আচমকা বাংলাদেশের বেনাপোল সীমান্ত হয়ে ভারতের পেট্রাপোলে পৌঁছলে আপনি ভয় পেতে পারেন। হঠাৎ করে আবার ভারতে লকডাউন শুরু হয়েছে, এমন ভেবে আতঙ্কিতও হতে পারেন। কারণ পরিস্থিতি এমনই। চারদিকে খাঁ খাঁ! কেউ বলছেন পরিস্থিতি নাকি ধূ ধূ মরুভূমির মতো। কেউ আবার বলছেন কোভিডকালেও এই চিত্র দেখা যায়নি। তবে যে যাই বলুক না কেন, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বৃহত্তম স্থলবন্দর পেট্রাপোলের চেহারা যে মোটেই ভালো নয়, তা সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করেছেন। 

পরিসংখ্যান বলে, পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার পেট্রাপোল-বেনাপোল আন্তর্জাতিক সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন প্রায় কয়েক হাজার মানুষ যাতায়াত করে থাকে। ঈদ কিংবা অন্য উৎসবের মৌসুমে সেই সংখ্যা অনেকটাই বাড়ে। বিশেষ করে ঈদ উপলক্ষে বাংলাদেশি পর্যটকদের কাছে ভারত তথা কলকাতা হয়ে উঠে প্রিয় ভ্রমণস্থল। সেইসব বাংলাদেশি পর্যটকদের অধিকাংশই আবার আসে পেট্রাপোল বন্দর দিয়ে। আর সেই বিদেশি পর্যটকদের ওপরই নির্ভরশীল পেট্রাপোল বন্দরের স্থানীয় ব্যবসায়ীদের রুটি-রোজগার। পরিবহন, খুচরো ব্যবসায়ী, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় কেন্দ্র, ফলওয়ালা, কসমেটিক্স বিক্রেতা, ভাতের হোটেল, চায়ের দোকান থেকে শুরু করে রিকশাচালক- সকলেরই উপার্জন নির্ভর করে এই পর্যটকদের আগমনের ওপর। কিন্তু সেই উপার্জনেই আজ বড় ধাক্কা বাংলাদেশি পর্যটকদের অনুপস্থিতি। 

বিশেষ করে গত বছরের ঈদেও যেখানে পেট্রাপোল স্থলবন্দর এলাকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ব্যবসায়ে যুক্ত মানুষজন দম ফেলার ফুরসত পাননি। আর এবার কার্যত ‘মাছি মারতে’ হচ্ছে তাদের। বৃহস্পতিবার পেট্রাপোল স্থলবন্দর ঘুরে দেখা গেলো এক হতাশা ও অলসতার ছবি। ভ্যানওয়ালা থেকে শুরু করে পরিবহন ব্যবসায়ী প্রত্যেকেই ‘লক্ষ্মী লাভের’ আশায় দিন গুনছেন। 

দেশ ট্রাভেলস-এর কলকাতা চ্যাপ্টারের মালিক মুহাম্মদ আলি হোসেন শেখ জানান, বরাবর ঈদে আমরা যে ব্যবসা করে থাকি, সেই তুলনায় এবার খুবই খারাপ ছিল। ভারত সরকার বাংলাদেশিদের জন্য ৬০ শতাংশ টুরিস্ট ভিসা, ৩০ শতাংশ মেডিকেল ভিসা এবং বাকি অন্য ভিসা প্রদান করে থাকে। কিন্তু এবারে ভিসা ইস্যু হয়নি বলে কোন রকম ব্যবসা পাইনি। পরিস্থিতি যখন স্বাভাবিক ছিল তখন প্রতিদিন দেশ ট্রাভেলস-এর ৮টি বাস চলাচল করতো কলকাতার নিউ মার্কেট থেকে পেট্রাপোল পর্যন্ত। আর এখন পর্যটকের অভাবে ওই একই যাত্রাপথে মাত্র ১টি বাস চলাচল করে, তাও আবার মাসে ১৫ দিন। 

তার দাবি, বর্তমান পরিস্থিতিতে পেট্রাপোল চেকপোস্ট কিংবা কলকাতার নিউ মার্কেটে মাত্র ২ শতাংশ ব্যবসা চলছে, বাকি ৯৮ শতাংশই বন্ধ। যাত্রীসংখ্যা কম, তেল খরচের অর্থও উঠছে না তাই শ্যামলী এসপি, সোহাগ, এনআর, সৌদিয়া, গ্রিন লাইন, রয়েল কোচসহ প্রতিটি পরিবহন সংস্থায় তাদের বাস পরিসেবা বন্ধ রেখেছে। 

কিন্তু মাস কয়েক আগেও তথাকথিত এই ‘ব্যাড প্যাচ’ বা ব্যবসায়িক মন্দা ছিল না। শুরুটা হয়েছে গত ৫ আগস্ট ছাত্র অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও শেখ হাসিনার দেশত্যাগের মধ্যে দিয়ে। ঘটনার আট মাস কেটে গেলেও ক্ষত শুকোয়নি। নিরাপত্তা ও কর্মী সংকটের কারণ দেখিয়ে বাংলাদেশিদের জন্য সাধারণ ভিসা প্রদান বন্ধ রেখেছে ভারত সরকার। আবার মেডিকেল ভিসা চালু থাকলেও তা প্রদানের সংখ্যা খুবই কম। আর তার প্রভাব গিয়ে পড়েছে ব্যবসায়। পর্যটকের অভাবে যেমন কলকাতার নিউ মার্কেটে প্রভাব পড়েছে, অনেক ব্যবসায়ীরা যেমন তাদের ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন বা অন্য ব্যবসায় ঝুঁকছেন, ঠিক তেমনই অবস্থা পেট্রাপোল স্থল বন্দরেও।

বৈদেশিক বিনিময়কেন্দ্রের মালিক বাবলু রায় জানান, আগে যে পরিস্থিতিতে কাজ করতাম সেটাই ভালো ছিল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি খুবই খারাপ। আগে প্রতিদিন গড়ে ২৫/৩০ জন পর্যটক আসতেন। কিন্তু বর্তমান দুই-তিন মাস মিলিয়েও সেই গ্রাহক পাই না। এমনকি ঈদের সময় যে পরিমাণ পর্যটক আসতেন, আনন্দ উপভোগ করতেন, এবার সেটাও নেই। তার প্রভাব ব্যবসায় পড়েছে। 

তিনি আরো জানান, বর্তমানে মেডিকেল এবং তীর্থ ভিসা নিয়ে বাংলাদেশি পর্যটকরা কলকাতা ও ভারতে আসছেন। তবে সেই সংখ্যাটা খুবই কম। তার অভিমত, টুরিস্ট ভিসা যতদিন না চালু হবে ততদিন স্বাভাবিকতা ফিরে আসবে না। 

বর্তমান পরিস্থিতিকে লকডাউনের সাথে তুলনা টেনে গ্রিন লাইন পরিবহনের কর্মী সুব্রত ঘোষ জানান, লকডাউনের সময় বুঝতাম সেটা বন্ধ, কিন্তু এখন না খোলা, না বন্ধ। সাধারণ মানুষ পুরোপুরি শুয়ে পড়েছে। আগে প্রতিদিন প্রতিটি পরিবহনের তরফে চারটি করে বাস আসা-যাওয়া করত। এখন সব পরিবহন একত্রিত হয়ে একটি করে বাস ছাড়া হয়। 

পেট্রাপোল সীমান্তে ‘কস্তূরী’ নামক ভাতের হোটেলের কর্মী প্রসেনজিৎ পাল জানান, হোটেলটি মূলত বাংলাদেশি পর্যটকের ওপরে নির্ভরশীল। আগে প্রতিদিন ৬ থেকে ৭ হাড়ি ভাত হতো, আর এখন মাত্র দুই হাড়ি। আগে আয় হতো ১২ হাজার রুপির উপর, আর এখন সেটা নেমে এসেছে দুই হাজারের কম। 

এমনকি, বাংলাদেশি পর্যটকদের ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে চাকা ঘোরে পেট্রাপোল সীমান্তে এক স্থানীয় লটারির টিকিট বিক্রেতারও। চন্দন দত্ত নামে ওই লটারির টিকিট বিক্রেতা জানান, এখানে যেমন স্থানীয় ভারতীয় ব্যবসায়ীরা টিকিট কিনতেন, সেভাবে বাংলাদেশি পর্যটকরাও। অনেক বাংলাদেশি লটারিতে নগদ অর্থও জিতেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে কেবলমাত্র স্থানীয়দের ওপরেই নির্ভর করতে হয়। আগে যেখানে দৈনিক ১ হাজার রুপি আয় হতো, এখন ১০০ রুপিও হয় না। 

সম্প্রতি দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে শীতলতা আসার পেছনে সামাজিক মাধ্যমের একাংশকে দায়ী করেছেন পরিবহন ব্যবসায়ী মুহাম্মদ আলি হোসেন শেখ। তার মতে, যেভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে অপপ্রচার ছড়ানো হচ্ছে, দুই দেশের সু-সম্পর্কের ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বাংলাদেশের একটি অংশে ভারত বয়কটের ডাক উঠলেও তারা বুঝতে পারছে যে ভারতের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু।

ঢাকা/সুচরিতা/এনএইচ 

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ব যবস য পর বহন কলক ত র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

মেঘের ভেলায় মেঘবালিকায়

সাজেককে বলা হয় মেঘের রাজ্য, কেউ তাকে বলে মেঘের দেশ। কেউ বলে মেঘবালিকা। মেঘের ভেলায় ভাসা আলাদা এক স্বর্গীয় রাজ্য সাজেক ভ্যালি। যে নামেই ডাকি না কেন তাতে সাজেকের রূপ-যৌবনে ভাটা পড়ে না। সেই মায়াবী সাজেক এখন সেজেছে নতুন রূপে। শীতের চাদরে মুড়িয়ে রেখেছে নিজেকে। মেঘের ভেলা, কুয়াশা, হিমশীতল বাতাস, পাহাড় আর প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য এখন মিলেমিশে একাকার।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বরফঢাকা উপত্যকাগুলো জনপ্রিয় পর্যটন স্পট। বিশেষ করে ভারতের কাশ্মীর, সিমলা, মানালি কিংবা সিকিমের ইয়ামথাং ভ্যালির মতো উপত্যকা জনপ্রিয়তার শীর্ষে। আমাদের দেশে বরফ পড়ে না। সে অর্থে উপত্যকাও কম। তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার অন্তর্গত সাজেক ইউনিয়নের একটি উপত্যকা সাজেক ভ্যালি। মাটির পাহাড় বেশি বৈচিত্র্যময়। তাই সাজেক ভ্যালি যেমন সবুজ, তেমন যেন মেঘ মোড়ানো কোনো ঊর্বশী। জনপ্রিয় এই ভ্রমণ গন্তব্যটি তাই অন্য সবার চেয়ে আলাদা। সাজেকের উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা, দক্ষিণে রাঙামাটির লংগদু, পূর্বে ভারতের মিজোরাম, পশ্চিমে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা অবস্থিত।

ভ্রমণপ্রিয় মানুষের কাছে সাজেক এখন অন্যতম আকর্ষণীয় গন্তব্য। পাহাড় কখনো মানুষকে একেঘেঁয়ে করে না। তাই সাজেক বারবার পর্যটকদের হাতছানি দেয়। অগ্রণী ব্যাংক বৈদেশিক বাণিজ্য শাখার উদ্যোগে এবং শাখার মহাব্যবস্থাপক জাহানারা বেগমের সার্বিক তত্ত্বাবধানে কয়েকজন উদ্যোমী নির্বাহী ও কর্মকর্তার নিরলস প্রচেষ্ঠায় সফলতা পায় আমাদের সাজেক ভ্রমণ।

এবারের সাজেক যাত্রা চাকরি জীবনের ছন্দপতন ঘটিয়ে ক্ষণিকের জন্য আবার সেই আড্ডার জীবনে ফেরা। ভ্রমণের আনন্দ শুরু হয়ে যায় মূলত রাজধানী থেকে বাসে ওঠার পরই। দৈনিক বাংলার মোড় থেকে ২টি গ্রীনলাইন ভলভো বাসে উঠে পড়লাম প্রায় ৬০ জন। চলার মাঝপথে দু’চার জন উঠলাম বাসে। শুরু হলো আমাদের স্বস্তির যাত্রা। বৃহস্পতিবার রাত হওয়ায় ঢাকা থেকে বের হওয়ার গাড়ির চাপ বেশি ছিল, এ কারণে রাস্তায় জ্যামও একটু বেশি ছিল। জ্যাম ঠেলে চলতে থাকে আমাদের বাস। চলতে থাকে আমাদের গল্প-আড্ডা। একে একে সবাই বলতে থাকে জমানো কথা, সমবেত কণ্ঠে গান এবং বাসের মধ্যেই নাচ।

রাত দেড়টার দিকে আমাদের বাস পৌঁছায় কুমিল্লা। সেখানে ২০ মিনিটের যাত্রাবিরতি। সবাই নেমে পড়ি। চা-পর্ব শেষ করে আবার উঠে পড়ি গাড়িতে। এ যাত্রায় কেউ ঘুমায় কেউ নাচ-গানে মশগুল। ভোরের আলো ফোটার আগেই ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভাঙে মূলত বাসের অস্বাভাবিক মুভমেন্টের কারণে। আঁকা-বাঁকা পথ বেয়ে চলার কারণে বাসের এমন মুভমেন্ট। বুঝতে পারলাম আমরা ঢুকে পড়েছি পাহাড়ি জেলা খাগড়াছড়িতে। বাসের পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাতেই চোখে পড়ে খাগড়াছড়ির মূল আকর্ষণ পাহাড়। ছোট ছোট পাহাড় ভেদ করে সরু রাস্তায় ছুটে চলছে আমাদের গাড়ি। কিছুক্ষণ পর সকাল সাড়ে ৬টার দিকে আমরা পৌঁছে যাই খাগড়াছড়ি। নেমে পড়ি সবাই। শীতের স্নিগ্ধ সকাল আর পাহাড়বেষ্টিত খাগড়াছড়ির নির্মল প্রকৃতি একটা অন্যরকম অনুভূতি জাগায়। সাজেক রাঙ্গামাটি জেলায় হলেও যাওয়ার জন্য খাগড়াছড়ি হয়ে যাওয়াই প্রথম পছন্দ।

বাস থেকে নেমে গ্রামীণ আবহে গড়া সুন্দর রেস্টুরেন্টে নাস্তা সেরে নেই। এখান থেকেই ভাড়া করতে হয় সাজেক যাওয়ার অন্যতম বাহন চান্দের গাড়ি। বিভিন্ন প্যাকেজে পাওয়া যায় এই গাড়ি। আমাদের আগে থেকেই ভাড়া করা চান্দের গাড়ি যথাসময়ে উপস্থিত। চালকের ফোন পেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে নেমে আসি সবাই। শহরের একটা হোটেলে সাময়িকের জন্য রুম নেওয়া ছিল আমাদের। মূলত ফ্রেশ হওয়ার জন্য এই রুম নেওয়া। সব পর্যটকের জন্যই এই সুবিধা আছে। 

নাস্তা সেরে উঠে পড়ি চান্দের গাড়িতে। খাগড়াছড়ি থেকে সাজেকের দূরত্ব ৭০ কিলোমিটার। বলতে গেলে প্রায় ৪ ঘণ্টার পথ। কিন্তু ৪ ঘণ্টায় সেখানে যাওয়া যায় না। একে পাহাড়ি উঁচু-নিচু, আঁকা-বাঁকা পথ, তার ওপর কিছু আনুষ্ঠানিকতা আছে সাজেকযাত্রায়। খাগড়াছড়ি থেকে প্রথমে পৌঁছাতে হবে দিঘীনালা। সেখানে সেনাবাহিনীর ক্যাম্প আছে। মূলত সেনাবাহিনী পর্যটকদের নিরাপত্তায় দিনে দুবার পর্যটকদের গাড়ি সাজেকে পৌঁছে দেয়। সেনাবাহিনীর এসকর্ট দিনে দুবার ছাড়ে। প্রথমটি ছাড়ে সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে (একটু কম-বেশি হতে পারে। দ্বিতীয়টি ২টা থেকে আড়াইটার মধ্যে। ৯টার মধ্যেই আমরা পৌঁছে যাই দিঘীনালা ক্যাম্পে। সেখানে সেনাবাহিনীর সদস্যদের কাছে তথ্য দিতে হয়। তথ্য দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি সেখানে। একে একে অন্য গাড়িগুলো চলে আসে। মোটরসাইকেলসহ অনেক মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকারও এসকর্টে যোগ দেয়। এরপর সকাল ১০টার কিছু সময় পর ছেড়ে দেয় এসকর্ট। দিঘীনালায় পাহাড়ি ফলমূল উপভোগ করলাম যেমন পেঁপে, আনারস, কলা ইত্যাদি।

পাহাড়ি পথ বেয়ে চলে গাড়ির বহর। সবুজে ঘেরা পাহাড়ি রাস্তায় সে এক অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করে। দুদিকে যতদূর চোখ যায় শুধু পাহাড় আর পাহাড়। এই অনেক উপরে তো আবার অনেক নিচে। প্রকৃতির সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে থাকবেন আপনি। উঁচু-নিচু পথে পরক্ষণেই চমকে উঠবেন। কিছু কিছু রাস্তা এত উঁচু যে ভয়ে চোখ বন্ধ রাখতে হয়। পথে পথে পাহাড়ি শিশুদের আতিথেয়তা।
পাহাড়ি এই অঞ্চলে মানুষের ঘনবসতি নেই। কিছুদূর পরপর রাস্তার পাশে চোখে পড়ে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর বাসিন্দাদের বাড়ি। এই রাজ্য শুধু তাদেরই। এখানে নেই কোলাহল, আধুনিকতা। লড়াই করে টিকে থাকাই এখানকার সহজ-সরল বাসিন্দাদের মুখ্য চিন্তা। তাদের জীবনযাপনে নেই কোনো আধুনিকতার ছোঁয়া। পথে পথে পর্যটকদের দেখে চোখে-মুখে তৃপ্তির ভাষা ফুটে ওঠে। আর এখানকার ছোট ছোট শিশুরা হাত নেড়ে অভিবাদন জানায় পর্যটকদের। অবশ্য তাদের এই অভিবাদন জানানোর পেছনে ক্ষুদ্র কিছু প্রত্যাশা কাজ করে। আর তা হলো পর্যটকদের কাছ থেকে চকোলেট, চিপসের মতো সামান্য উপহার পাওয়া। পর্যটকরাও তাদের হতাশ করেন না। পর্যটকদের উপহার পেয়ে তাদের খুশির যেন সীমা ধরে না। এভাবে পথের অ্যাডভেঞ্চার শেষ করে দুপুরে পৌঁছালাম সৌন্দর্যের লীলাভূমি সাজেকে।

চান্দের গাড়ি থেকে নেমে সোজা চলে গেলাম আগে থেকে ঠিক করে রাখা সাজেকের সবচেয়ে নান্দনিক নাস্রাং রিসোর্টে। এখানে কিছুটা অপেক্ষা করতে হয় ফর্ম ফিলাপের জন্য। ফলে সাময়িকের জন্য আমাদের সবাই বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে গেলাম। মোটামুটি আধুনিক সব সুযোগই রাখা হয়েছে এসব রিসোর্টে। রিসোর্টগুলো এমনভাবে বানানো যেখান থেকে উপভোগ করা যায় পাহাড়ের সৌন্দর্য। দুচোখ যতদূর যায় শুধু পাহাড় আর পাহাড়। আপাতত পাহাড়ে দুচোখ বুলিয়ে ভ্রমণের ক্রান্তি দূর করার মিশনে নামলাম। রিসোর্টের ঠান্ডা পানিতে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম দুপুরের খাবার খেতে। অবশ্য সাজেকে খাবার গ্রহণের ঘণ্টাখানেক আগে হোটেলে বলে রাখা ভালো। কারণ হোটেলগুলোতে বাড়তি খাবার করা হয় না। এজন্য আগে থেকে বলে রাখা নিরাপদ। 

দুপুরে খাওয়ার পর একটু বিশ্রাম নিয়ে নাস্রাং রিসোর্টে পাহাড়ের চূড়ায় মনোমুগ্ধকর গ্রামীণ হাঁড়িভাঙ্গা ও ঝুড়িতে বল নিক্ষেপ খেলা অনুষ্ঠিত হয়। ১৫ মিনিট পায়ে হাঁটার পথে সর্বোচ্চ কংলাকের চূড়ায় সবাই আরোহণ করলাম। চূড়ায় ওঠার সাথী হিসেবে ১০ টাকায় ভাড়া করা বাশেঁর লাঠি নেয়া হয়েছে । সেখানে টক, ঝাল, মিষ্টি চা উপভোগ করি এবং স্থানীয় লোকজনের সাথে পারস্পারিক আলাপ-আলোচনা করি। এরপর সূর্যাস্ত দেখার জন্য সাজেক হ্যালিপ্যাড যাই। সেখানে সূর্যাস্ত উপভোগ করি, বিন্নি ধানের চালের মালপোয়া, জিলাপি ও বাশেঁর পিয়াজু ,পেঁপে, বাঁশের চোঙ্গায় চা উপভোগ করি। তারপর সন্ধ্যা নেমে আসলে সবাই রিসোর্ট  ফিরে আসি। নাস্রাং রিসোর্টে পাহাড়ের চূড়ায় আমাদের আলোচনা, রেফেল ড্র এবং পুরস্কার বিতরণী পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। সবশেষে রাতের খাবার গ্রহণের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমাদের প্রথম দিনের কার্যক্রম সমাপ্তি ঘটে।

সাজেকে যারা যাবেন, কখনই ভোর মিস করবেন না। সাজেকের ভোর-সকালের সঙ্গে কোনো কিছুরই তুলনা চলে না। মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিলাম ভোর সাড়ে পাঁচটায়। তবে পাহাড়ের ডাকে ঘুম ভাঙ্গে তার আগেই। পাহাড় তার সৌন্দর্য দেখার জন্যই হয়তো কানে কানে বলে যায়, ‘ওঠো হে পথিক, দেখো আমাকে।’ ঘুম ঘুম চোখে দরজা খুলতেই হিমশীতল একরাশ বাতাস এসে ছুঁয়ে যায় শরীর, স্নিগ্ধ করে মন। বাইরে কুয়াশার চাদরে পাহাড়ের যেন নিজেকে লুকানোর চেষ্টা। কিন্তু পাহাড় পারে না তার সৌন্দর্য লুকাতে। কুয়াশা ভেদ করে চোখ খুঁজে নেয় তার সৌন্দর্য। সূর্যিমামা হয়তো প্রস্তুত হচ্ছেন সবকিছু আলোকিত করতে। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম তার অপেক্ষায়। আর চারদিকে দেখতে থাকলাম প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য। 

এভাবে কেটে গেলো বেশ কিছুক্ষণ। সূর্যিমামা উঠে পড়লো। তার রক্তিম আলো পাহাড়ের গায়ে পড়তেই আড়মোড়া ভাঙে সবুজ পাহাড়। হেসে ওঠে সূর্যের সঙ্গে। নাস্রাং রিসোর্টে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে সূর্যোদয়  দেখতে দেখতে সেখানে কিছু ছবি তুলি। তারপর অনেকে মিলে মেঘের সঙ্গে মিতালি করতে করতে সাজেক হ্যলিপ্যাডের দিকে যাই। সেখানে গিয়ে মেঘ উপভোগ করতেই হঠাৎ সাজেক ভ্যালিতে বৃষ্টি নেমে আসল। বৃষ্টি আর মেঘের অপরূপ প্রকৃতির ছোঁয়ায় সবাই এক অন্যরকম পরিবেশে হারিয়ে গেল। এরপর বৃষ্টি থেমে গেলে আমরা রিসোর্টে চলে আসি। সকালের নাস্তা সেরে সাজেক বিদায় জানিয়ে আমরা আবার চান্দের গাড়িতে করে খাগড়াছড়ির দিকে রওনা হই। 

তারা//

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কাশ্মীর সীমান্তে ভারত ও পাকিস্তানের সেনাদের মধ্যে চতুর্থ দিনের মতো গোলাগুলি
  • মেঘের ভেলায় মেঘবালিকায়
  • ভারতজুড়ে কাশ্মীরি দুই বোনের প্রশংসা
  • বহু পর্যটকের প্রাণ রক্ষা করলেন কাশ্মীরি দুই বোন রুবিনা ও মুমতাজ
  • সীমান্তে গোলাগুলি, ফিরছেন ভিসা বাতিল হওয়া নাগরিকেরা
  • কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর হামলার নিন্দা উদীচীর
  • পর্যটকদের বাঁচাতে গিয়ে নিজেই গুলিতে প্রাণ হারালেন কাশ্মীরি তরুণ