ট্রাম্প প্রশাসনের বাড়তি শুল্ক আরোপ ইস্যুতে টালমাটাল বিশ্বের সব শেয়ারবাজার। রীতিমতো ধস নেমেছে খোদ যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারে। বড় পতন হচ্ছে ইউরোপের বাজারেও। ঈদের টানা ছুটি শেষে লেনদেন শুরু হলে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারেও পতনের শঙ্কায় ছিলেন অনেক বিনিয়োগকারী। আদতে তেমনটি হয়নি। ঢাকার শেয়ারবাজারে বেশির ভাগ শেয়ার দর হারিয়েছে বটে; তবে পতনের হার ছিল কম। ফলে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায়ও সূচক কম পয়েন্ট হারিয়েছে।
টানা ৯ দিনের ছুটি শেষে গতকাল রোববার দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স ১৩ দশমিক ৯৭ পয়েন্ট বা মাত্র শূন্য দশমিক ২৬ শতাংশ হারিয়ে ৫২০৫ পয়েন্টে নেমেছে। এ পতন গত ২৩ মার্চের তুলনায়ও কম। ওই দিন সূচকটি হারিয়েছিল ১৮ পয়েন্টের বেশি।
অন্যদিকে দ্বিতীয় শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) প্রধান মূল্য সূচক সিএসসিএক্স শূন্য দশমিক ১৩ শতাংশ বেড়ে ৮৮৫৪ পয়েন্টে উঠেছে। এদিন ডিএসইর লেনদেন ১০০ কোটি টাকা বেড়ে ৪১৫ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। ব্রোকারেজ হাউস কর্মকর্তারা বলেন, বিনিয়োগকারীরা সতর্ক কেনাবেচা করায় কিছু শেয়ার দর হারিয়েছে বটে; তবে তা আশঙ্কাজনক নয়।
সূচকের পতন কম হলেও উভয় বাজারে লেনদেন হওয়া বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ার দর হারিয়েছে। ডিএসইতে তালিকাভুক্ত ৩৬০ কোম্পানির মধ্যে ৩৫৫টির কেনাবেচা হয়েছে। এর মধ্যে ৬৬টির দর বেড়েছে, বিপরীতে ২৬০টি দর হারিয়েছে, অপরিবর্তিত ছিল ২৯টির। বিপরীত চিত্র ছিল মিউচুয়াল ফান্ড খাতে। তালিকাভুক্ত ৩৭ মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে গতকাল ৩৩টিরই দর বেড়েছে।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বেশির ভাগ শেয়ারের দর কমলেও ঢাকার বাজারে ৫ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত ২৯ কোম্পানির শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের দর বেড়েছে। বিপরীতে ২৪ কোম্পানির শেয়ার ৫ থেকে সোয়া ৯ শতাংশ পর্যন্ত দর হারিয়েছে। দর হারানো কোম্পানিগুলোর মধ্যে বস্ত্র খাতের প্রাধান্য ছিল।
ট্রাম্পের বাড়তি শুল্কারোপের খবরে বস্ত্র খাতের প্রায় সব শেয়ার দর হারিয়েছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানির ৮০ শতাংশের বেশি তৈরি পোশাক। সরাসরি পোশাক রপ্তানি করে– এমন কোম্পানির সংখ্যা হাতেগোনা হলেও, রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তুলা বা বস্ত্র বা অন্যান্য এক্সেসরিজ সরবরাহ লাইনে যুক্ত অনেক প্রতিষ্ঠান। ঢাকার শেয়ারবাজারে বস্ত্র খাতের অধীনে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ৫৮টি। এর মধ্যে ৫৭টি দর হারিয়েছে। গড়ে শেয়ারগুলোর দর কমেছে ৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ। বাজার মূলধন কমেছে ৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বস্ত্র খাতের তালিকাভুক্ত ৫৮ কোম্পানির মধ্যে ৫ থেকে সাড়ে ৭ শতাংশ পর্যন্ত দর হারিয়েছে ২০ কোম্পানির শেয়ার। এর মধ্যে ৭ শতাংশের ওপর দর হারিয়েছে ড্রাগন সোয়েটার, হামিদ ফেব্রিক্স, মেট্রো স্পিনিং, নিউ লাইন ক্লোথিংস এবং সিমটেক্স।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে দরপতন না হওয়ার কারণ ব্যাখ্যায় প্রাইম ব্যাংক সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা কম। দেশের মোট রপ্তানির ১৮ শতাংশের গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। তাছাড়া ওই দেশে রপ্তানির ৮০ শতাংশ তৈরি পোশাক, যার ৮০ শতাংশের বেশি কম মূল্যের পোশাক, যার চাহিদা কখনোই কমবে না। বরং মন্দা বা সংকটের সময় বাংলাদেশের পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। কারণ অন্য দেশ আমাদের মতো কম মূল্যে পণ্য সরবরাহ করতে পারে না। ২০০৮ সালের মন্দায়ও এটা দেখা গেছে।
মনিরুজ্জামান বলেন, ‘দেশের শেয়ারবাজারের দরপতন বিশ্বের বড় বাজারগুলোর মতো দরপতনের শঙ্কা দেখি না। কারণ আমাদের বাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর খুব কমসংখ্যক রপ্তানি করে। এখানে বিদেশি বিনিয়োগও কম। তার পরও দরপতন যে হয়নি, তা নয়। বস্ত্র খাতের বেশ কিছু শেয়ারের দর ৫ শতাংশের ওপর কমেছে।’
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: শ য় রব জ র দ শ র শ য় রব জ র শ য় র দর হ র য় ছ দশম ক
এছাড়াও পড়ুন:
৯ কোটির ল্যাবে বাড়ছে ই-বর্জ্য
শিক্ষার্থীদের অ্যানিমেশন, রোবটিকসহ প্রযুক্তি শিক্ষা দিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দু’দফায় বসানো হয় ডিজিটাল ল্যাব। এর মাধ্যমে নিত্যনতুন সফটওয়্যার এবং ডিভাইসের ব্যবহারও তাদের শেখানোর কথা ছিল। সে লক্ষ্যে বসানো হয় কম্পিউটারসহ নানান প্রযুক্তি সরঞ্জাম। কিন্তু কয়েক বছর না যেতেই সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার ১৮টি ল্যাব অচল হতে চলেছে। অনেক সরঞ্জাম নষ্ট হয়ে বাড়ছে ই-বর্জ্য। প্রযুক্তি শিক্ষার বদলে ল্যাবগুলো এখন পরিণত হচ্ছে বোঝায়।
২০১২ সালে ‘শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব’ ও ২০১৮ সালে ‘স্কুল অব ফিউচার’ নামে সারাদেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করা হয়। শুরুতে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার ১৩টি প্রতিষ্ঠানে এমন ল্যাব স্থাপন করে তথ্য ও যোগাযোগ
প্রযুক্তি অধিদপ্তর। এর বর্তমান নাম হয়েছে ‘আইসিটিডি’। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আরেকটি প্রকল্পে উপজেলার আরও পাঁচ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করা হয়।
এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার্থীদের যুগোপযোগী শিক্ষার মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়ানো এবং স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা। সে লক্ষ্যে স্কুল অব ফিউচার ও শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করা হয়েছিল। বাস্তবে সেগুলোর বেশির ভাগই ব্যবহার হচ্ছে না। শিক্ষার্থীরাও পাচ্ছে না প্রযুক্তি শিক্ষা। অনেক ল্যাবের কিছু উপকরণ ই-বর্জ্যে পরিণত হচ্ছে। এতে ল্যাব তৈরিতে খরচ হওয়া অন্তত ৯ কোটি টাকা পানিতে যেতে বসেছে।
সরেজমিন উপজেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশ ল্যাব প্রায় অচল বা তালাবদ্ধ পাওয়া গেছে। তাড়াশ ইসলামিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের স্কুল অব ফিউচারের অবস্থা জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক আব্দুস সালামের ভাষ্য, অপারেটর না থাকায় ল্যাবের কার্যক্রম বন্ধ আছে। নওগাঁ জিন্দানী ডিগ্রি কলেজে স্থাপিত ডিজিটাল ল্যাবের ৩০টি ডেস্কটপ কম্পিউটারসহ অন্যান্য ডিজিটাল সামগ্রী অচল হওয়ার পথে। ল্যাবটি অনেকটা ই-বর্জ্যে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বেলাল হোসেন আনছারী।
গুল্টা বাজার শহীদ এম মনসুর আলী ডিগ্রি কলেজের ল্যাবের ল্যাপটপগুলো নষ্ট হওয়ার পথে। পাঁচ থেকে সাতটির কোনো হদিস নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। উপজেলা আইসিটি কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে কম্পিউটারগুলো প্রতিষ্ঠানে ফেরত দিতে বারবার তাগাদা দিলেও কলেজের অধ্যক্ষ আসাদুজ্জামান তাতে সাড়া দেননি। অভিযোগ উঠেছে, এসব ল্যাপটপ ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। যদিও অধ্যক্ষ তা অস্বীকার করেছেন।
ল্যাবগুলো এভাবে বোঝায় পরিণত হওয়ার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুরুতে নিম্নমানের সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়েছিল। এতে কয়েক বছরের মধ্যেই তা বিকল বা অচল হয়ে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে গেছে। অথচ এসব ল্যাব পরিচালনার জন্য একজন করে ল্যাব সহকারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা সরকারিভাবে নিয়মিত মাসিক বেতন-ভাতা পাচ্ছেন।
এসব ল্যাব স্থাপনে উপজেলায় কত টাকা খরচ হয়েছিল, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য মেলেনি। স্থানীয় আইসিটি খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, যে ধরনের সরঞ্জাম রয়েছে, তাতে ১৮টি ল্যাবে সরকারের অন্তত ৯ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে একটি সিন্ডিকেট আগের জেনারেশন সংস্করণের ল্যাপটপ, ডেস্কটপ, প্রিন্টার, স্ক্যানার, ওয়েবক্যাম, এলইডি টিভি, হোয়াইট বোর্ড, রাউটার, ট্যাব, সার্ভার সিস্টেমসহ ফার্নিচার সরবরাহ করে। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের পণ্য সরবরাহ করে মোটা অঙ্কের টাকা লুটে নিয়েছে।
ল্যাব প্রতিষ্ঠায় কত টাকা ব্যয় হয়েছিল, সে তথ্য রাখা হয়নি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটেও। সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানপ্রধান ও উপজেলা আইসিটি কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে ল্যাবের সমস্যা সমাধানে টেকনিশিয়ান চেয়ে বারবার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরে আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু কোনো সাড়া মেলেনি বলে অভিযোগ তাদের। ফলে শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল পদ্ধতিতে শিক্ষা, অ্যানিমেশন, রোবটিকসহ প্রযুক্তি শিক্ষার উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়েছে।
তাড়াশ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে কয়েকটি কম্পিউটার এখনও সচল রয়েছে। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের পর ল্যাবকক্ষটি তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের সূত্র জানায়, আইসিটি ল্যাব হিসেবে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটি বিশেষ কক্ষ রয়েছে।
এসব ল্যাবে কম্পিউটার, ইন্টারনেট অ্যাক্সেস এবং অন্যান্য ডিজিটাল সরঞ্জাম রাখা হয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা দেওয়ার কথা। নতুন সফটওয়্যার এবং ডিভাইস কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, তাও শিখবে তারা। বাস্তবে এ শিক্ষা অধরা বলে জানিয়েছে তামিম, রাফিদ, রেজওয়ানসহ কয়েকজন শিক্ষার্থী।
শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে ১৪টি শর্ত দেওয়া হয়। সেগুলোর বেশির ভাগই মানা হয়নি। এলাকার এমপিরা নিয়ম না মেনে তাদের পছন্দের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য ডিও লেটার দিয়ে ল্যাব স্থাপন করেছেন।
উপজেলা আইসিটি কর্মকর্তা আবু রায়হান ল্যাবগুলোর করুণ অবস্থার কথা স্বীকার করেছেন। ডিজিটাল ল্যাবের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাঁর কার্যালয় থেকে বিভিন্ন ল্যাব পরিদর্শন করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর প্রতিবেদন পাঠানো হচ্ছে। ল্যাব প্রতিষ্ঠার সময় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের শুধু পত্র দিয়ে জানিয়েছিল। কত বরাদ্দ, কেমন মানের ডিজিটাল সামগ্রী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সরবরাহ করেছে, তাও তাদের লিখিত বা মৌখিকভাবে জানানো হয়নি।