পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত ১০টি কোম্পানির প্রকৃত অবস্থা জানতে তাদের প্রধান কার্যালয়, কারখানা প্রাঙ্গণ এবং অন্যান্য সম্পর্কিত স্থান সরেজমিন পরিদর্শনের জন্য ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জকে (ডিএসই) অনুমতি দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

সম্প্রতি ডিএসইর কোম্পানিগুলোর পরিদর্শনের অনুমতি চেয়ে বিএসইসির কাছে আবেদন জানায়। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সার্বিক দিক বিবেচনা করে ডিএসইকে কোম্পানিগুলোর কারখানা সরেজমিন পরিদর্শন করার অনুমতি প্রদান করেছে বিএসইসি। সংশ্লিষ্ট সূত্র রাইজিংবিডি ডটকমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

কোম্পানিগুলো হলো- অ্যাসোসিয়েটেড অক্সিজেন লিমিটেড, ফার কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, কৃষিবিদ সিড লিমিটেড, নাহি অ্যালুমিনিয়াম কম্পোজিট প্যানেল পিএলসি, রিং সাইন টেক্সটাইল লিমিটেড, খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, বিচ হ্যাচারি লিমিটেড, গ্লোবাল হেভি কেমিক্যাল লিমিটেড, ইন্দো-বাংলা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড এবং ফু-ওয়াং সিরামিক লিমিটেড।

এসব কোম্পানির আর্থিক অবস্থা বেশ নাজুক। এর তিনটি কোম্পানি সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে শেয়ারহোল্ডারদের জন্য কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা দিতে পারেনি।

পরিদর্শনের অনুমতি পাওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে ফার কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ ১ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ, কৃষিবিদ সিড ১ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ, নাহি অ্যালুমিনিয়াম কম্পোজিট প্যানেল পিএলসি ৪ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ, খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজ ১ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ, বিচ-হ্যাচারি ১০ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ, ইন্দো-বাংলা ফার্মাসিউটিক্যালস ০.

১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ এবং ফু-ওয়াং সিরামিক ২ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ শেয়ারহোল্ডারদের প্রদান করেছে। আর সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ প্রদান করেনি অ্যাসোসিয়েটেড অক্সিজেন, রিং সাইন টেক্সটাইল ও গ্লোবাল হেভি কেমিক্যাল।

জানা গেছে, বেশ কয়েকটি কোম্পানি দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সিকিউরিটিজ আইন যথাযথভাবে পরিপালন করছে না। কোনো কোনোটি লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে না এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তা বিনিয়োগকারীদের বিতরণ করছে না। আবার কোনো কোনো কোম্পানির উৎপাদন দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। কোনো কোনো কোম্পানি তাদের বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) নিয়মিত করছে না। আবার কোনো কোনো কোম্পানি যথাসময়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বিনিয়োগকারীদের জানাচ্ছে না।

২০২৩ সাল থেকে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সার্বিক কার্যক্রম খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নেয় ডিএসই। ওই বছরের ৪ ডিসেম্বর অনুমতি চেয়ে বিএসইসিকে চিঠি দিয়েছিল ডিএসই। পরবর্তীতে ২০২৪ সালের ২২ জানুয়ারি ৩১টি কোম্পানি পরিদর্শনের জন্য ডিএসইকে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে আরো ২৩টি কোম্পানির সরেজমিন পরিদর্শনের অনুমতি দেওয়া হয়। ডিএসইর চিঠির প্রেক্ষিতেই দুই দফায় ৫৪টি কোম্পানি সার্বিক অবস্থা দেখার অনুমতি পেয়েছিল ডিএসই।

কোম্পানিগুলোর মধ্যে বিচ হ্যাচারি ‘এ’ ক্যাটাগরিতে, ফার কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ ‘বি’ ক্যাটাগরিতে, নাহি অ্যালুমিনিয়াম কম্পোজিট প্যানেল ‘বি’ ক্যাটাগরিতে, খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজ ‘বি’ ক্যাটাগরিতে, ইন্দো-বাংলা ফার্মাসিউটিক্যালস ‘বি’ ক্যাটাগরিতে, ফু-ওয়াং সিরামিক ‘বি’ ক্যাটাগরিতে, অ্যাসোসিয়েটেড অক্সিজেন ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে, রিং সাইন টেক্সটাইল ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে এবং গ্লোবাল হেভি কেমিক্যাল ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে অবস্থান করছে। আর এসএমই প্ল্যাটফর্মে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর কোনো ক্যাটাগরি নির্ধারণ করা হয়নি। তাই কৃষিবিদ সিডের কোনো ক্যাটাগরিতে নেই।

বিএসইসির সিদ্ধান্ত

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ পিএলসি পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত ১০টি কোম্পানির প্রধান কার্যালয়, কারখানা প্রাঙ্গণ এবং অন্যান্য সম্পর্কিত স্থান সরেজমিন পরিদর্শনের জন্য অনুমতি চেয়ে আবেদন জানিয়েছে। সার্বিক দিক বিবেচনা করে ডিএসইর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১০ কোম্পানির প্রধান কার্যালয়, কারখানা প্রাঙ্গণ এবং অন্যান্য সম্পর্কিত স্থান পরিদর্শন করার অনুমতি প্রদান করা হলো। এ বিষয়ে বিএসইসির সংশ্লিষ্ট বিভাগ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

প্রসঙ্গত, চলতি বছরের গত ৪ মার্চ ডিএসইর পরিদর্শন দল সরেজমিন গিয়ে পেপার ও প্রিন্টিং খাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানি খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেডের কারখানা বন্ধ পায়। এর আগে গত ৩ ফেব্রুয়ারি ডিএসইর পরিদর্শন দল সরেজমিন গিয়ে বস্ত্র খাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানি সাফকো স্পিনিংস মিলস লিমিটেডের কারখানাও বন্ধ পায়। এদিকে, গত বছরের ২২ অক্টোবর তুং হাই নিটিং অ্যান্ড ডাইং লিমিটেডের কারখানা সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়েও বন্ধ পায় ডিএসই। কোম্পানিগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি জানার জন্য কারখানা পরিদর্শনে যান ডিএসই’র কর্মকর্তারা। এসব কারণে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত দুর্বল কোম্পানিগুলো সরেজমিন পরিদর্শন করার উদ্যোগ নিয়েছে ডিএসই।

ঢাকা/এনএইচ

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ইন ড স ট র জ ব এসইস র ন র জন য ড এসইর ড এসই অবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

স্থায়ী সমাধান ও অনিয়ম বন্ধে ব্যবস্থা কী

ব্রোকারেজ হাউস মালিক ও মার্চেন্ট ব্যাংকারদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে শেয়ারবাজারের নেগেটিভ ইকুইটি তথা ঋণাত্মক ঋণ হিসাবের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশনিংয়ের বাধ্যবাধকতার সময়সীমা আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) গত বৃহস্পতিবার এক জরুরি সভায় সময় বাড়ানোর এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

শেয়ারবাজারে ২০১০ সালের ধসের পর ঋণাত্মক ঋণ হিসাবের এই সমস্যা তৈরি হয়। এরপর প্রায় দেড় দশক ধরে শেয়ারবাজারে সমস্যাটি জেঁকে বসেছে। এই সময়ে বিএসইসির কোনো নেতৃত্ব সমস্যাটির স্থায়ী সমাধান করেননি বা করতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেননি। বরং সব কমিশনই সমস্যাটির তাৎক্ষণিক সমাধান হিসেবে শুধু সময় বাড়িয়ে নিরাপত্তা সঞ্চিতিতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ছাড় দেওয়া দিয়েছে। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠানও নিজে থেকে এই সমস্যা সমাধানে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা ক্রমাগতভাবে কমেছে। সেই সঙ্গে একশ্রেণির ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকের কাছে ঋণাত্মক ঋণ হিসাবগুলো অনিয়মের এক হাতিয়ারে পরিণত হয়। তাই শেয়ারবাজার–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এই সমস্যাকে বাজারের জন্য ‘ক্যানসার’ হিসেবে অভিহিত করেন। তাঁরা বলছেন, সাধারণ ওষুধে (সময় বৃদ্ধির মতো সিদ্ধান্ত) এখন আর এই ক্যানসারের নিরাময় সম্ভব নয়। এই রোগ সারাতে অস্ত্রোপচার করতে হবে। তার জন্য নিতে হবে কঠোর ও বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা।

ঋণাত্মক ঋণ হিসাব কী ও কেন তৈরি হয়

২০১০ সালের ধসের আগে দেশের শেয়ারবাজারে বড় ধরনের বুদ্‌বুদ বা উল্লম্ফন দেখা দেয়। ওই সময় শেয়ারবাজার সম্পর্কে না জেনে না বুঝে হাজার হাজার মানুষ লাভের আশায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাতে শেয়ারের দাম ও লেনদেন ক্রমাগত বাড়তে থাকে। ফলে শেয়ারসূচক লাগামহীনভাবে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠে। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ব্যাপক আগ্রহের সুযোগ নিয়ে গ্যাম্বলার তথা কারসাজিকারকেরা তৎপর হয়ে ওঠেন। তাঁরা কারসাজির মাধ্যমে অনেক শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়েছেন। যার অনিবার্য ফল হিসেবে ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে ধস নামে। এই ধসের আগে অস্বাভাবিক উত্থানপর্বে ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোও যথাযথ বাছবিচার ছাড়াই শেয়ারের বিপরীতে বিনিয়োগকারীদের ‘মার্জিন লোন’ বা প্রান্তিক ঋণসুবিধা দেয়। কখনো নিয়মের মধ্যে থেকে আবার কখনো নিয়ম ভেঙে কয়েক গুণ বেশি ঋণসুবিধা দেওয়া হয় বিনিয়োগকারীদের। একসময় বাজারে ধস নামতে শুরু করে। তাতে শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক হারে কমতে থাকে এবং ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর দেওয়া বিপুল পরিমাণ ঋণ আটকে যায়।

এত দিনেও কেন শেয়ারবাজারের ঋণাত্মক ঋণ হিসাবের স্থায়ী কোনো সমাধান হলো না, সেটি এক বড় প্রশ্ন। যত দ্রুত সম্ভব এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান দরকার। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহ করে প্রয়োজনে সময় বেঁধে দিয়ে এসব অনাদায়ি ঋণ অবলোপনের ব্যবস্থা নিতে হবেফারুক আহমেদ সিদ্দিকী, সাবেক চেয়ারম্যান, বিএসইসি

এই ধসে পুঁজি হারিয়ে ও নিঃস্ব হয়ে ঋণগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের বড় অংশই বাজার ছেড়ে চলে যান। ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো পরে আর এসব বিনিয়োগকারীকে খুঁজে পায়নি। আবার ২০১০ সালের ধসের পর বাজারে পতন ঠেকাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘ফোর্সড সেল’ বা ‘জোরপূর্বক বিক্রি’ বন্ধ ঘোষণা করে। ফলে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রি করে অনাদায়ি ঋণ আদায়ে সময়মতো উদ্যোগ নিতে পারেনি।

বিষয়টি একটি উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যেতে পারে। ধরা যাক, একজন বিনিয়োগকারী ঋণযোগ্য কোনো এক কোম্পানির শেয়ার কিনতে নিজের ১০০ টাকার (ঋণসীমা ১ অনুপাত ২ হারে) বিনিয়োগের বিপরীতে ২০০ টাকা ঋণ নিয়ে মোট ৩০০ টাকা বিনিয়োগ করেন। তখন ওই শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল ১০০ টাকা। ফলে ওই বিনিয়োগকারী যেখানে নিজের বিনিয়োগের টাকায় একটি শেয়ার কেনার সামর্থ্য ছিল, সেখানে ২০০ টাকা ঋণসুবিধা পাওয়ায় তিনি তিনটি শেয়ার কিনতে সক্ষম হন। এভাবে ব্যাপক হারে শেয়ারের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু পরে যখন বাজারে ধস নামে, তখন শেয়ারের দাম নেমে আসে ৫০ টাকা বা তারও নিচে। তাতে ৩০০ টাকার তিনটি শেয়ারের দাম কমে হয় ১৫০ টাকা বা এর চেয়ে কম। তখন ওই শেয়ার ১৫০ টাকায় বিক্রি করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পক্ষে পুরো ঋণ আদায়ের সুযোগ ছিল না। অন্যদিকে বিনিয়োগকারীর নিজের ১০০ টাকার পুঁজির পুরোটাই লোকসানের খাতায় চলে যায়। উল্টো ঋণের আসল ও সুদ মিলিয়ে বড় দেনা তৈরি হয়। এ অবস্থায় অনেক বিনিয়োগকারী নিজের পুঁজি হারিয়ে আর বাজারমুখী হননি। এরই মধ্যে শেয়ারের দাম আরও কমে। তাতে ঋণাদাতা প্রতিষ্ঠানের অনাদায়ি ঋণের পরিমাণও সুদে–আসলে কাগজে–কলমে বাড়তে থাকে। এভাবে শেয়ারবাজারে বড় অঙ্কের ঋণাত্মক ঋণ বা মন্দ ঋণ বা নেগেটিভ ইকুইটির বোঝা ভারী হয়ে ওঠে।

বিএসইসি সূত্রে জানা যায়, দেশের শেয়ারবাজারে ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর মোট অনাদায়ি ঋণাত্মক ঋণের পরিমাণ ৯ হাজার কোটি টাকার বেশি। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক হিসাবমান নিয়ম অনুযায়ী, ঋণদাতা যেকোনো প্রতিষ্ঠানকে প্রতিবছর তার অনাদায়ি ঋণের বিপরীতে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রভিশনিং বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি হিসেবে সংরক্ষণ করতে হয়। সাধারণত প্রতিষ্ঠানের মুনাফা থেকে এই নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়। তাতে প্রতিষ্ঠানের মুনাফা কমে যায়। ২০১০ সালের পর শেয়ারবাজারে দীর্ঘ সময় ধরে মন্দাবস্থা চলে। তাতে ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর বড় অংশই মুনাফার দেখা পায়নি। ফলে তাদের পক্ষে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণের আর্থিক সামর্থ্যও ছিল না। এই অবস্থায় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির পক্ষ থেকে দফায় দফায় নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণে সময় বাড়িয়ে ছাড় দেওয়া হয়।

এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান দরকার। বছর বছর সময় বাড়িয়ে এই সমস্যার সমাধান হবে না। এ ছাড়া ঋণাত্মক ঋণ হিসাবের অনিয়ম রোধে তদারকি ব্যবস্থা জোরালো করতে হবে। তদারকির দুর্বলতার কারণেই আমরা বাজারে ঋণাত্মক ঋণ হিসাব নিয়ে নানা ধরনের অনিয়মের কথা শুনতে পাইসাইফুল ইসলাম, সভাপতি, ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশন (ডিবিএ)

ব্রোকারেজ হাউস মালিকদের সংগঠন ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ঋণাত্মক ঋণ হিসাবগুলোকে অবলোপনের বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য বিএসইসির কাছে আবেদন করেছি। আমরা মনে করি, এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান দরকার। বছর বছর সময় বাড়িয়ে এই সমস্যার সমাধান হবে না। এ ছাড়া ঋণাত্মক ঋণ হিসাবের অনিয়ম রোধে তদারকি ব্যবস্থা জোরালো করতে হবে। তদারকির দুর্বলতার কারণেই আমরা বাজারে ঋণাত্মক ঋণ হিসাব নিয়ে নানা ধরনের অনিয়মের কথা শুনতে পাই।’

ঋণাত্মক ঋণ যেভাবে অনিয়মের হাতিয়ার

এদিকে ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর বিপুল অনাদায়ি ঋণ অনেকের কাছে অনিয়মের হাতিয়ারে পরিণত হয়। লাভের আশায় অনেক প্রতিষ্ঠান এই সমস্যার সমাধানে উদ্যোগ না নিয়ে সময় বাড়ানোর চাপ তৈরি করার মাধ্যমে দেড় দশক ধরে সমস্যাটি জিইয়ে রেখেছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাও তাতে সহায়তা দিয়ে গেছে। অনাদায়ি ঋণ মূলত ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের দায়। তাই যে প্রতিষ্ঠানের এই দায় বেশি, সেটি তত দুর্বল হয়েছে। আর প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই ঋণের দায় বাড়িয়ে দুর্বল করার পেছনে কিছু কিছু কর্মকর্তারও ব্যক্তিগত স্বার্থ ছিল। তাঁরা এসব ঋণাত্মক ঋণ হিসাবকে নিজেদের স্বার্থে অনিয়মের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। কীভাবে সেটি করলেন তার একটি ধারণাভিত্তিক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।

ধরা যাক, কোনো একজন বিনিয়োগকারী ৫০ টাকা দামে একটি কোম্পানির শেয়ার কিনেছেন। পরে বাজারে সেই শেয়ারের দাম নেমে এসেছে ২০ টাকায়। এ রকম পরিস্থিতিতে ওই বিনিয়োগকারী ঋণদাতা ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকের দুর্নীতিগ্রস্ত কিছু কর্মকর্তার শরণাপন্ন হলেন। দুজনের মধ্যে একধরনের সমঝোতা হলো। বাজারমূল্যের চেয়ে কিছুটা বেশি দামে (যেমন ২৫ বা ২৭ টাকা) ওই বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে সেই শেয়ার কিনে নেন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব হিসাবে। বিনিময়ে ওই কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে শেয়ারপ্রতি নগদে নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ গ্রহণ করেন। তাতে বিনিয়োগকারী বাজারমূল্যের চেয়ে কিছু টাকা বেশি পান। অন্যদিকে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি করে নিজে নগদ অর্থ কামিয়ে নেন। পরে ওই সব শেয়ার নেগেটিভ ইকুইটি বা ঋণাত্মক ঋণ হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। এতে প্রতিষ্ঠানের অনাদায়ি ঋণের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পায় এবং আর্থিক সক্ষমতা কমে যায়। বেসরকারি মালিকানাধীন ব্রোকারেজ হাউস, মার্চেন্ট ব্যাংক, ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশেও (আইসিবি) এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। ফলে ২০১০ সালের পর থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের নেগেটিভ ইকুইটির বোঝা কেবলই বেড়েছে।

সমস্যার স্থায়ী সমাধান কী

বাজার–সংশ্লিষ্ট একটি পক্ষ বলছে, এখন আর শুধু নিরাপত্তা সঞ্চিতির সময় বাড়িয়ে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যাটির সমাধান করতে হলে সব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণাত্মক ঋণ হিসাবের পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। তারপর সেসব হিসাবকে ব্লক হিসাবে স্থানান্তরের মাধ্যমে এসব হিসাবে অনুমোদন ছাড়া শেয়ার কেনাবেচা বন্ধ রাখতে হবে। এরপর প্রতিষ্ঠানভেদে সুনির্দিষ্ট তথ্য–উপাত্তের ভিত্তিতে এসব অনাদায়ি ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় সময়সীমা বেঁধে দিয়ে ধাপে ধাপে প্রভিশনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এ–ও বলছেন, ব্যাংকে যে পন্থায় খেলাপি ঋণ অবলোপন বা রাইট অফ করা হয়, শেয়ারবাজারেও সেই পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে কিছু কিছু অনাদায়ি ঋণের ক্ষেত্রে। কারণ, এসব ঋণ আদায়ের বাস্তব সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। অনেক বিনিয়োগকারীকে এখন আর খুঁজে পাওয়াও যাবে না। আবার শেয়ারবাজারে ঋণের ক্ষেত্রে শেয়ার ছাড়া আর কোনো জামানতও থাকে না। ফলে হয় শেয়ার বিক্রি করে এসব অনাদায়ি ঋণ সমন্বয় করতে হবে ধাপে ধাপে, অন্যথায় অবলোপনের পথে যেতে হবে। এটি করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো যেন নতুন করে আর ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে জন্য সরকারি কিছু নীতি সহায়তাও দিতে হবে।

সর্বশেষ বিএসইসি সময় বাড়ানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে ঋণাত্মক ঋণ হিসাবের প্রভিশনিংয়ের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে আলাদা কর্মপরিকল্পনা তৈরির শর্তারোপ করা হয়েছে। সেই শর্ত পরিপালনের মাধ্যমে শেয়ারবাজারের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান যেন হয়, সেটিই প্রত্যাশা বাজার অংশীজনদের। কারণ, এই সমস্যার স্থায়ী নিরাময় চায় বাজার–সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ। আর সেই নিরাময়ে বিএসইসিকে চিকিৎসকের ভূমিকায় থেকে সুচিন্তিত ও বাস্তবভিত্তিক কার্যকর সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে।

জানতে চাইলে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, এত দিনেও কেন শেয়ারবাজারের ঋণাত্মক ঋণ হিসাবের স্থায়ী কোনো সমাধান হলো না, সেটি এক বড় প্রশ্ন। যত দ্রুত সম্ভব এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান দরকার। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহ করে প্রয়োজনে সময় বেঁধে দিয়ে এসব অনাদায়ি ঋণ অবলোপনের ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রতিষ্ঠানভেদে ও ক্ষতির পরিমাণ বিবেচনায় নিয়ে সমাধান করতে হবে। আর এসব হিসাবে অনিয়ম রোধেও কার্যকর পদক্ষেপ দরকার।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • এপ্রিলজুড়ে দর পতন, আস্থা ফেরানোর উদ্যোগ নেই
  • পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক পতনের কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি
  • অস্বাভাবিক বাড়ছে ইস্টার্ন লুব্রিকেন্টসের শেয়ার দর, তদন্তের নির্দেশ
  • মানিলন্ডারিং সচেতনতায় ৫ ব্রোকার-মার্চেন্ট ব্যাংক পরিদর্শনের আদেশ
  • বিএসইসি চেয়ারম্যানের পদত্যাগের গুঞ্জনে ঘুরে দাঁড়ালো সূচক
  • স্থায়ী সমাধান ও অনিয়ম বন্ধে ব্যবস্থা কী
  • অমীমাংসিত ইস্যুর সমাধান করতে গিয়ে নতুন সমস্যা
  • সপ্তাহ শেষে ডিএসইর সূচক নেমেছে আবারও ৫ হাজারের নিচে
  • পুঁজিবাজারে মূলধন কমেছে ১৩ হাজার ১৯ কোটি টাকা
  • ডিএসইতে পিই রেশিও কমেছে ১.৮৮ শতাংশ