ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ (আমেরিকাকে আবার মহান করো) নীতিগুলো কি উল্টো ফল দেবে? মানে, ট্রাম্প কি আসলে তাঁর নিজের দেশের বদলে এশিয়াকে—বিশেষ করে পূর্ব এশিয়াকে—আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি শক্তিশালী করে তুলছেন?

বর্তমানে যা দেখা যাচ্ছে, তাতে পরিস্থিতি তেমনই দেখাচ্ছে। কারণ, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শুল্ক ও বাণিজ্যনীতি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোকে দূরে ঠেলতে গিয়ে মিত্রদেরও সরিয়ে দিচ্ছে। আর এই নীতিগুলোর ফলে পূর্ব এশিয়া ও ইউরোপ পরস্পরের কাছাকাছি আসার সুযোগ পাচ্ছে।

একটা সম্ভাব্য জোটের কথা এখন অনেকেই বলছেন। এর নাম সিপিটিপিপি। এই কাঠামো গড়ে উঠলে তা বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও সক্রিয় মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চলগুলোর একটি হয়ে উঠতে পারে। আর তেমন হলে আমেরিকার একঘরে হয়ে পড়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

ট্রাম্পের শুল্কনীতি যদি চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের চোখে অতিরিক্ত আক্রমণাত্মক মনে হয়, তাহলে ইউরোপ-এশিয়া অর্থনৈতিক জোট একটি কৌশল হিসেবে খুব কার্যকর হবে। যদিও অনেকে মনে করেন, এশিয়ায় আমেরিকার উপস্থিতি এতটাই দৃঢ় যে এমন হুমকিকে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই।

টোকিওর ন্যাশনাল গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজের অর্থনীতির অধ্যাপক ইউকিং শিং-এর মতে, ট্রাম্প প্রশাসনের আনা তথাকথিত ‘বিপ্লবাত্মক পরিবর্তনগুলো’ চীনের সিপিটিপিপিতে যোগ দেওয়ার জন্য ভালো সহায়ক পরিবেশ তৈরি করেছে। এখন এই সম্ভাব্য সিপিটিপিপি চুক্তিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নও যোগ দেবে কি না, তা নিয়েও এখন বিতর্ক চলছে।

সম্প্রতি টোকিওতে ফরেন করেসপনডেন্টস ক্লাব অব জাপানে এক আলোচনায় শিং বলেন, বিশ্বায়নের এই যুগে সিপিটিপিপি হয়তো বৈশ্বিক বাণিজ্যের একটি নতুন কাঠামো হয়ে উঠতে পারে।

সিপিটিপিপি কী? এ হলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপের উত্তরসূরি। এই পার্টনারশিপ ট্রাম্প তাঁর প্রথম রাষ্ট্রপতি পদে থাকা অবস্থায় বেরিয়ে যাওয়ার কারণে ভেঙে পড়েছিল। এতে যুক্ত আছে অস্ট্রেলিয়া, ব্রুনেই, কানাডা, চিলি, জাপান, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো, নিউজিল্যান্ড, পেরু, সিঙ্গাপুর, ব্রিটেন এবং ভিয়েতনাম। দক্ষিণ কোরিয়াও এতে যোগ দেওয়ার বিষয়ে ভাবছে।

ট্রাম্পের শুল্ক পদক্ষেপগুলো তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদের শুরুর দিকেই আর্থিক বাজারগুলোকে বড় আঘাত দিয়েছে। শুধু তা–ই নয়, সেই সঙ্গে আমেরিকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। এই পদক্ষেপগুলোর প্রাথমিক লক্ষ্য ইউরোপ ও এশিয়া। মনে হচ্ছে, ট্রাম্প ইউরোপ ও এশিয়ার সম্পর্কের বিষয়ে নতুন চিন্তাভাবনা তৈরি করতে উত্সাহ জোগালেন।

অর্থনৈতিক সমস্যার দ্রুত সমাধান খোঁজার আশায় এ ধরনের জটিল এক ব্যবস্থায় হঠাৎ করে এলোপাতাড়ি ছুরি চালালে এর ফলাফল ভয়ানক হতে পারে। এমনকি জীবনঘাতী হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।

চীন পূর্ব এশিয়া ও ইউরোপে আক্রমণাত্মক কূটনীতি থেকে ধীরগতির কূটনীতি গ্রহণ করবে। চীনের উদ্দেশ্য হবে বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ময়দান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমাগত সরে যাওয়ার ফলে তৈরি হওয়া শূন্যতার সুযোগ কীভাবে গ্রহণ করা যায়। শুধু চীন নয়, বরং ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়াও ট্রাম্পের আমেরিকা ফার্স্ট নীতির শিকার। ফলে তারা সবাই হয়তো একসঙ্গে কাজ করার কথা ভাবতে পারে। নইলে বিশ্ববাজারভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থা রক্ষা করা কঠিন হয়ে যাবে।

চীন এবং এশিয়ার অন্যান্য কিছু দেশ বৈশ্বিক উত্পাদন সরবরাহ চেইনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যদি বাণিজ্যযুদ্ধ তীব্র হয়, তাহলে এই দেশগুলোর হাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কাজে লাগানোর মতো শক্তিশালী কিছু হাতিয়ার আছে। আমেরিকার বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এ দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল। দেশগুলো থেকে কোম্পানিগুলো পণ্য উৎপাদন করিয়ে বিশ্বব্যাপী রপ্তানি করে। তাদের অংশগ্রহণ ছাড়া আমেরিকার বাণিজ্য ভারসাম্য গভীর আঘাত পেতে পারে। এমনকি আমেরিকার শেয়ারবাজারেও মারাত্মক ধস নামতে পারে।

পূর্ব এশিয়ার শক্তিগুলোর মধ্যে একটি বাড়তি বোঝাপড়ার পরিবেশ লক্ষ করা যাচ্ছে। জাপান, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া ৩০ মার্চ একমত হয়েছে যে তারা ত্রিপক্ষীয় অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সহযোগিতা বাড়াবে। একে পূর্ব এশিয়ার একীকরণের দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। কারণ, এই তিনটি দেশই এই অঞ্চলের তিনটি বৃহত্তম অর্থনীতি।

তবে এত কিছুর পরেও এর মানে এই নয় যে পূর্ব এশিয়ায় ‘চীন নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার’ জন্ম হচ্ছে—এমনটাই মনে করেন অধ্যাপক কেন্ট ক্যাল্ডার। তিনি ওয়াশিংটনের জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের এডউইন ও.

রেইশোয়ার সেন্টারের পরিচালক। টোকিওর এক আলোচনায় তিনি বলেন, ‘আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে যুক্তরাষ্ট্র ও এশিয়ার সম্পর্কের পেছনে খুব গভীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা কাজ করে।’

কেন্ট ক্যাল্ডার বলছেন, এমন কিছু ‘স্থিতিশীল বাস্তবতা’ আছে, যা আগামী বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র ও এশিয়ার সম্পর্ক আরও মজবুত করতে পারে। যেমন খাদ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে চীনের জনসংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে চার গুণ বেশি। এটা চীনের জন্য একধরনের দুর্বলতা, আর যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একধরনের শক্তি। কারণ, তারা খাদ্য রপ্তানিতে বড় এবং খাদ্য উৎপাদন-সম্পর্কিত উদ্ভাবনেও এগিয়ে।

শক্তির জোগানেও যুক্তরাষ্ট্র গত কয়েক বছরে বড় রপ্তানিকারক হয়ে উঠেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি হয়েছে। যেমন চীনের ডিপসিক প্রযুক্তির আবির্ভাব। কিন্তু চীন আমেরিকার সিলিকন ভ্যালির সমতুল্য কিছু তৈরি করতে পেরেছে কি না, তা এখনো বলা যাচ্ছে না। এ ছাড়া এশিয়া মহাদেশ ঘিরে থাকা সমুদ্রপথগুলোর ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেড়েছে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এই অঞ্চলে শক্তিশালী ভূমিকা রাখা সম্ভব হতে পারে।

পণ্য ও জ্বালানির বিপুল পরিমাণ লেনদেন সম্প্রতি চীনকে আরও ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। একসময় চীন ছিল জ্বালানি রপ্তানিকারক। কিন্তু এখন তারা বিশ্বের অন্যতম বড় জ্বালানি আমদানিকারকে পরিণত হয়েছে। চীন এখন প্রতিদিন এক কোটিরও বেশি ব্যারেল অপরিশোধিত তেল আমদানি করে। এর বেশির ভাগই আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে।

অধ্যাপক ক্যাল্ডার বলছেন, গত এক প্রজন্মে চীন ও বাকি বিশ্বের মধ্যে একটি গভীর নির্ভরশীল সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।

এই নির্ভরতা সবচেয়ে স্পষ্টভাবে দেখা যায় ভারত মহাসাগর অঞ্চলে। এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র এখনো ভূরাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী।

চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই নির্ভরতা বেড়েছে। এটি একদিকে স্থিতিশীলতার ভিত্তি হতে পারে। কিন্তু অন্যদিকে তা চীনের জন্য একটি বড় ঝুঁকিও তৈরি করেছে। একটি দেশ হিসেবে তাদের প্রবৃদ্ধি ঘটছে। বিশ্বের সঙ্গে তাদের যোগসূত্র দিনে দিনে গভীরতর হচ্ছে।

ট্রাম্পের আমলে বাণিজ্য ও শুল্কযুদ্ধ ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। তা থেকে একটা জিনিস খুব স্পষ্ট হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য ও বিনিয়োগের কাঠামো আসলে অনেক বেশি জটিল। এই বাস্তবতা বোধ হয় ট্রাম্প প্রশাসনের বোঝার বাইরে।

অর্থনৈতিক সমস্যার দ্রুত সমাধান খোঁজার আশায় এ ধরনের জটিল এক ব্যবস্থায় হঠাৎ করে এলোপাতাড়ি ছুরি চালালে এর ফলাফল ভয়ানক হতে পারে। এমনকি জীবনঘাতী হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।

এন্টনি রাওলি সাংবাদিক, ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউর সাবেক বাণিজ্য সম্পাদক

সাউথ চায়না মর্নিং নিউজ থেকে নেওয়া ইংরেজির অনুবাদ

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ক ব যবস থ আম র ক র ন র জন ইউর প

এছাড়াও পড়ুন:

সমঅধিকার কতদূর!

অন্তর্বর্তী সরকারের নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন ‘সর্বক্ষেত্রে সর্বস্তরে নারীর প্রতি বৈষম্য বিলুপ্তি এবং নারী-পুরুষের সমতা অর্জনের লক্ষ্যে পদক্ষেপ চিহ্নিতকরণ’ শীর্ষক প্রতিবেদন জমা দিয়েছে গত ১৯ এপ্রিল। প্রতিবেদনের ভূমিকায় বলা হয়েছে, এ কমিশনের প্রধান বিবেচনা হবে নারীর প্রতি সব ধরনের  বৈষম্য নিরসন এবং নারী-পুরুষ সমতা অর্জনে পদক্ষেপগুলো চিহ্নিত করা এবং সেগুলো বিভিন্ন মেয়াদে বাস্তবায়নে সুপারিশ তৈরি করা। সুপারিশ প্রণয়নে বিভিন্ন আর্থসামাজিক খাতে নারীর অবস্থা ও অবস্থান বিশ্লেষণ করে ১৭টি অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। 
কমিশনের এ প্রতিবেদনের পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনা দেখা যাচ্ছে; যা খুবই স্বাভাবিক। কেউ কেউ খুব ইতিবাচক হিসেবে এটিকে দেখছেন, আবার কেউ শুধু বিরোধিতার জন্য সমালোচনায় সীমাবদ্ধ। কমিশনও আশা করেছে, ‘এই প্রতিবেদন জনমানসে নাড়া দেবে, ভাবাবে এবং তর্ক-বিতর্ক সৃষ্টি করার মাধ্যমে নারীর সমতা অর্জনে সহায়তা করবে।’ 
সমাজে কোনো কালে সর্বসম্মতিতে কোনো বিষয় সমাধানের প্রান্তে নিয়ে আসা সম্ভব না; যা একজনের কাছে প্রগতিশীল বলে গণ্য, তা অন্যের কাছে অহেতুক বা বাড়াবাড়ি। 
কমিশনের সুপারিশমালায় কয়েকটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়েছে। যেমন সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদের অধীনে নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্যমূলক বিধান বিদ্যমান রয়েছে। বিয়ে, তালাক, সন্তানের অভিভাবকত্ব ও ভরণপোষণের ক্ষেত্রে ধর্মীয় আইন অনুসরণ বাধ্যতামূলক হওয়ায় নারীরা বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকেন। কমিশন এ বৈষম্য দূর করার জন্য সংবিধানে পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে। এ ক্ষেত্রে অভিন্ন পারিবারিক আইন অর্জনের লক্ষ্যে অধ্যাদেশ জারির সুপারিশ করা হয়েছে। 
আমরা কম-বেশি সবাই জানি, বাংলাদেশে উন্নয়ন খাতের অনেক সংগঠনই ‘নারী ও পুরুষ’– এই বাইনারি ধারণার বাইরে অন্যান্য লিঙ্গ বৈচিত্র্যের মানুষের অধিকার বিষয়ে জনমনে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করে থাকে। যদিও ধর্ষণ আইন সংস্কারের বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘লিঙ্গ, বয়স, ধর্ম, জাতীয়তা, ভাষা ও প্রতিবন্ধিতার পার্থক্য নির্বিশেষে নিরপেক্ষ বিচার ও আইনশৃঙ্খলা নিশ্চিত করা’র সুপারিশ রয়েছে। এখানে লিঙ্গ বৈচিত্র্যের মানুষের জন্য স্পষ্ট সুপারিশের অনুপস্থিতিতে বিষয়টি অস্পষ্ট রয়ে গেছে যে, এ বিষয়ে সংস্কার কমিশনের অবস্থান কী? 
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন সম্পর্কে ‘নিজেরা করি’র সমন্বয়কারী ও মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির বলেন, ‘প্রতিবেদনে নারীর সব বিষয় সার্বিকভাবে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। এটি একটি বড় পদক্ষেপ। এ জন্য কমিশনকে সাধুবাদ জানাই। এখন এর বাস্তবায়ন নির্ভর করবে এই সরকার  এবং পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের ওপর। আমরা এর বাস্তবায়ন চাই; এমনকি পরবর্তী যে নির্বাচিত সরকার আসবে তারাও যেন তাদের মেনিফেস্টোতে বিষয়গুলো রাখে, আমরা তা নিশ্চিত করতে চাই।’ অভিন্ন পারিবারিক আইনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বাণিজ্য চলছে অভিন্ন আইন দ্বারা; এটা কোনো ধর্মীয় আইন দ্বারা চলছে না। এমনকি ক্রিমিনাল বা ফৌজদারি আইনও অভিন্ন। এগুলো যদি গ্রহণ করা যায়, তবে শুধু নারীর বিষয়ে এত আপত্তি কেন?’ 
তিনি আরও বলেন, ‘সংসদীয় আসন সংখ্যা বৃদ্ধি, নারী আসন বৃদ্ধি, সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদে আসা– এসব বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই।’
সম্প্রতি এক টেলিভিশন চ্যানেলে ‘টকশো’তে ব্যারিস্টার সারা হোসেনকে অভিন্ন পারিবারিক আইন নিয়ে খুবই ধৈর্য সহকারে যুক্তি দিয়ে একজন মাওলানাকে বোঝানোর চেষ্টা করতে দেখা গেছে। সারা হোসেন যুক্তি দিয়ে বোঝাচ্ছেন, ‘জামায়াতের সদস্য যারা ইংল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডা বা অন্য উন্নত দেশে আছেন, তারা তো সেখানকার অভিন্ন আইনের অধীনেই বিয়ে করছেন, শরিয়া আইনে বিয়ের কোনো সুযোগ সেখানে নাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘১৮৯০ সালে যে অভিভাবকত্ব আইন হয়েছে, সেটা নিয়ে তো আপনাদেরকে একবারও মাঠে নামতে দেখিনি। এমনকি পারিবারিক নির্যাতন আইন ২০১০ সবার জন্য অভিন্ন; মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান সবার জন্যই আছে। সব ধর্মের জন্য একই আইন আছে। আপনি আপনার ধর্মের আচার-আচরণ পালন করতে পারেন, কিন্তু আইনটা অভিন্ন থাকতে হবে। অভিন্ন আইন বিভিন্ন দেশে প্রচলিত।’ 


সারা হোসেন যতই তাঁকে যুক্তি দিয়ে বোঝাচ্ছেন, ততই তিনি ধর্মকে টেনে এনে ‘বিচার মানি, কিন্তু তালগাছ আমার’ জাতীয় কথা বলতে থাকলেন। ধর্ম নিয়ে যারা রাজনীতি করেন, তারা এই অভিন্ন পারিবারিক আইনের বিরোধিতা করবেনই। তাই এমন ধরনের কোনো কোনো সংগঠনের তৎপরতাও শুরু হয়ে গেছে। তাদের ভাষ্যমতে, অভিন্ন পারিবারিক আইন নাকি ইসলামবিরোধী! কারণ বিয়ে, তালাক ইত্যাদি ক্ষেত্রে সমানাধিকার মানেই হলো নারী আর অমর্যাদাকর জীবনযাপনে বাধ্য হবে না। কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গসমতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে মাতৃত্বকালীন অধিকার এবং নারীর প্রজনন অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র এসব বিষয়ে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নিয়ম হয়তো আছে, কিন্তু এগিয়ে যাওয়ার পথটা প্রশস্ত হবে নীতিমালা গ্রহণ ও সুপারিশ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে। 
পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার টিকে থাকার প্রধান শর্ত হলো ‘মুনাফা’। তা সে যে প্রকারে হোক না কেন। কল্যাণরাষ্ট্রগুলো অর্থনৈতিক চরিত্রের দিক থেকে পুঁজিবাদী হলেও রাষ্ট্রের নাগরিকদের সব প্রকার মৌলিক অধিকারের জোগান দিয়ে থাকে। সেখানে একজন কর্মজীবী নারীকে শিশুসন্তান নিয়ে দুর্ভাবনায় থাকতে হয় না বিধায় তাঁর কাজ বাধাগ্রস্ত হয় না। বরং সর্বোচ্চ যেটুকু শ্রম দেওয়া যায়, তিনি তাঁর সবটাই দিয়ে থাকেন। যাতে রাষ্ট্রই লাভবান হয়। বিষয়টি উপলব্ধি করেছে উন্নত দেশগুলো। তাই তারা এগিয়ে গেছে। সেখানে নারীর প্রতি বৈষম্য অনেক কম। আমাদের দেশে ঠিক এর বিপরীত চিত্র দেখা যায়। একজন নারীকে ঘুম থেকে উঠে পরিবারের সব সদস্যের জন্য খাদ্যের সম্ভার সাজিয়ে রাখাতে ঘরের মধ্যেই নিরলস ছুটতে হয়। তারপর স্কুলপড়ুয়া সন্তানের জন্য টিফিন, স্বামী এবং তার নিজের জন্য দুপুরের খাবার তৈরি করে তা আবার ব্যাগে ভরে দেওয়া; সন্তানকে বারবার মনে করিয়ে দেওয়া– ‘টিফিনটা ঠিকমতো খেয়ো কিন্তু, পানি খেয়ো বেশি করে।’ তারপর আবার ছুট লাগাতে হয় অফিসের উদ্দেশে। যারা অফিসের গাড়ি পান, তাদের ভাগ্য ভালো; নয়তো পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নিতে গিয়েও কত রকম বিড়ম্বনা– ‘এই আপা উইঠেন না, লেডিস সিট নাই।’ তারপর অনেক বাস মিস করে রীতিমতো যুদ্ধ করে অফিসে পৌঁছানোর পর বসের মুখঝামটা, ‘সময়মতো অফিসে আসতে পারেন না তো চাকরি করেন কেন?’ বস মানুষটি ভুলে যান, শ্রেণিগত ও লিঙ্গীয় সুবিধার কারণে তাঁকে নারীর এই কাজগুলো করতে হয় না।
আমাদের মতো দেশে গৃহস্থালির কাজকর্ম করতে আসে একেবারে নিম্নবিত্ত মানুষ। মূলত নারীরা যুক্ত থাকেন এই কাজে। এ ধরনের চাকরির না আছে দীর্ঘস্থায়িত্বের নিশ্চয়তা, যথাযোগ্য মাইনে; না আছে ছুটিছাটা। তাই তাঁকে বিকল্প হিসেবে কয়েকটি বাসায় কাজ করে জীবনধারণের নিশ্চয়তা বিধান করতে হয়। তাই এই অপ্রাতিষ্ঠানিক সেক্টরের শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি, শ্রমঘণ্টা, বিশ্রাম, ছুটি ইত্যাদি বিষয় নির্ধারণ করে দেওয়া প্রয়োজন। 
কমিশনের সুপারিশমালায় সব খাতে নারী ও পুরুষ শ্রমিকের জন্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করার কথা বলা হয়েছে। এ প্রতিবেদনের বাস্তবায়ন হতে পারে নারীর ক্ষমতায়নের পক্ষে এক বিশাল পদক্ষেপ।
অধিকারকর্মী ও আদিবাসী নেত্রী ইলিরা দেওয়ান বলেন, ‘আন্তরিকতা থাকলে এই সরকার অবশ্যই কমিশনের প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন শুরু করতে পারে। বিগত সরকারের আমলে বান্দরবানের ব্যাংক ডাকাতির ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিশুসহ আটক বম নারীদের এখনো (গত ৮ মাসে) কারাগারে আটক রাখা হয়েছে। নারীর মানবাধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বম নারীদের মুক্তি দেওয়া হলে তা হবে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।’ 
লেখক: সমন্বয়ক, সাংগাত বাংলাদেশ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বাংলাদেশের সঙ্গে গঙ্গা চুক্তি বাতিলের দাবি বিজেপি নেতার
  • যেদিকে তাকাই, শুধু অবিশ্বাস: ভারতের বিভিন্ন শহরে ভয়ে ঘরবন্দী কাশ্মীরি শিক্ষার্থীরা
  • সমঅধিকার কতদূর!