রোহিঙ্গারা কি এবার দেশে ফিরতে পারবেন
Published: 7th, April 2025 GMT
শরণার্থী সমস্যা, বিশ্বজুড়ে একটি জটিল সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, সমগ্র বিশ্বে প্রায় ৪৩ দশমিক ৪ মিলিয়ন শরণার্থী নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রহীন ও বিতাড়িত একটি জীবন যাপন করে আসছে। এখানে উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় হলো, বিশ্বজুড়ে নানাভাবে বাস্তুচ্যুত শরণার্থীদের আশ্রয় হয়েছে তার দেশের আশপাশে থাকা নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে। এই
প্রবণতার কারণে শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া নিম্ন আয়ের দেশগুলো নিজেদের উন্নয়ন সমস্যা মোকাবিলার পাশাপাশি শরণার্থীদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনায় নানাভাবে হিমশিম খাচ্ছে।
শরণার্থীদের পরিচিতির রাজনীতির কারণেও শরণার্থীদের আরও বেশি অবহেলিত ও বৈষম্যপূর্ণ জীবন যাপন করতে হয়। এর সঙ্গে আরও যুক্ত হয় আন্তর্জাতিক মহলের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ। যেমন ইউরোপের ইউক্রেনের বাস্তুচ্যুত শরণার্থীদের সারা বিশ্ব যে দৃষ্টিতে এবং গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে; বাংলাদেশ, মধ্যপ্রাচ্য কিংবা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বসবাসরত শরণার্থীদের সেভাবে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে না। যে কারণে এসব দেশে শরণার্থীদের নানা রকম সমস্যার মধ্যে মানবেতর জীবন যাপন করতে হয়। সেই জায়গায় প্রত্যাবাসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আরও অনেক দূরের বিষয় হিসেবে দেখা যায়।
এমন একটি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের ষষ্ঠ বিমসটেকের বৈঠকের সময় মিয়ানমার থেকে একটি ইতিবাচক সাড়া আমরা দেখতে পাই, যা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য একটি আশার সঞ্চার করেছে। এই আলোচনায় মিয়ানমারের উপপ্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী উ থান শিউ প্রাথমিকভাবে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন, যাদের মিয়ানমার নিজ দেশের বাসিন্দা বলে, তারা যাচাই করে নিশ্চিত হতে পেরেছে। তিনি আরও বলেন যে দ্রুততার সঙ্গে বাকি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভেরিফিকেশন করা হবে।
মিয়ানমার সরকারের এই ইতিবাচক বক্তব্য একটি অন্যতম মাইলফলক বলে আমরা মনে করতে পারি। যদিও ২০১৮ সালেই মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনবিষয়ক একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়, যার বাস্তবায়ন আমরা কখনোই দেখতে পাইনি। কিন্তু এবারের পটভূমি ভিন্ন হবে, সেটাই আমরা আশা করি।
বিগত সরকারের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমস্যা মোকাবিলায়, বিশেষ করে প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে নজিরবিহীন ব্যর্থতার মধ্যে মিয়ানমারের উপপ্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি-সংক্রান্ত হাই রিপ্রেজেন্টেটিভের প্রতিনিধির যৌথ বিবৃতি আমাদের আশাবাদী করে তোলে। এর পেছনে হয়তো গত মাসে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের বাংলাদেশে ভ্রমণ এবং আমাদের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের ইফতার ও সভার একটি ভূমিকা পালন করে থাকতে পারে।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে এসব জটিল বিষয় মাথায় রেখেই আমাদের পরবর্তী পরিকল্পনা করতে হবে। কেননা, মিয়ানমার রাজি হলেও এখানে আরাকান আর্মিসহ আরও যতগুলো ফ্যাক্টরের কথা আলোচনা করা হলো, সেগুলো সঠিকভাবে কাজ না করলে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন অধরাই থেকে যাবে।আমাদের মনে আছে, সেই সভায় আমাদের প্রধান উপদেষ্টা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ‘মেহমান’ হিসেবে উল্লেখ করে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন, যেন রোহিঙ্গারা আগামী ঈদ তাদের নিজ দেশে করতে পারে। এমন একটি পরিস্থিতিতে মিয়ানমার সরকারের রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে এমন সারা বেশ ইতিবাচক। হতে পারে জাতিসংঘ মহাসচিবের এ ভ্রমণ একটি বড় ভূমিকা রেখেছে এই সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে।
মিয়ানমারের এই বক্তব্য একটি বড় কারণে বেশ ইতিবাচক এবং গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হলো যেহেতু মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের তাদের দেশের বাসিন্দা হিসেবে মেনে নিচ্ছে, এর মাধ্যমে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে একটি আনুষ্ঠানিক নিশ্চয়তা পাবে। মিয়ানমার সরকারের এই বক্তব্য ইতিবাচক হলেও এর বাস্তবায়ন অনেকগুলো ভূরাজনৈতিক জটিল বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল।
এখন প্রশ্ন হলো, এই ইতিবাচক প্রতিশ্রুতির মধ্য দিয়ে আমরা কতটা নিশ্চিত হতে পারব যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অন্তত এই ১ লাখ ৮০ হাজার তাদের নিজ দেশে ফেরত যেতে পারবে। সেই বিষয়গুলো মাথায় রেখে বাংলাদেশ সরকারকে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের কিছু বিষয়য়ের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।
প্রথমত, আরাকানে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাবিষয়ক সিদ্ধান্ত কতটা প্রয়োগযোগ্য বা বাস্তবায়নযোগ্য হবে, সেটা একটি বড় প্রশ্ন। কেননা, মিয়ানমারের সাম্প্রতিক যুদ্ধ পরিস্থিতি এবং রাখাইনে আরাকান আর্মির একচ্ছত্র আধিপত্য, এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে দেবে কি না, সে বিষয়ের সুরাহা প্রয়োজন। যদিও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে আরাকান আর্মির সঙ্গে তারা রোহিঙ্গা বিষয় নিয়ে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে আসছে। যেখানে আরাকান আর্মিও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে।
তবে এটি ভুলে গেলে চলবে না যে মিয়ানমার জান্তার সঙ্গে আরাকান আর্মির যুদ্ধাবস্থার কারণে রাখাইন মূলত এখন আরাকান আর্মির দখলে। সেই জায়গা থেকে আরাকান আর্মি মিয়ানমারের জান্তার কথা কেন বা কতটা শুনবে, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। একই সঙ্গে আমাদের এ-ও ভেবে দেখা দরকার যে এটি মিয়ানমারের কোনো রাজনৈতিক চাল কি না? তবে আমি নিশ্চিত, আমাদের নীতিনির্ধারকদের মাথায়ও এই বিষয় রয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আরাকান আর্মি এবং মিয়ানমারের জান্তা শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে নিয়মিত সমন্বয় সাধন একটি অন্যতম পদক্ষেপ হিসেবে আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে।
দ্বিতীয়ত, আমরা বেশ অনেকবারই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে মিয়ানমারের এ ধরনের ইতিবাচক আশ্বাস পেয়েছি, কিন্তু তার প্রয়োগ আমরা দেখতে পারিনি। যে কারণে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় দেওয়ার পর একজন রোহিঙ্গাও এখন পর্যন্ত নিজ দেশে ফেরত যেতে পারেনি। মিয়ানমার সরকারের এ ধরনের আশ্বাসকে আমরা কতটা ইতিবাচকভাবে দেখব, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। কেননা, আমাদের অবস্থা এখন ঘরপোড়া গরু যেমন সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পায়, ঠিক তেমন। তারপরও এই প্রচেষ্টা এবং আশ্বাস রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিজ দেশে ফেরত যাওয়ার ক্ষেত্রে আশাবাদী হতে শেখায়।
তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ফেরত গেলে তারা সেখানে কতটা নিরাপদ জীবন যাপন করতে পারবে, সেটি বেশ ভালোভাবে ভেবে দেখতে হবে। মিয়ানমারের বিদ্যমান যুদ্ধ পরিস্থিতি, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য একটি নিরাপদ আবাসস্থল গড়ে তুলতে দেবে কি না, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। কেননা, মিয়ানমারে বসবাসরত রোহিঙ্গারাও নানাবিধ নিরাপত্তাঝুঁকিতে মানবেতর জীবন যাপন করে আসছে। মিয়ানমারে একটি নিরাপদ ব্যবস্থা গড়ে তোলার বিদ্যমান আলোচনা জারি রাখাও গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এটি ভলান্টারি বা স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনের একটি পূর্বশর্ত।
আমরা জানি, বিগত দশকগুলোতে ঘটে যাওয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন স্বেচ্ছায় এবং জাতিসংঘের সব নিয়ম মেনে হয়েছে কি না, এ বিষয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। এর সঙ্গে রোহিঙ্গাদের পূর্ণাঙ্গ নাগরিকত্বের বিষয়টাকে যেন গুরুত্ব দেওয়া হয়, সে বিষয়গুলোর দিকেও পরবর্তী ধাপে নজর দিতে হবে। তাই নিরাপত্তাঝুঁকি ও নাগরিকত্ব বিষয়গুলোর সঠিক দিকনির্দেশনা না থাকলে প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া ফলপ্রসূ না হওয়ার আশঙ্কা রয়ে যায়।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে এসব জটিল বিষয় মাথায় রেখেই আমাদের পরবর্তী পরিকল্পনা করতে হবে। কেননা, মিয়ানমার রাজি হলেও এখানে আরাকান আর্মিসহ আরও যতগুলো ফ্যাক্টরের কথা আলোচনা করা হলো, সেগুলো সঠিকভাবে কাজ না করলে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন অধরাই থেকে যাবে।
● বুলবুল সিদ্দিকী নৃবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আর ক ন আর ম র শরণ র থ দ র স ল দ শ সরক র জনগ ষ ঠ র আম দ র প পর স থ ত পরবর ত র জন ত য একট সমস য ন করত
এছাড়াও পড়ুন:
রেকর্ড হয়েছে, জানতেনই না পারভেজ
সব সংস্করণ মিলিয়েই বাংলাদেশের সবচেয়ে দ্রুততম ফিফটি এখন পারভেজ হোসেনের। কাল বিকেএসপিতে শাইনপুকুরের বিপক্ষে আবাহনীর হয়ে খেলতে নেমে ১৫ বলে ফিফটি করেছেন তিনি। শুধু লিস্ট ‘এ’ নয়, ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ টি–টোয়েন্টিতেও বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে দ্রুততম ফিফটি এখন পারভেজের।
ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ টি-টোয়েন্টিতে এর আগে দ্রুততম ফিফটি ছিল শুভাগত হোমের, ২০১৯ সালে শাইনপুকুরের হয়ে মোহামেডানের বিপক্ষে যিনি ফিফটি করেছিলেন ১৬ বলে।
এমন একটি রেকর্ডের কথা ব্যাটিংয়ের সময় নাকি জানতেনই না পারভেজ। মুঠোফোনে প্রথম আলোকে পারভেজ আজ বলছিলেন, ‘আমি আসলে পরে শুনেছি। যখন ব্যাটিং করেছি, তখন জানতামই না।’
৪ চার ও ৬ ছক্কায় ২৩ বলে ৬১ রান করে শেষ পর্যন্ত অপরাজিত থেকে দলকে ১০ উইকেটের জয় এনে দিয়েছেন পারভেজ। তবে সব ছাপিয়ে গেছে তাঁর রেকর্ড। এমন এক কীর্তি গড়তে পেরে অনুভূতি কেমন? পারভেজের উত্তর, ‘এ রকম কোনো কিছু হলে তো সবারই ভালো লাগে। আমারও একই। তবে আমার রেকর্ড খুব একটা দেখার অভ্যাস নেই।’
১৫ বলে ফিফটি করেছেন পারভেজ