ঢাকা-দিল্লির পদক্ষেপই ঠিক করবে সম্পর্কের গতিপথ
Published: 6th, April 2025 GMT
ব্যাংককে বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের পর অনুষ্ঠিত বৈঠকে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও নরেন্দ্র মোদি দুই দেশের সম্পর্কের ‘চরম টানাপোড়েন’ দূর করতে নিজেদের উদ্বেগের বিষয়গুলো একে অন্যকে বলেছেন। কোনো কোনো ইস্যুতে দুই নেতা পাল্টা বক্তব্য দিয়েছেন। আবার শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর বিষয়ও আলোচনায় এসেছে।
তবে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ আর ভারতের শীর্ষ নেতারা দুই দেশের জনগণের স্বার্থে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে জোর দিয়েছেন। বিশেষ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আলোচনায় বলেছেন, ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের কেন্দ্রে মানুষ। দুই প্রতিবেশীর সম্পর্ক মানুষের স্বার্থে। সম্পর্কটা কোনো ব্যক্তিবিশেষ বা দলকে ঘিরে নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে এ বার্তা বাংলাদেশের জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার অনুরোধ করেছেন নরেন্দ্র মোদি।
গত শুক্রবার থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের সাংরিলা হোটেলে আধা ঘণ্টার বেশি সময়ের ওই বৈঠকে দুই শীর্ষ নেতা অতীত আর বর্তমানের বিষয়গুলো সামনে এনেছেন সম্পর্কের ভবিষ্যতের স্বার্থে। আর আলোচনাজুড়ে ছিল দুই দেশের প্রসঙ্গগুলো।
অধ্যাপক ইউনূস চীনের কাছে নদী ও পানি ব্যবস্থাপনার ৫০ বছরের মহাপরিকল্পনা চেয়েছেন। তবে কি চীন প্রসঙ্গটি ব্যাংককের আলোচনায় ঊহ্য থেকে গেল!শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে ওই বৈঠকে উপস্থিত সূত্রগুলোর সঙ্গে কথা বলে ধারণা পাওয়া গেছে যে এটা নির্ভর করছে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণের ওপর। শেখ হাসিনার বিচারপ্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার বিষয়টিও এসেছে।
ইউনূস-মোদির প্রতীক্ষিত বৈঠকটি এমন এক সময়ে হলো, যার ঠিক এক সপ্তাহ আগে চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বেইজিংয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করেছিলেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। বেইজিংয়ের সেই বৈঠকে ভারতের সঙ্গে অভিন্ন নদীর তিস্তার প্রস্তাবিত প্রকল্পে চীনের ঠিকাদারদের স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ। অধ্যাপক ইউনূস চীনের কাছে নদী ও পানি ব্যবস্থাপনার ৫০ বছরের মহাপরিকল্পনা চেয়েছেন। তবে কি চীন প্রসঙ্গটি ব্যাংককের আলোচনায় ঊহ্য থেকে গেল!
আরও পড়ুনইউনূস–মোদি বৈঠক: যেসব বিষয়ে আলোচনা হলো১৪ ঘণ্টা আগেইউনূস-মোদির বৈঠকে উপস্থিত বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে বাংলাদেশ-ভারতের শীর্ষ নেতাদের আলোচনায় সরাসরি ‘চীন’ শব্দটি উল্লেখ না থাকলেও বিষয়টি এসেছে। নরেন্দ্র মোদি আলোচনার এক পর্যায়ে বলেছেন, দুই দেশের সম্পর্কের মাঝে ‘তৃতীয় পক্ষের’ কোনো প্রয়োজন নেই। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন, তার অভ্যুদয়—সব মিলিয়ে দুই দেশ একে অন্যকে যতটা জানে, বোঝে, তা নিশ্চয় অন্য কারও পক্ষে সম্ভব নয়! কাজেই বাংলাদেশের সফলতা, সংকটে সব সময় পাশে থাকার বাসনা ভারতের।
সম্পর্ক খারাপ হয় এমন বক্তব্য পরিহার করার যে প্রসঙ্গ ভারতের প্রধানমন্ত্রী সামনে এনেছেন, একই বিষয় তাঁদেরও বিবেচনায় থাকা বাঞ্ছনীয়।সাবেক রাষ্ট্রদূত ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) সভাপতি এম হুমায়ুন কবীরসংখ্যালঘুদের বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের প্রসঙ্গ এলে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হিসেবে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের যে ভূমিকা রয়েছে, সেটা ভারত উল্লেখ করেছে। এ সময় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়, নির্যাতনের বেশির ভাগ ঘটনা ৫ থেকে ৮ আগস্ট। যার সঙ্গে বিশেষ কোনো সম্প্রদায় নয়, রাজনৈতিক কারণ জড়িত। তারপরও বাংলাদেশ বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। সরেজমিনে পরিস্থিতি দেখতে ভারতের সাংবাদিকদের বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
দুই দেশ ভবিষ্যৎমুখী ও জনগণকেন্দ্রিক সম্পর্কের ওপর জোর দিয়েছে। তাই খোলাখুলিভাবে শীর্ষ দুই নেতা চ্যালেঞ্জগুলোর কথাও বলেছেন। কিন্তু গত প্রায় আট মাসের চরম টানাপোড়েনের জেরে ভুক্তভোগী হয়েছেন সাধারণ জনগণ। বাংলাদেশের জনগণের জন্য ভারতীয় ভিসা একেবারেই সীমিত হয়ে পড়েছে। এতে ভারতে তো বটেই, ভারত থেকে তৃতীয় দেশের ভিসা পাওয়া বাংলাদেশের মানুষের জন্য প্রায় দুষ্কর হয়ে পড়েছে। আর ভিসার হার নেমে আসায় দুই দেশের মধ্যে বাস-ট্রেন যোগাযোগও প্রায় কমে গেছে। অথচ শুক্রবারের আলোচনায় ভিসা আর যোগাযোগের প্রসঙ্গগুলো আসেনি।
নরেন্দ্র মোদি আলোচনার এক পর্যায়ে বলেছেন, দুই দেশের সম্পর্কের মাঝে ‘তৃতীয় পক্ষের’ কোনো প্রয়োজন নেই। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন, তার অভ্যুদয়—সব মিলিয়ে দুই দেশ একে অন্যকে যতটা জানে, বোঝে, তা নিশ্চয় অন্য কারও পক্ষে সম্ভব নয়!বৈঠকে সীমান্ত হত্যার বিষয়টি এসেছে। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এসব হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি সব সময় কষ্ট অনুভব করেন। ভারতকে এই ঘটনাগুলো প্রতিরোধের জন্য উপায় খুঁজে বের করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, প্রাণহানির সংখ্যা কমাতে একসঙ্গে কাজ করলে কেবল অনেক পরিবারই বড় ধরনের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে না, বরং আস্থা ও আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে এবং ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও জোরদার করতে সাহায্য করবে।
এ বিষয়ে নরেন্দ্র মোদি বলেন, ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা শুধু আত্মরক্ষার জন্য গুলি চালায় এবং মৃত্যুর ঘটনাগুলো ভারতের ভেতরে ঘটে। উভয় নেতা বিষয়টি নিয়ে একসঙ্গে কাজ করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
ব্যাংককে উপস্থিত কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলে ধারণা পাওয়া গেছে, বিমসটেকের শীর্ষ সম্মেলনে নেতাদের সম্মানে আয়োজিত নৈশভোজে অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির কথা হয়েছে। অর্থাৎ বৃহস্পতিবারের সেই অনানুষ্ঠানিক আলোচনার পর দিনের বৈঠকের জন্য একধরনের ইতিবাচক আবহ তৈরি করেছিল। সব মিলিয়ে ব্যাংককে শুক্রবারের আলোচনা ইতিবাচক হলেও দুই পক্ষই নিজেদের অবস্থান জোরালোভাবে তুলে ধরেছে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দুই দেশের সম্পর্ক এখন যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, তাতে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক স্তরে যোগাযোগটা জরুরি ছিল। এখন ইউনূস-মোদি বৈঠকের পর সময় বলে দেবে, সম্পর্ক এগিয়ে দুই পক্ষ কতটা উদ্যোগী ভূমিকা নিচ্ছে।
ব্যাংককের আলোচনায় উপস্থিত কয়েকজন কূটনীতিক আভাস দিয়েছেন, এক বৈঠকেই সব সংকট কেটে যাবে, এমন উচ্চাশা কোনো পক্ষই করেনি। বৈঠক হওয়াটাও ইতিবাচক। কারণ, দুই শীর্ষ নেতাই মুখোমুখি বসে কথা বলেছেন। আর বৈঠকের জন্য তৈরি হয়েই ব্যাংককে একে অন্যের সঙ্গে কথা বলেছেন। প্রাসঙ্গিকভাবেই এসেছে ব্যক্তিগত যোগাযোগের স্মৃতিচারণা। সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার যে প্রত্যয় দুই নেতা ব্যক্ত করেছেন, তাঁদের পরবর্তী পদক্ষেপই নির্ধারণ করবে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার গতিমুখ।
সব মিলিয়ে ব্যাংককে শুক্রবারের আলোচনা ইতিবাচক হলেও দুই পক্ষই নিজেদের অবস্থান জোরালোভাবে তুলে ধরেছে।সাবেক রাষ্ট্রদূত ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) সভাপতি এম হুমায়ুন কবীর প্রথম আলোকে বলেন, দুই নেতা প্রথমবারের মতো আলোচনায় বসে দুই দেশের আগের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন। সামনাসামনি বসে এ বিষয়গুলো আলোচনায় উত্থাপনের ফলে তা সুরাহার জন্য তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক একধরনের দায়বোধ তৈরি হতে পারে। ফলে দুই নেতা হয়তোবা নতুন করে ভাবার সুযোগ পাবেন। এতে দুই দেশের সম্পর্কে হয়তো গতির সঞ্চার হতে পারে। দুজনের জন্যই সম্পর্ককে সাবলীল রাখার একধরনের চাপ তৈরি হতে পারে। ফলে সামগ্রিকভাবে ব্যাংককের বৈঠককে ইতিবাচকই বলা চলে।
এম হুমায়ুন কবীরের মতে, সম্পর্ক খারাপ হয় এমন বক্তব্য পরিহার করার যে প্রসঙ্গ ভারতের প্রধানমন্ত্রী সামনে এনেছেন, একই বিষয় তাঁদেরও বিবেচনায় থাকা বাঞ্ছনীয়।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইউন স ম দ শ ক রব র সব ম ল য় উপস থ ত প রসঙ গ র জন য র প রস বল ছ ন র ওপর ব ষয়ট
এছাড়াও পড়ুন:
এনসিপি: তারুণ্যের উত্থান, নাকি জাসদের ছায়া
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরের সময়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগের ভেতর থেকে একদল তরুণ রাজনীতিবিদের নেতৃত্বে গঠিত এই দল মূলধারার রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি হতাশ হয়ে বিকল্প রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়তে চেয়েছিল। তারা মনে করত, আওয়ামী লীগ প্রকৃত সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছে; বরং তারা সরকার চালানোর পুরোনো পদ্ধতি চালু করেছে।
বাংলাদেশ: সামরিক শাসনের কালো অধ্যায়, জাসদের উত্থান ও পতন, রাষ্ট্র বনাম রাজনীতি—এই বইগুলো অনুসারে মহিউদ্দিন আহমদের বক্তব্য হচ্ছে, স্বাধীনতার পরের সময়টি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের একদিকে সম্ভাবনাময়, অন্যদিকে অত্যন্ত জটিল ও অস্থির একটি অধ্যায়। তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী তরুণ প্রজন্ম সমাজতান্ত্রিক পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে পথে নেমেছিল, কিন্তু তাদের কৌশলগত ভুল এবং বাস্তবতা বিচারের ঘাটতির কারণে সেই স্বপ্ন অনেকাংশেই ভেঙে পড়ে।
প্রায় ৫০ বছর পর, বাংলাদেশ আবারও ছাত্রদের নেতৃত্বে ছাত্র-জনতার সংমিশ্রণে একটি বৃহৎ রাজনৈতিক জাগরণের সাক্ষী হয়েছে। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে শুরু হওয়া এই বিক্ষোভ মূলত বৈষম্য, দুর্নীতি ও শাসনব্যবস্থার দুর্বলতার বিরুদ্ধে ছিল। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গঠিত হয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)—একটি নতুন রাজনৈতিক শক্তি, যার শিকড় বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক ‘পাঠচক্র’ ও তরুণদের রাজনৈতিক আলোচনার মধ্যে প্রোথিত।
এখানে একটি ঐতিহাসিক মিল খুঁজে পাওয়া যায়—১৯৭০-এর দশকে যেমন জাসদ গঠিত হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রদের চিন্তা ও আদর্শ থেকে, তেমনি এনসিপিও উঠে এসেছে একধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও আদর্শগত অনুসন্ধান থেকে। এমনকি এই ধারাবাহিকতার গোড়া খুঁজলে ১৯৬০-এর দশকে সিরাজুল আলম খান ‘দাদা ভাই’-এর নেতৃত্বে গঠিত ‘নিউক্লিয়াস’ নামের গোপন আলোচনা চক্রের কথাও মনে পড়ে, যেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার রূপরেখা নিয়ে চিন্তা হতো।
আরও পড়ুনবিএনপি কি তরুণ প্রজন্মের চাওয়া বুঝতে পারছে০৬ এপ্রিল ২০২৫আজকের এনসিপির তরুণ নেতারাও সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে একই রকম গভীরভাবে ভাবছেন। তবে এখানেই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি উঠে আসে, তাঁরা কি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিচ্ছেন, নাকি জাসদের পথেই আবার হাঁটছেন? কারণ, ইতিহাস আমাদের শেখায়, শুধু উচ্চ আদর্শ বা রাজনৈতিক আবেগ দিয়ে নয়, একটি আন্দোলনের সাফল্য নির্ভর করে সঠিক কৌশল, ধৈর্য এবং জনগণের বাস্তব চাহিদা বোঝার ওপর।
এই লেখায় খতিয়ে দেখতে চেষ্টা করব, জাসদ ও এনসিপির মধ্যে কী কী মিল রয়েছে, কী কী মৌলিক পার্থক্য রয়েছে এবং সেই সঙ্গে জাসদের অভিজ্ঞতা থেকে বর্তমান তরুণদের জন্য কী কী শিক্ষণীয় দিক থাকতে পারে।
‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ বনাম ‘দ্বিতীয় রিপাবলিক’
‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ অথবা ‘দ্বিতীয় রিপাবলিক’—এ ধরনের ধারণা শুনতে অনেক বড় কথা মনে হলেও সাধারণ মানুষ এসব বুঝতে পারে কি? ১৯৭২ সালে জাসদ যখন সমাজবদলের কথা বলেছিল, তখন তারা মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আর শহরের কিছু বুদ্ধিজীবীর চিন্তার জগতে সীমাবদ্ধ ছিল। তারা চেয়েছিল শ্রেণিবিহীন সমাজ গড়তে, রাষ্ট্রব্যবস্থা একেবারে পাল্টে ফেলতে।
মহিউদ্দিন আহমদ তাঁর জাসদের উত্থান ও পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি বইয়ে বলেন, জাসদ একরকম নিজেদের তাত্ত্বিক জগতে আটকে পড়েছিল, ফলে তারা জনতার আবেগ ও বাস্তবতা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল। একইভাবে বদরুদ্দীন উমরও বিভিন্ন সময়ে সাক্ষাৎকারে বাম ধারণার দলগুলোর মধ্যে শ্রমিক-কৃষক শ্রেণির সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে দুর্বলতা এবং নেতৃত্বে মধ্যবিত্তের প্রাধান্য সম্পর্কে সমালোচনা করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, এ দলগুলোর মধ্যে শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে কার্যকর সম্পর্ক স্থাপনের অভাব ছিল, যা তাদের গণভিত্তি গড়ে তুলতে বাধা সৃষ্টি করেছে।
জাসদের মতো আজকের এনসিপি ‘দ্বিতীয় রিপাবলিক’-এর কথা বলছে। তারা চায় নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত, সংবিধান পাল্টাতে এবং নতুন ধরনের সরকার গঠন করতে। কিন্তু গ্রামের কৃষক, বিদেশে কাজ করা শ্রমিক, পোশাক কারখানার শ্রমিক কিংবা শহরের রিকশাওয়ালারা এসব বুঝবেন কীভাবে? তাঁদের দুঃখ-দুর্দশা তো অন্য জায়গায়—চালের দাম, কাজের নিশ্চয়তা, চিকিৎসা, বিচার পাওয়ার আশা। যাঁরা নতুনভাবে রাষ্ট্র গঠনের কথা বলছেন, তাঁরা কি এই মানুষের ভাষায় কথা বলছেন?
রাজনৈতিক চিন্তাবিদ গ্রামসি তাঁর প্রিজন নোটবুকস বইয়ে বলেছিলেন, কোনো ‘তাত্ত্বিক ধারণা’ জনগণের জীবনের সঙ্গে যুক্ত না থাকলে তা কাগজে থাকবে, বাস্তবে নয়। এ ছাড়া সমাজবিজ্ঞানী পিয়েরে বুর্দিয়ো বলেছিলেন, সমাজের বাস্তবতা না বুঝে যারা কেবল বড় বড় কথা বলে, তারা একধরনের জোর করে চাপিয়ে দেওয়া রাজনীতি করে।
আমাদের দেশে যেখানে ধনিক শ্রেণি নিজের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত, গরিব শ্রেণি তাত্ত্বিক রাজনৈতিক ভাষা বোঝে না আর মধ্যবিত্তের একাংশ বিভ্রান্ত, সেখানে এনসিপি কি সেই প্রয়োজনীয় ‘হোমওয়ার্ক’ শেষ করতে পেরেছে, যা জাসদ ৫০ বছর আগে করতে পারেনি। তারা কি কেবল নিজেরা নিজেদের বোঝে, নাকি সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নেওয়ার মতো ভাষা ও কৌশল তৈরি করতে পেরেছে? এবার ইতিহাসের পরিণতি কি আলাদা হবে?
‘শহরের রাজনীতি’ বনাম ‘গ্রামীণ বাস্তবতা’
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস দেখলে বোঝা যায়, গণজাগরণ বা প্রতিরোধ আন্দোলনের উৎস শুধু শহর নয়, বরং বহু সময়েই তা উঠে এসেছে গ্রাম থেকে। ঔপনিবেশিক আমলে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, হাজী শরীয়তুল্লাহর ফরায়েজি আন্দোলন, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা কিংবা তেভাগা আন্দোলন—সবই শুরু হয়েছিল গ্রামের মাটিতে, শোষিত কৃষক ও ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষের হাত ধরে।
কিন্তু স্বাধীনতার পর আমাদের রাজনীতিতে একটা প্রবণতা দেখা যায়—আন্দোলনের ভাষা, দৃষ্টি ও নেতৃত্ব ক্রমেই শহরকেন্দ্রিক। অথচ বাংলাদেশের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষ এখনো গ্রামে বসবাস করে। তাদের জীবনের সমস্যা, চাহিদা, চিন্তা—সবকিছুই শহরের মানুষের চিন্তার জগৎ থেকে অনেক ভিন্ন।
এখানে আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, শহরভিত্তিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব অনেক সময় গ্রামীণ জনগণের ‘এজেন্সি’, অর্থাৎ তাদের চিন্তা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এবং সামাজিক শক্তিকে উপেক্ষা করে। এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে আরও দূরে সরিয়ে দেয়। জাসদের মতো বহু দল এই দূরত্ব কমাতে পারেনি। তারা শহরের সভা-সেমিনার আর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ব্যস্ত ছিল।
কিন্তু যাঁদের জন্য তারা সমাজ বদলাতে চেয়েছিল, সেই গ্রামের মানুষ, শ্রমিক, কৃষকদের কাছে পৌঁছানোর মতো ভাষা, কর্মসূচি বা সম্মানজনক অবস্থান তৈরি করতে পারেনি। বিষয়টি আরও সহজভাবে তুলে ধরেছিলেন কাজী জাওয়াদ তাঁর ‘জাসদের রাজনীতি’ শিরোনামের একটি প্রবন্ধে, যা সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত হয় ১৯৮০ সালের ১৮ এপ্রিল।
বিশ্ব ইতিহাসের অনেক উদাহরণ আমাদের দেখায়, রাজনৈতিক আন্দোলন তখনই টিকে থাকে, যখন তা শহরের দেয়াল পেরিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে পৌঁছাতে পারে। যেমন চিলিতেও ২০১৯ সালে ছাত্রদের নেতৃত্বে একটি আন্দোলন শুরু হয়। শুরুতে শহরভিত্তিক হলেও পরে তা কৃষক, শ্রমিক, নারী ও আদিবাসীদের যুক্ত করে এক বিস্তৃত গণ-আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গ্যাব্রিয়েল বোরিচ নামের এক ছাত্রনেতা পরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ফলে আন্দোলনটি বিদ্রোহ থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা পর্যন্ত পৌঁছায়, যা একটি সফল গণভিত্তিক পরিবর্তনের দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে।
অন্যদিকে মিসরের ‘এপ্রিল ৬ আন্দোলন’ শুরু হয়েছিল ২০০৮ সালে, শহরের কিছু তরুণ মধ্যবিত্ত শ্রেণির অংশগ্রহণে; যদিও এটি সোশ্যাল মিডিয়াভিত্তিক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, কিন্তু গ্রামের মানুষের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করতে পারেনি। ২০১১ সালের মিসরীয় বিপ্লবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট ওয়েল গনিম (২০১২) তাঁর রেভল্যুশন ২.০ বইয়ে লিখেছেন, এই আন্দোলন কায়রো ও শহরকেন্দ্রিক থাকায় তা সহজেই ব্যর্থ হয় এবং রাষ্ট্র আবার দমনমূলক হয়ে ওঠে। তাহলে প্রশ্ন হলো, এনসিপি কি শহরের ক্যাম্পাস ছেড়ে দেশের মাটি, মানুষের ভাষা, শ্রমজীবী জনগণের বাস্তবতাকে বুঝে তাঁদের সঙ্গে পথ চলতে পারবে?
‘সশস্ত্র সংগ্রাম’ বনাম ‘সামাজিক চেতনা’
জাসদ ও এনসিপির মধ্যে মূল পার্থক্য তাদের আন্দোলনের কৌশলে। জাসদের কৌশল ছিল সশস্ত্র সংগ্রাম। জাসদ সশস্ত্র বিপ্লবের পথে হেঁটেছিল—পুলিশ স্টেশন ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়েছিল এবং ১৯৭৫ সালে কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেছিল, যাতে বহু সামরিক কর্মকর্তা নিহত হন। এমনকি ১৯৭৪ সালের ২৫ মে জাসদপন্থী গণবাহিনী ভারতীয় হাইকমিশনের এক কর্মকর্তাকে অপহরণের চেষ্টা করলে পুলিশের গুলিতে কয়েকজন নিহত হন। এসব ঘটনায় জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ও অনাস্থা তৈরি হয়।
এই অস্থিরতার ভেতরে মানুষ শান্তির জন্য নতুন নেতৃত্ব খুঁজতে থাকে। আওয়ামী লীগ ও জাসদের হঠকারিতায় বিরক্ত জনগণ ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি ও জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানকে সামনে নিয়ে আসে। জিয়া পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন এবং স্থিতিশীলতার বার্তা দেন, যা তখনকার প্রেক্ষাপটে ছিল এক বড় মোড়।
আজকের এনসিপি জাসদের মতো সহিংস পথে না গিয়ে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ ও সংস্কারের পথে হাঁটছে। তবে ২০২৪ সালের আন্দোলনের সময় ভারতের হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে এনসিপির পূর্বতন রূপ ‘নাগরিক কমিটি’ ভারতীয় হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ করে। যদিও এই প্রতিবাদ রাজনৈতিকভাবে যৌক্তিক ছিল, তবে কোনো কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে বড় ধরনের কূটনৈতিক উত্তেজনার জন্ম দিতে পারত।
তা ছাড়া সম্প্রতি সেনাপ্রধানকে ঘিরে কিছু ভুল–বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছে। এনসিপিঘনিষ্ঠ কয়েকজন ছাত্রনেতা তাঁদের বক্তব্যে সেনাপ্রধানের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়ায় এবং জনমনে বিভাজন তৈরি করে। পরে এনসিপির পক্ষ থেকে এটি ‘ব্যক্তিগত মতামত’ বলে ব্যাখ্যা দেওয়া হলেও বিষয়টি নিয়ে জনমনে উদ্বেগ থেকেই যায়।
এসব ঘটনা আমাদের ১৯৭৫ সালের উত্তপ্ত পরিস্থিতির স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। হানটিংটন, জন কিনের মতো অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, মানুষ পরিবর্তন চায়, কিন্তু বিশৃঙ্খলা নয়; তারা স্থিতিশীল নেতৃত্ব চায়। তাঁদের মতে, ‘বিপ্লব’ যদি মানুষের নিরাপত্তার সঙ্গে সংযুক্ত না থাকে, তবে সেটি টেকসই হয় না।
এ বাস্তবতায় প্রশ্ন উঠছে, বর্তমান তরুণ নেতৃত্ব কি শৃঙ্খলা ও দায়িত্বশীলতার বার্তা দিতে পারছেন? নাকি তাঁরা জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলছেন? যদি এই অস্থিরতা চলতে থাকে, মানুষ আবারও কোনো বিকল্প স্থিতিশীল নেতৃত্বের দিকে তাকাবে; যেমন ১৯৭৫ সালে ঘটেছিল।
আমার এই লেখার উদ্দেশ্য শুধু ইতিহাসের আলোকে সতর্কবার্তা। বর্তমান তরুণ নেতৃত্ব চাইলে ভিন্ন ইতিহাস গড়তে পারেন। তবে শুধু রাজনৈতিক ট্যাগিং করে, অন্যকে খাটো করে রাজনৈতিক বাস্তবতা এড়ানো বা বদলানো যায় না। দরকার পরিণত নেতৃত্ব, যাঁরা আবেগ নয়, বাস্তবতা দিয়ে নিজেদের কাজকর্মকে এগিয়ে নিতে পারবেন।
সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে, বর্তমান তরুণ নেতৃত্ব বর্তমান বাস্তবতার প্রেক্ষিতে অনেক সমস্যাকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারছেন; যদিও সমস্যা সমাধানের রুপরেখা তৈরি করতে তাঁদের অনেক সময় প্রয়োজন হবে। একটা জিনিস মাথায় রাখা উচিত, তাঁরা জাতীয় পর্যায়ে রাজনীতিতে নেমেছেন। এ ক্ষেত্রে বারবার ভুল করার কোনো সুযোগ নেই।
মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন শিকদার শিক্ষক ও গবেষক, রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়