ইরাবতী উপচে পড়ছে মুসলমান বিধবাদের চোখের পানিতে
Published: 6th, April 2025 GMT
মিয়ানমারে ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা হাজার হাজার। ধর্ম–বর্ণ–ধনী-গরিবনির্বিশেষে কেউ ছাড় পায়নি। দেশের মধ্যাঞ্চলেই ক্ষয়ক্ষতি বেশি। বিশেষ করে মান্দালয় অঞ্চলে।
মান্দালয় ও পাশের অমরাপুরা মিয়ানমারের পুরোনো রাজধানী। ফলে এখানে আছে পুরোনো দিনের অনেক স্থাপনা। আবার ভূমিকম্পের কেন্দ্রও ছিল এই শহরের খুব কাছে। ফলে মান্দালয়ের অবস্থা হয়েছে আণবিক বোমা পড়ার পর হিরোশিমা-নাগাসাকির অবস্থার মতো।
মিয়ানমারের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ এই শহরের মুসলমান পরিবারগুলো ভূমিকম্পে বাড়তি বিধ্বস্ত। ভূমিকম্প আঘাত হানে শুক্রবার জুমার সময়। এই অঞ্চলের প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমান পুরুষদের বড় অংশ এ সময় মসজিদে ছিলেন। জুমা সাধারণত একটা নির্দিষ্ট সময়ে মসজিদেই পড়ার রেওয়াজ। আবার ভূমিকম্পের দিনটি ছিল রোজার মাসের শেষ জুমাবার। ফলে উপস্থিতির সংখ্যা ছিল স্বাভাবিক জুমার চেয়ে বেশি।
ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল দুপুরে নামাজের সময়ে। মুসল্লিরা কেউ মসজিদে এ সময় ছিলেন রুকুতে, কেউ সিজদায়, কেউবা মোনাজাতে। কোথাও নামাজ সবে শুরু হচ্ছিল। মধ্য মিয়ানমারের মসজিদগুলোও অধিকাংশ পুরোনো আমলের তৈরি।
ভূমিকম্পের আঘাতে স্থাপনাগুলো সহজেই ভেঙেচুরে পড়ে যায়। দুই দফা কম্পন হয়। প্রথম কম্পনে বেঁচে যাওয়ারা যখন আহত ব্যক্তিদের সরাচ্ছিলেন, তখন আরও জোরের দ্বিতীয় কম্পন হয়। ফলে ইতিমধ্যে বেঁচে যাওয়ারাও আহত-নিহত হন।
ফলাফল হয়েছে ভয়াবহ এক ট্র্যাজেডি। মুসলমান পল্লিগুলোতে শোকের মাতম যেন খানিকটা বেশিই। বিধবাদের কান্নায় ভারী হয়ে আছে পরিবেশ। অনেক পাড়ায় মৃতদের দাফন-কাফনও আটকে ছিল অনেকটা সময়। কারণ, একদিকে পুরুষ মানুষের অভাব, অন্যদিকে এসব অঞ্চলে সরকার বলে কিছু নেই এখন। গৃহযুদ্ধের কারণে সামরিক বাহিনী উদ্ধার তৎপরতার জন্য আসতেও সাহস পাচ্ছে না। স্থানীয় মানুষের কাছে তারা খুবই ঘৃণিত সংস্থা। ফলে রাষ্ট্রীয় উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতাও এখানে খুব অল্প।
ভূমিকম্পে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা মান্দালয় ও সাগাইংয়ের মাঝ দিয়েই বইছে মিয়ানমারের প্রাণরেখা ইরাবতী নদী। ইরাবতীর পশ্চিমে হলো সাগাইং এবং পূর্বে মান্দালয়। সাগাইংয়ে রয়েছে মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় মাদ্রাসা।
এই নদীর দুই দিকে আগে থেকেই অনেক মুসলমান বসতি। এখানকার মুসলমানদের বাহ্যিক দিক দেখে বাংলাদেশের মতো বোঝা যায় না। তবে মসজিদ দেখে আশপাশের জনবসতির ধরন টের পেতে হয়। মসজিদগুলোও স্থাপত্যে বাংলাদেশ-ভারতের চেয়ে ভিন্ন। বামার স্থাপত্য নকশায় সেগুলো তৈরি। মসজিদগুলো এখানে অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যাপীঠ হিসেবেও ব্যবহৃত হতো।
এ রকম অনেক মসজিদই এখানে রাজা বোধাপায়ার আমলে তৈরি। অমরাপুরা যখন ১৭৮৩ সালে রাজধানী হিসেবে ঘোষিত হয়, সেই বোধাপায়ার আমলে রাজদরবারে মুসলমানদের নানা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কেবল বাংলা নয়, সুদূর আফগানিস্তান থেকেও এখানে অনেক মুসলমান এসেছেন তখন। এ সময় মান্দালয়-অমরাপুরা সড়কজুড়ে কিছু পরপরই অনেকগুলো মসজিদ তৈরি হয়। কিছু দরগাহও আছে এদিকে। এখানেই আছে বিখ্যাত আবিদ হুসাইনির লিঙ জিঙ গোয়ে দরগাহ। মান্দালয়ে রাজা মিঙদিনের আমলে রাজপ্রাসাদের ভেতরও মসজিদ ছিল। সেসময় বার্মিজ মুসলমানদের মক্কায় হজের সময় থাকার জন্য সেখানে বাড়ি বানিয়েছিলেন এখানকার রাজা। বলা বাহুল্য, সেসব দিন এখন একান্ত অতীতের বিষয়।
এখানকার টিকে থাকা মসজিদ ও দরগাহগুলো সংস্কারের প্রতি পরবর্তী সময়ের বামার জাতীয়তাবাদীদের খুব বেশি আগ্রহ ছিল না। এমনকি মুসলমানরা নিজেরা সেসবের সংস্কার করতে চাইলেও অনুমতি পাওয়ার সমস্যা ছিল। ২০১২-১৩ থেকে এসব বিষয়ে একধরনের বিদ্বেষই দেখা যেতে শুরু করে।
এরপরও অনেক মুসলমান স্থাপনা টিকে ছিল এদিকে। কিন্তু এবারের ভূমিকম্পে সব ধূলিসাৎ হয়ে গেল। আরাকানের বাইরে মিয়ানমারজুড়ে মুসলমানের সংখ্যা কত—এ নিয়ে বিভ্রান্তি আছে। কামিয়ান ছাড়া অন্য কোনো মুসলিম সম্প্রদায়কে এখানে পৃথক ‘জাতি’সত্তা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। তবে অনেক সংস্কৃতির মুসলমান আছেন দেশজুড়ে। সরকার জাতি হিসেবে স্বীকার না করলেও কেন্দ্রীয় এই অঞ্চলে মুসলমানরা নিজেদের ‘বার্মিজ মুসলমান’ বলে উল্লেখ করে থাকে।
স্বীকৃতি-অস্বীকৃতি মিলে আরাকানের বাইরে এ রকম ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা হবে অন্তত ১৫ লাখ। এর বড় একাংশ রেঙ্গুন এবং আরেক অংশ ইরাবতীর দুই পাড়ে থাকতেন। মিয়ানমারের অন্যান্য অঞ্চল থেকে কেন্দ্রীয় অঞ্চলে মুসলমানরা তুলনামূলকভাবে শান্তিতে থাকতে পারতেন। তবে ভূমিকম্প এবার এ রকম মানুষদের বড় সংখ্যায় উদ্বাস্তু করেছে। বিশেষ করে নারীপ্রধান পরিবারের সংখ্যা বাড়িয়েছে বিপুল।
রেঙ্গুন থেকে এক বন্ধু জানালেন সাগাইং ও মান্দালয়ে অন্তত এক হাজার মুসলমানের মারা যাওয়ার খবর মিলছে। সামনে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। কিছু অঞ্চল এখনো স্বাভাবিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। প্রথম তিন দিন সাগাইংয়ে কোনো উদ্ধার তৎপরতাই ছিল না বলা যায়। কারণ, বাড়িঘরের চার ভাগের তিন ভাগই পড়ে গেছে।
রেঙ্গুন সূত্রে পাওয়া খবর হলো, মসজিদ বিধ্বস্ত হয়েছে অন্তত এক শ। তবে এই তথ্য তৃতীয় কোনো পক্ষ দ্বারা যাচাইয়ের সুযোগ নেই।
সরকারি উদ্ধার তৎপরতার অনুপস্থিতির মাঝে মালয়েশিয়া থেকে একদল উদ্ধারকারী এসে মান্দালয় ও সাগাইংয়ে বিধ্বস্ত মসজিদের সুরকির নিচে থেকে মৃতদেহ বের করছে। উদ্ধারকর্মীদের সর্বশেষ হিসাবে ইরাবতীর দুই পাড়ে বিধ্বস্ত হয়নি এমন মসজিদ পাওয়া দুষ্কর। বলা বাহুল্য, বৌদ্ধদের অনেক প্যাগোডাও এই দুর্যোগে বিধ্বস্ত হয়েছে। কিন্তু সেখানে মৃতের সংখ্যা মুসলমানদের মতো নয়। কারণ, দুপুরে সেখানে মসজিদের মতো জনসমগাম ছিল না। তবে বৌদ্ধ ধর্মালয়ের কিছু আবাসিক ভবন ধসে অনেক শিক্ষার্থী মারা গেছেন এদিকেও। এর বাইরেও ধর্ম–জাতিনির্বিশেষে মৃতের সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে।
সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা এ মুহূর্তে সাড়ে তিন হাজারের মতো। তবে মৃত্যুর চেয়েও ধ্বংসলীলাই ঘটেছে সীমাহীন। আশপাশের অঞ্চলের মধ্যে পঁচাত্তর বছর আগে কেবল আসামে এ রকম ভয়াবহ মাত্রার ভূমিকম্প ঘটেছিল।
আলতাফ পারভেজ: গবেষক ও লেখক
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র ভ ম কম প র ম সলম ন ক ম সলম ন অন ক ম সরক র মসজ দ এ রকম
এছাড়াও পড়ুন:
অভিযান, পণ্য জব্দের পরও দমছে না চোরাকারবারিরা
দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে নজরদারি। নিরাপত্তা চৌকিতে বিজিবির তৎপরতাও কম নয়। এরপরেও সিলেটের দুর্গম সীমান্ত অঞ্চল দিয়ে থামছে না চোরাচালান। স্থানীয়রা বলছেন, দুর্গম অঞ্চলের সীমান্ত জোনে স্থানীয়দের সহায়তা পায় তারা।
সিলেট সীমান্তে বারবার অভিযানে বিপুল পরিমাণ ভারতীয় পণ্যদ্রব্য উদ্ধার করা হচ্ছে। প্রায় প্রতি সপ্তাহে কোটি কোটি টাকার পণ্যদ্রব্য উদ্ধার করা হলে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে চোরাকারবারি ও বহনকারীরা। এ ছাড়া এসব পণ্য কোন চক্রের মাধ্যমে বাজারে নিয়ন্ত্রিত হয়, তার ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই।
এক সপ্তাহ আগে আড়াই কোটি টাকার পণ্য উদ্ধারের পর শনিবার সিলেট ব্যাটালিয়নের (৪৮ বিজিবি) আওতাধীন সিলেট জেলার বিভিন্ন সীমান্ত থেকে ৬ কোটি টাকার পণ্য উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে পণ্যবাহী তিনটি ট্রাকও রয়েছে।
জানা গেছে, শনিবার বিজিবি-৪৮ এর উপঅধিনায়ক মেজর নূরুল হুদার নেতৃত্বে সীমান্তে পৃথক অভিযান পরিচালনা করা হয়। তামাবিল, প্রতাপপুর, সংগ্রাম ও শ্রীপুর সীমান্তে অভিযানকালে অবৈধভাবে ভারত থেকে আনা বিপুল পরিমাণ পণ্যসহ চোরাচালানের মালপত্র পরিবহনে ব্যবহৃত তিনটি ট্রাক ও পিকআপ জব্দ করা হয়েছে। উদ্ধার হওয়া ভারতীয় এসব পণ্যের মূল্য ৬ কোটি টাকা বলে বিজিবি জানিয়েছে।
এর আগে গত ১৬ এপ্রিল ৪৮ বিজিবি বিছনাকান্দি, সোনারহাট, পান্থুমাই, সংগ্রাম, লাফার্জ, বাংলাবাজার, প্রতাপপুর, উৎমা ও শ্রীপুর বিওপি ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকার চোরাচালানের মালপত্র জব্দ করে। ১৪ এপ্রিল ভারতীয় দুম্বা, ছাগলসহ ৬১ লাখ টাকার এবং ১২ এপ্রিল ১ কোটি ২৮ লাখ টাকার ভারতীয় পণ্য উদ্ধার করে বিজিবি।
জানা গেছে, সিলেটের চোরাচালানের পণ্য নিয়ন্ত্রণকারী জৈন্তাপুরের হরিপুর বাজারের ব্যবসায়ীদের এরই মধ্যে তছনছ করে দিয়েছে সেনাবাহিনী। সেখানে অভিযান পরিচালনার পর চোরাকারবারিরা রুট পরিবর্তন করে নানা কৌশলে বিভিন্ন স্থানে পণ্য নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আগে হরিপুর বাজারের গুদামে রাখা হতো চোরাই পণ্য। সেসব গুদামে ব্যবসায়ীরা এখন আগের মতো ভারতীয় পণ্য রাখার সাহস পাচ্ছেন না। তারা সরাসারি সীমান্ত থেকে পণ্য নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। আর এ কারণেই সীমান্তে চোরাই পণ্যের প্রবাহ বেড়েছে।
চোরাকারবারি ও বহনকারীদের আটক প্রসঙ্গে ৪৮ বিজিবি অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্নেল নাজমুল হক সমকালকে জানান, অভিযানের সময় বিজিবির তৎপরতা টের পেয়ে পণ্য ফেলে পালিয়ে যান চোরাকারবারি চক্রের সদস্যরা। যার কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের আটক করা সম্ভব হয় না। বিজিবি যেমন অভিযান করছে, তেমনি চোরাকারবারিদের একটা নেটওয়ার্কও রয়েছে। এর মাধ্যমে তারা খবর রাখে অভিযানের।
সিলেট জেলা সীমান্তের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চোরাই পণ্যের সরবরাহ আসে গোয়াইনঘাট উপজেলার প্রতাপপুর সীমান্ত হয়ে। সেখানকার এলাকা সমতল। তাই চোরাই পণ্য সরবরাহে সুবিধা বেশি। এর পরই রয়েছে সংগ্রাম, বিছনাকান্দি ও তামাবিল সীমান্ত।
এ ছাড়া জৈন্তাপুর উপজেলার রাজবাড়ি বিওপির আওতাধীন ডিবির হাওর, ঘিলাতলা, ফুলবাড়ী ও টিপরাখলা সীমান্ত দিয়ে বেশি চোরাচালান হয়। অভিযোগ রয়েছে, এসব এলাকার সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে আশ্রয় ও সহায়তা পায় চোরাকারবারিরা। এ বিষয়ে গোয়াইনঘাট থানার তোফায়েল আহমেদ জানান, সীমান্ত এলাকায় মূলত বিজিবি টহল দেয়। স্থানীয়রা সচেতন হলে এবং প্রশাসনকে সহায়তা দিলে সমস্যা কমবে।