ওষুধ ও সেবা মিলছে না শিশু, মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি
Published: 7th, April 2025 GMT
অর্থ সংকটের কারণে দেশে ৪ হাজার ৫৬২টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে সেবা কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। ১০ মাস ধরে অনেক কেন্দ্রে বিনামূল্যের ওষুধ মিলছে না। বন্ধ আছে সন্তান প্রসবের আগে জরুরি পরীক্ষা-নিরীক্ষাও।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মা ও শিশুমৃত্যুর হার কমাতে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রেগুলো প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এসব কেন্দ্রে বেশির ভাগ নিম্ন আয়ের মানুষ সেবা নেন। বর্তমান সংকট চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার বৃদ্ধির ঝুঁকি তৈরি করেছে।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ সূত্র জানায়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালিত হয় কৌশলগত পরিকল্পনার (ওপি) মাধ্যমে। ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রেগুলো এর আওতায় পরিচালিত হয়। এর অর্ধেক ব্যয় সরকার বহন করে, বাকি অর্থ আসে দাতা সংস্থাগুলো থেকে। প্রতিদিন গড়ে ৬৫ থেকে ৭০ লাখ মানুষ সেবার জন্য যেত। এ হিসাবে প্রায় পৌনে সাত কোটি মানুষ ওষুধ ও সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সেবামূলক কার্যক্রম চলে স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচির (এইচপিএনএসপি) মাধ্যমে। এর চতুর্থ কর্মসূচির মেয়াদ শেষ হয়েছে গত বছর জুনে। জুলাইয়ে নতুন করে ১ লাখ ৬ হাজার ১০০ কোটি টাকার পঞ্চম এইচপিএনএসপি শুরু হওয়ার কথা ছিল। নানা জটিলতায় ১০ মাসেও এ কর্মসূচির অনুমোদন মেলেনি। পরে দেড় বছরের জন্য একটি স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা করা হয়। তাতেও দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি। বর্তমান সংকটের মূল কারণ এটি।
এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আজ সোমবার (৭ এপ্রিল) বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস পালিত হচ্ছে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য– ‘জন্ম হোক সুরক্ষিত, ভবিষ্যৎ হোক আলোকিত’।
ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে জন্মনিয়ন্ত্রণ, মা ও শিশুস্বাস্থ্য এবং বয়ঃসন্ধিকালীন সেবা (কিশোর প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা) দেওয়ার কথা। আয়রন, ফলিক এসিড, ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স, ক্যালসিয়াম, কৃমিনাশক, প্যারাসিটামল, মেট্রোনিডাজল, পেন্টোনিক্স-২০, হিস্টাসিনসহ ২৮ ধরনের ওষুধ সরবরাহ করার কথা এসব স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা.
সমকালের মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, জেলার রাঢ়ীখাল ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে ৬ মাস ধরে রোগীদের বিনামূল্যের ওষুধ দেওয়া হচ্ছে না। এর মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীও রয়েছে। নারীদের জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ির সংকটও আছে। সন্তান প্রসবের আগে জরুরি পরীক্ষা সেবাও বন্ধ। ফলে স্বাভাবিক প্রসবের হার কমছে। প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ জনকে সেবা না নিয়েই ফিরতে হচ্ছে। এসব রোগীর শুধু পরামর্শ দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে।
জেলার ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রের এক কর্মকর্তা জানান, তারা ওষুধ ও প্রয়োজনীয় উপকরণের জন্য পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে বারবার চিঠি দিচ্ছেন।
যশোরের মনিরামপুর উপজেলার ১৭ ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রের অবস্থা একই রকম। তিন মাস ধরে বিনামূল্যের ওষুধ সরবরাহ বন্ধ। মনিরামপুর সদর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রের পরিবারকল্যাণ পরিদর্শক (এফডব্লিউভি) শ্রাবন্তী দাস বলেন, ‘কৃমিনাশক বড়ি ছাড়া কোনো ওষুধ নেই। ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে কোনো ওষুধ বরাদ্দ পাইনি। ওষুধ আসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি রোগীরা জেনে গেছেন। এ জন্য সেবা নিতে লোকজন কম আসেন। যারা আসেন তাদের রোগ সম্পর্কে মৌখিক পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।’
রোহিতা ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিবারকল্যাণ পরিদর্শক রিনা পারভেজ বলেন, ‘নভেম্বরের পর আর ওষুধ আসেনি। ওষুধ না থাকায় রোগীরাও এখন আর আসেন না। অন্তঃসত্ত্বা নারীরা এলে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করি। বাকি সময় অলস বসে কাটাতে হচ্ছে।’
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, অনেক কেন্দ্র থেকে ওষুধের জন্য বারবার আবেদন করা হচ্ছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনও বন্ধ। এসব কেন্দ্রের বিদ্যুৎ বিল ১০ মাস বকেয়া। সবচেয়ে বড় বিষয়, এসব কেন্দ্রে সেবা নেন নিম্ন আয়ের মানুষ, যাদের বেসরকারিভাবে চিকিৎসা করানোর সক্ষমতা নেই। সংকট দেখা দিয়েছে পরিবার পরিকল্পনার উপকরণেও।
স্বাস্থ্য খাতের অগ্রগতির একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার নিয়ন্ত্রণ। দেশে শিশুমৃত্যুর হার কমছে না, বরং বাড়ছে। ২০২৩ সালের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিএসএস) প্রতিবেদন বলছে, আগের তুলনায় দেশে শিশুমৃত্যুর হার বেড়েছে। ২০২১ সালে দেশে ১ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুহার ছিল হাজারে ২২ জন; ২০২২ সালে তা বেড়ে হয়েছে ২৫। এ ছাড়া ৫ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুও আগের চেয়ে বেড়ে ৩১ জন হয়েছে। ২০২১ সালে প্রতি হাজারে এই হার ছিল ২৮ জন।
শিশুমৃত্যু বাড়লেও দেশের মাতৃমৃত্যু কিছুটা কমেছে। প্রতি লাখ জীবিত শিশু জন্মের বিপরীতে মাত্যৃমৃত্যু কমে ১৫৬ জন হয়েছে, ২০২১ সালে যা ছিল ১৬৮ জন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লা বলেন, এখনও ৫০ শতাংশের বেশি শিশুর জন্ম হয় বাড়িতে। অপ্রশিক্ষিত মানুষের হাতে সন্তান প্রসবের কারণে অনেক সময় মা ও শিশু মৃত্যুঝুঁকিতে পড়ছে। দেশে প্রাতিষ্ঠানিক ও নিরাপদ প্রসব বাড়াতে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রগুলো বড় ভূমিকা রাখছিল।
আবিদ হোসেন মোল্লা বলেন, এখনও দেশে ৫ বছরের কম বয়সে শিশুমৃত্যুর মধ্যে প্রায় অর্ধেক সংখ্যক মারা যায় জন্মের ২৮ দিনের মধ্যে। অর্থাৎ নবজাতক অবস্থায়। ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে সেবা বন্ধ হলে এর প্রভাব পড়বে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হারে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-এসডিজি অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যুর হার ৭০-এর নিচে এবং নবজাতক মৃত্যুর হার প্রতি ১০০০ জীবিত জন্মে ১২ জনের নিচে নামিয়ে আনতে হবে। বর্তমান বাস্তবতায় এ দুটি লক্ষ্যে পৌঁছানো কঠিন হবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প রসব র র জন য বছর র
এছাড়াও পড়ুন:
ভালোবাসাই ধরে রেখেছে বিষ্ণুরামের পুতুল নাচ
সেই কিশোর বেলার কথা। হাত আর আঙুলের কারুকার্যে এমন মন জয়– না দেখলে আফসোসই রয়ে যেত! তখন সপ্তম কিংবা অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। পাশের পাড়ায় পুতুল নাচ দেখার আয়োজন হয়েছে। দারুণ কৌতূহল! দেখতে যাই। শো শেষ। কিন্তু মন তো মানে না। আরও দেখতে চায়! সে আয়োজনে যে কতবার দেখেছি! আজও সেই পুতুলের অভিনয়, ডায়ালগ, গানের অংশ, বেশ মনে পড়ে। সত্যি লোকসংস্কৃতির এক আনন্দদায়ক অংশ পুতুল নাচ। ছোটদের সঙ্গে বড়রাও দেখলে তো কম মজা পায় না!
পুতুল নাচকে জীবন চলার সঙ্গী করে চলেছেন গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের রামজীবন ইউনিয়নের খুঙুয়া গ্রামের বিষ্ণুরাম দাস। পূর্বজদের মাছধরা পেশা ছেড়ে বাবা বানুরামের হাত ধরে এই কলা শিখেছেন বিষ্ণুরাম। পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেলেও ভালোবেসে ফেলেছেন বলে ছাড়তে পারছেন না পুতুল নাচানো। তাঁর খোঁজ পেয়ে দেখতে গেলে হাসিমুখে বলতে থাকেন কথাগুলো। বিষ্ণুরাম বলেন, ‘বাবা ভারতীয় এক দলের পুতুল নাচ দেখে মুগ্ধ হয়ে শিখতে যান তাদের সঙ্গে। শিখে এসে ১৯৮৫ সালে কাজ শুরু করেন কুড়িগ্রামের মনিকা পুতুল নাচের দলে। এরপর পাশের গ্রামের আফসার উদ্দিনের নেতৃত্বে নাসিমা পুতুল নাচ নামে দল গড়েন। সেটি ১৯৯৭-৯৮ সালের কথা। এ দল কত কত জায়গায় যে শো দেখিয়েছে তার শেষ নেই।’
বাবার কাছ থেকে বিষ্ণুরাম এ কলা শিখে শো করা শুরু করেন। বলেন, ‘এখনও বিভিন্ন জায়গায় শো চালাই। মানুষ দেখে, আনন্দ পায়। তবে ছোটরা মজা পায় খুব। এই তো কিছুদিন আগে নাটোরে বকুলপুরের স্বাধীনতা পালাটি করে আসি। গাইবান্ধা শিল্পকলা একাডেমিতেও মাঝেমধ্যে শো দেখাতে ডাক পড়ে। তবে জীবনযাপনের চাহিদা যেভাবে বাড়তিছে তাতে এই কামাইয়ে কী হয়! কেননা, সব সময় তো শো চলে না।’ পাশে বসা সহযোগী তাঁর স্ত্রী বলেন, ‘এমন মজি গেইছে যে, ছাড়বারও পায় না, জেবন চলাও দায়!’ বিষ্ণুরাম বলেন, ‘এটা নিয়েই থাকতে হয়। এটা এক সাধনা! নতুন পালা তৈরি, ফির দলে কেউ মারা গেলে কিংবা অন্য কাজে বা কোথাও চলে গেলে সেই প্লেয়ার তৈরি করতে সময় কী কম লাগে! গড়ি তুলতে খাটনিও লাগে তো। যেমন আগে ভোকাল অধীর দা, অনিল কাকা মারা গেলে নয়া করি বানা লাগছে।’
এক দলে কতজন লাগে; জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘পুতুল নাচানো ছাড়াও ভোকাল, বাদ্য বাজনাদার, জোগালিসহ কমপক্ষে আট-নয়জন মানুষ লাগে একটা দলে।’ ভাই কৃষ্ণরামকে দেখিয়ে বলেন, ‘এনার ছেলে আমার ছেলেকে তৈরি করছি। তবে এ শুধু ভালোবাসার টানে। এখন নেতৃত্বে আছে মতিন সর্দার। গলা দেন জাকির সর্দার। সব মিলে আট-নয়জনের একটি টিম।’ পুতুল নাচানো দেখাতে বললে, বিষ্ণুরাম দাস কোনো রকমে গড়ানো টিনের ঘরের বারান্দার বাক্সে তাংড়ানো পুতুল বের করে কালো পর্দা টাঙিয়ে হাত আর আঙুলের কারসাজি দেখালেন পুতুলকে নাচিয়ে নাচিয়ে। তবে ভোকাল না থাকায় গান-কথা শোনা হলো না। শো কখন কখন হয় জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, ‘দুর্গাপূজায় হয়, রাসে হয়, আর শীতকালে টুকটাক হয়। তবে আগের মতো ডাক আইসে না। যদি স্কুল-কলেজে দেখানোর আয়োজন হতো, তবে খারাপ হতো না কিন্তু! কেননা, এর মাধ্যমে শিক্ষামূলক, সমাজ সচেতনতামূলক, বিভিন্ন বিষয় প্রচার করা যেত। আনন্দও পেত সবাই। আর আমাদেরও শো চলত, এই শিল্পটাও বাঁচিয়ে রাখা যেত!’ বিষ্ণুরাম জানান, এই গাইবান্ধায় শুধু আমাদের দলই আছে। এখনও এটা ধরি আছি, সংসার যেমন চলে চলুক, যতদিন পারি চালামো। কেননা, মানুষ তো দেখালে দেখে, আনন্দও পায়।’ এ যেন এক মায়ার টান!