প্রথম আলো:

কয়েক মাস ধরেই সংস্কার নিয়ে অনেক কথাবার্তা শোনা গেছে। সংস্কার নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

হোসেন জিল্লুর রহমান: সংস্কার বর্তমান সময়ে খুব চালু একটি শব্দ, কিন্তু সংস্কার বিষয়টি আসলে কী? প্রথম থেকেই একটি ধারণা তৈরি হয়েছে, যাতে মনে হতে পারে সংস্কার মানে হচ্ছে সবকিছু ওলট-পালট করে ফেলা এবং বড় ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তন নিয়ে আসা। আমাদের দেখা দরকার সংস্কারের প্রয়োজনীয়তাগুলো আসলে কোথায়। আমি মনে করি, তিনটি দৃষ্টিকোণ থেকে এই প্রয়োজনীয়তাগুলো দেখা জরুরি।

প্রথমত, আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের কার্যকারিতা বাড়ানো। আমাদের বিস্তৃত রাষ্ট্রযন্ত্র রয়েছে, কিন্তু সেখানে কাঙ্ক্ষিত সেবা ও তা ডায়নামিকভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। কাগুজে নীতির আধিক্য রয়েছে, কিন্তু বাস্তবায়নের অক্ষমতার বৃত্তে আটকে থাকার বাস্তবতা রয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগ বলেন, শিক্ষা বিভাগ বলেন, ওয়ান-স্টপ সার্ভিসের কথা বলেন বা অন্য বহু বিভাগের কথা বলেন, সংস্কারের অন্যতম লক্ষ্য হওয়া উচিত এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্রের কার্যকারিতা ও সেবার মানসিকতায় আমূল পরিবর্তন আনা।

এখানে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে গেড়ে বসা প্রশাসনিক সংস্কৃতির, যেখানে মেধা, দক্ষতা ও সেবাধর্মী মানসিকতার পরিবর্তে বিভিন্ন গোষ্ঠীচিন্তা ও দাপটের রাজত্ব লক্ষণীয়। প্রশাসন ক্যাডারের আলোচিত বিষয়টি এখানে উল্লেখ্য, যেমন উল্লেখ্য স্থানীয় সরকারগুলোকে ক্ষমতাহীন করে রাখার মানসিকতা। এখানে আরও উল্লেখ্য বিভিন্ন সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্ন দলীয় পেশাজীবীর বিভাগীয় কর্মকাণ্ডে অযৌক্তিক দাপট।

দ্বিতীয়ত, যে ক্ষেত্রে সংস্কার জরুরি, তা হলো ক্ষমতাকাঠামো ও ক্ষমতাবিন্যাসের সংস্কার। স্বৈরাচারী প্রবণতাগুলো রোধে সুনির্দিষ্ট কাঠামোগত ও প্রায়োগিক জায়গাগুলো চিহ্নিত করা এই কাজের একটি অংশ। অন্য অংশটি হচ্ছে কার্যকর পরিবর্তনের সুপারিশ নিয়ে বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে ঐকমত্য তৈরি করা, গত ১৫ বছরের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনামলের অন্যতম স্তম্ভগুলো ছিল প্রধানমন্ত্রী পদের অতি ক্ষমতায়ন, এলাকায় ‘এমপিরাজ’ প্রতিষ্ঠা, পুলিশ প্রশাসন ও বিচার প্রশাসনের চূড়ান্ত ও নিষ্ঠুর অপব্যবহার। ন্যূনতম এই তিন জায়গায় ক্ষমতাকাঠামোর সংস্কার ছাড়া অর্থবহ সংস্কার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।

রাষ্ট্রযন্ত্রের কার্যকারিতা বাড়ানো ও স্বৈরাচারী প্রবণতা রোধে ক্ষমতাকাঠামোর সংস্কারের বাইরে তৃতীয় একটি দৃষ্টিকোণ থেকেও সংস্কারের আলোচনা প্রাসঙ্গিক। সেটি হচ্ছে একটি উন্নত সমাজ তৈরির জন্য কিছু সংস্কার। একটা সময়ে আমরা একটি দারিদ্র্যক্লিষ্ট দেশ ছিলাম। এখন আমাদের একধরনের আর্থিক সক্ষমতা তৈরি হয়েছে, সমাজে নানা ধরনের গতিময়তার দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। বাসযোগ্য শহর, উন্নত মানের কানেকটিভিটি, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ—আমাদের চাহিদার পরিধি সম্প্রসারিত করার সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে নতুন চিন্তা, নতুন উদ্ভাবনের প্রয়োজন হবে, সেটাও সংস্কারের অংশ।

এই তিন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সংস্কারের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক তৈরি হবে। সংস্কারের গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়বে। আমরা কেন সংস্কার চাইছি? শেষ বিচারে সেটা তো এ রকম যে মানুষের জীবন যেন আরেকটু সুস্থির হয়, আরেকটু উন্নত হয়। তাঁরা যেন মনে করেন যে তাঁরাও এই দেশের একজন অংশীদার। এই দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণে তাঁদেরও ভূমিকা রাখার অধিকার রয়েছে। কিন্তু সংস্কার নিয়ে এখন যে আলোচনাগুলো হচ্ছে, আমি তার মধ্যে একটি একমাত্রিক প্রবণতা লক্ষ করছি।

প্রথম আলো:

আরেকটি বহুল আলোচিত বিষয় হলো ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’। এ বিষয়ে আমাদের অগ্রগতি কত দূর?

হোসেন জিল্লুর রহমান: ‘রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’ শব্দটা হয়তো তাত্ত্বিক কর্মকাণ্ড বা একাডেমিক জগৎ থেকে আমাদের এখানে এসেছে। কিন্তু আমি এখন একটু চিন্তিত, একটু উদ্বিগ্ন এই কারণে যে সংস্কারের মতো রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আলোচনায়ও সাধারণ মানুষ মানে জনগণের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে না। এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনায় একধরনের ‘এলিটিস্ট অ্যাপ্রোচ’ লক্ষ করা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এগুলো ‘ওপর মহল’-এর একটা আলোচনা। যে নতুন দল গঠিত হয়েছে, তাদের বক্তব্যে সংস্কার, নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত—এসব শব্দ বেশি বেশি করে শোনা গেলেও তাদের ক্ষেত্রেও একই ‘এলিটিস্ট অ্যাপ্রোচ’ই দেখা যাচ্ছে।

রাজনৈতিক বন্দোবস্ত শুধু রাজনৈতিক খেলোয়াড়দের বিষয় নয়, এতে জনগণেরও অংশীদারত্ব থাকতে হয়। রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মাঠে যারা আছে, অর্থনীতির মাঠে যারা আছে, শুধু তারা মিলেই বন্দোবস্ত তৈরি করবে—এটা একটা এলিটিস্ট ধারণা। এভাবে বন্দোবস্ত তৈরি হলে তাতে জনগণের চেয়ে এলিটদের স্বার্থই প্রাধান্য পাবে।

সবাই দাবি করছে, জনগণের পক্ষে তারাই দায়িত্বপ্রাপ্ত, ক্ষমতাপ্রাপ্ত, নৈতিকভাবে তারাই দাবিদার। কিন্তু সত্যিকার অর্থে জনগণ কোথায়? এসব আলোচনায় জনগণের ভয়েসটা কোথায়? রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড ও রাজনৈতিক পরিসরে আমি গত সাত মাসে সবচেয়ে বড় অনুপস্থিত ‘ফ্যাক্টর’ যেটা দেখছি, তা হলো জনগণ।

প্রথম আলো:

জনগণকে যুক্ত করার প্রক্রিয়াটা কেমন হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

হোসেন জিল্লুর রহমান: সরকারের কথা যদি বলি, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা নিজেদের মূলত দাপ্তরিক কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছেন। জনসম্পৃক্ততার কাজে তাঁরা পুরোপুরি অনুপস্থিত। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এটাই তাঁদের একটা প্রধান কাজ বলে আমি মনে করি।

রাজনীতিবিদেরা কীভাবে জনসম্পৃক্ত হবেন, সেই প্রক্রিয়া তাঁদেরকেই উদ্ভাবন করতে হবে। তাঁদের যদি সে রকম উদ্দেশ্য থাকে, আমরা তা বুঝতে পারব। তাঁরা কি চেষ্টা করছেন কৃষকের সঙ্গে বসে কৃষির সমস্যা বোঝার, শ্রমিকদের সঙ্গে বসে তাঁদের কথাগুলো শোনার? এই যে বিভিন্ন ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, বিনিয়োগের জায়গাগুলো কেন স্থবির হয়ে আছে, উদ্যোক্তাদের সঙ্গে, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কি এগুলোর সমাধানের বিষয়ে কোনো আলোচনা করা হচ্ছে?

কিছু আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়তো হচ্ছে। কিন্তু এগুলো খুবই একতরফা। এখানে অল্প কিছু লোক বলেন, অন্যরা ‘অডিয়েন্স’ (দর্শক বা শ্রোতা) হিসেবে উপস্থিত থাকেন। এ ধরনের আলোচনায় জনসম্পৃক্ততা বা জনগণের সঙ্গে সংযোগ তৈরি হয় না।

ড.

হোসেন জিল্লুর রহমান

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: হ স ন জ ল ল র রহম ন জনগণ র র আল চ আম দ র প রথম ক ষমত

এছাড়াও পড়ুন:

অশুভ শক্তির ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বললেন ড. কামাল হোসেন

সংস্কার ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সহযোগিতা করা সব রাজনৈতিক দল ও জনগণের নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করেন গণফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ড. কামাল হোসেন। তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশে গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার এক নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে। কোনো অশুভ শক্তি বা ষড়যন্ত্র যেন এই রক্তস্নাত বিজয় ও মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণে বাধা সৃষ্টি করতে না পারে সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

আজ রোববার বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবে গণফোরাম আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ড. কামালের একটি লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনানো হয়। অনুষ্ঠানে তিনি নিজেও উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানের শেষ দিকে তিনি কয়েক মিনিট কথাও বলেন।

গণফোরামের ইমেরিটাস সভাপতি ড. কামাল হোসেনের জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা অংশ নেন। অনুষ্ঠান মঞ্চের ব্যানারে লেখা ছিল ‘বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতা, গণফোরামের প্রতিষ্ঠাতা, ইমেরিটাস সভাপতি ড. কামাল হোসেনের ৮৮তম জন্মদিন উৎসব’।

অনুষ্ঠানে লিখিত বক্তব্যে কামাল হোসেন বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ছাত্র–জনতার যে ঐক্য গড়ে উঠেছে তা দেশ গড়ার কাজে নতুন দিগন্ত তৈরি করবে। স্বাধীন ও বৈষম্যমুক্ত এক নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে দেশের জনগণ।

বিগত সময়ে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয়করণের ফলে প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছিল বলে লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করেন ড. কামাল হোসেন। এসব প্রতিষ্ঠান সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন তিনি।

যথাসময়ে সংস্কার কর্মসূচি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথ যাতে সুগম হয় সেই প্রত্যাশার কথাও লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করেন ড. কামাল। পরে অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে নতুন প্রজন্মের ওপর বিশ্বাস রাখার আহ্বান জানান তিনি। একই সঙ্গে তিনি বলেন, গণতন্ত্রের স্বার্থে নিজেদের ঐক্যকে ধরে রাখে জনগণ। যেকোনো ঝুঁকি নিতে জনগণ দ্বিধাবোধ করে না। বহুবার এর প্রমাণ জনগণ দিয়েছে। দেশের মানুষ হবে গণতন্ত্রের পাহারাদার।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নূরুল আম্বিয়া বলেন, দেশের রাজনীতিতে যত দিন পর্যন্ত গোয়েন্দা বিভাগের হস্তক্ষেপের অবসান না হবে তত দিন স্বাধীনভাবে গণতন্ত্র চর্চা করা সম্ভব হবে না।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে নিয়ে চক্রান্ত হচ্ছে বলে অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেন বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ। তিনি বলেন, সংবিধান সংশোধন করা যেতে পারে। তবে সংবিধান নিয়ে যে চক্রান্ত হচ্ছে, তা প্রতিহত করা হবে।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন গণফোরামের সভাপতি পরিষদের সদস্য এস এম আলতাফ হোসেন। স্বাগত বক্তব্য দেন দলের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান। বক্তব্য দেন গণফোরাম নেতা জগলুল হায়দার, অধ্যাপক আবদুল লতিফ মাসুমসহ অনেকে।
অনুষ্ঠানের শুরুতে ড. কামাল হোসেনকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেন গণফোরামের নেতা–কর্মীরা। অনুষ্ঠান শেষে কেক কেটে জন্মদিন উদ্‌যাপন করেন নেতা–কর্মীরা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে জেএসডির বৈঠক
  • অশুভ শক্তি যেন বাংলাদেশ বিনির্মাণে বাধা সৃষ্টি করতে না পারে: ড. কামাল
  • ছাত্র-জনতার ঐক্যে দেশ গড়ার কাজে নতুন দিগন্ত তৈরি হবে: ড. কামাল
  • অশুভ শক্তির ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বললেন ড. কামাল হোসেন
  • পুনর্বহালের দাবি জানালেন অপসারিত কাউন্সিলররা
  • আমরা জুলুম করে রাজনীতি করতে চাই না : নাহিদ ইসলামের বাবা 
  • ‘সিন্ধু দিয়ে হয় আমাদের পানি, নয় তাদের রক্ত বইবে’, ভারতকে বিলাওয়ালের হুঁশিয়ারি
  • সিন্ধুতে হয় পানি, না হয় ভারতীয়দের রক্ত বইবে: বিলাওয়াল ভুট্টো
  • অজ্ঞাত স্থানে বসে পরিষদ চালান ৩ চেয়ারম্যান
  • ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে হুমকির মুখে কাশ্মীরি শিক্ষার্থীরা, উত্তরাখন্ডে হিন্দু নেতার বিরুদ্ধে এফআইআর