ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষার দেশ বিনির্মাণে বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্রের সংস্কার অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী দেশের সিংহভাগ মানুষ সংস্কারের পক্ষে। দেশ পুনর্গঠনের লক্ষ্যে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে দেশের পুলিশ, প্রশাসন, আইন, বিচার, আর্থিক খাত, নির্বাচন, গণমাধ্যম প্রভৃতি ক্ষেত্র সংস্কারের উদ্দেশ্যে কমিশন গঠন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বেশির ভাগ কমিশন তাদের প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে এগুলোর ওপর ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়েছে। সেই কমিশন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের উদ্দেশ্য হচ্ছে সব রাজনৈতিক দল ও সমাজের নানা পেশার মানুষের মতামত নিয়ে একটি জুলাই-আগস্ট চার্টার্ড তৈরি করা; পরবর্তীকালে রাজনৈতিক সরকার এর পূর্ণ বাস্তবায়ন করবে এবং মেনে চলবে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশীজনের কাছ থেকে কখনও প্রকাশ্যে আবার কখনও অপ্রকাশ্যে এবং নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে চলমান সংস্কার উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। যেমন সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া, এটি করার অধিকার শুধু রাজনৈতিক সরকারের। সুতরাং আগে নির্বাচন দিতে হবে। কোনো কোনো মহল বলছে, যারা সংস্কার কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত তারা দেশের নাগরিক নন। ফলে তাদের প্রস্তাবকৃত সংস্কার মানা হবে না। আবার কেউ কেউ বলছেন, সংস্কারের নামে নির্বাচন পেছানোর পাঁয়তারা করা হচ্ছে। দেশের জনগণ তা মানবে না, দ্রুত জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে। আজ এই লেখায় মূলত আলোচনা করতে চেষ্টা করব রাষ্ট্র সংস্কারের সুফলভোগী মূলত কে বা কারা। একই সঙ্গে দেখতে চেষ্টা করব চলমান সংস্কার কার্যক্রমের প্রধান প্রধান অংশীজন কারা এবং তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় কী কী? 


প্রথম কথা হলো, রাষ্ট্র সংস্কারের প্রথম এবং প্রধান সুবিধাভোগী এ দেশের সাধারণ জনগণ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কে এই সাধারণ জনগণ? সেই জন সাধারণ জনগণ, যারা ক্ষেত-খামারে, অফিসে, শিল্পকারখানায়, জলে ও স্থলে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। কোনো রাজনৈতিক দলের লাঠিয়াল বাহিনীর কাজ করেন না। তারা রাষ্ট্রের কাছ থেকে অতিরিক্ত এবং ব্যক্তিগত কোনো সুযোগ-সুবিধা প্রত্যাশা করেন না। তারা যা প্রত্যাশা করেন তা হলো, তাদের উৎপাদিত ফসল ও শ্রমের ন্যায্য মূল্য, মানুষ হিসেবে যথাযথ সম্মান, নিজস্ব মতামত ও ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার, নিজ নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা, সন্তানের শিক্ষার সুযোগ, স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা। 


অন্য যেসব অংশীজন রয়েছে, তার মধ্যে আছে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, বিভিন্ন ব্যবসায়ী সমিতি, পরিবহন সমিতি, সংঘ, ক্লাব, পেশাজীবী সংগঠন ইত্যাদি। এদের আবার নিজস্ব সুযোগ-সুবিধার আলোকে রাষ্ট্রকে দেখার এবং ব্যবহারের নজির রয়েছে। মূলত রাষ্ট্র সংস্কারের প্রথম বাধাগুলো এখান থেকেই আসছে। প্রথমেই আলোচনা করা যাক, রাজনৈতিক দলের দৃষ্টিতে তারা কতটুকু রাষ্ট্র সংস্কারের পক্ষে? প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব দর্শন ও কর্মপরিকল্পনা থাকে। দলগুলো রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার আগে মুখে মুখে জনগণের কথা বললেও ক্ষমতায় যাওয়ার পর রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী হয়ে ওঠেন একেকজন একেকটি এলাকার প্রধান। তাঁর কথাই আইন। তিনি যা বলবেন এলাকার লোক তা মানতে বাধ্য। না মানলে নানা মাত্রায় হামলা, মামলা ও জেল-জুলুম নেমে আসে। অন্তত স্বাধীনতা পরবর্তী বছরগুলো থেকে সর্বশেষ জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের আগের অভিজ্ঞতার আলোকে এটা নিশ্চিত করে বলাই যায়। মূলত ব্যক্তিগত এবং গোষ্ঠীস্বার্থের কারণে দলগুলো রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার পর তাদের আচরণ জনমতের বিরুদ্ধে যেতে থাকে। অন্যদিকে দলগুলোর ভেতরে আর গণতান্ত্রিক চর্চা না হওয়াও একটি কারণ। 


অন্য যেসব অংশীজন রয়েছে যেমন– বিভিন্ন ব্যবসায়ী সমিতি বা সংঘ, তারাও সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিজের ব্যবসায়ী স্বার্থসিদ্ধির জন্য সরকারি দলের লেবাসে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। দলগুলোও তাদের সহযোগিতা করে। কারণ এরাই দলের ফান্ডে যত চাঁদা তার সিংহভাগ সরবরাহ করেন। ফলে ব্যবসায়ীরা সরকারের কাছ থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়ে জনগণের পকেট কেটে তা দেশে-বিদেশে পাচার করে আরাম-আয়েশে জীবন কাটান। রাষ্ট্র সংস্কারের ফলে যদি কেউ বর্তমানে যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন সেগুলো কমে যায় বা প্রশ্নের মুখে পড়ে তাহলে সেই সংস্কারের পক্ষে কেন তিনি দাঁড়াবেন! সুতরাং বাধা এখান থেকেও আসছে– হোক তা প্রকাশ্যে অথবা অপ্রকাশ্যে।

আরও একটি অংশীজন হলো প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তারা তো রাষ্ট্রের কর্মচারী। তারা কেন রাষ্ট্র সংস্কারের বিরোধী হবেন? হওয়ার নানা কারণ রয়েছে। প্রথমত, তারা রাষ্ট্রের কর্মচারী ও জনগণের করের টাকায় তাদের বেতন-ভাতা হয় এবং তাদের প্রধান কাজ জনগণকে সেবা দেওয়া– কথাটা তাদের মাথায় নেই। তারা জনগণের সেবক না হয়ে ইতোমধ্যে জনগণের কর্তারূপে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। তাই যেখানে রাষ্ট্রের একজন কর্মচারী হয়ে এ দেশের প্রত্যেক মানুষকে স্যার বলার কথা, কিন্তু ঘটনা ঘটেছে উল্টো; জনগণকেই তারই টাকায় যাঁর বেতন-ভাতা হয়, তাঁকে স্যার বলতে বাধ্য হতে হয়। রাজনীতিতে যেমন জবাবদিহির অভাব ঘটেছে, তেমনি সরকারি চাকরির ক্ষেত্রও অনেকটা জবাবদিহির বাইরে চলে গেছে। ফলে সমাজে দুর্নীতি বেড়েছে। ভন্ড রাজনীতিক, অসৎ ব্যবসায়ীদের মতো দেশের অর্থ পাচার করে সরকারি কর্মচারীদেরও বিদেশের বেগমপল্লিতে বাড়ি-গাড়ির তথ্য বেরিয়ে আসছে।


এখন রাষ্ট্র সংস্কারের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো দেশ থেকে দুর্নীতি কমানো ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। সত্যি সত্যিই যদি রাষ্ট্র সেদিকে অগ্রসর হয়, তাহলে যারা এতদিন অনৈতিক সুবিধা নিয়ে আসছেন, তাদের সেই সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে এবং জবাবদিহির মধ্যে পড়তে হবে। কে চায় তাঁর সোনার সংসারে এমন আগুনের তাপ এসে লাগুক! সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই তারা এসব সংস্কার উদ্যোগে সহযোগিতা করবেন না, এটা পরিষ্কার। ইতোমধ্যে কিছু ক্ষেত্রে সেই আলামত দেখাও গিয়েছে। পুলিশ কাজ করছে না ঠিকমতো, প্রশাসনে অস্থিরতা বিরাজ করছে, সরাকারি নির্দেশ যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে না। মোট প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের মধ্যে যে ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধার সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে, তা প্রশ্নের মুখে পড়বে চলমান সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়িত হলে। তাই এই সংস্কারে তাদের সহযোগিতা খুব যে পাওয়া যাবে তা আশা করা যায় না।


তাহলে দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, বিভিন্ন সমিতি, সংঘ, পেশাজীবী সংগঠন সবাই সংগঠিত এবং অনৈতিক সুবিধা নিয়ে আরামের সাম্রাজ্যে বসবাস করছে। তারা কোনো কালে জনগণের সুযোগ-সুবিধার কথা বিবেচনা করে বিশেষ কিছু করেছেন এমন নজির খুব কম। এমন পরিস্থিতিতে দেশের চলমান সংস্কার উদ্যোগে তারা পরিপূর্ণ সহযোগিতা করবেন এমনটা আশা করা ভুল। সুতরাং এ জাতির সামনে কি কোনো মুক্তির পথ নেই? কেউ কি নেই, যে এ জাতির মুক্তির ত্রাতা হয়ে উঠতে পারেন। হয়তো আছেন অথবা নেই। এর জন্য একটি শক্তিশালী জনগণকেন্দ্রিক রাজনৈতিক শক্তিই পারে এ দেশের সাধারণ মানুষের মুক্তির পথ খুলে দিতে। কিন্তু সেই রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা দল কোথায়? আপাতত অপেক্ষা ছাড়া ভাগ্যহত এ জাতির সামনে দ্বিতীয় বিকল্প কি দেখা যাচ্ছে?

মো.

সাইফুজ্জামান: শিক্ষাবিষয়ক উন্নয়নকর্মী
shakdip@gmail.com 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন ত চলম ন স স ক র সরক র র ব যবস য় জনগণ র অ শ জন প রথম দলগ ল

এছাড়াও পড়ুন:

স্বাধীনতা কি তবে ছিনতাই হয়ে গেছে

অনেকেই মনে করেন যে আমাদের স্বাধীনতা ছিনতাই হয়ে গেছে। মনে করাটা যে একেবারে অযৌক্তিক তাও বলবার উপায় নেই। মুক্তি তো পরের কথা, এমনকি স্বাধীনতাও খুব একটা দৃশ্যমান নয়। বিশেষ করে সাধারণ মানুষ তো তাকে দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু ছিনতাইয়ের ঘটনা যদি ঘটেই থাকে, তবে কে করল ওই মর্মান্তিক কাজটা? কেউ কেউ বলেন, ছিনতাই করেছে মৌলবাদীরা।

দেখাই তো যাচ্ছে তাদের জঙ্গি তৎপরতা ক্রমবর্ধমান, কেউ নেই তাদের নিয়ন্ত্রণ করার মতো; হয়তো সামনে এমন সময় অপেক্ষা করছে যখন লেজই বরং কর্তৃত্ব করবে মাথার ওপর, মৌলবাদীদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে সমাজ ও রাষ্ট্রে। অন্যরা বলেন ভিন্ন কথা। তাদের মতে, স্বাধীনতা চলে গেছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর হাতে। তারা এখন হর্তাকর্তা। সাম্রাজ্যবাদীরা পুঁজিবাদী; এবং পুঁজিবাদী ও মৌলবাদীদের ভেতর একটা আপাতদূরত্ব, বলা যায় প্রায় বৈরিতা থাকলেও অন্তরে তারা পরস্পর থেকে মোটেই দূরে নয়। উভয়ে গণবিরোধী, ব্যক্তিগত মালিকানায় ও মুনাফায় বিশ্বাসী এবং প্রকৃত গণতন্ত্রের শত্রুপক্ষ। তাদের নিকটবর্তিতা প্রশ্নাতীত।

ওই যে উপলব্ধি, স্বাধীনতা ছিনতাই হয়ে যাবার, সেটা কি সঠিক? আরও একটি মৌলিক জিজ্ঞাসা অবশ্য দেখা দিয়েছে। স্বাধীনতা কি সত্যিকার অর্থে এসেছিল, নাকি যা ঘটেছিল সেটি হলো ক্ষমতার হস্তান্তর। সাতচল্লিশের ‘স্বাধীনতাটা’ যে মোটেই স্বাধীনতা ছিল না, ছিল ব্রিটিশ শাসকদের ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে-দেওয়া, ছেড়ে দিয়ে সেটি তুলে দিয়ে-যাওয়া তাদের অনুগত পাকিস্তানি শাসকশ্রেণির হাতে, তা তো আজ আর মোটেই অস্পষ্ট নয়। একাত্তরে পাকিস্তানি শাসকেরা চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। ক্ষমতা চলে এসেছে বাংলাদেশি শাসকশ্রেণির হাতে, সরাসরি না-হলেও তাকেও তো এক ধরনের ক্ষমতার হস্তান্তরই বলা চলে। ক্ষমতা যাদের কাছে যাবে বলে আশা ছিল তাদের কাছে যায়নি, যায়নি জনগণের কাছে, রয়ে গেছে ওই শ্রেণির হাতে। 

সংখ্যার হিসাবে দল যতই হোক শ্রেণি কিন্তু একটাই, শাসকশ্রেণি। ওই শাসকশ্রেণির বিভিন্ন অংশ ভিন্ন ভিন্ন নামে, নানা রকম পোশাকে, এমনকি পরস্পরবিরোধী আদর্শের আওয়াজ তুলে ক্ষমতায় আসা-যাওয়া করে। ওদের ভেতর পারস্পরিক সহনশীলতার অভাব রয়েছে, হিংস্রভাবে তারা একে অপরকে আক্রমণ করে। পারলে শেষ করে দিতে চায়। কিন্তু এদের মূল আদর্শ ও লক্ষ্য একটাই। সেটি হলো ক্ষমতায় যাওয়া এবং সেখানে টিকে থাকা; আর ক্ষমতায় থেকে তারা যা করতে চায় সেটি হলো অবাধ লুণ্ঠন এবং ক্ষমতাকে যাতে স্থায়ী করা যায় সে-ব্যবস্থা গ্রহণ। তাদের ভেতর যে লড়াইটা সেটি ওই ক্ষমতা দখল ও ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে। সেটি তাদের রাজনীতি; এবং এ বিষয়ে তো সন্দেহের কোনো সুযোগ নেই যে, ওই রাজনীতিই হচ্ছে বর্তমান  বাংলাদেশে রাজনীতির মূলধারা। বিশ্ব এখন গণমাধ্যমের (ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট) আওতাধীন।

গণমাধ্যম আসলে প্রচারমাধ্যম। বাংলাদেশের প্রচারমাধ্যম সম্পূর্ণরূপে শাসকশ্রেণির কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণের অধীনে রয়েছে; ফলে আমরা, সাধারণ মানুষেরা, প্রতিনিয়ত তাদের ঝগড়াবিবাদ তো বটেই, আরও যেটি গুরুত্বপূর্ণ সে লুণ্ঠনের আদর্শের সঙ্গে প্রত্যক্ষে-অপ্রত্যক্ষে পরিচিত হই। এই লুণ্ঠনকারীরা আমাদের বীর, তাদের বীরত্বই অনুকরণীয়।

এ দেশে কখনোই জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। একটি জনবিচ্ছিন্ন ও ক্ষুদ্র শাসকশ্রেণি দেশ শাসন করেছে। এটা ব্রিটিশ আমলে ঘটেছে, পাকিস্তান আমলেও সত্য ছিল, বাংলাদেশের কালেও মিথ্যা নয়। আগের দুই সময়ের মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভেতর যে বুদ্ধিজীবীরা ছিল, শাসকশ্রেণিকে তারা বলত, ‘তোমরা ও আমরা’; তোমরা শাসক, আমরা শাসিত। এখন মধ্যবিত্তের ছোট একটি খণ্ড শাসকশ্রেণির অংশ হয়ে গেছে, বড় খণ্ড নেমে গেছে নিচে, জনগণের কাছাকাছি। এখনকার প্রধান বুদ্ধিজীবীরা শাসকশ্রেণির সঙ্গে আছে, যদিও দলীয়ভাবে তারা বিভক্ত, রাজনৈতিক নেতাদের মতো। তারা তাই ‘তোমরা ও আমরা’ কথাটা বলতে পারে না, বলে ‘আমরা ও তোমরা’, আমরা শাসকদের সহযোগী, আর তোমরা হচ্ছো জনসাধারণ। সশব্দে বলে না, কিন্তু তাদের অবস্থান, চিন্তাধারা ও বক্তব্য ওই বিভাজনটাকে জানিয়ে দেয়। 

এই যে শাসকশ্রেণি, সেটি অখণ্ড বটে। তাদের ভেতরকার যে কলহ সেটি শরিকদের যুদ্ধ ছাড়া আর কিছুই নয়। সম্পত্তির ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে ভাইয়ে-ভাইয়ে শত্রুতা হয়, রাজনীতিকে-রাজনীতিকে লড়াই বাধবে না কেন। এই শ্রেণি নানা উপাদানে গঠিত। এদের ভেতর ব্যবসায়ী, আমলা, পেশাজীবী সবাই রয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে যেটুকু স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, তা যে এরা এনেছে তা নয়; ‘স্বাধীনতা’ এনেছে জনগণ, একবার ভোট দিয়ে; দ্বিতীয়বার ভোট এবং রক্ত দুটোর বিনিময়ে।

শাসকশ্রেণির একাংশ তো স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরুদ্ধে ছিল; কেউ কেউ প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেছে। ঘোরতর শত্রুতা করেছে জামায়াতিরা। পরে তারা ক্ষমতার একাংশ হয়ে গেছে। এই যে আপাত-অদ্ভুত ঘটনা, এর ব্যাখ্যা কী? ব্যাখ্যা অন্য কিছু নয়, সেটি এই যে, শ্রেণিগতভাবে এ মৌলবাদীরাও শাসকশ্রেণির বাইরে নয়, ভেতরেই আছে। আওয়ামী লীগ এদের সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করেছে, তাতে কোনো অসুবিধা হয়নি, যদিও ইতিহাসের নির্দেশ মানলে দু’পক্ষের থাকার কথা ছিল পরস্পরবিরোধী অবস্থানে। বিএনপির তো কথাই নেই, তারা তো জামায়াতকে কোলে টেনে নিয়েছে। দল সত্য নয়, সত্য হচ্ছে শ্রেণি। দল বা ইতিহাস দিয়ে লোক চেনা যায় না, খুব সহজে চেনা যায় শ্রেণিগত পরিচয় দিয়ে।

আন্দোলন সংগ্রাম যা করবার তা মূলত জনগণকে করতে হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে এটা সত্য ছিল, পাকিস্তান আমলেও সত্য থেকেছে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর নির্বাচন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ সব কিছুতে জনগণ ছিল; কেবল ছিল না, তাদের কারণে ওইসব ঘটনায় সাফল্য এসেছে, দুর্ভোগ যা তাদের পোহাতে হয়েছে। কিন্তু সংগ্রামের যা অর্জন সেটি তাদের ঘরে যায়নি, পৌঁছে গেছে এখন যারা শাসক অর্থাৎ জনগণের শত্রু তাদের হাতে, তারাই ক্রমাগত হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে, বিচ্ছিন্ন হয়েছে জনগণ থেকে এবং নিপীড়ন চালিয়েছে ওই জনগণের ওপরই।

ব্রিটিশ শাসনের কালে এই শাসকশ্রেণির যাত্রার সূত্রপাত ঘটে। সে সময়ে তারা উঠতি শ্রেণি, তারা চাইছিল ব্রিটিশ যখন চলে যাবে তখন তাদের হাতে যেন ক্ষমতা দিয়ে যায়; ক্ষমতা নিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব ছিল, যে দ্বন্দ্ব রূপ নিয়েছিল নির্মম সাম্প্রদায়িকতার। জনগণের ভেতর সাম্প্রদায়িকতা ছিল না, প্রতিবেশীকে তারা প্রতিবেশী হিসেবে দেখত, শাসনক্ষমতা পাবার জন্য লোলুপ শ্রেণিটি সাধারণ মানুষকে আত্মঘাতী সংঘর্ষে লিপ্ত করেছে। দুর্ভোগ যা সেটা সাধারণ মানুষকে ভোগ করতে হয়েছে, আর দুই দিকের দুই বিত্তবান শ্রেণি শাসনক্ষমতা পেয়ে নিজেদের বিত্তবেসাত বাড়িয়ে তুলেছে।

পাকিস্তান আমলে শাসনক্ষমতা ছিল অবাঙালিদের হাতে; বাঙালি মধ্যবিত্ত কিছুটা সুযোগ-সুবিধা পেল ঠিকই, কিন্তু অবাঙালিদের তুলনায় সে প্রাপ্তিটা ছিল সামান্য; অবধারিত রূপেই একটা দ্বন্দ্ব বেধে উঠল দু’পক্ষের মধ্যে। জনগণের অসন্তোষটা ছিল আরও বড়; তারা কিছুই পায়নি, তারা ছিল বিক্ষুব্ধ। বাঙালি মধ্যবিত্ত চেয়েছে স্বায়ত্তশাসন, জনগণ চেয়েছে মুক্তি। কিন্তু জনগণের নিজস্ব রাজনৈতিক দল ছিল না। তারা ওই স্বায়ত্তশাসনকামী জাতীয়তাবাদীদের পেছনে যেতে বাধ্য হয়েছে। এবং তাদের কারণে অবাঙালি শাসকেরা এই দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছে। যুদ্ধটা ছিল জনযুদ্ধ।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ‘জনগণ নির্বাচনের জন্য মুখিয়ে আছে’
  • ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে উত্তাল ঢাবি
  • গাজায় নির্যাতিতদের পক্ষে নোবিপ্রবি শিক্ষার্থীদের ক্লাস-পরীক্ষা বর
  • ঢাকা-দিল্লির পদক্ষেপই ঠিক করবে সম্পর্কের গতিপথ
  • রাজনৈতিক দলে সংস্কার যে কারণে জরুরি
  • ‘‘মিডিয়া ট্রায়াল বন্ধ করে দেন, জনগণ আস্ত একটা মিডিয়া’’
  • চলতি মাসেই কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামছে বিএনপি
  • শেখ হাসিনাকে ফেরত চাইল ঢাকা, দিল্লি চুপ
  • স্বাধীনতা কি তবে ছিনতাই হয়ে গেছে