২২ আগস্ট ১৯১১, মঙ্গলবার। ফ্রান্সের বিখ্যাত ল্যুভর মিউজিয়াম বা চিত্রশালা। ৭,৮২,৯১০ বর্গফুটের এই চিত্রশালায় রয়েছে বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করা ৩৮ হাজার বিখ্যাত আর প্রাচীন শিল্পকর্ম ও ভাস্কর্য।

সোমবার ছিল চিত্রশালার সাপ্তাহিক ছুটি। স্বভাবতই মঙ্গলবারে দর্শক উপস্থিতি ছিল বেশি। সাধারণত চিত্রশালার ফটক সকাল নয়টায় খোলার আগেই একদল পেশাদার শিল্পীর আগমন ঘটে। তাঁরা বিক্রির জন্য চিত্রশালায় থাকা বিখ্যাত ক্ল্যাসিক চিত্রকর্মগুলোর নকল তৈরি করেন। এ সময় চিত্রকর্মের পুনর্মুদ্রণ বা রিপ্রোডাকশনের কোনো উন্নত উপায় না থাকায় বিশ্বের প্রায় সব চিত্রশালায় বিখ্যাত চিত্রকর্মগুলো নকল করে বিক্রি করা আইনসিদ্ধ ছিল। এসব নকল ছবির মূল খদ্দের ছিলেন সদ্য ধনী হওয়া আমেরিকানরা। আমেরিকা থেকে প্যারিসে আসা অনেক পর্যটক ফেরত যাওয়ার সময় আভিজাত্য প্রমাণের জন্য বিখ্যাত চিত্রকর্মের দু-একটা নকল নিয়ে যেতেন। এ ছাড়া বনেদি ও শৌখিন ইউরোপীয়দের কাছেও নকল ছবির কদর ছিল। বিখ্যাত চিত্রকর্মগুলোর মধ্যে মুরিল্লো, রাফায়েল, তিশিয়ান, রুবেন্স, রেনোয়ারের ছবির চাহিদা ছিল বেশি। তবে সবচেয়ে বেশি চাহিদা ছিল লেওনার্দো দা ভিঞ্চির ‘মোনালিসা’র। চিত্রশালায় আগত দর্শকদেরও বেশির ভাগের আগ্রহ থাকে মোনালিসার প্রতি। ফলে সেখানে ভিড়ও থাকে বেশি।

চিত্রশালার দ্বিতীয় তলায় সালোঁ কেয়ার গ্যালারিতে মোনালিসাকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। সালোঁ কেয়ার দৈর্ঘ্যে ২৩ মিটার আর প্রস্থে ৩২ মিটার। এখানে আরও কয়েকটি চিত্রকর্ম আছে। মোনালিসার দুই পাশে আছে তিশিয়ানের আঁকা ‘অ্যালেগোরি অব ম্যারেজ’ আর করেজ্জোর আঁকা ‘দ্য মিস্টিক ম্যারেজ অব সেন্ট ক্যাথরিন’।

মোনালিসা যখন নেই

লুই বেরোদ একজন পেশাদার নকলনবিশ শিল্পী। নকলনবিশ হিসেবে মধ্যবয়সী বেরোদের সুনাম ছিল। এর আগে তিনি মোনালিসাসহ বেশ কয়েকটি বিখ্যাত ছবির নকল করেছেন। প্রায় ১৫ দিন হলো বেরোদ আমেরিকা থেকে বেড়াতে আসা এক পর্যটকের সঙ্গে ভালো টাকার বিনিময়ে মোনালিসা নকলের চুক্তি হয়েছে। কাজের বায়না হিসেবে তিনি মোটা টাকাও নিয়েছেন। নকলনবিশরা চিত্রশালার দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই ভেতরে প্রবেশ করে চিত্রকর্মের সামনের ভালো স্থান বেছে নিয়ে কাজ শুরু করে দেন। দর্শকের ভিড় বাড়ার আগেই তাঁরা তাঁদের কাজ যতটা পারেন এগিয়ে নেন। বেরোদ প্রতিদিনই চিত্রশালায় সকাল সকাল হাজির হয়ে কাজটি দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করছেন। সরকারি ছুটির দিন হিসেবে রোববারে দর্শকসমাগম বেশি হয়। তাই এদিন পেশাদার শিল্পীদের কাজের সুযোগ দেওয়া হয় না। আবার সোমবার ছিল চিত্রশালার সাপ্তাহিক ছুটি। ফলে বেরোদ পরপর দুই দিন কাজ করতে পারেননি। তাই মঙ্গলবার সকাল সকাল তিনি চিত্রশালায় চলে আসেন। বলতে গেলে তিনিই সালোঁ কেয়ারে প্রথম প্রবেশ করেন।

বেরোদ গ্যালারিতে ঢুকে দেখেন যে মোনালিসা তার স্বস্থানে নেই। তিনি বেশ অবাক আর বিরক্ত হন। বেরোদ জানতেন, এ ধরনের চিত্রকর্মগুলোকে কখনো কখনো ছবি তোলার জন্য ফটো স্টুডিওতে নেওয়া হয়, আবার কখনো অন্য গ্যালারিতে বদলি করা হয়। বেরোদের আর তিন-চার দিনের কাজ বাকি আছে। কাজ শেষ করতে দেরি হলে মক্কেল থেকে বাকি টাকা পেতেও দেরি হবে। তাই বেরোদ একটু মনঃক্ষুণ্ন হলেন। মনে মনে বললেন যে তাঁর কাজের শেষবেলায় মোনালিসাকে সরানোর কি প্রয়োজন ছিল?

বিস্ময় আর বিরক্তি নিয়ে বেরোদ গ্যালারির প্রবেশমুখে থাকা নিরাপত্তাকর্মী মাক্সিমিলান আলফঁস পুপারদ্যাঁর কাছে গেলেন। মোনালিসার অনুপস্থিতির বিষয়ে প্রশ্ন করলেন তাঁকে। পুপারদ্যাঁ গ্যালারিতে ঢুকে দেখলেন, মোনালিসাকে টাঙানোর চারটি আংটা বা হুক যথাস্থানে আছে কিন্তু মোনালিসা নেই, জায়গাটা ফাঁকা। এবার বিস্ময় হওয়ার পালা পুপারদ্যাঁর। এই গ্যালারির দায়িত্ব তাঁর, এখান থেকে মোনালিসাকে সরানোর কোনো পরিকল্পনা থাকলে তাঁর অবশ্যই জানার কথা। আতঙ্কে তাঁর ঘাম বের হতে লাগল। তিনি ছুটলেন নিচতলায় ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জর্জ বেনেদেতের কার্যালয়ে। পুপারদ্যাঁ পরিচালকসহ ফিরে এলেন মোনালিসার গ্যালারিতে। মোনালিসার শূন্যস্থান দেখে বেনেদেতের চোখও ছানাবড়া। হতভম্ব বেনেদেত ছুটলেন প্যারিসের পুলিশপ্রধান লুই লেপ্যাঁর কাছে।

এদিকে দর্শক উপস্থিতি বাড়তে শুরু করেছে। মোনালিসাকে দেখতে না পেয়ে তাঁদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। কেউ কেউ উষ্মা প্রকাশ করছেন। পরিস্থিতি ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে। শত শত ডলার বা পাউন্ড খরচ করে বিদেশি দর্শকেরা এসেছেন ‘মোনালিসা’কে দেখতে, তাঁরাও অস্থির হয়ে পড়েছেন।

লেপ্যাঁ খবরটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করলেন। সঙ্গে সঙ্গেই খবরটি পৌঁছে গেল মন্ত্রীর কাছে। এরপর মন্ত্রী, সচিব, পুলিশপ্রধানসহ সবাই পৌঁছে গেলেন ল্যুভর চিত্রশালায়। শুরু হয়ে গেল লঙ্কাকাণ্ড। লেপ্যাঁ দর্শকদের চিত্রশালা ত্যাগের নির্দেশ দিলেন। দর্শকদের জানানো হলো যে চিত্রশালার পানি সরবরাহের প্রধান পাইপ ফেটে গেছে। তাই দর্শকদের দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে হবে। এরপর চিত্রশালাজুড়ে ‘মোনালিসা’কে খোঁজা শুরু হলো। শ খানেক পুলিশ আর চিত্রশালার কর্মচারীরা প্রতিটি কক্ষ তন্নতন্ন করে খুঁজতে শুরু করলেন। বাথরুম, স্টোররুম থেকে শুরু করে চিত্রশালার প্রতিটি কোনা খুঁজলেন তাঁরা। সব জিনিস ওলট–পালট করে দেখলেন। হাজারো খোঁজাখুঁজির পরেও ‘মোনালিসা’র হদিস মিলল না। নিচতলায় সিঁড়ির গোড়ায় পাওয়া গেল ‘মোনালিসা’র বুলেটপ্রুফ কাচের বাক্স আর অলংকৃত একটি ফ্রেম, যা কিনা ১৯০৯ সালে কাউন্টেস দ্য বর্ন উপহার দিয়েছিলেন। ফ্রেম আর কাচের বাক্সে সামান্যতম আঁচড় পাওয়া গেল না, একেবারেই অক্ষত। মনে হচ্ছিল মোনালিসা আলতোভাবে এগুলো থেকে বেরিয়ে গেছে। নিখোঁজ হয়ে গেল পাঁচ মিলিয়ন ডলার মূল্যের (বর্তমানের ১১৩ মিলিয়ন ডলার) ‘মোনালিসা’।

লেপ্যাঁ পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত চিত্রশালা বন্ধ ঘোষণা করলেন। ফ্রান্সের সীমান্ত বন্ধ করে দিলেন। ইউরোপ আর আমেরিকার সব বন্দরে বার্তা পৌঁছে গেল, ২০ আগস্টের পর প্যারিস থেকে ছেড়ে আসা সব জাহাজ আটক করে তল্লাশি চলাতে হবে।

বিকেল থেকে প্যারিসে থাকা স্থানীয় ও বিদেশি সাংবাদিকেরা ল্যুভরের ফটকে জমায়েত হতে শুরু করলেন। ভারপ্রাপ্ত পরিচালক হাজারটা ফোন পেলেন। জবাবে বললেন, ‘আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি যে মোনালিসা নেই।’ এরপর মোনালিসার নিরুদ্দেশের সংবাদ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গেল। প্যারিসের দৈনিক লা তেমস সন্ধ্যায় বিশেষ সংস্করণ প্রকাশ করল। হকাররা রাস্তায় রাস্তায় চিৎকার করতে থাকল, ‘মোনালিসা চলে গেছে’। প্যারিসের মোড়ে মোড়ে ভিড় জমতে থাকল। আলোচনার বস্তু একটাই, ‘মোনালিসা গেল কোথায়?’

নাটের গুরু

মার্কুইস এদুয়ার্দো দে ভেলফিয়ের্নোর (Marques Eduardo de Velfierno) জন্ম ১৮৫০ সালে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস এইরেসে। ‘মার্কুইস’ সভ্রান্ত পরিবারের পদবি। মার্কুইসের পরিবার এই পদবির অধিকারী ছিলেন না। তিনি নিজেই এই পদবি তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন সম্পন্ন কৃষিজীবী। পিতার মৃত্যুর পর ভাগে পাওয়া কৃষিজমিগুলো বিক্রি করে দিয়ে মার্কুইস ব্যবসা শুরু করেন। মার্কুইস স্বভাবগতভাবে বেশ চালাক-চতুর বা ধূর্ত ছিলেন, সময়ের আগে ভাবতে পারতেন। তিনি অত্যন্ত বিলাসী জীবন যাপন করতেন। তার অর্থের ক্ষুধা এত প্রবল ছিল যে তিনি এর জন্য যেকোনো কিছুই করতে পারতেন। ছবি বা চিত্রকর্ম কেনাবেচার মাধ্যমে তিনি ব্যবসা শুরু করেন। এরপর তিনি সাধারণ শিল্পী দিয়ে নামীদামি চিত্রকর্মের নকল তৈরি করে বিক্রি করা শুরু করেন। তাঁর ব্যবসার সুনাম দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের বড় বড় শহরে প্রচারিত হতে থাকে। সাও পাওলো, রিও ডি জেনিরো থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহর থেকে শতাব্দীপ্রাচীন ভালো ভালো ছবির নকলের জন্য অর্ডার আসতে থাকে। দিনে দিনে মার্কুইসের ব্যবসার ব্যাপক প্রসার ঘটতে থাকল, আর প্রচুর অর্থসমাগম হতে লাগল। কিছু ভালো শিল্পীকেও তিনি দলে ভেড়ালেন।

মার্কুইসের ব্যবসায় একজন দোসর ছিলেন ফরাসি শিল্পী ইভ শোদ্রাঁ। ইভ ফ্রান্সের ব্যো আর্ট একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ নেন এবং শিল্পীর সনদ পান। কিন্তু শিল্পী হিসেবে তিনি বিশেষ উন্নতি করতে পারেননি। তাঁর মধ্যে উদ্ভাবনী শক্তি বা সৃষ্টিশীলতার অভাব ছিল। তিনি শিল্পীর পেশা বদলে প্রথমে শিল্প সংরক্ষণের পেশা বেছে নেন, পরে অধিক লাভজনক হওয়ায় নিজেকে নকলনবিশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। চিত্রকর্মের নকল করার ক্ষেত্রে তিনি বেশ উন্নতি করেন। তাঁর নকল ছবির বাজারমূল্য অত্যন্ত চড়া ছিল। ইভ যেকোনো প্রাচীন ছবির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়গুলোও ভালোভাবে নকল করতে পারতেন তিনি। নতুন আঁকানো ছবির মধ্যে সুন্দরভাবে প্রাচীনত্বের ছাপ ফুটিয়ে তুলতে পারতেন। ইভের আঁকানো বা নকল করার গতিও খুব দ্রুত ছিল। সে খুব অল্প সময়ে নিখুঁত নকল ছবি তৈরি করতে পারতেন। ইভ মূলত মুরিল্লোর ছবি খুব ভালো নকল করতে পারতেন। তাঁর আঁকা মুরিল্লোর ছবি এতটা নিখুঁত হতো যে অনেকে তা মুরিল্লোর চেয়েও সুন্দর বলতেন। আর্জেন্টিনাতে ইভের সঙ্গে মার্কুইসের পরিচয় হয়। মার্কুইস ইভের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে মাঝেমধ্যে নকল ছবিকে আসল ছবি বলে বিক্রি করতেন। এভাবেই মার্কুইস আর ইভের মধ্যে একটা অশুভ মৈত্রী গড়ে উঠল।

মার্কুইস তাঁর ব্যবসাকে আরেক ধাপ এগিয়ে বৈশ্বিকরূপ দিতে চাইলেন। তিনি চিত্রশিল্পের রাজধানী প্যারিসে তাঁর ব্যবসার প্রসার ঘটাতে চাইলেন। ইভও প্যারিসে ফেরত যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। মার্কুইস ১৯০৮ সালে প্যারিসে এসে তাঁর ব্যবসা চালু করলেন। সিন নদীর তীরে তিনি তাঁর বিলাসবহুল দপ্তর তৈরি করলেন। কাজ শুরুর অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি প্যারিসেও প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলেন, আয় দু-তিন গুণ বেড়ে গেল। আপাতদৃষ্টে তাঁর কর্মকাণ্ডে মনে হয়েছিল যে বিভিন্ন চিত্রকর্মের নকল করে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় ভালো দামে বিক্রি করাই তাঁর উদ্দেশ্য। আসলে তলেতলে সে এমন কিছু করার ফন্দি করছিল, যা তাঁকে রাতারাতি কোটিপতি বানিয়ে দেবে।

বলা হতো, উনিশ শতকে ব্রিটিশরা পছন্দের যেখানে যা পেত, তা কিনে নিত, মূল্য কোনো বিষয় ছিল না। আর বিশ শতকে আমেরিকানরা সেই ভূমিকা পালন করছে। তাই মার্কুইস আমেরিকাকে লক্ষ্যবস্তু বানাল। বিখ্যাত চিত্রকর্মের নকলের জন্য সেখানকার ধনীদের যে হাহাকার আর অর্থ খরচের বহর, তা থেকে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে আসল বা মূল চিত্রকর্মের জন্য তাঁরা আরও অনেক অনেক অর্থ ব্যয় করবেন।

অর্থলিপ্সু মার্কুইস আর সূক্ষ্ম নকলবিশারদ ইভ সঠিক সময়ে, সঠিক স্থানে, সঠিক অভিজ্ঞতা নিয়ে ঐতিহাসিক প্রতারণার ফন্দি আঁটলেন। শুরু হলো মার্কুইসের পরিকল্পনা। তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী ইভ ল্যুভরে বসে মোনালিসার একটা নিখুঁত নকল তৈরি করবেন। চিত্রশালার নিয়ম অনুযায়ী, নকল ছবি কিছুটা ছোট বা বড় মাপে আঁকাতে হয়। ইভ মোনালিসাকে কিছুটা ছোট করে কাপড়ের ক্যানভাসে আঁকবেন। নকলের কাজ শেষ হলে ছবিটি মার্কুইসের দপ্তরের স্টুডিওতে নিয়ে গিয়ে ধীরস্থিরভাবে আসল মাপের ছয়টি নকল মোনালিসা পাতলা কাঠের প্যানেলে তৈরি করবেন। এরপর মার্কুইস আসল মোনালিসাটি ল্যুভর থেকে গায়েব করে দেবেন আর নকল মোনালিসাগুলোকে আমেরিকায় আসল মোনালিসা হিসেবে বিক্রি করবেন। নকল ছবির ব্যবসায় মার্কুইসের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা এবং গ্রহণযোগ্যতার কারণে আমেরিকার ধনী ক্রেতারা তাঁকে খুব একটা সন্দেহ করবেন না। তারা ল্যুভর থেকে চুরি হওয়া মূল মোনালিসা ভেবে তা কিনে নেবেন।

সারথি ইভকে সঙ্গে নিয়ে কাজে নেমে পড়লেন মার্কুইস। ইভ মোনালিসার একটা নকল তৈরির জন্য সালোঁ কেয়ারে আসা–যাওয়া শুরু করলেন। এদিকে মার্কুইস ইতালিতে এসে ষোড়শ শতাব্দীর একটা বড় আলমারি কিনে তার পেছনের পাতলা প্যানেলটা খুলে নিয়ে প্যারিসে এলেন। এরপর সেটিকে ৩১ ইঞ্চি বাই ২১ ইঞ্চি মাপের ছয়টি টুকরা করলেন, ছয়টা নকল মোনালিসার জন্য। এটাই ছিল আসল মোনালিসার সঠিক মাপ।

ইভ ল্যুভরে বসে মোনালিসার নকল তৈরি শেষে মার্কুইসের স্টুডিওতে কাজ শুরু করলেন। সেখানে ইভ সঠিক মাপের কাঠের প্যানেলে প্রথম মোনালিসাটি তৈরি করামাত্র মার্কুইস তা নিয়ে জাহাজে চেপে নিউইয়র্কে এলেন এবং একটা ব্যাংকের ভোল্টে রেখে দিলেন। এভাবে একেক করে ছয়টা নকল মোনালিসা তিনি সেই ভোল্টে জমা করলেন। নিরাপত্তার কারণে এবং সন্দেহের ঊর্ধ্বে থাকার জন্য মার্কুইস একসঙ্গে সব কটি আমেরিকায় নেননি। শেষের মোনালিসাটা জমা দিলেন ১৯১১ সালের মে মাসের শুরুতে। সব প্রস্তুতি শেষ করতে মার্কুইসের বছরখানেক লাগল। মোনালিসা বিক্রির সব প্রস্তুতি শেষ হলো, এখন শুধু মোনালিসার উধাও হয়ে যাওয়ার পালা।

মার্কুইস মোনালিসাকে উধাও করার জন্য বেশ আগে থেকেই একজনকে খুঁজছিলেন। তিনি এ কাজের জন্য পেয়ে গেলেন ভিনসেনৎসো পেরুজ্জিয়াকে। পেরুজ্জিয়া ভাগ্যান্বেষণে ১৯০৮ সালে ইতালি থেকে ফ্রান্সে আসেন। তিনি ফ্রান্সের বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি শেষে ল্যুভরে রংমিস্ত্রির চাকরি পেয়ে যান। প্যারিসে পেরুজ্জিয়া ই’ওপিতাল সাঁ-লুই এলাকার ৫ নম্বর সড়কে থাকতেন। এটি ছিল ল্যুভর থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে। কাজের মধ্য দিয়ে তিনি ল্যুভরের প্রতিটি গ্যালারির প্রবেশ-প্রস্থানের পথ, চিত্রশালার নিয়মকানুন, নিরাপত্তা, পরিবেশ, সংস্কৃতি—সবই জানতেন। মোনালিসাসহ চিত্রশালার অমূল্য ছবিগুলো সুরক্ষার জন্য ফ্রেমের ওপর বুলেটপ্রুফ কাচের বাক্স লাগানোর কাজেও পেরুজ্জিয়া জড়িত ছিলেন।

পেরুজ্জিয়ার সঙ্গে মার্কুইসের চুক্তি হলো যে মোনালিসাকে গ্যালারি থেকে সরিয়ে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় মার্কুইসকে তা হস্তান্তর করবে। সেখান থেকে মার্কুইস মোনালিসাকে অধিক নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেবে। পেরুজ্জিয়া তাঁর কাজে সহযোগিতা করার জন্য ভিনসেন্ট ও মাইকেল লানচেলোত্তি  নামে দুই ভাইকে বেছে নিলেন। তাঁরাও ইতালি থেকে প্যারিসে এসেছিলেন। মার্কুইস পেরুজ্জিয়াকে একটি মাস্টার কি বা চাবি এবং চিত্রশালার একটি নকশা দেন। নকশায় মোনালিসাকে নিয়ে বেরিয়ে আসার পথ উল্লেখ ছিল। মার্কুইস পেরুজ্জিয়াকে কাজের পারিশ্রমিক হিসেবে প্রথম কিস্তির অর্থ দিলেন, যার পরিমাণ পেরুজ্জিয়ার কল্পনাতীত ছিল।

হারিয়ে গেল মোনালিসা

সালোঁ কেয়ারের পাশে সাল দুশাতে গ্যালারির সঙ্গে একটি ছোট স্টোররুম আছে। সেখানে আশপাশের গ্যালারির যাবতীয় অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখা হয়। এ ছাড়া নকলনবিশরা তাঁদের নিত্যকার কাজ শেষে আঁকানোর সামগ্রীগুলোও এখানেই রাখতেন, যাতে প্রতিদিন তাঁদের এগুলো টানাটানি করতে না হয়।

২০ আগস্ট ১৯১১, রোববার। পেরুজ্জিয়া ও লানচেলোত্তি ভ্রাতৃদ্বয় দর্শক প্রবেশ বন্ধ হওয়ার আগেই ল্যুভরে প্রবেশ করলেন। তাঁদের একজনের হাতে খয়েরি রঙের মোড়কের মধ্যে তিনটি অ্যাপ্রোন ছিল। অ্যাপ্রোনগুলো ছিল সাদা রঙের ঢিলাঢালা এবং উচ্চতায় প্রায় হাঁটু পর্যন্ত। ল্যুভরের কর্মীরা এ ধরনের অ্যাপ্রোন পরিধান করে থাকেন। চিত্রশালা বন্ধ হওয়ার সময় হলে দর্শকেরা ল্যুভর থেকে বের হওয়া শুরু করেন। পেরুজ্জিয়া তাঁর দলসহ এ সময় সালোঁ কেয়ারের কাছাকাছি অবস্থান করছিলেন। দর্শক বা নিরাপত্তাকর্মীরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাঁরা ত্বরিত স্টোররুমে ঢুকে পড়লেন। কিছুক্ষণ পরে চারদিক অন্ধকারে ডুবে যাবে। স্বল্প আলোতে তারা নিজেদের অবস্থান ঠিক করে নিলেন। এমন জায়গা বেছে নিলেন, যেখানে তাঁরা সারা রাত আরামের সঙ্গে কাটিয়ে দিতে পারবেন।

বিকেল পাঁচটার মধ্যে স্টোররুম, এরপর ল্যুভরের প্রকাণ্ড ফটক বন্ধ হয় গেল। নীরবতা ও অন্ধকার ছেয়ে ফেলল পুরো চিত্রশালাকে। স্টোররুমও অন্ধকারে ছেয়ে গেল। তিন নিশিকুটুম্ব সঙ্গে থাকা চিজ আর ফ্লাস্কে আনা মদ খেল। এরপর পরের দিনের পরিকল্পনা ঝালিয়ে নিয়ে নতুন ভোরের প্রত্যাশায় ঘুমিয়ে পড়লেন।

২১ আগস্ট ১৯১১, সোমবার। আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই স্টোররুমে লুকিয়ে থাকা নিশিকুটুম্বরা সক্রিয় হয়ে উঠলেন। সঙ্গে থাকা সাদা অ্যাপ্রোন গায়ে চাপিয়ে নিলেন। এরপর তাঁরা স্টোররুম থেকে বেরিয়ে সালোঁ কেয়ারের দরজার মুখে এসে দাঁড়ালেন। এক ভাইকে গ্যালারিগুলোর প্রবেশমুখ লক্ষ রাখার জন্য রেখে, আরেক ভাইকে সঙ্গে নিয়ে পেরুজ্জিয়া স্যালেন কেয়ারে প্রবেশ করলেন। পেরুজ্জিয়া খুব সাবধানতার সঙ্গে বুলেটপ্রুফ বাক্সসহ মোনালিসাকে দেয়াল থেকে আলগা করে নিলেন। এরপর তাঁরা মোনালিসাকে ধরাধরি করে গ্র্যান্ড গ্যালারি হয়ে প্রবেশ করলেন সাল দো সেপ্ত মেত্রে গ্যালারিতে। এই গ্যালারির ভেতরে এক কোনায় নিচে নামার সিঁড়ি আছে। এই সিঁড়ি শুধু চিত্রশালার রক্ষণাবেক্ষণ বা সার্ভিসের সঙ্গে জড়িত নিম্নপদের কর্মচারীরা ব্যবহার করেন।

তিনজন সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলেন। ল্যান্ডিংয়ের জায়গাটা কিছুটা প্রশস্ত ছিল। সেখানে সঙ্গে থাকা স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে পেরুজ্জিয়া পাঁচ মিনিটের মধ্যে কাচের বুলেটপ্রুফ বহিরাবরণ ও অলংকৃত ফ্রেম থেকে মোনালিসাকে মুক্ত করলেন। পেরুজ্জিয়া সেগুলো সিঁড়ি ঘরের এক কোনায় ঠেলে দিলেন। এরপর পেরুজ্জিয়া মোনালিসাকে তাঁর ঢোলা অ্যাপ্রোনে ঢুকিয়ে ফেললেন। সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি না, তা পরীক্ষা করতে দুই ভাইকে আবারও দোতলায় পাঠালেন।

এ পর্যন্ত তাঁদের পরিকল্পনা ঠিকমতো এগোলেও এখানে এসে হোঁচট খেল। পেরুজ্জিয়া মাস্টার কি দিয়ে সিঁড়ি ঘর থেকে বেরোনোর দরজা খুলতে ব্যর্থ হলেন। অনেক চেষ্টা করেও সফল হলেন না। শেষ চেষ্টা হিসেবে সঙ্গে থাকা স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে দরজার নবটা খুলে ফেললেন। তবু দরজা খুলল না। ঠিক এমন সময় ওপর থেকে তাঁর সঙ্গীরা শিস বাজিয়ে পেরুজ্জিয়াকে সতর্কবার্তা পাঠালেন।

পেরুজ্জিয়া একধরনের বিরক্তি নিয়ে সিঁড়ির শেষ ধাপে বসে পড়লেন। ওপর থেকে নেমে এল পানির মিস্ত্রি সভ। পেরুজ্জিয়া স্বগতোক্তির মতো বিড়বিড় করে বলতে লাগল, কোন বেকুব যে দরজাটায় তালা মেরে রেখেছে। সাদাসিধা সভ তাঁর কাছে থাকা মাস্টার কি দিয়ে দরজাটা খুলে দিলেন। পেরুজ্জিয়ার ভাগ্যও খুলে গেল। মোনালিসার বেরিয়ে যেতে আর কোনো বাধা থাকল না। সভ তার পথে চলে গেল, আর পেরুজ্জিয়া একটু দম নিয়ে দুই ভাইকে নিয়ে ভিসকন্তি (Visconti) উঠানে পৌঁছে গেলেন। এখানে ল্যুভর থেকে নদীর দিকে বেরিয়ে যাওয়ার ফটক। সেখানকার প্রহরী পাশে একটা লাল ছাতার নিচে ঝিমুচ্ছিলেন।

পেরুজ্জিয়া ল্যুভর থেকে বাইরে বেরিয়ে অ্যাপ্রোন খুলে তা দিয়ে মোনালিসাকে পেঁচিয়ে ল্যুভর আর সিন নদীর মাঝের কুঁই ডি ল্যুভর সড়ক ধরে তাঁর আস্তানায় পৌঁছে গেলেন। সকাল নয়টার মধ্যেই তাঁদের অপারেশন শেষ হলো। এক ঘণ্টার মধ্যে পেরুজ্জিয়া সিন নদীর তীরে মার্কুইসের গ্যালারিতে গিয়ে মোনালিসা বিজয়ের কথা জানালেন। পেরুজ্জিয়া ল্যুভরে প্রবেশ থেকে মোনালিসাকে তাঁর কক্ষে নিয়ে আসার পুরো গল্প মার্কুইসকে সুন্দর করে বর্ণনা করলেন। সেই রাতে মার্কুইস ও ইভ দামি মদসহ বিলাসী নৈশভোজ করলেন।

মার্কুইস আগেই ছয়টি নকল মোনালিসা আমেরিকায় রেখে এসেছিলেন, আর তা বিক্রির জন্য ছয়জন সম্ভাব্য খদ্দেরও ঠিক করে রেখেছিলেন। মার্কুইস খদ্দেরদের এ–ও বলে রেখেছিলেন, তাঁরা যেন ২১ আগস্ট থেকে সংবাদপত্রে নজর রাখেন। মোনালিসা নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মার্কুইস আমেরিকায় পৌঁছে গেলেন। ইতিমধ্যে মোনালিসার নিখোঁজ সংবাদ সারা বিশ্বে জানাজানি হয়ে গেছে। খদ্দেরদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সবাইকে একটা করে নকল কিন্তু নিখুঁত মোনালিসা গছিয়ে দিলেন। বিনিময়ে তিনি পেলেন ৯০ মিলিয়ন ডলার। প্যারিসে ফিরে এসে মার্কুইস তাঁর কুকর্মের অংশীদারদের তাঁদের হিস্যা বুঝিয়ে দিলেন এবং প্যারিস থেকে উধাও হয়ে গেলেন। এরপর মার্কুইস মোনালিসা বা পেরুজ্জিয়ার কোনো খোঁজ নেননি। ইভও প্যারিস থেকে দূরে শাতোয় চলে গেলেন। পেরুজ্জিয়া পরবর্তী দুই বছর মার্কুইসের অপেক্ষায় ৫ নম্বর সড়কে তাঁর এক কক্ষের বাসভবনে থেকে গেলেন। আজীবন বিভিন্ন রাজপ্রাসাদে থাকতে অভ্যস্ত মোনালিসাকেও পরের দুই বছর পেরুজ্জিয়ার এই নোংরা আর দীনহীন কক্ষে থাকতে হলো।

ল্যুভর এক সপ্তাহের জন্য বন্ধ রাখার পর ৩০ আগস্ট দর্শকের জন্য খুলে দেওয়া হলো। মোনালিসা নিখোঁজের ঘটনায় ল্যুভরের পরিচালক র্জ তেওফিল ওমেল চাকরিচ্যুত হলেন। ফরাসি সরকার প্রধান বিচারপতি অঁরি দায়স্ককে সভাপতি করে উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করে এবং তদন্ত শুরু হয়।

ফরাসি সরকার নিখোঁজ মোনালিসার মূল্য ধার্য করলেন ২৫০০০ ফ্রাঁ। মোনালিসাকে অক্ষত উদ্ধার করলে উদ্ধারকারী এই পুরস্কার পাবেন।

তদন্ত, পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি—কোনো কিছুতেই কোনো লাভ হলো না। শেষ পর্যন্ত মোনালিসার কোনো খোঁজ না পেয়ে সরকার হতাশ হয়ে গেল। ১৯১২ সালের নভেম্বর মাসে শিল্পকলা মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী সংসদকে জানালেন যে মোনালিসার ল্যুভরে ফিরে আসার আর কোনো আশা তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। এরপর সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে মোনালিসার তদন্ত কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। ১৯১৩ সালের জানুয়ারিতে ল্যুভরের নতুন ক্যাটালগে মোনালিসার আর স্থান হলো না। ধীরে ধীরে মানুষের মন থেকেও মোনালিসা হারিয়ে যেতে শুরু করল।

  ফিরে এল মোনালিসা

আলফ্রেদো জেরি ইতালির ফ্লোরেন্সে চিত্রকর্ম আর ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন জিনিস কেনাবেচার ব্যবসা করেন। বোর্গো ওনিসসান্তি সড়কে তাঁর অভিজাত দোকান। আসন্ন ক্রিসমাস আর নববর্ষ মাথায় রেখে জেরি ১৯১৩ সালের নভেম্বর মাসে ইতালিসহ ইউরোপের বেশ কিছু পত্রিকায় চিত্রকর্ম আর প্রাচীন সামগ্রী ক্রয়ের আগ্রহ প্রকাশ করে বিজ্ঞাপন দেন। এতে তিনি বেশ ভালো সাড়া পান। অনেক আগ্রহী বিক্রেতা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। প্রতিদিন ডাকে পাওয়া চিঠিগুলো থেকে উপযুক্ত সামগ্রীগুলো নির্বাচন করে তিনি তালিকা করতে শুরু করেন। সব চিঠি তাঁর কাছে সমান গুরুত্ব না পেলেও একটি চিঠি তাঁর নজর কাড়ে। চিঠিতে প্যারিসের এক পোস্ট অফিসের সিল ছিল। প্রেরকের নাম ‘লেওনার্দো’। স্বাক্ষরের তারিখ ২৯ নভেম্বর ১৯১৩। চিঠিতে লেখা ছিল, ‘লেওনার্দোর চুরি যাওয়া শিল্পকর্মটি আমার কাছে আছে। আমি এটি ইতালির সম্পত্তি মনে করি। কারণ, এটির শিল্পী একজন ইতালিয়ান। আমার স্বপ্ন, শিল্পকর্মটি সে দেশে ফিরে আসুক, যেখান থেকে এটি আবির্ভূত আর অনুপ্রাণিত হয়েছিল। লেওনার্দো।’ তিনি চিঠিটি কয়েকবার পড়লেন। তাঁর মনে হলো চিঠিটি ভুয়া। তবে অপরিশীলিত ভাষা, বাহুল্যবর্জিত শব্দ আর স্বাক্ষরের অলংকরণ দেখে তাঁর খটকা লাগল।

মোনালিসা নিখোঁজ হওয়ার পর দুই বছর পার হয়ে গেছে। এরই মধ্যে মোনালিসা উদ্ধার বা খুঁজে পাওয়ার অনেক ভুয়া গল্প ইউরোপ ও আমেরিকার পত্রপত্রিকায় নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়েছে। পত্রিকায় কখনো উল্লেখ থাকত যে মোনালিসাকে সুইজারল্যান্ডে দেখা গেছে, আবার কখনো বলা হতো যে সে হল্যান্ডে আছে। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে মোনালিসার জন্য পুলিশ একাধিকবার ফ্রান্স থেকে আমেরিকাগামী জাহাজে তল্লাশি চালায়। শেষমেশ সব সংবাদই গুজব হিসেবে প্রমাণিত হয়। ১৯১৩ সালের আগস্ট মাসে এক ধনী ইংলিশম্যান প্যারিসে ব্রিটিশ দূতাবাসে মোনালিসার একটি নকল নিয়ে এসে দাবি করেন যে এটিই খোয়া যাওয়া মোনালিসা। পরে প্রমাণিত হয়, এটি ছিল খুব উন্নত মানের একটি নকল। সেপ্টেম্বর মাসে রাশিয়ার একটি পত্রিকায় প্রকাশ পায় যে মোনালিসা সেন্ট পিটার্সবার্গের একটি ব্যক্তিগত গ্যালারিতে ঝোলানো আছে। ১ নভেম্বর দ্য নিউইয়র্ক টাইমস প্রকাশ করে যে গোপন তথ্যের ভিত্তিতে চোরাই মোনালিসার জন্য পুলিশ ব্রংক্সের একটি অ্যাপার্টমেন্টে তল্লাশি চালিয়েছে। এ ধরনের সংবাদ ইউরোপ ও আমেরিকায় অহরহ প্রকাশ পাচ্ছিল। এ কারণে অনেক আগে থেকেই জেরি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলেন যে কেউ না কেউ আসল মোনালিসার নামে নকল মোনালিসা নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করবে। আবার জেরি এ–ও জানত যে হারিয়ে যাওয়া মোনালিসা যদি সে উদ্ধার করতে পারে, তবে সে বিরাট সেলিব্রেটিতে পরিণত হবে এবং আরও ধনী হয়ে যাবে। প্রচার, প্রসিদ্ধি আর লিরার স্রোত তার দিকে ধেয়ে আসবে। চিঠির বিষয়টা আলোচনার জন্য তিনি জিওভান্নি পোগ্গির (Giovanni Poggi) কাছে ছুটলেন।

পোগ্গি ছিলেন ১৫৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত ফ্লোরেন্সের বিখ্যাত উফফিৎসি চিত্রশালার পরিচালক। পোগ্গি জেরির কথা শুনে খুব একটা আস্থা রাখতে পারলেন না। তিনি বললেন যে এটা হয়তো বা খুব ভালো মানের নকল হতে পারে। তবে তিনি জেরিকে চিঠির উত্তর দিতে পরামর্শ দিলেন। জেরি ‘লেওনার্দোকে’ লিখলেন, ছবিটিতে তাঁর আগ্রহ আছে, তবে দেখার পর এটার দাম নিয়ে আলাপ করবেন।

জেরি সঙ্গে সঙ্গেই ‘লেওনার্দো’র উত্তর পেলেন। ‘লেওনার্দো’ জেরিকে প্যারিসে আসার আমন্ত্রণ জানান। জেরি বিচক্ষণ ব্যবসায়ী, প্যারিসে গেলে বিপদের শঙ্কা থাকতে পারে ভেবে ‘লেওনার্দো’কে ইতালিতে আসার আহ্বান জানালেন। শেষে ঠিক হলো যে ২২ ডিসেম্বর ফ্লোরেন্স থেকে প্রায় তিন শ ষাট কিলোমিটার দূরে মিলান শহরে তাঁরা মিলিত হবেন। ‘লেওনার্দো’ মোনালিসাকে যেকোনো মূল্যে বিক্রির জন্য অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। তিনি অপেক্ষায় না থেকে ৯ ডিসেম্বরেই ট্রেনযোগে প্যারিস থেকে রওনা দিয়ে ফ্লোরেন্স পৌঁছে যান।

১০ ডিসেম্বর, বুধবার। জেরির দোকানে বেশ ভিড়, খরিদ্দারেরা জিনিসপত্র দেখছেন, দরদাম করছেন। এঁদের মধ্যে একজনকে একটু ভিন্ন রকম দেখাচ্ছে। সে বেশ আয়েশের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে জিনিসপত্র দেখছেন। খদ্দেরের ভিড় কমে এলে সেই ব্যক্তি জেরির কাছাকাছি এসে ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘লেওনার্দো মোনালিসাকে তার নিজ শহরে নিয়ে এসেছে।’ জেরি লক্ষ করলেন যে ‘লেওনার্দো’ উচ্চতায় পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি, হালকা–পাতলা, শ্যামলা বর্ণের। পাকানো মোচের অধিকারী এবং মোচের আগা মোম চর্চিত। হাবেভাবে চাটুকার ধরনের। পরনের সুটটা বেশ সস্তা। সে জানাল যে তার নাম লেওনার্দো ভিনসেনৎসো। সে উঠেছে জেরির স্টুডিওর কাছাকাছি পানৎসানি সড়কে অবস্থিত আলবার্গো ত্রিপোলি-ইতালিয়া হোটেলে।

ঘটনার আকস্মিকতায় জেরি কিছুটা হকচকিত হলেও লেওনার্দোকে পরদিন বিকেল তিনটায় আসার জন্য বললেন। জেরি জানতেন যে পরিচালক পোগ্গি ফ্লোরেন্স থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে বোলোনিয়া শহরে গেছেন। জেরি তাঁকে ফ্লোরেন্সে ফিরে অসার জন্য জরুরি তারবার্তা পাঠালেন। পরদিন তিনটার আগেই পোগ্গি জেরির দোকানে এসে পৌঁছালেন। এবার তাঁদের অপেক্ষার পালা। তাঁরা ঘন ঘন ঘড়ি দেখছেন। তিনটা বেজে পাঁচ মিনিট, সাত মিনিট, দশ মিনিট—এভাবেই সময় এগিয়ে যাচ্ছে। পোগ্গি প্রথম থেকেই সন্দিহান ছিলেন। আর সময় নষ্ট না করে তিনি বিদায় নেওয়ার জন্য গায়ে কোট চড়ালেন। ঠিক এ সময়ে ‘লেওনার্দো’কে দরজায় দেখা গেল।

পোগ্গির পরিচয় পেয়ে ‘লেওনার্দো’কে বেশ উৎফুল্ল মনে হলো। হাত মেলানোর সময় বললেন যে ফ্লোরেন্সের চিত্রশালার সংরক্ষকের সঙ্গে মিলিত হয়ে সে খুব আনন্দবোধ করছেন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। কালবিলম্ব না করে তাঁরা তিনজন ট্রিপোলি-ইতালিয়া হোটেলের দিকে যাত্রা শুরু করলেন। দোকান থেকে বেরোনোর আগে ‘লেওনার্দো’ মোনালিসার জন্য পাঁচ লাখ লিরা দাবি করলেন, যা এখনকার সময়ের ২১ লাখ ডলারের সমান। জেরি তাঁর প্রস্তাবে সম্মত হলেন, তবে তা যদি আসল মোনালিসা হয়। হোটেলটি ছিল অত্যন্ত সাধারণ মানের। ‘লেওনার্দো’র কক্ষটি ছিল চতুর্থ তলায়। রুমের সাইজটাও খুব ছোট। তিনজন রুমে প্রবেশের পর নড়াচড়া করাই কঠিন হয়ে গেল। ‘লেওনার্দো’ দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দিলেন, কোনো কথা না বাড়িয়ে বিছানার নিচ থেকে মাঝারি আকারের সাদা কাঠের একটি বাক্স বের করে বিছানার ওপর রাখলেন। তিনজনের কারও মুখে কোনো শব্দ নেই। ‘লেওনার্দো’ বাক্সটা খুললেন। বাক্সটা অনেক রকম জঞ্জাল, যেমন উলের আন্ডারগার্মেন্টস, কোঁচকানো জামা, এক জোড়া ছেঁড়া জুতা, একটি ভাঁজ করা টুপি, একটি ম্যানডোলিন, কিছু ছোটখাটো যন্ত্রপাতি, এমনকি ছবি আঁকানোর কিছু ব্রাশ দিয়ে ভর্তি ছিল। এসব কিছু ‘লেওনার্দো’ মেঝেতে নামিয়ে রাখার পর একটা নকল তলদেশ দেখা গেল। সেটা উঠিয়ে তার নিচ থেকে লাল সিল্ক কাপড়ে জড়ানো একটা বান্ডিল বের করে বিছানায় রাখলেন। নিঃশব্দে সে বান্ডিলটা খুলতে শুরু করলেন। এই মুহূর্তটা সম্পর্কে জেরি উল্লেখ করেন, ‘আমাদের বিস্ফারিত চোখের সামনে অক্ষত ও সুন্দরভাবে সংরক্ষিত মোনালিসা উদ্ভাসিত হলো। আমরা জানালার কাছে নিয়ে গেলাম। মোনালিসাকে আমাদের সঙ্গে আনা তার একটা ছবির সঙ্গে মেলানোর জন্য। পোগ্গি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন, আমাদের কোনো সন্দেহ রইল না যে এটি সত্যিকার মোনালিসা। ছবির পেছনের নম্বর ও চিহ্নের সঙ্গে ল্যুভরের ক্যাটালগে থাকা মোনালিসার পেছনের নম্বর ও চিহ্নের মিল আছে। জেরির মধ্যে কোনো সন্দেহ না থাকলেও পোগ্গি এটা তার চিত্রশালায় নিয়ে গিয়ে লেওনার্দো দ্য ভিঞ্চির অন্যান্য চিত্রকর্মের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে চাইলেন। ‘লেওনার্দো’ রাজি হয়ে গেলেন। ‘লেওনার্দো’ আবারও মোনালিসাকে লাল সিল্ক দিয়ে জড়িয়ে ফেললেন। পোগ্গি ও জেরি সেটি নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেন।

হোটেল থেকে বেরোনোর সময় হোটেলের প্রহরী তাদের থামিয়ে চিত্রকর্মটি পরীক্ষা করলেন। মোনালিসাকে তিনি হোটেলে টাঙানো কোন চিত্রকর্ম সন্দেহ করেছিলেন। অশিক্ষিত প্রহরী মোনালিসার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না, তাঁদের ছেড়ে দিলেন। তাঁরা ঊর্ধ্বশ্বাসে উফফিৎসির দিকে ছুটলেন আর মনে মনে ভাবলেন, এই নিরাপত্তাব্যবস্থা ল্যুভরে থাকলে মোনালিসাকে নিরুদ্দেশ হতে হতো না।

উফফিৎসিতে এসে তাঁরা মোনালিসাকে আরও সূক্ষ্মভাবে পরীক্ষা করলেন। মোনালিসার গায়ে ছিল প্রায় পাঁচ লাখ ক্র্যাকুলার। ক্র্যাকুলার হচ্ছে পুরোনো ছবিতে থাকা ফাটা ফাটা দাগ। প্রায় প্রতিটি পুরোনো ছবিতে এ ধরনের ক্র্যাকুলার থাকে। ছবিভেদে ক্র্যাকুলারের সংখ্যা ও প্যাটার্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। এই সংখ্যা ও প্যাটার্ন দিয়ে এগুলোকে চেনা যায়, অনেকটা মানুষের ফিঙ্গারপ্রিন্টের মতো। পোগ্গি ও জেরি নিশ্চিত হলেন, মোনালিসা আজ সেখানেই আবির্ভূত হয়েছেন চার শ বছর আগে যেখান থেকে তার যাত্রা শুরু হয়েছিল। জেরি মোনালিসার সঠিকতা নিশ্চিত বা বিশ্বাসযোগ্যতার প্রমাণ পাওয়ার পর পুলিশকে ফোন করলেন।

ফ্লোরেন্স থেকে রাজা ভিক্তর ইমানুয়েল, পোপ দশম পায়াস এবং ফরাসি রাষ্ট্রদূত কেমিলকে ফোন করে আনন্দের সংবাদটা পৌঁছে দেওয়া হলো। মোনালিসা উদ্ধারের সংবাদে ইতালিবাসী উচ্ছ্বসিত আর ফরাসিবাসী দ্বিধান্বিত হলেন। উফফিৎসির সম্মুখে জনতার ঢল নেমে এল। অনেকে সাশ্রুনয়নে মোনালিসার সঙ্গে ছবি তুলল। তাঁদের ভাবভঙ্গিতে মনে হচ্ছিল ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরেছে। ইতালিয়ান চেম্বার অব ডেপুটিতে (সংসদ) বাগ্‌যুদ্ধ চলছিল। একজন চেঁচিয়ে উঠল—‘লা জোকোন্দা’ অর্থাৎ মোনালিসাকে পাওয়া গেছে। সব বাগ্‌যুদ্ধ থেমে গেল।

অপর দিকে ফ্রান্সের সরকার, চিত্রশালার কর্মকর্তা, গণমাধ্যম এবং জনতা—কেউই বিষয়টি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। ল্যুভরের একজন কিউরেটরকে রাতে ফোন করে বিষয়টি জানানো হয়। তিনি তখন নৈশভোজ করছিলেন। ফোন ধরে তিনি অবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন, ‘অসম্ভব’ এবং ফিরে গেলেন নৈশভোজে।

হারিয়ে যাওয়ার সময় মোনালিসা যেভাবে পত্রিকার প্রথম পাতা দখলে রেখেছিল, উদ্ধারের পর ঠিক একই অবস্থার সৃষ্টি হলো। মোনালিসা আবারও ইউরোপ আর আমেরিকার পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতা দখলে নিল। পত্রিকাগুলো একের পর এক প্রতিবেদন ছাপতে থাকল। দ্য ইলাস্ট্রেটেড লন্ডন নিউজ ২০ ডিসেম্বর থেকে ৩ জানুয়ারির মধ্যে মোনালিসাকে নিয়ে তিনটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করল।

মোনালিসার উদ্ধারে ইতালিবাসী আবেগে উদ্বেলিত হয়ে উঠল, তাদের মধ্যে জাতীয়তাবোধ উথলে পড়তে শুরু করল। তারা মোনালিসাকে ইতালিতেই রেখে দিতে চাইল। তাদের যুক্তি—মোনালিসার শিল্পী ইতালির, মোনালিসার জন্ম ইতালিতে, আর মোনালিসার মডেলও ছিলেন ইতালির। ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ান এটিকে চুরি করে ফ্রান্সে নিয়ে গিয়েছিলেন। অতএব এ সম্পত্তি ইতালির, ফ্রান্সের নয়। তাদের অনেকে পেরুজ্জিয়াকে ধন্যবাদও জানাল। ১৯১২ সালে ইতালির লিবিয়া বিজয়ের নায়ক গাব্রিয়েলে দান্নুৎসিও একাধারে ছিলেন সেনাপতি, বিমানযোদ্ধা, কবি, নাট্যকার, বক্তা, সাংবাদিক। মোনালিসা উদ্ধারের পর তিনি পেরুজ্জিয়াকে অভিনন্দন জানান এবং চুরির বিষয়টি তাঁর মাথায় না আসার কারণে আক্ষেপ করতে থাকেন। ভাবটা এমন যে তাঁর মাথায় এলে তিনি মোনালিসাকে অনেক আগেই চুরি করে দেশে ফেরত আনতেন। ইতালি সরকার এ ধরনের আবেদনে খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে, মোনালিসাকে ফ্রান্সে ফেরত দেওয়ার বিষয়ে খুব তড়িঘড়ি করে চুক্তি করল। ঠিক হলো যে ফ্রান্সে যাওয়ার আগে ফ্লোরেন্স, রোম আর মিলানে মোনালিসার বিশেষ প্রদর্শনী হবে। এরপর সে ইতালি ত্যাগ করে প্যারিসে চলে যাবে।

২০ ডিসেম্বর মোনালিসা বিরাট প্রহরী দলসহ ট্রেনে চেপে রোমের পথে যাত্রা করল। প্রতিটি স্টেশনে নিরাপত্তাকর্মীরা সাদাপোশাকে সতর্ক অবস্থানে থেকে ট্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। রোমে পৌঁছানোর পর মোনালিসাকে নেওয়া হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। রাজা ইমানুয়েলসহ রাজধানীর গণ্যমান্য ব্যক্তিরা তাকে দর্শন দেন। সেখানে বিশেষ এক আয়োজনের মাধ্যমে ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোনালিসাকে ফরাসি রাষ্ট্রদূতের কাছে হস্তান্তর করেন। এখান থেকে মোনালিসাকে ফরাসি দূতাবাসে নেওয়া হয়। দূতাবাসে ইতালির রানি, রানিমাতা, পুরো কূটনৈতিক মহল ও বিশিষ্টজনেরা মোনালিসাকে শ্রদ্ধা জানালেন।

এরপর মোনালিসাকে রোমানদের প্রদর্শনের জন্য ২৩ ডিসেম্বর ভিলা বোর্গেস গ্যালারিতে আনা হয়। প্রদর্শনী চলে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ২৮ ডিসেম্বরের মোনালিসা রোম থেকে প্যারিসের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। পথে ২৯ ডিসেম্বর মোনালিসা মিলানবাসীর জন্য যাত্রাবিরতি করে। মোনালিসাকে একনজর দেখার জন্য সেখানে প্রায় ৬০০০০ দর্শক উদ্‌গ্রীবভাবে অপেক্ষা করছিলেন।

সব শেষে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যরাতে মোনালিসা ফ্রান্সে প্রবেশ করল। নববর্ষের প্রথম দিন মোনালিসা এসে পৌঁছাল প্যারিসে। প্যারিসের লে ইলাসত্রেসিওঁ পত্রিকা আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে শিরোনাম করল—‘অবশেষে সে আবার ফ্রান্সে’। ল্যুভরে নেওয়ার আগে প্যারিসের বিশিষ্টজনদের জন্য তিন দিনের বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। প্রদর্শনী শেষে ১৯১৪ সালের ৪ জানুয়ারি, রোববার সকাল ১০টায় মোনালিসাকে নিয়ে প্যারিসবাসী বিরাট মিছিলসহ ল্যুভরে এসে পৌঁছায়। দর্শকের প্রবল চাপ সহ্য করার জন্য মোনালিসাকে প্রথম দুই দিন বড় একটা গ্যালারিতে জায়গা দেওয়া হয়। এরপর মোনালিসা ফিরে এল তার শত বছরের আবাস সালোঁ কেয়ারে।

পেরুজ্জিয়ার বিচার

জেরি ও পোগ্গি হোটেল থেকে চলে যাওয়ার পর ‘লেওনার্দো’ একটু ঘুমানোর চেষ্টা করলেন। এমন সময় ফ্লোরেন্সের পুলিশপ্রধান ফ্রান্সেস্কো তারানতেল্লি তাঁর দরজার কড়া নাড়লেন। ‘লেওনার্দো’ নীরবে নিজেকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করলেন। তাঁর প্রবল বিশ্বাস ছিল যে তাঁকে আটক রাখা হবে না; বরং মোটা রকমের পুরস্কার দেওয়া হবে, তিনি জাতীয় বীরের স্বীকৃতি পাবেন। থানায় যাওয়ার পর ‘লেওনার্দো’ পুলিশকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন। তিনি জানালেন তাঁর প্রকৃত পরিচয়। নাম: ভিনসেনৎসো পেরুজ্জিয়া। জন্ম: ৮ অক্টোবর ১৮৮০। জন্মস্থান: কোমো হ্রদের পাশে দুমেনৎসা নামে ছোট একটা গ্রামে।

ধরা পড়ার পর পেরুজ্জিয়া মোনালিসাকে চুরি করার ঘটনাকে দেশপ্রেম বলে দাবি করেন। তিনি বলেন যে ১৭৯৬ সালে নেপোলিয়ান ইতালির বেশির ভাগ জাদুঘর থেকে গাড়ি ভর্তি করে চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য, প্রাচীন পাণ্ডুলিপি আর বস্তা ভরে সোনাদানা নিয়ে গেছেন। শত বছরের এই গ্লানির বিষয়ে কোনো ইতালিয়ান কিছু না বলায় পেরুজ্জিয়া খুব লজ্জাবোধ করতেন। তিনি যখন ল্যুভরে মোনালিসার সামনে দাঁড়াতেন, তখন তাঁর মনে হতো যে বিদেশের মাটিতে মোনালিসা খুব কুণ্ঠিত আর অপমানবোধ করছে। এরপরই তিনি চিন্তা করেন যে ইতালির এই সেরা চিত্রকর্মটি নিজের দেশকে উপহার দেবেন।

পেরুজ্জিয়ার বক্তব্যে ইতালিবাসী আপ্লুত হয়, তারা পেরুজ্জিয়াকে দোন কিহোতের সঙ্গে তুলনা করে, আর মোনালিসা দুলসিনেয়ার ৎরূপ নেয়। এক অজ্ঞাতনামা ইতালিয়ান পেরুজ্জিয়ার জামিনের জন্য পাঁচ হাজার লিরা প্রদানের প্রস্তাব করেন। জেলখানায় তাঁর কাছে প্রতিদিন এত চিঠি, উপহার, মিষ্টি আর সিগারেট আসত যে তাঁর কক্ষ উপচে পড়ত।

পেরুজ্জিয়ার বক্তব্যে ইতালিবাসী খুব উদ্দীপ্ত হলেও পুলিশপ্রধান তারানতেল্লি তাঁর বক্তব্য মোটেও বিশ্বাস করলেন না। তিনি পেরুজ্জিয়ার বয়ানকে ডাহা মিথ্যা ও সাজানো নাটক মনে করলেন। তবে তিনি পেরুজ্জিয়ার অভিনয়ের প্রশংসা করেন। পুলিশপ্রধান ধারণা করেন, মোনালিসা চুরির পাণ্ডুলিপি পেরুজ্জিয়া নয়, অন্য কেউ লিখেছেন। ইতালির শিল্পকলামন্ত্রী রিক্কি কোররাদো মনে করেন, পেরুজ্জিয়া মোনালিসাকে ফ্লোরেন্সে নিয়ে আসেনি; বরং অর্থলোভী পেরুজ্জিয়াকে মোনালিসাই ফ্লোরেন্স টেনে এনেছে।

পেরুজ্জিয়া আটক হওয়ার পর ফ্রান্স ও ইতালিতে দুই সরকারই বেশ কিছু তদন্ত পরিচালনা করে। তদন্ত থেকে জানা যায়, চুরির অংশীদার হিসেবে মার্কুইস থেকে পাওয়া অর্থ পেরুজ্জিয়ার কল্পনার অতীত ছিল। কিন্তু সেই অর্থ উড়াতে তাঁর বেশি সময় লাগল না। বছর ঘুরতে না ঘুরতে তাঁর আরও অর্থের প্রয়োজন হয়ে পড়ল। ঘরেই অমূল্য রতন পড়ে আছে, মার্কুইসেরও কোনো খোঁজ নেই। পেরুজ্জিয়ার মাথায় নতুন বুদ্ধি জেগে উঠল। তিনি মোনালিসাকে বিক্রি করার চেষ্টা করলেন। তদন্তে বেরিয়ে আসে, মোনালিসাকে বিক্রির জন্য পেরুজ্জিয়া লন্ডনের চিত্রকর্ম ব্যবসায়ী হেনরি ডুভিন, আমেরিকার কোটিপতি জে পি মর্গান এবং প্যারিস ও মিলানের শিল্প ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু কেউই তাঁকে পাত্তা দেননি। মজার ব্যাপার যে তাঁরা কেউ পুলিশকেও খবর দেয়নি। তবে বিচার চলাকালে ডুভিন স্বীকার করেন যে ১৯১২ সালের কোনো একসময় পেরুজ্জিয়া তাঁর কাছে এসেছিলেন। তিনি তাঁর কথায় বিশ্বাস রাখতে পারেননি, প্রতারক ভেবে তিনি তাঁকে বিদায় করে দিয়েছিলেন।

পেরুজ্জিয়া ল্যুভরের সিঁড়ি ঘরের দরজা খুলতে না পেরে দরজার যে বল্টুটা স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে খুলেছিলেন, তদন্তকালে সেটি ভিসকন্তির উঠানের বাগানে পাওয়া যায়। তদন্তকারীরা পেরুজ্জিয়ার গ্রামের বাড়িতে তাঁর পিতা ও ভাইদের কাছ থেকে জানতে পারেন যে পেরুজ্জিয়া কিছুদিন আগে চিঠিতে তাঁদেরকে বলেছিলেন যে শিগগিরই তিনি খুব ধনী হতে যাচ্ছেন। তদন্তের সময় লানচেলোত্তি ভ্রাতৃদ্বয় এবং পেরুজ্জিয়ার কথিত এক প্রেমিকা মাতিলদে ক্লামাজিরান্দকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁরা সবাই মোনালিসার চুরি বিষয়ে কোনো কিছুই জানেন না বলে সাক্ষ্য দেন।

পেরুজ্জিয়ার অতীতের কিছু অপরাধ তাঁর সততা ও দেশপ্রেমের অভিনয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করে। ফরাসি পুলিশের নথি থেকে জানা যায়, ১৯০৮ সালের ২৩ জুন ফ্রান্সের লিয়ন শহরের পাশে ডাকাতির উদ্যোগ নেওয়ার অভিযোগে পেরুজ্জিয়াকে মাকোঁ জেলে এক রাত কাটাতে হয়েছিল। এর কিছুদিন পর একজন পতিতার সঙ্গে পেরুজ্জিয়ার হাতাহাতি হয়। এ সময়ে তাঁর পকেটে একটি ছুরি ছিল। ছুরি রাখার দায়ে তাঁর আট দিনের জেল ও ১৬ ফ্রাঁ জরিমানাও হয়েছিল।

জনতার আবেগ আর পেরুজ্জিয়ার দেশপ্রেমিক চোরের অভিনয়ের কারণে সরকার তাঁর বিচার শুরুতে কিছুটা বিলম্ব করে। ইতিমধ্যে মোনালিসা নিরাপদে ফ্রান্সে ফিরে গেছে। পেরুজ্জিয়া সম্পর্কে বিভিন্ন নেতিবাচক তথ্য প্রকাশ পাওয়ায় ইতালিবাসীর আবেগেও ভাটা পড়তে শুরু করেছে। জেলখানায় পেরুজ্জিয়ার জন্য উপহার আসা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। তাঁর নামে উচ্ছ্বসিত ও আবেগপূর্ণ লেখালেখিও আর প্রকাশ পাচ্ছে না। ১৯১৪ সালের ৪ জুন ফ্লোরেন্সে পেরুজ্জিয়ার বিচার শুরু হয়।

বিচারের শুরুতে পেরুজ্জিয়ার মানসিক অবস্থা নির্ধারণের জন্য আদালত একজন মনোবিজ্ঞানীকে নিয়োগ দেয়। তিনি তাঁকে অতিশয় চুপচাপ দেখেন এবং মনমরা শিয়ালের সঙ্গে তুলনা করেন। পেরুজ্জিয়া আদালতে পূর্বের মতোই বলেন যে দেশের জন্য ভালোবাসা থেকে তিনি মোনালিসাকে চুরি করেছেন। বিচারের সময় তিনি বলেন যে মোনালিসাকে নিয়ে আসার পর প্রথম রাতে তিনি তাঁর দিকে তাকিয়ে নেশাগ্রস্ত হয়ে যান, তাঁর হাসিতে কোরবান হয়ে যান। এর পর থেকে পেরুজ্জিয়া মোনালিসাকে যখনই দেখতেন, তাঁর ভালোবাসা গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে।

আদালতে চুরি সম্পর্কে পেরুজ্জিয়া বলেন, ১৯১১ সালের ২১ আগস্ট চিত্রশালার সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছিল। ছুটির দিনে ল্যুভরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলে। অন্যান্য দিনের মতো তিনি কর্মীর সাদাপোশাকে ল্যুভরে প্রবেশ করেন। দর্শক না থাকায় সালোঁ কেয়ার ফাঁকা ছিল। তিনি মোনালিসাকে দেয়াল থেকে খুলে নিয়ে সিঁড়ি ঘরে চলে যান। সেখানে তিনি মোনালিসার কাচের বাক্স আর ফ্রেম খুলে ফেলেন। এরপর মোনালিসাকে তাঁর অ্যাপ্রোনের ভেতরে ঢুকিয়ে নির্বিঘ্নে গেট দিয়ে বেরিয়ে সোজা তাঁর বাসায় চলে যান। মোনালিসাকে লুকিয়ে রেখে তিনি কিছুটা দেরিতে ল্যুভরে ফিরে এসে তাঁর কাজে লেগে যান।

বিচারকালে বাদীপক্ষ ও বিচারক পেরুজ্জিয়াকে অনেক প্রশ্ন করেন। যার অনেকগুলোর উত্তরে তিনি অসংলগ্ন তথ্য দেন অথবা সত্য এড়িয়ে যান। প্রশ্নোত্তর পর্বে পেরুজ্জিয়া বলেন যে তিনি লন্ডনের আর্ট ডিলার ডুভিনের কাছে গিয়েছিলেন তার সঙ্গে পরামর্শ করতে যে কীভাবে মোনালিসাকে ইতালিতে ফেরত নেওয়া যায়। লানচেলোত্তি ভ্রাতৃযুগল প্রসঙ্গে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, তাঁরা কাঠমিস্ত্রি ছিলেন এবং তাঁদের সাহায্য নিয়ে তিনি একটা নকল পাটাতনসহ কাঠের বাক্স তৈরি করেছিলেন। এই বাক্সেই তিনি মোনালিসাকে লুকিয়ে রেখেছিলেন। চুরির সঙ্গে এই ভ্রাতৃযুগলের কোনো সম্পর্ক ছিল না।

সব সাক্ষ্যপ্রমাণ শেষে বাদীপক্ষ পেরুজ্জিয়াকে তিন বছরের শাস্তি প্রদানের সুপারিশ করেন। বিপরীতে পেরুজ্জিয়ার উকিলরা দাবি করেন, অপরাধ সংঘটিত হয়েছে ফ্রান্সে এবং ফ্রান্স এই বিচারে কোনো আগ্রহ দেখায়নি, তাকে ফ্রান্সে পাঠানোর কোনো অনুরোধও করেনি। তাই ইতালিতে এই বিচার অবৈধ, অতএব পেরুজ্জিয়াকে মুক্তি দেওয়া হোক। তারা আরও বলেন, এই চুরির ফলে কেউ কিছুই হারায়নি। বরং মোনালিসা অধিক মানুষের মন জয় করেছে। ল্যুভর আরও বিখ্যাত হয়েছে। ইতালি ও ফ্রান্সের মধ্যকার বৈরী সম্পর্কে উষ্ণতা এসেছে। পত্রপত্রিকা আর পোস্টকার্ড বিক্রেতারা তাঁদের প্রোডাক্ট বিক্রি করে লাভবান হয়েছেন। জেরি ফ্রান্স থেকে ২৫ হাজার ফ্রাঁ আর ‘লিজিয়ন অব অনার’ খেতাব পেয়েছেন। অর্থাৎ পেরুজ্জিয়ার এই কাজে কোনো খারাপ ফল বা প্রভাব পড়েনি। অতএব পেরুজ্জিয়ার অপরাধ কোনো শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়।

শেষ পর্যন্ত আদালত পেরুজ্জিয়াকে এক বছর পনেরো দিনের সাজা প্রদান করেন। পেরুজ্জিয়ার উকিল রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করলে, ১৯১৪ সালের ২৯ জুলাই রায় পুনর্বিবেচনার শুনানি হয়। নতুন রায়ে তাঁর সাজা কমিয়ে সাত মাস নয় দিন করা হয়। যেহেতু পেরুজ্জিয়া এই পরিমাণ সময় ইতিমধ্যেই জেলে ছিলেন। তাই নতুন রায় ঘোষণার পর তিনি মুক্তি পেয়ে যান।

শেষ কথা

মোনালিসা চুরির ঘটনা ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিল্পকর্ম কেলেঙ্কারি। মোনালিসা চুরি হয়েছিল এবং দুই বছর নিখোঁজ ছিল, এটা সত্য। পেরুজ্জিয়া চুরি করেছিলেন, তা প্রমাণিত, এটা তিনি নিজেই স্বীকার করেছিলেন। তবে কীভাবে চুরি হয়েছিল, কেন চুরি হয়েছিল, তা অমীমাংসিত থেকে যায়। পেরুজ্জিয়ার পেছনে কে ছিল বা চুরির সময় কে তাঁকে সহযোগিতা করেছিল, তা আজও রহস্য হয়ে আছে।

মোনালিসার উধাও হয়ে যাওয়ার বিষয়ে যত বয়ান বাজারে প্রকাশ পেয়েছে, তার কোনোটাই মীমাংসিত সত্য নয়। আজও এই রহস্য চিত্রশিল্পের জগতে আলোচিত হয়। এই চুরির নায়ক হিসেবে সে সময়ের আলোচিত কবি গিয়োম আপোলিনের ও শিল্পী পাবলো পিকাসোর নামও ঘুরেফিরে এসেছে।

মোনালিসার চুরি যাওয়া ও এর নেপথ্যের কাহিনি সম্পর্কে দুটি জনপ্রিয় বয়ান পাওয়া যায়। প্রথমটি ছিল চুরির প্রধান কুশীলব মার্কুইসের আর দ্বিতীয়টি ছিল চোর পেরুজ্জিয়ার নিজের। মার্কুইসের বয়ানটির উৎস ১৯১৪ সালের জানুয়ারি মাসে সাংবাদিক কার্ল ডেকারকে দেওয়া তাঁর সাক্ষাৎকার। মার্কুইসের শর্ত ছিল যে তাঁর মৃত্যুর পর এটি প্রকাশ করা হবে। তাঁর মৃত্যুর পর ১৯৩২ সালের ২৫ জানুয়ারি স্যাটারডে ইভনিং পোস্ট–এ সাক্ষাৎকারটি ছাপানো হয়। পেরুজ্জিয়ার বয়ানটি আদালতে তাঁর সাক্ষ্য থেকে পাওয়া। দুজনের বয়ানের মধ্যেই বেশ কিছু ত্রুটি ছিল। তবে পেরুজ্জিয়া নিজেকে বাঁচানোর জন্য বেশ কিছু মিথ্যার আশ্রয় নেন। আদালত মনে করেন যে ব্যক্তি পেরুজ্জিয়ার সক্ষমতা, শিক্ষাদীক্ষা, মানসিক অবস্থা—সবকিছুই প্রমাণ করে, মোনালিসা চুরির পরিকল্পনা করার মতো যোগ্যতা তাঁর ছিল না। বিপরীতে মার্কুইস সব দোষ নিজের ঘাড়ে নিয়ে যে বয়ান দেন, তাতে সাংবাদিক ডেকার কতটুকু খাদ মিশিয়েছিলেন তা বোঝা খুব মুশকিল। তবে মার্কুইসের বয়ানের সঙ্গে ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত তদন্তে উদ্‌ঘাটিত অনেক তথ্যের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। মার্কুইসের সাক্ষাৎকার নিয়ে অনেক গবেষণা হয়, আজও হচ্ছে। তাঁর ব্যক্তি চরিত্র এবং প্রতিটি কথা ও কাজ নিয়েও অনেক অনুসন্ধান হয়েছে, বইও রচিত হয়েছে। সব তথ্যপ্রমাণ থেকে ধারণা করা যায় যে মার্কুইসের বয়ান সত্যের অধিক কাছাকাছি।

ভাগ্যের নির্মম পরিহাস যে মুক্তি পেয়ে কপর্দকহীন পেরুজ্জিয়া তাঁর গ্রামে ফিরে যান। সেখানে তাঁকে বীরের সংবর্ধনা দেওয়া হয়। প্রথম মহাযুদ্ধকালে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯২১ সালে তিনি যুদ্ধ থেকে ফিরে আসেন এবং বিয়ে করেন। রুটি–রুজির জন্য তাঁকে আবারও ফ্রান্সে ফিরে যান এবং হৎ-সেভোয়া শহরে রঙের দোকান খোলেন। সেখানেই তিনি ১৯৪৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন। মার্কুইস ঘটনার পরে মরক্কোর কাসাব্লাঙ্কা শহরে থিতু হন, এরপর আর কখনো জনসমক্ষে উপস্থিত হননি। তিনি ১৯৩১ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

 তথ্যসূত্র

১.

মোনালিসার প্রেম, ভবেশ রায়, নন্দিতা, ১৯৮৭

২. দ্য লস্ট মোনা লিসা, আর এ স্কটি, ট্রান্সওয়ার্ল্ড পাবলিশার্স, যুক্তরাজ্য, ২০০৯

৩. মোনা লিসা, ডোনাল্ড স্যাসন, হার্পার–কলিন্স পাবলিশার্স, ২০০১

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব খ য ত চ ত রকর ম ন ল স র জন য ব ক র র জন য ল য ভর থ ক ব ল টপ র ফ শ ল পকর ম র জন য ত ল য ভর র ড স ম বর আম র ক র আম র ক য় র জন য ব ন র জন য র জন য প কর ছ ল ন ব যবস য় র ব যবস স র একট এ ধরন র দ ই বছর র প রথম নকল ত র এরপর ম র কর ম র র পর ম বর ম প রস ত ল ত হয় কর ন য স র এক বল ন য র পর চ ত হল ন হয় ছ ল কল ত র র পর প ত হয় ছ য র পর র প রব স ন দর ত পর চ আর প র মন ত র র প রস করছ ল আগস ট তদন ত র সময় র দরজ সরক র বলল ন নকল ক করছ ন ব ষয়ট প রহর করব ন করল ন অপর ধ সময় র অবস থ এ সময় আসল ম উপহ র নকল র নকল ম ত নজন দরজ র হওয় র

এছাড়াও পড়ুন:

২৫ লাখ টাকার স্বর্ণালংকার ফেরত দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন খাইরুল

এক যাত্রীর ফেলে দেওয়া ২৫ লাখ টাকার স্বর্ণাংলকার ফিরিয়ে দিয়ে সততার দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন কলেজছাত্র ও পার্টটাইম অটোরিকশাচালক খাইরুল ইসলাম। এ ঘটনায় খাইরুলকে নিয়ে তার এলাকার বাসিন্দারাও গর্বিত।

খাইরুল ইসলাম বগুড়ার শাজাহানুপর উপজেলার বেতগাড়ি এলাকার শাহজাহান আলীর ছেলে। তিনি সরকারি শাহ সুলতান কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্র। সংসারে অভাব অনটনের কারনে পার্টটাইমে অটোরিকশা চালিয়ে নিজের পড়ালেখার খরচ চালানোর পাশাপাশি সংসারে সহায়তা করে থাকেন।

গত ২৯ মার্চ অটোরিকশা চালানোর সময় শহরতলীর বনানী এলাকায় তার অটোরিকশায় একটি ব্যাগ দেখতে পান। খাইরুল বুঝতে পারেন, এটি কোনো যাত্রী ভুল করে ফেলে রেখে গেছেন। ব্যাগের মালিক না পেয়ে খাইরুল ব্যাগ নিয়ে বাড়ি গিয়ে মায়ের সামনে ব্যাগ খুলে দেখেন, ১৮ ভরি স্বর্ণালংকার ও নগদ ১৫ হাজার টাকা আর কিছু কাপড়।

খাইরুলের মা ফাতেমা খাতুন খাইরুলকে নির্দেশ দেন, এই ব্যাগ মালিকের কাছে ফেরত দিতে। মায়ের কথায় তিনি ব্যাগ ফেরত দিতে মালিককে খুঁজতে থাকেন। দু’দিন ধরে মালিককে খুঁজে না পেয়ে বগুড়া সদর থানায় বিষয়টি অবগত করেন এবং ব্যাগ থানায় জমা রাখেন। একপর্যায়ে পুলিশ জানতে পারে, ব্যাগের মালিকের নাম শাহিন আলম। তার বাড়ি পাবনা জেলায়। তিনি একজন স্বর্ণ ব্যবসায়ী। ঈদের দুদিন আগে বগুড়ায় এসেছিলেন কেনাকাটা করতে। ওই সময় ১৮ ভরি স্বর্ণালংকার কিনে নিয়ে যাচ্ছিলেন। বনানী এলাকায় বাসের জন্য অটোরিকশায় যান। এরপর বাস দেখে দ্রুত বাসে ওঠে পড়েন অটোরিকশায় ব্যাগ ফেলে রেখে।

বগুড়া পুলিশ শাহিন আলমের সন্ধান পেয়ে পেয়ে তাকে বগুড়া সদর থানায় ডেকে পাঠান। ৪ মার্চ রাত ১১টার দিকে বগুড়া সদর থানায় আসেন তিনি। সেখানে ডাকা হয় অটোরিকশাচালক খাইরুলকেও। সেখানে পুলিশের সামনে প্রকৃত মালিক হারোনো জিনিসপত্রের সঠিক বর্ণনা দিলে তার হাতে তুলে দেওয়া হয় ব্যাগ।

শাহিন বলেন, ঈদের দুদিন আগে ২৯ মার্চ তিনি ব্যবসার কাজে বগুড়া শহরে আসেন। এরপর তিনি শহরের নিউমার্কেট থেকে ২৫ লক্ষাধিক টাকায় ১৮ ভরি স্বর্ণের বিভিন্ন গহনা কিনে একটি কালো ব্যাগে ভরে বাড়ি যাওয়ার জন্য শহরের সাতমাথায় যান। এরপর সিএনজিচালিত একটি অটোরিকশায় চেপে বনানী যান। সেখানে পাবনাগামী একটি বাসে উঠে রওনা দেন। বাসটি যখন শাজাহানপুর উপজেলার মাঝিরা এলাকায় পৌঁছে, তখন তার মনে হয় তিনি ভুল করে স্বর্ণালংকারসহ তার ব্যাগটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় ফেলে রেখে গেছেন। এরপর তৎক্ষণাৎ তিনি বাস থেকে নেমে পড়েন এবং শাহজাহানপুর ও বগুড়া সদর থানার দ্বারস্থ হন।

পুলিশের পরামর্শে তিনি শাজাহানপুর থানায় একটি জিডি করেন। সেইসঙ্গে তিনি কয়েকদিন ধরে সাতমাথায় ওই সিএনজিচালককে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকেন। কিন্তু তার দেখা না পেয়ে তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। ব্যাগ পেয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে খাইরুলকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন এবং খাইরুলকে পুরস্কৃত করেন।

সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক খাইরুল ইসলাম বলেন, তার গাড়িতে পাওয়া ব্যাগটি তিনি বাড়িতে রেখে দুদিন যাবত মালিককে খুঁজে না পেয়ে পুলিশকে জানান। পুলিশের সহায়তায় ব্যাগের প্রকৃত মালিককে ফেরত দেন। খাইরুল বলেন, অন্যের ব্যাগটি আমার কাজে মস্তবড় বোঝার মতো মনে হচ্ছিল। ব্যাগটি প্রকৃত মালিককে ফেরত দিতে পেরে স্বস্তি পেলাম। 

খাইরুলের এলাকার বাসিন্দা স্কুলশিক্ষক রুহুল আমিন বলেন, স্বর্ণালংকারসহ খাইরুল ব্যাগ মালিককে ফিরিয়ে দিয়ে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন, তাতে আমরা এলাকাবাসীও গর্বিত।

বগুড়া সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এসএম মইনুদ্দিন বলেন, এ যুগেও যে হাজারো মানুষের ভিড়ে সৎ মানুষ আছে; তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ সিএনজিচালক খাইরুল ইসলাম। সততার জন্য আমি তাকে স্যালুট জানাই।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ঈদে সড়ক দুর্ঘটনায় ২৪৯ জন মারা গেছেন: রোড সেফটি ফাউন্ডেশন
  • বিয়ে করেছেন মীরাক্কেলের জামিল
  • ভাঙ্গায় মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগে বাবা আটক
  • ১৪ মিনিটের ঝড়ে লন্ডভন্ড লিভারপুল, ২৬ ম্যাচ পর হারল প্রিমিয়ার লিগে
  • আক্কেলপুরে অটোরিকশার ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে সড়ক অবরোধ
  • এনরিকে ও ক্যাম্পোসের পিএসজির চারে চার
  • একই রশিতে ঝুলছিল মা ও ছেলের লাশ
  • সিঙ্গাপুর যাচ্ছেন তামিম
  • ২৫ লাখ টাকার স্বর্ণালংকার ফেরত দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন খাইরুল