রেস্তোরাঁয় পরোটা ভাজা নিয়ে দুই শ্রমিকের ঝগড়া, রডের আঘাতে প্রাণ গেল একজনের
Published: 6th, April 2025 GMT
জয়পুরহাট শহরের একটি রেস্তোরাঁয় দুজন কর্মীর ঝগড়ার জেরে রডের আঘাতে একজনের মৃত্যু হয়েছে। আজ রোববার বিকেল চারটার দিকে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। এর আগে সকাল সাড়ে আটটার দিকে শহরের নতুনহাটে অবস্থিত কুসুম কিচেন নামে একটি রেস্তোরাঁয় এ ঘটনা ঘটে।
নিহত হোটেলশ্রমিকের নাম জাহিদ হাসান মোল্লা (৩৮)। তিনি ফরিদপুরের সালথা উপজেলার রামকান্তপুর গ্রামের ইসহাক মোল্লার ছেলে। তিন বছর ধরে রেস্তোরাঁটিতে কাজ করছিলেন তিনি। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে অভিযুক্ত শাহিন মিয়াকে। তাঁর বাড়ি ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলায়।
জয়পুরহাট থানা-পুলিশ ও রেস্তোরাঁ সূত্রে জানা গেছে, আজ সকালে পরোটা ভাজা নিয়ে জাহিদ হাসান ও শাহিন মিয়ার মধ্যে ঝগড়া বাধে। একপর্যায়ে শাহিন মিয়া হাতের কাছে থাকা লোহার রড দিয়ে জাহিদের মাথায় আঘাত করেন। এতে জাহিদ মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। রেস্তোরাঁর অন্য শ্রমিকেরা এসে জাহিদকে জয়পুরহাট জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে বিকেল চারটার দিকে তিনি মারা যান।
রেস্তোরাঁটির ব্যবস্থাপক পরিচয় দেওয়া লিটন চৌধুরী নামে একজন ব্যক্তি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, পরোটা ভাজা নিয়ে রেস্তোরাঁর দুই শ্রমিক জাহিদ ও শাহিন মিয়া ঝগড়া লাগে। একপর্যায়ে শাহিন লোহার রড দিয়ে জাহিদের মাথায় আঘাত করেন। এতে জাহিদ গুরুতর আহত হন। তিনি বিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। জাহিদ তিন বছর এই রেস্তোরাঁয় শ্রমিকের কাজ করছিলেন।
জয়পুরহাট সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নুর আলম সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, শ্রমিক হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত শাহিন মিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ঘটনায় হত্যা মামলার প্রস্তুতি চলছে।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
টরন্টোর গো ট্রেনে কিছুক্ষণ
গো ট্রেনে পিকারিং থেকে উঠি। ডাউনটাউনে যাব অসম বয়সের তিনজন। আমি একা বসলাম। অন্যপাশে তরুণ দম্পতি। পাশ্চাত্যে যে কোনো জায়গায় বা যে কোনো অবস্থায় যুগল দম্পতি বা প্রেমিকের নানাভাবে তাদের ভালোবাসা প্রকাশে কোনো সংকোচ বা দ্বিধা নেই। আমার কাছে কখনও অশ্লীলও মনে হয়নি। কারণ, ওদের একটা আর্ট আছে। আমি কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে দেখলাম। পরের স্টেশনে আরও একটি মাঝবয়সী দম্পতি উঠল। একটি মাঝবয়সী দম্পতির রোমান্টিকতা আমাকে আরও বিস্মিত করল। পরে জানলাম এ ধরনের দম্পতির নতুন রিলেশনশিপ। তবুও ভালো লাগল। আমাদের দেশে এমন করলে মানুষ বলত বুড়ো বয়সের ভীমরতি। জীবন যেন সব বয়সে উপভোগ্য, এটা উপলব্ধি করলাম।
দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম ট্রেনের জানালায়। বাইরের দিকে তাকালাম। ঝরা পাতার ঋতু আমাকে বিমর্ষ করে তুলল। কিছুদিন আগেও এ পথে বর্ণিল প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য বিমুগ্ধ করেছে। কত সুন্দর হতে পারে প্রকৃতির যে ঋতুকে ওরা ফল বা পতিত বলে। অর্থাৎ মরার আগে জেগে ওঠার মতো। এত বর্ণ প্রকৃতির হতে পারে, আমার জানা ছিল না। লাল-হলুদ-সবুজের মাখামাখি প্রকৃতির গায়ে। নববধূও এতটা বর্ণময় হয় না। কেমন করে হারিয়ে গেল প্রকৃতির বর্ণিল সাজ একটু একটু করে। এখন যেন ‘মাঘের সন্ন্যাসী’। আমিও নস্টালজিক হয়ে পড়লাম।
শহরে আসা কলেজ জীবন, ইউনিভার্সিটি জীবন আরও এক ধরনের বোধসম্পন্ন মধুময় সময়। নতুন নতুন মুখের সাথে পরিচিত হওয়া, নতুন কিছু শেখা বোঝা। স্যারদের লেকচারের ভাষা অন্যরকম; আগে কথাগুলো অশ্লীল মনে হতো। কত সহজভাবেই-না আকরাম স্যার ‘যোগাযোগ’ উপন্যাস পড়ালেন। কুমুর গভীর উপলব্ধি নিজের মাঝে ধারণ করে ফেললাম। তবুও কোথায় যেন আশির দশকীয় একটি সংকোচ রয়েই গেল। হঠাৎ একদিন রেজিস্ট্রার বিল্ডিং থেকে আর্টস ফ্যাকাল্টিতে আসার পথে পেছন থেকে একটি ছেলে আওড়াতে লাগল ‘ঘোমটা মাথায় ছিল না তার মোটে/ মুক্ত বেণী পিঠের ’পরে লোটে/ কালো? তা সে যতই কালো হোক/ দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ’। পেছনে তাকানোর সাহস পাইনি কিন্তু বুকের ভেতরে এক শিহরণ ধুকধুক করতে লাগল। অনেক দিন পর তার নাম জানলাম, যাকে দেখলে আমি ভূত দেখার মতো চমকাতাম। কারণ, আমি আশির দশকের দুর্বল চিত্তের এক কালো মেয়ে, যার অনেক লম্বা চুল। আর একজন পেছনে নয়, সামনেই আবৃত্তি করল– ‘চুল তার কবে কার অন্ধকার বিদিশার নিশা/ মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য’। আমি অভিভূত হই, শিহরিত হই, কিন্তু ভীতু মফস্বলের আদর্শ আমাকে বলে– পালা পালা।
আরও তিনটি মেয়ে পরের স্টেশনে গো ট্রেনে উঠল। ওদের চুটিয়ে আড্ডা আড়চোখে দেখলাম। জীবন তো বৃক্ষ নয়, জীবন জীবন্ত প্রাণবন্ত। আমার মতো জীবনের সাথে প্রতারণা করে না ওরা। এটাই পাশ্চাত্য জীবনের সবচেয়ে ভালো লাগা আমার। গো ট্রেনের এক ঘণ্টা আমার কাছে নস্টালজিক হলেও উপভোগ্য মনে হয়েছে। ছাত্রজীবনেই একজনের গলায় মালা পরালাম বলতে গেলে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবুও এই মেনে নেওয়ার স্বভাবের সনাতনী ভাবনায় মেনে নিলাম। কিন্তু গো ট্রেনের দম্পতিদের মতো রোমান্স প্রকাশ্যে করার সাহস হলো না। একটি চুম্বনের জন্য রিকশার হুড কত টানতে হয়েছে। তখন আমরা ছিলাম বিবাহিত। হঠাৎ কলকাকলিতে সম্বিত ফিরে এলো। দৃষ্টি ফেরালাম ট্রেনের কামড়ায়। নজর পড়লো একজন প্রেগন্যান্ট মহিলার ওপর। আমরা প্রেগন্যান্সি ঢাকবার জন্য শাড়ি ওড়না কতভাবে পেটের ওপর টেনেছি। ওরা প্রেগন্যান্সি দেখানোকে আনন্দ বা গর্ববোধ করে। ছোট টিশার্ট আর ট্রাউজার পরা মহিলা কি উল্লাস চোখেমুখে সাথে আরও একজন মেয়ে। আমার সহযাত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, ওদের লজ্জা করে না। সে বলল, এটাতে লজ্জার কী আছে। এটা তো ওদের আনন্দময় প্রাপ্তি বলে ভাবে। একজন বৃদ্ধ মহিলা উঠল। একটি ছেলে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ওনাকে এনে বসালেন। কুশল বিনিয়ম করলেন হাসি মুখে ওরা; কিন্তু শুধু সহযাত্রী। একটি কথা না বললেই নয়। পাশ্চাত্য শহরে রাস্তাঘাটে যার সাথেই দেখা হয় হাই বা হ্যালো বলে মৃদু হাসি হেসে সম্ভাষণ করে। আরও ভালো লাগলো ওদের ডিসিপ্লিন। প্রত্যেক যাত্রী সুন্দরভাবে সিটে বসে চোখাচুখি হলে মৃদু হাসি দেয়, যেন কত চেনা। ট্রেনের কামড়ায় ওরা বই নিয়ে ওঠে। বিশেষ করে একটু বয়স্ক মানুষদের দেখলাম নিবিষ্ট চিত্তে বইয়ের পাতায় ডুবে আছেন। ছাত্রছাত্রী বা কর্মজীবী টাইপের অনেকে ল্যাপটপ খুলে কাজ করছে ট্রেনের কামরায়। ওদের গতিময় জীবনে যেন স্থবিরতার ঠাঁই নেই। একেবারে অল্পবয়সীরা একটু হাসিঠাট্টায় মেতে যাচ্ছে। ওখানে একটি জিনিস আমার কাছে অবাক লেগেছে, ট্রেন জ্যামে পড়ে। সাথে সাথে অ্যানাউন্স করে যাত্রীদের জানিয়ে দেয়। আরও একটা ব্যাপার দেখলাম, ট্রেনে দু’একজন গাঁজাখোর উঠেছে। সবাই বেশ সহানুভূতির দৃষ্টি নিয়ে ওদের দিকে তাকায়। এসব গাঁজা আসক্ত লোকেরা শহরেও কিছু কিছু গর্হিত কাজ করে। কিন্তু ওদের প্রতি কেউ খারাপ ভঙ্গি পোষণ করে না। ট্রেনের কামড়ায় দেড় ঘণ্টা সময় বিচিত্র জীবন অবলোকন করলাম। বিশেষ করে ওরা কাউকে ন্যূনতম ডিস্টার্ব করে না। যার যার রুচিমতো সে আনন্দ করছে, কাজ করছে– আমাদের মতো সমালোচনায় কেউ লিপ্ত হয় না। যথা সময়ে ট্রেন স্টেশনে থামল। হুড়োহুড়ি নেই। ধীরে ধীরে সবাই নামল।
ভাবলাম একই বিশ্বগ্রামের মানুষ আমরা, জীবন যাপনে কত ভেদ। ওদের জীবনে প্রচণ্ড রকমের ডিসিপ্লিন আছে, আছে প্রচণ্ড মুক্তি। প্রত্যেকে প্রত্যকের রুচিশীলতা, আনন্দময়তা যেভাবে উপভোগ করলো ট্রেনের একটি কামরায়; কেউ কারোর বিনোদনের অন্তরায় হলো না। v