Prothomalo:
2025-04-12@15:18:32 GMT

এত ঘৃণা কেন নারীর জন্য

Published: 7th, April 2025 GMT

তখন সবেমাত্র ঈদের ছুটি শুরু হয়েছে। শেষ মুহূর্তের সামান্য কেনাকাটার উদ্দেশ্যে ঢাকার মোটামুটি নামকরা এক বিপণিবিতানে গিয়েছিলাম।

জমজমাট ঈদের কেনাকাটা চলছে সেখানে। ফ্যাশনজগতের সুপ্রসিদ্ধ কোনো এক ব্র্যান্ডের দোকানে সামান্য কিছু কেনার জন্য পা বাড়াই। হঠাৎ কানে আসে ‘খালি এক শ!, খালি এক শ!’

অবাক হয়ে দেখলাম, বিপণিবিতানের হাঁটা পথের ওপর ছোট ছোট কাপড়ের টুকরা নিয়ে বসেছেন কয়েকজন বিক্রেতা। ফুটপাতে হকারদের এ ধরনের বিকিকিনির দৃশ্য খুবই স্বাভাবিক আমাদের কাছে। এমনকি নিউমার্কেট, গাউছিয়া, হকার্স মার্কেটেও এই ধরনের ব্যবসা হরহামেশাই চোখে পড়ে। কিন্তু অভিজাত বিপণিবিতানগুলোতে সাধারণত এই রকম দৃশ্য চোখে পড়ে না। কিছুটা কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেলাম সামনে।

একটুকরা কাপড় হাতে তুলে নিলাম। কাপড়টি দেড় গজের মতো হবে। বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘পুরো কাপড়টাই কি এক শ টাকা?’ তিনি মুহূর্তের মধ্যে কাপড়ের টুকরাটি আমার হাত থেকে ছোঁ মেরে নিয়ে বলে উঠলেন, ‘পুরা কাপড় না, এক গজ এক শ টাকা।’ এর সঙ্গে জুড়ে দিলেন, ‘এত বুদ্ধি নিয়ে রাতে ঘুমান ক্যামনে? এরেই কয় মাইয়া মাইনষের বুদ্ধি!’

দোকানদারের হঠাৎ এ রকম মন্তব্যে শুনে এক মুহূর্তে মাথা গরম হয়ে গেল। প্রতিবাদ জানালাম আমি। কিছুটা উচ্চ স্বরে কথাবার্তা হওয়ায় আশপাশে কয়েকজন জমে গেল। তাঁরা আমার পক্ষ নিলেন। বিক্রেতাকে আমার কাছে ক্ষমা চাইতে বললেন। কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দা। কিছুতেই ক্ষমা চাইবেন না আমার কাছে। অবশেষে সবার চাপে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হলেন তিনি।

সেইখান থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে একতলা নিচে নেমে এক দোকানে ঢুকলাম। পাশের দোকান থেকে ভেসে আসছে দুজন বিক্রেতার আলাপচারিতা। তাঁরা কথা বলছেন বিগত সরকারের আমলে পালিয়ে থাকা নেত্রীদের পাওয়া গেলে কীভাবে শাস্তি দেওয়া যেতে পারে, সেই প্রসঙ্গে। তাঁদের আলাপে ব্যবহৃত ভাষা এতটাই কদর্য আর আদি রসাত্মক ছিল যে পুরো শরীর রি রি করে উঠল।

সেখান থেকে বের হয়ে চলে যাই বিপণিবিতানের একদম নিচে থাকা এটিএম বুথে টাকা তুলতে। সেখানে দুজন পুরুষ টাকা জমা দিচ্ছিলেন। টাকা তুলতে তুলতে তাঁদের মধ্যকার কথাবার্তা আমার কানে এল। তাঁদের কথাবার্তার মূল বিষয় ছিল, নারী সহকর্মীদের মেধা আর সৌন্দর্যের তুলনামূলক বিশ্লেষণ। দেখতে সুন্দর একজন নারী সহকর্মী বুদ্ধিতে যে একেবারে ফাঁকা, সে বিষয়ে একমত হলেন তাঁরা।

বৈষম্য কমিয়ে আনার অর্থ কেবল শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে কিংবা কর্মক্ষেত্রে নারীর উপস্থিতি নিশ্চিত করা নয়, বরং নারী–পুরুষসহ সবার জন্য এমন পরিবেশ নিশ্চিত করা, যেখানে সবাই একই রকম সুযোগ-সুবিধার মধ্যে বসবাস করে নির্ভয়ে, প্রাণের আনন্দে বেড়ে উঠবে আর এগিয়ে যাবে। সেই রকম বাংলাদেশ আমরা কি কখনো দেখে যেতে পারব?

মাত্র একটি ঘণ্টার মধ্যে তিনটি ঘটনা ও পরিস্থিতি রীতিমতো অসুস্থ করে তুলল আমাকে। অথচ পুরো বিপণিবিতানে নারী ক্রেতার অভাব নেই। পুরুষ ক্রেতার বিপরীতে প্রায় সমানসংখ্যক নারীর উপস্থিতি আছে সেখানে।

ভাবছিলাম, এতটা প্রতিহিংসা, ঘৃণা আর কদর্যতা নিয়ে বসবাসকারী এই পুরুষদের মাঝে কতটা নিরাপদ নারী? মানসিকভাবে দারুণ আহত ও ক্লান্ত আমি নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে সেখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ডেকে পাঠালাম। কাজটি মোটেই সহজ ছিল না আমার জন্য। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর একজন কর্মকর্তা এলে তাঁকে সংক্ষেপে আমার উদ্বেগের কথা জানালাম।

শুধু তা–ই নয়, আমার প্রথম অভিজ্ঞতার ব্যাপারে অভিযোগ জানিয়ে এর প্রতিকার চাইলাম। তিনি আমাকে প্রতিশ্রুতি দিলেন যে ঘটনাটি তাঁরা তদন্ত করবেন এবং এর অগ্রগতি আমাকে জানাবেন। অবশ্য তিনি তাঁর কথা রেখেছিলেন। ঘটনার ঠিক পরদিনই আমাকে জানানো হয়, আমার প্রতি বিরূপ মন্তব্যকারী সেই বিক্রেতাকে কঠোরভাবে শাসন করা হয়েছে এবং ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে, সে ব্যাপারে তাঁকে মৌখিকভাবে সতর্ক করা হয়েছে। তবে এ ধরনের মৌখিক সতর্কীকরণ আদৌ কোনো কাজ করে বলে আমার মনে হয় না। তাই আমি আশ্বস্ত হতে পারিনি, কিন্তু মেনে নিতে হয়েছে।

এভাবে প্রতিদিন ছেড়ে দিয়ে, সয়ে গিয়ে, উপেক্ষা করে, অপমানে জর্জরিত হয়েই নারীদের পথ চলতে হয়। এই পথচলা খুব অপমানের, কষ্টের আর ক্লান্তির। তবু পথ চলতে হয়। অন্তবিহীন পথে ক্লান্তির বোঝা নিয়েই একটি জীবন পাড়ি দিতে হয় আমাদের। অথচ কোন অপরাধে আমাদের এই অবহেলা, অসম্মান আর অপমান বয়ে বেড়াতে হয়, তার কোনো সদুত্তর নেই। অপরাধের পরিসংখ্যান বলে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, চুরি, ডাকাতি, অপহরণ, অর্থ আত্মসাৎ, ঘুষ, দুর্নীতিসহ পৃথিবীর যাবতীয় অপরাধের সিংহভাগ সংঘটিত হয় পুরুষের দ্বারা।

অথচ এসব জানার পরও পুরুষ পুরুষকে ঘৃণা করে না। পুরুষের যাবতীয় ঘৃণা যেন নারীর জন্য তুলে রাখা, যে নারী তাঁকে জন্ম দেন, স্নেহ–মমতা দিয়ে আগলে রাখেন। কিছু করে না–করেও হাজারো অপরাধে অপরাধী নারী। আর নারীর অপরাধ খুঁজে পাওয়া গেলে তো কথাই নেই। নারীর কথাবার্তা, পোশাক, চলন-বলন—সবকিছু মূল্যায়নের জন্য নম্বরপত্র হাতে প্রতিমুহূর্তে তৈরি থাকে আমাদের সমাজ। এমনকি পুরুষ দ্বারা সংঘটিত অপরাধকে আড়াল করতেও নারীর সম্পৃক্ততা খুঁজে বের করার জন্য চলে জোর তৎপরতা। এই চেষ্টা একবার সফল হলে নিমেষেই পুরুষের অপরাধটি লঘু হয়ে যায়।

নারী বা মেয়েদের প্রতি ঘৃণা কিংবা অবজ্ঞা করার এই প্রবণতাকে ‘মিসোজনি’ বলে। এটি এমন একটি চর্চা, যা পুরুষের তুলনায় নারীকে নিম্ন সামাজিক মর্যাদা দেয় এবং পুরুষতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখে। জানি না সর্বত্র মিসোজনির চর্চা দেখে বড় হতে থাকা প্রজন্মকে আমরা কীভাবে আগলে রাখব?

এই দেশে মেয়েরা বড় হচ্ছে প্রতিমুহূর্তে নির্যাতিত হওয়ার ভয় নিয়ে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে; আর অন্যদিকে ছেলেরা নির্যাতক হয়ে ওঠার আত্মবিশ্বাস নিয়ে বড় হচ্ছে। ব্যক্তিপর্যায়ে সচেতন হয়েও অনেক ক্ষেত্রেই আমরা ব্যর্থ হচ্ছি আমাদের ঘরের ছেলেদের প্রচলিত অর্থে ‘পুরুষ’ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া থেকে বাঁচাতে। পারছি না নারী আর পুরুষের মধ্যকার বৈষম্যকে কমিয়ে আনতে।

বৈষম্য কমিয়ে আনার অর্থ কেবল শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে কিংবা কর্মক্ষেত্রে নারীর উপস্থিতি নিশ্চিত করা নয়, বরং নারী–পুরুষসহ সবার জন্য এমন পরিবেশ নিশ্চিত করা, যেখানে সবাই একই রকম সুযোগ-সুবিধার মধ্যে বসবাস করে নির্ভয়ে, প্রাণের আনন্দে বেড়ে উঠবে আর এগিয়ে যাবে। সেই রকম বাংলাদেশ আমরা কি কখনো দেখে যেতে পারব?

নিশাত সুলতানা লেখক ও উন্নয়নকর্মী
[email protected]

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন শ চ ত কর আম দ র র জন য অপর ধ ই রকম

এছাড়াও পড়ুন:

সংস্কার দ্রুত এগিয়ে নেওয়ার তাগিদ প্রধান উপদেষ্টার

আগামী ডিসেম্বর থেকে জুন ২০২৬ এর মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের লক্ষ্য নিয়ে সংস্কার কার্যক্রম দ্রুত এগিয়ে নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ ইউনূস। 

শনিবার বিকেলে ঐকমত্য কমিশনের দুই সদস্যের সঙ্গে বৈঠকে তিনি এ তাগিদ দেন। প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি প্রফেসর আলী রীয়াজ এবং সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য গঠন) মনির হায়দার এ সময় উপস্থিত ছিলেন। 

বৈঠকে প্রফেসর আলী রীয়াজ ও ড. বদিউল আলম মজুমদার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রমের অগ্রগতি সম্পর্কে কমিশনের চেয়ারম্যানকে অবহিত করেন। তারা জানান, বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পৃথকভাবে আলোচনা চলমান। শনিবার পর্যন্ত মোট ৮টি দলের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। আগামী বৃহস্পতিবার বিএনপির সঙ্গে আলোচনার সময়সূচি নির্ধারণ করা আছে। 

তারা আরও জানান, সংস্কার কার্যক্রমের বিষয়ে জনমত যাচাই এবং সে বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।
 
এ সময় কমিশনের সভাপতি ড. ইউনূস আগামী ডিসেম্বর মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্য নিয়ে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা তথা সামগ্রিক সংস্কার প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার তাগিদ দেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ