মিয়ানমারে ভূমিকম্প: বৃষ্টি-গরমে বেড়েছে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের দুর্দশা
Published: 6th, April 2025 GMT
মিয়ানমারে শক্তিশালী ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের দুর্দশা আরও বাড়িয়ে তুলেছে বৃষ্টিপাত ও গরম আবহাওয়া। গতকাল শনিবার ও আজ রোববার দেশটিতে বৃষ্টি হয়েছে। এতে ব্যাহত হয়েছে উদ্ধারকাজ ও ত্রাণ সরবরাহ। এরই মধ্যে দেশটিতে ভূমিকম্পে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৪৭১।
২৮ মার্চ মিয়ানমারের মধ্যাঞ্চলে ৭ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, মৃত্যুর পাশাপাশি এখন পর্যন্ত দেশটিতে ৪ হাজার ৬৭১ জন আহত হয়েছেন। নিখোঁজ ২১৪ জন। এ ছাড়া ভূমিকম্পে ৫ হাজার ২২৩টি ভবন, ১ হাজার ৮২৪টি মন্দির ও প্যাগোডা, ১৬৭টি হাসপাতাল, ১৬৯টি সেতু, ১৯৮টি বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জাতিসংঘের উন্নয়ন প্রকল্পের (ইউএনডিপি) তথ্য অনুযায়ী, শনিবার সন্ধ্যায় ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের সবচেয়ে কাছের শহর মান্দালয়ে প্রায় ৪৫ মিনিট বৃষ্টি হয়। শহরটিতে এখনো মানুষ ভয়ে ঘরে ফেরেননি। খোলা আকাশের নিচে তাঁদের অনেক তাঁবু বৃষ্টি ও ঝোড়ো বাতাসে ভেঙে গেছে। পর্যাপ্ত ত্রিপলের অভাবে অনেক মানুষকে তাঁদের জিনিসপত্রসহ বৃষ্টিতে ভিজতে হয়েছে।
এ ছাড়া বৃষ্টিপাতের কারণে ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে মরদেহগুলো বের করা আরও কঠিন হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন উদ্ধারকারীরা। এমন শঙ্কার মধ্যে আজ সকালে আবারও মান্দালয়ে বৃষ্টি হয়েছে। সেখানে তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠবে এবং আরও বৃষ্টি হবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। ইউএনডিপির কর্মকর্তা টান টান বলেন, আবহাওয়া চরম রূপ ধারণ করেছে।
বৃষ্টিপাত ও প্রচণ্ড গরমের কারণে খোলা আকাশের নিচে গড়ে তোলা সাময়িক আশ্রয়শিবিরগুলোতে রোগবালাই ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে আজ জাতিসংঘের ত্রাণ ও মানবিক সহায়তাসংক্রান্ত সংস্থার (ওসিএইচএ) প্রধান টন ফ্লেচার বলেছেন, উপদ্রুত এলাকাগুলোয় জরুরি ভিত্তিতে খাবার, পানি ও বিদ্যুৎ–ব্যবস্থা মেরামত করা দরকার। অনেক মানুষ এখনো থাকার মতো কোনো আশ্রয় পাননি। তাঁদের জন্য তাঁবু প্রয়োজন।
২৮ মার্চের ভূমিকম্পে মিয়ানমারের পরেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল প্রতিবেশী দেশ থাইল্যান্ড। দেশটির সরকার জানিয়েছে, ভূমিকম্পের কারণে দেশটিতে এখন পর্যন্ত ২৪ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তাঁদের মধ্যে ১৭ জনই নিহত হয়েছেন রাজধানী ব্যাংককে ৩৩ তলা একটি ভবন ধসে। ওই ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো ৭৭ জন আটকা রয়েছেন।
যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করছে জান্তাআগে থেকেই মিয়ানমারের অবস্থা বেহাল। ২০২১ সালে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে সামরিক জান্তা। তখন থেকে জান্তাবিরোধী বিদ্রোহী ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সশস্ত্র যোদ্ধাদের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর লড়াই চলছে। চার বছর ধরে চলা এই গৃহযুদ্ধের কারণে যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এতে ভূমিকম্প উপদ্রুত এলাকার ৫ কোটির বেশি মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছানো জটিল হয়ে পড়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে ত্রাণ সরবরাহের জন্য ২ এপ্রিল থেকে সাময়িক যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে জান্তা সরকার। তবে নিজেদের দেওয়া যুদ্ধবিরতি ভেঙে এখন পর্যন্ত বিদ্রোহীদের ওপর অন্তত ১৬টি হামলা চালিয়েছে তারা। এরই মধ্যে শনিবার থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে দেখা করেছেন জাতিসংঘের কর্মকর্তা টম ফ্লেচার। মিয়ানমারে মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য ‘জোরদার, সমন্বিত ও সামষ্টিক’ পদক্ষেপ নিতে আলোচনা হয়েছে বলে জানান তিনি।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
৯ কোটির ল্যাবে বাড়ছে ই-বর্জ্য
শিক্ষার্থীদের অ্যানিমেশন, রোবটিকসহ প্রযুক্তি শিক্ষা দিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দু’দফায় বসানো হয় ডিজিটাল ল্যাব। এর মাধ্যমে নিত্যনতুন সফটওয়্যার এবং ডিভাইসের ব্যবহারও তাদের শেখানোর কথা ছিল। সে লক্ষ্যে বসানো হয় কম্পিউটারসহ নানান প্রযুক্তি সরঞ্জাম। কিন্তু কয়েক বছর না যেতেই সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার ১৮টি ল্যাব অচল হতে চলেছে। অনেক সরঞ্জাম নষ্ট হয়ে বাড়ছে ই-বর্জ্য। প্রযুক্তি শিক্ষার বদলে ল্যাবগুলো এখন পরিণত হচ্ছে বোঝায়।
২০১২ সালে ‘শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব’ ও ২০১৮ সালে ‘স্কুল অব ফিউচার’ নামে সারাদেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করা হয়। শুরুতে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার ১৩টি প্রতিষ্ঠানে এমন ল্যাব স্থাপন করে তথ্য ও যোগাযোগ
প্রযুক্তি অধিদপ্তর। এর বর্তমান নাম হয়েছে ‘আইসিটিডি’। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আরেকটি প্রকল্পে উপজেলার আরও পাঁচ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করা হয়।
এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার্থীদের যুগোপযোগী শিক্ষার মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়ানো এবং স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা। সে লক্ষ্যে স্কুল অব ফিউচার ও শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করা হয়েছিল। বাস্তবে সেগুলোর বেশির ভাগই ব্যবহার হচ্ছে না। শিক্ষার্থীরাও পাচ্ছে না প্রযুক্তি শিক্ষা। অনেক ল্যাবের কিছু উপকরণ ই-বর্জ্যে পরিণত হচ্ছে। এতে ল্যাব তৈরিতে খরচ হওয়া অন্তত ৯ কোটি টাকা পানিতে যেতে বসেছে।
সরেজমিন উপজেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশ ল্যাব প্রায় অচল বা তালাবদ্ধ পাওয়া গেছে। তাড়াশ ইসলামিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের স্কুল অব ফিউচারের অবস্থা জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক আব্দুস সালামের ভাষ্য, অপারেটর না থাকায় ল্যাবের কার্যক্রম বন্ধ আছে। নওগাঁ জিন্দানী ডিগ্রি কলেজে স্থাপিত ডিজিটাল ল্যাবের ৩০টি ডেস্কটপ কম্পিউটারসহ অন্যান্য ডিজিটাল সামগ্রী অচল হওয়ার পথে। ল্যাবটি অনেকটা ই-বর্জ্যে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বেলাল হোসেন আনছারী।
গুল্টা বাজার শহীদ এম মনসুর আলী ডিগ্রি কলেজের ল্যাবের ল্যাপটপগুলো নষ্ট হওয়ার পথে। পাঁচ থেকে সাতটির কোনো হদিস নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। উপজেলা আইসিটি কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে কম্পিউটারগুলো প্রতিষ্ঠানে ফেরত দিতে বারবার তাগাদা দিলেও কলেজের অধ্যক্ষ আসাদুজ্জামান তাতে সাড়া দেননি। অভিযোগ উঠেছে, এসব ল্যাপটপ ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। যদিও অধ্যক্ষ তা অস্বীকার করেছেন।
ল্যাবগুলো এভাবে বোঝায় পরিণত হওয়ার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুরুতে নিম্নমানের সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়েছিল। এতে কয়েক বছরের মধ্যেই তা বিকল বা অচল হয়ে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে গেছে। অথচ এসব ল্যাব পরিচালনার জন্য একজন করে ল্যাব সহকারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা সরকারিভাবে নিয়মিত মাসিক বেতন-ভাতা পাচ্ছেন।
এসব ল্যাব স্থাপনে উপজেলায় কত টাকা খরচ হয়েছিল, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য মেলেনি। স্থানীয় আইসিটি খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, যে ধরনের সরঞ্জাম রয়েছে, তাতে ১৮টি ল্যাবে সরকারের অন্তত ৯ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে একটি সিন্ডিকেট আগের জেনারেশন সংস্করণের ল্যাপটপ, ডেস্কটপ, প্রিন্টার, স্ক্যানার, ওয়েবক্যাম, এলইডি টিভি, হোয়াইট বোর্ড, রাউটার, ট্যাব, সার্ভার সিস্টেমসহ ফার্নিচার সরবরাহ করে। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের পণ্য সরবরাহ করে মোটা অঙ্কের টাকা লুটে নিয়েছে।
ল্যাব প্রতিষ্ঠায় কত টাকা ব্যয় হয়েছিল, সে তথ্য রাখা হয়নি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটেও। সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানপ্রধান ও উপজেলা আইসিটি কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে ল্যাবের সমস্যা সমাধানে টেকনিশিয়ান চেয়ে বারবার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরে আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু কোনো সাড়া মেলেনি বলে অভিযোগ তাদের। ফলে শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল পদ্ধতিতে শিক্ষা, অ্যানিমেশন, রোবটিকসহ প্রযুক্তি শিক্ষার উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়েছে।
তাড়াশ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে কয়েকটি কম্পিউটার এখনও সচল রয়েছে। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের পর ল্যাবকক্ষটি তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের সূত্র জানায়, আইসিটি ল্যাব হিসেবে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটি বিশেষ কক্ষ রয়েছে।
এসব ল্যাবে কম্পিউটার, ইন্টারনেট অ্যাক্সেস এবং অন্যান্য ডিজিটাল সরঞ্জাম রাখা হয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা দেওয়ার কথা। নতুন সফটওয়্যার এবং ডিভাইস কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, তাও শিখবে তারা। বাস্তবে এ শিক্ষা অধরা বলে জানিয়েছে তামিম, রাফিদ, রেজওয়ানসহ কয়েকজন শিক্ষার্থী।
শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে ১৪টি শর্ত দেওয়া হয়। সেগুলোর বেশির ভাগই মানা হয়নি। এলাকার এমপিরা নিয়ম না মেনে তাদের পছন্দের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য ডিও লেটার দিয়ে ল্যাব স্থাপন করেছেন।
উপজেলা আইসিটি কর্মকর্তা আবু রায়হান ল্যাবগুলোর করুণ অবস্থার কথা স্বীকার করেছেন। ডিজিটাল ল্যাবের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাঁর কার্যালয় থেকে বিভিন্ন ল্যাব পরিদর্শন করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর প্রতিবেদন পাঠানো হচ্ছে। ল্যাব প্রতিষ্ঠার সময় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের শুধু পত্র দিয়ে জানিয়েছিল। কত বরাদ্দ, কেমন মানের ডিজিটাল সামগ্রী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সরবরাহ করেছে, তাও তাদের লিখিত বা মৌখিকভাবে জানানো হয়নি।