে ব্যর্থ হন। তৃতীয়ত, অন্য কর্মচারীকে কাজে অনুপস্থিত থাকতে, বিরত থাকতে বা কর্তব্য পালন না করতে উস্কানি দেওয়া। চতুর্থত, যে কোনো কর্মচারীকে কাজে অনুপস্থিত থাকতে বা কাজ না করতে প্ররোচিত করা।
বিশেষ এই বিধানে এসব অপরাধের তিন ধরনের শাস্তি দেওয়া যাবে– বরখাস্ত, অব্যাহতি এবং পদাবনতি বা বেতন হ্রাস।

অধ্যাদেশটি পুনর্বহালের কারণ হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ গত মার্চে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে দেওয়া চিঠিতে বলেছে, দেশের বিদ্যমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সরকারি কর্মচারীদের মাঝে নানা মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বসহ অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকে যথাযথ কর্তৃপক্ষের আইনসংগত আদেশ-নির্দেশ পালনে অনীহা প্রকাশ করছেন। ফলে সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিসহ সরকারি কর্মকাণ্ড সম্পাদনে শৈথিল্য প্রদর্শিত হচ্ছে। এ কারণে সরকারি কর্মচারীদের বিশৃঙ্খলার বিষয়ে দ্রুত আইনগত কার্যক্রম গ্রহণের ব্যবস্থা হিসেবে রহিত করা ‘সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ, ১৯৭৯’ পুনরায় কার্যকর করার প্রস্তাব করে তারা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোখলেস উর রহমান সমকালকে বলেন, ‘কর্মচারী বিশেষ বিধান অধ্যাদেশ আমরা পর্যালোচনা করছি। এটি পুরোপুরি ফেরানো হবে, নাকি ২০১৮ সালের চাকরি আইন সংশোধনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ধারাগুলো যুক্ত করা হবে– তা নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মতামত চাওয়া হয়। তারা জানিয়েছেন, আইনটি স্পর্শকাতর। তারা ভালোভাবে বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
জানা যায়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ নিয়ে কাজ করছে। খসড়া প্রস্তাব তৈরি হলে তা প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে। তিনি সম্মতি দিলে উপদেষ্টা পরিষদে উপস্থাপন করা হবে।
এই বিশেষ বিধান কার্যকর হলে কর্মস্থলে অনুপস্থিত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কোনো তদন্ত করতে হবে না। এর জন্য সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) কোনো মতামতও লাগবে না। নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করে অভিযুক্তের জবাব, ব্যক্তিগত শুনানি পর্যালোচনা করে স্বীয় বিবেচনায় চাকরিচ্যুতিসহ অন্য শাস্তি দিতে পারবে।

অধ্যাদেশ অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে প্রথম নোটিশের জবাব দুই থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে দিতে হবে। প্রস্তাবিত দণ্ড কেন আরোপ করা হবে না– এমন নোটিশের জবাব দিতে হবে তিন দিনের মধ্যে। দণ্ডিত হওয়ার সাত দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের ঊর্ধ্বতনের কাছে আপিল করতে পারবেন। সর্বশেষ তিনি আদেশ রিভিউয়ের জন্য আবেদন করতে পারবেন রাষ্ট্রপতির কাছে। বিশেষ বিধানের ৭ ধারায় বলা হয়েছে, এই অধ্যাদেশের যে কোনো বিধানের আওতায় গৃহীত কার্যক্রম ও আদেশ সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। 

জানতে চাইলে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া সমকালকে বলেন, কোনো দক্ষ সরকার খারাপ আইন জারি করে না। এই বিশেষ বিধানটি অনেকটা আক্রোশমূলক। মূলত কর্মকর্তাদের আন্দোলন থেকে বিরত রাখতে এবং যার-তার বিরুদ্ধে যখন-তখন ব্যবস্থা নিতে এমন আইন করা হয়। তিনি বলেন, রাজনৈতিক সরকার যেমন মামলা দিয়ে বিরোধী দলকে দমন করে, এ আইনটি তেমন।    
বর্তমানে কোনো সরকারি কর্মকর্তা পলাতক থাকলে বা অন্য কোনো অপরাধ করলে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা-২০১৮ অনুযায়ী লঘুদণ্ড বা গুরুদণ্ড দেওয়া হয়। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে এবং অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা থাকলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে নোটিশ পাঠানো হবে। ওই কর্মকর্তা নোটিশ পাওয়ার ১০ কার্যদিবসের মধ্যে জবাব দেবেন বা সময়ের জন্য আবেদন করবেন। সময় চেয়ে আবেদন করলে লঘুদণ্ডের ক্ষেত্রে ৭ কার্যদিবস এবং গুরুদণ্ডের ক্ষেত্রে ১০ কার্যদিবস অতিরিক্ত সময় মঞ্জুর করা হবে। এর পর ব্যক্তিগত শুনানি হবে। শুনানির পরিপ্রেক্ষিতে অব্যাহতি বা লঘুদণ্ড দেওয়া যাবে অথবা তদন্ত কর্মকর্তা বা বোর্ড নিয়োগ করা হবে। 

তদন্তে সত্যতা পাওয়া গেলে লঘুদণ্ড প্রদান করা যাবে। গুরুদণ্ড প্রদান করতে হলে দ্বিতীয় নোটিশ পাঠাতে হবে। এর পর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ৭ কার্যদিবসের মধ্যে জবাব দেবেন। জবাব সন্তোষজনক হলে লঘুদণ্ড দেবেন। আর গুরুদণ্ডের সিদ্ধান্ত বহাল থাকলে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) মতামতের জন্য পাঠাতে হবে। সর্বশেষ ক্যাডার সার্ভিসের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির অনুমতি নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করবে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ। তদন্ত কর্মকর্তা বা বোর্ড কত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবে, এ বিষয়ে নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করা নেই। এ জন্য অসংখ্য অভিযোগ ঝুলে থাকে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।  
চূড়ান্ত প্রজ্ঞাপনে অভিযুক্ত কর্মকর্তা রাষ্ট্রপতির কাছে রিভিউ আবেদন করতে পারবেন। আবেদন মঞ্জুর না হলে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে আপিল করতে পারবেন। প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে রায় বহাল থাকলে প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল করতে পারবেন। এ দুই ধাপের পর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল এবং রিভিউয়ের আবেদন করতে পারবেন।          

বিশেষ বিধানের ৭ ধারায় বলা হয়েছে, এই অধ্যাদেশের যে কোনো বিধানের আওতায় গৃহীত কার্যক্রম ও আদেশ সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। 
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহ্দীন মালিক সমকালকে বলেন, কেউ যদি সরকারের কোনো পদক্ষেপে সংক্ষুব্ধ হয়, তাহলে তাকে আদালতের দ্বারস্থ হতে বাধা দেওয়া যাবে না। এটা আইনের শাসনের মৌলিক কথা। তিনি বলেন, কেউ আদালতে যেতে পারবে না– এমন কোনো বিধান আইন বা অধ্যাদেশে থাকতে পারবে না। এটা সংবিধান পরিপন্থি।  
নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রশাসনের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, কোনো কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করতে কমপক্ষে এক থেকে দেড় বছর সময় লাগে। কারণ, কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে সুষ্ঠু তদন্ত করতে হয়। এর পর সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কাউকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে চাকরিচ্যুত করা যায় না। আর অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। মানুষ চায়, সব ক্ষেত্রে আইনের শাসন থাকবে। 

সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার সমকালকে বলেন, অনেক চাকরিজীবী কোনো যুক্তি ও নিয়মকানুন মানেন না। ছুটি ছাড়াই কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন। তাদের বিশেষ বিধানে শাস্তি দেওয়া যায়। তবে আইনটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে।  


 

সম্পর্কিত নিবন্ধ