সংস্কার নিয়ে এবি পার্টির সঙ্গে আগামীকাল আলোচনায় বসবে ঐকমত্য কমিশন
Published: 6th, April 2025 GMT
পবিত্র ঈদুল ফিতরের ছুটির পর আবারও সংস্কার প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য গঠনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। আগামীকাল সোমবার বিকেলে এবি পার্টির সঙ্গে আলোচনা করবে কমিশন।
আগামীকাল বেলা তিনটায় জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে এবি পার্টির সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিপক্ষীয় আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে বলে কমিশনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার প্রস্তাব তৈরির জন্য গত বছরের অক্টোবরে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। এর মধ্যে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন, বিচার বিভাগ ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশ নিয়ে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে ঐকমত্য কমিশন। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোর বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে লিখিত মতামত নেওয়ার পর গত ২০ মার্চ থেকে দলগুলোর সঙ্গে আলাদা আলাদা আলোচনা শুরু করে কমিশন। অবশ্য এসব আলোচনায় প্রধান উপদেষ্টা উপস্থিত থাকছেন না। ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বে কমিশনের সদস্যরা দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন।
ইতিমধ্যে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ লেবার পার্টি এবং রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে আলোচনা করেছে কমিশন। এরই ধারাবাহিকতায় এবি পার্টির সঙ্গে আলোচনায় বসছে ঐকমত্য কমিশন। এরপর পর্যায়ক্রমে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও আলোচনা করবে কমিশন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জ ত য় ঐকমত য
এছাড়াও পড়ুন:
নির্বাচনী ট্রেনের ট্র্যাক ঠিক করতে যা করা দরকার
এ মুহূর্তে দেশে কোনো রাজনৈতিক সংকট নেই; যা দেখছি তা অতীতের জঞ্জাল পরিষ্কার করে ভবিষ্যৎ যাত্রার চ্যালেঞ্জ। নিশানা: একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। এই সাধারণ ঐকমত্য (যদি তা ঠিক ধরে নেই) ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনের একই সঙ্গে কারণ এবং ফলাফল।
তা সত্ত্বেও অতি সম্প্রতি লক্ষ করা যাচ্ছে, মরিয়া হওয়া পতিত শক্তির ভয়াবহ অপতথ্যের প্রচারাভিযানের প্রভাবে অংশীজনের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস। যেন চলমান সংস্কার পূর্ণ না হলে নির্বাচন হবেই না; আবার দ্রুত নির্বাচন হলে সংস্কারপ্রক্রিয়া মাঠেই মারা যাবে। একেই বলে উভয়সংকট!
এ অবস্থায় প্রতিনিয়ত কথার বাহাসে একটা প্রশ্ন বেমালুম এড়িয়ে যাচ্ছি আমরা—জুলাই-আগস্ট বিপ্লব না হলে সুষ্ঠু নির্বাচন ও রাষ্ট্রীয় সংস্কারের আলোচনাটি পর্যন্ত সম্ভব হতো কি, সর্বজনাব...?
জনগণের নির্বাচিত সরকার দেশ পরিচালনা করবে, এ নিয়ে তো তর্কের অবকাশ নেই; সেই অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে, ফ্যাসিবাদী শাসনে পচে যাওয়া প্রতিষ্ঠান ঠিকঠাক করাটাও তো জরুরি ছিল। এতেও হয়তো কারও দ্বিমত নেই, তবে অবশ্যই পতিত আওয়ামী লীগ ও তার দোসরেরা ছাড়া।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার যেমন বলছে না নির্বাচন দেওয়া হবে না, বিএনপিসহ অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোও তো নীতিগতভাবে সংস্কারের বিরোধিতা করছে না। শুধু কিছু রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর, সামাজিক মাধ্যমের অতিকথন এবং আড্ডার উর্বর আলোচনা চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সমাজে ধূম্রজাল সৃষ্টি এবং সুশীল সমাজকে বিভ্রান্ত ও রাজনৈতিক মনকে উতলা করতে পেরেছে।
দেখুন, এই যে সন্দেহের রাজনৈতিক আবহ, অস্বীকার করা যাবে না, এর একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা (লিগ্যাসি) আছে। আসলে ক্ষমতাসীনদের প্রতিশ্রুতি ভাঙার বেদনায় আহত এক জাতি আমরা। রাজনীতিকদের অনেকেই কেন জানি যৌক্তিক ও দূরদর্শী; কিন্তু জনসেবার সরল পথ অনুসরণ করতে দ্বিধান্বিত থাকেন। হতে পারে পুরোনো মানসিকতা অথবা নিজেদের সামর্থ্য সম্পর্কে কিছুটা হীনম্মন্যতা থেকে, আন্দোলন-সংগ্রাম ও রাজনৈতিক দর–কষাকষির জায়গায় আমরা আলোচনার টেবিলে নিজেদের শক্তিমত্তা খুব একটা দেখাতে পেরেছি বলে মনে পড়ছে না।
যখনই সংলাপে বসেছি, তখন ফলাফল শূন্যই হয়েছে বেশি। যে কারণে ২০২৪-এর পর্যন্ত নানা সময়ে ঘটেছে সহিংস পরিবর্তন এবং ১৯৯৫,২০০৬, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ব্যর্থ সংলাপ।
রাজনৈতিক ময়দান হোক আর আলোচনার টেবিল হোক, বাংলাদেশে রাজনৈতিক উত্তরণের উদ্যোগ সফল পরিণতি না পাওয়ার অন্যতম সাধারণ কারণ একটি ন্যূনতম রাজনৈতিক ঐকমত্য এবং গ্রহণযোগ্য চুক্তিতে পৌঁছার ব্যর্থতা। সুতরাং কার্যকর সংস্কার ও প্রকৃত সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হলে সেটাই করতে হবে আজ, যা অতীতে সম্ভব হয়নি এবং সেটিই হবে এক নতুন দৃষ্টান্ত।রাজনৈতিক ময়দান হোক আর আলোচনার টেবিল হোক, বাংলাদেশে রাজনৈতিক উত্তরণের উদ্যোগ সফল পরিণতি না পাওয়ার অন্যতম সাধারণ কারণ একটি ন্যূনতম রাজনৈতিক ঐকমত্য এবং গ্রহণযোগ্য চুক্তিতে পৌঁছার ব্যর্থতা। সুতরাং কার্যকর সংস্কার ও প্রকৃত সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হলে সেটাই করতে হবে আজ, যা অতীতে সম্ভব হয়নি এবং সেটিই হবে এক নতুন দৃষ্টান্ত। যা মানুষ সোজাসাপটা ক্রেইগকে বুঝবে এবং বিশ্বাস করতে পারবে। অতীতে না পারা সেই রাজনৈতিক চুক্তিকেই এবার সফল করতে হবে। এবং সে জন্য দরকার হবে খোলামনের জাতীয় সংলাপ।
কেন, ভাই? সংস্কার কমিশনগুলোর রিপোর্টের ওপর তাদের মতামত তো দিয়েই দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। ঠিক, কিন্তু ওই ফিডব্যাক মূলত একপক্ষীয় প্রতিক্রিয়া, সাংকেতিক ভাষায় লিখিত রিপোর্টের বক্তব্যের মতোই। অংশীজনের চিন্তার দূরত্বও জাতির জন্য দুশ্চিন্তার বিষয়।
এখনকার বাস্তবতায় একটি সত্যিকারের দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় এবং মুখোমুখি প্রাণবন্ত আলোচনা ব্যতীত কমিশনগুলোর সুপারিশ এবং অংশীজনের সুচিন্তিত মতামতের ভিত্তিতে জাতীয় ঐকমত্যের দলিল প্রস্তুত করা প্রায় অসম্ভব। তাই অতি প্রয়োজনীয় সংস্কার ও অবশ্যম্ভাবী নির্বাচন নিয়ে শতধাবিভক্তি বা জাতীয় হতাশা তৈরির আগেই একটি সর্বজনীন অংশীজনের সংলাপ আয়োজন করা যেতে পারে ৷
আরও পড়ুনবিএনপি ও এনসিপির মধ্যে কেন এই বাক্যুদ্ধ ১১ ঘণ্টা আগেসপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠিত বড় বড় আন্তর্জাতিক সম্মেলন বা কিছু কিছু দেশে বিপ্লবোত্তর জাতীয় কনভেনশনের আলোকে একটি জাতীয় সম্মেলনের উদ্যোগ নিতে পারে সরকার। কেউ বলতে পারেন, ওরকম কোনো আয়োজন না করলেই বা ক্ষতি কী? এর উত্তর হচ্ছে: তাতে শতাব্দীর অনন্য সুযোগ হাতছাড়া হতে পারে, দেশ থেকে যেতে পারে নেতৃস্থানীয়দের আত্মম্ভরিতায় ভরা হাসিনা আমলের সংস্কৃতির বৃত্তেই।
আমরা যদি জাতীয় সংলাপ ও সমঝোতার পথ বেছে নিই, সেখানে কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন অধিবেশনে তর্ক-বিতর্ক হতে পারে প্রাসঙ্গিক জাতীয় ইস্যুগুলো নিয়ে। সেই সংলাপের ভিত্তি হতে পারে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের অলিখিত ঘোষণাপত্র, যা রচিত হতে পারে ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রামের উদ্দেশ্য ও জন-আকাঙ্ক্ষার আলোকে।
সরকারি কর্তৃপক্ষ এবং বিভিন্ন কমিশনের সুপারিশ ও পর্যবেক্ষণগুলো সেখানে ভালোভাবে উপস্থাপিত হতে পারবে। রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনের প্রতিনিধিদের দ্বারা ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রণীত একটি সামাজিক চুক্তির দলিলে সই করা যেতে পারে শীর্ষ পর্যায়ের সম্মেলনে।
যেটা হতে পারে ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র পরিচালনার সনদ, যে দলিল জাতি হিসেবে আমাদের সভ্যতা ও অধিকতর যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখতে পারে। এতে করে সংস্কার এবং জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধন নিয়ে রাজনৈতিক মালিকানায় কোনো ঘাটতি থাকবে না। রাজনৈতিক নেতৃত্বও এই এক্সারসাইজ করে সমৃদ্ধ হতে পারে।
এরপর অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য এবং সব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল ও শক্তিগুলোকে নিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের আর কোনো বাধাই থাকে না। তবে ন্যায় ও নৈতিকতার স্বার্থে বলে রাখি, একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বন্দোবস্তে ফ্যাসিবাদী, অগণতান্ত্রিক বা গণতন্ত্র হত্যাকারী দল ও গোষ্ঠীর গণবিরোধী ও দেশবিরোধী রাজনীতির কোনো বৈধতা নেই।
প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষায় যে ‘নির্বাচনী ট্রেন’ ইতিমধ্যে চালু হয়েছে এবং চলতে থাকবে, তাকে সঠিকভাবে গন্তব্যের দিকে পৌঁছুতে সাহায্য করতে পারে মসৃণ রাজনৈতিক ট্র্যাক।
একটি সফল জাতীয় সংলাপ সেই পথ এবং যাত্রাকে আরও নির্বিঘ্ন করতে পারে। আমাদের সম্মিলিত ভবিষ্যৎ গড়ার দায়িত্ব নেওয়া এবং সে অনুযায়ী কাজ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া, এখন জীবিত প্রজন্মের সিদ্ধান্তের ব্যাপার।
খাজা মাঈন উদ্দিন সাংবাদিক
( লেখকের মতামত নিজস্ব)