‘নিঃসঙ্গ’ ধর্মান্তরিত মুসলিমদের সহায়তায় কাজ করে চলা কারা এই ‘নিউ মুসলিম সার্কেল’
Published: 6th, April 2025 GMT
ধর্মীয় ও পারিবারিক উৎসবের আমেজে পবিত্র রমজানে এক মাস রোজা পালন করেছেন বিশ্বের মুসলিমরা। রোজা শেষে উদ্যাপন করেছেন পবিত্র ঈদুল ফিতরও। রোজা ও ঈদকে ঘিরে তাঁদের মধ্যে আনন্দ–আয়োজনের কমতি ছিল না। তবে এর মধ্যেই ‘বিচ্ছিন্নতা ও নিঃসঙ্গতা’কে পুঁজি করে পুরোটা সময় হয়তো কাটিয়েছেন কিছু মুসলিম। ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্মকে গ্রহণ করেছেন তাঁরা। এমনটাই বলছে একটি দাতব্য সংস্থা।
‘নিউ মুসলিম সার্কেল’ নামের এই দাতব্য সংস্থা যুক্তরাজ্যের ইংল্যান্ডের পিটারবরো শহরে অবস্থিত। সংস্থাটি নতুন মুসলিম হওয়া ব্যক্তিদের বিপৎসংকুল পথচলায় নানাভাবে সহায়তা করে আসছে। তাঁদের নামাজ আদায় করা, রোজা রাখা ও পবিত্র কোরআনের তিলাওয়াত শেখানোর পাশাপাশি নিয়মিত দেখা–সাক্ষাৎ ও খাবারের ব্যবস্থা এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে।
নাটালিয়া জামান ২০০৭ সালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। দাতব্য সংস্থাটি নওমুসলিমদের জন্য যেভাবে কাজ করছে, সে জন্য এটিকে একটি ‘নিরাপদ জায়গা’ ও ‘লাইফলাইন’ বলে আখ্যায়িত করেন তিনি।
মুসলিম হওয়ার পর লন্ডন থেকে ইংল্যান্ডের পিটারবরো শহরে চলে আসেন নাসিরাহ। বলেন, বিচ্ছিন্ন ও নিঃসঙ্গ ওই সময় অন্যের সমর্থন পেতে যে সংগ্রাম তাঁকে করতে হয়েছে, তাতে একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।২০১৩ সালে নিউ মুসলিম সার্কেল প্রতিষ্ঠা করেন নাসিরাহ আলম (৪৭) নামের একজন নারী। তিনি বলেন, প্রতিবছর এ সংস্থা থেকে সহায়তা নেওয়া নতুন মুসলিমের সংখ্যা বাড়ছে। ২০ বছর আগে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে থাকার সময় তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন।
মুসলিম হওয়ার পর লন্ডন থেকে ইংল্যান্ডের পিটারবরো শহরে চলে আসেন নাসিরাহ। বলেন, বিচ্ছিন্ন ও নিঃসঙ্গ ওই সময় অন্যের সমর্থন পেতে যে সংগ্রাম তাঁকে করতে হয়েছে, তাতে একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
পরে ২০ জনের মতো নারীকে নিয়ে শুরু করেন ওই প্রতিষ্ঠানের যাত্রা। এখন তাঁদের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ১০০। নতুন মুসলিম হওয়া পুরুষদেরও তাঁরা প্রয়োজনীয় সহায়তা দিয়ে থাকেন। পিটারবরো শহরের বাইরে ক্যামব্রিজশায়ারের ফেনল্যান্ডেও কাজ করেন তাঁরা।
নাসিরাহ আলম বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে ১৮ বছর থেকে শুরু করে প্রায় ৭০ বছর বয়সী ব্যক্তিরা কাজ করছেন। তাঁদের কেউ আফ্রিকান বংশোদ্ভূত, কেউ পূর্ব ইউরোপীয়, কেউবা ক্যারিবীয়। এ এক সত্যিকারের বৈচিত্র্যের সমাবেশ।’
ইসলাম চারিত্রিক শুদ্ধতার ওপরে জোর দেয়। তাই (ভিন্ন ধর্ম থেকে আসার পর) নিজেকে আরও ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়োজন হয়।নাসিরাহ আলম, দাতব্য সংস্থা ‘নিউ মুসলিম সার্কেল’ এর প্রতিষ্ঠাতা‘লোকজন যখন ইসলামে দীক্ষিত হন, তখন তাঁরা নিজেদের একরকম হারিয়ে ফেলেন। তাঁরা মনে করেন যে অন্য কারও মতো হওয়ার জন্য তাঁদের খাপ খাইয়ে নিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, এটি রান্না করার বা পোশাক পরার নতুন উপায় হতে পারে। আমরা বলি, দেখো, তুমি এটি করতে পার; তবে তুমি যা তা–ই হতে পারবে’, বলেন নাসিরাহ।
নাসিরাহ বলেন, ‘ইসলাম চারিত্রিক শুদ্ধতার ওপরে জোর দেয়। তাই (ভিন্ন ধর্ম থেকে আসার পর) নিজেকে আরও ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়োজন হয়।’
নাটালিয়া জামানের জন্মভূমি লাটভিয়ায়। মুসলিম হওয়ার আগে অর্থোডক্স খ্রিষ্টান ছিলেন তিনি। ইসলাম গ্রহণ করার প্রক্রিয়াকে তিনি ‘ধীরগতির ও দীর্ঘযাত্রার’ বলে উল্লেখ করেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর দারুণভাবে ভালো লাগায় আচ্ছন্ন হয়ে যাওয়ার অনুভূতির কথা স্মরণ করেন তিনি।
নাটালিয়া জানান, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর বন্ধুদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কায় প্রথম দিকে নিজের নতুন ধর্মীয় পরিচয় গোপন করেছিলেন তিনি।
নাটালিয়া জামান বলেন, নতুন পরিচয় প্রকাশের কাজটি করতে ধাপে ধাপে এগোনোর প্রয়োজন ছিল। এ ক্ষেত্রে তাঁর স্বামী সহায়তাকারীর ভূমিকা পালন করেছেন, দিয়েছেন প্রয়োজনীয় সমর্থনও।
মুসলিম হওয়ার পর তাঁকে কিছু কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে উল্লেখ করে এই নারী বলেন, ‘আমার সঙ্গে একটা প্রতিবন্ধী সন্তান ছিল। আমারও ছিল কিছু স্বাস্থ্যগত সমস্যা। এসব সমস্যা আমাকে ইসলাম সম্পর্কে জানতে আকৃষ্ট করে এবং আমি খুবই ধর্মপ্রাণ মুসলিম হয়ে উঠি।’
নিউ মুসলিম সার্কেলের সহায়তা না পেলে তাঁকে সত্যিকার অর্থে সংগ্রাম করতে হতো বলে জানান নাটালিয়া। বলেন, ‘আমার কোনো ভাইবোন নেই। আমরা বড় পরিবারও নই। নিউ মুসলিম সার্কেলই আমার পরিবার হয়ে উঠেছে। এটি আমার নিরাপদ স্থান ও প্রাণশক্তি।’
‘নিজের পরিচয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করুন’
পিটারবরোর বাসিন্দা হেলে অলিভার। এই নারী বলেন, ১৯৯৮ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হন তিনি। এর আগে মুসলিম বন্ধুদের মাধ্যমে তিনি এ ধর্ম গ্রহণে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তবে মুসলিম হওয়ার পর সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক কারণে ‘খুবই বিচ্ছিন্ন’ হয়ে পড়েছেন বলে অনুভব করতে শুরু করেন।
হেলে বলেন, ‘নতুন মুসলিম হিসেবে আপনি আপনার ধর্ম পালনে সফল হতে চাইবেন, আত্মপরিচয় খুঁজতে চাইবেন। এসবের জন্য আপনার চারপাশের মানুষের সমর্থন প্রয়োজন।’
নওমুসলিম এ নারী বলেন, তাঁর পরিবার মনে করেছিল, তিনি ‘মগজধোলাই’ এর শিকার হয়েছেন। তাই ৯/১১ হামলা সংঘটিত হওয়ার পর তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। তাঁর চারপাশের পরিচিতজনেরাও তাঁকে স্বাগত জানাননি।
‘এমন পরিস্থিতিতে আপনি নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে করবেন.
নিজের পরিবার এখন তাঁর ধর্মবিশ্বাসকে মেনে নিয়েছে বলে জানান হেলে। আরও জানান, নিউ মুসলিম সার্কেল একটা ‘সেতুর’ মতো কাজ করার চেষ্টা করছে। শহরের মসজিদ, গির্জা, ফুড ব্যাংক ও কমিউনিটির অন্যান্য সংগঠনের সঙ্গে কাজ করছে তারা।
হেলে বলেন, ‘ইসলাম ধর্মে নতুন দীক্ষিত হওয়া ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরাও যে স্বাভাবিক মানুষ, তা বোঝাতে বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসের লোকজন ও সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ।’
ঈদ এলে প্রায়ই নিজেকে ‘নিঃসঙ্গ’ বলে মনে হয়, এমনটাই জানান হেলে অলিভার। বলেন, ‘ঈদের সময় পার্কে গেলে আনন্দ হয় ও নিউ মুসলিম সার্কেল অনেককে একত্র করে। কিন্তু যখন বাড়িতে যাবেন, নিজেকে নিঃসঙ্গ মানুষের ভুবনে খুঁজে পাবেন।’
যুক্তরাজ্যভিত্তিক দাতব্য প্রতিষ্ঠান দ্য কনভার্ট মুসলিম ফাউন্ডেশন বলেছে, ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে নিজের সুচিন্তিত ও আধ্যাত্মিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন হয়। সঙ্গে আছে বৈষম্যের শিকার হওয়াসহ একগুচ্ছ ব্যতিক্রমী চ্যালেঞ্জও।
প্রতিষ্ঠানটি আরও বলছে, নিউ মুসলিম সার্কেলের মতো উদ্যোগগুলো নওমুসলিমদের নিরাপদ জায়গা করে দিয়ে ওইসব চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে ওঠার পথ করে দিচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে তাঁরা ধর্মচর্চা, হাতে–কলমে ইসলাম সম্পর্কে জানা ও একই রকমের অভিজ্ঞতার শিকার লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প ট রবর পর ব র র পর ব ক জ কর কর ছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
মানবাধিকার সুরক্ষায় কাজ করবে ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি হিউম্যান রাইটস অ্যাসোসিয়েশন’
ক্যাম্পাসে মানবাধিকার সুরক্ষা ও সচেতনতা তৈরির লক্ষ্য নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি হিউম্যান রাইটস অ্যাসোসিয়েশন’। রোববার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতিতে সংবাদ সম্মেলন করে সংগঠনটির আনুষ্ঠানিক যাত্রার কথা জানানো হয়।
‘রাইজ ফর রাইটস (অধিকারের জন্য জাগো)’ স্লোগানকে সামনে রেখে গত বৃহস্পতিবার সংগঠনটির ২৫ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। রোববার সংবাদ সম্মেলনে ওই কমিটি ঘোষণা করা হয়।
নতুন এই সংগঠনের আহ্বায়ক হয়েছেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী তাহমিদ সাকিব। সদস্যসচিব করা হয়েছে ফ্রেঞ্চ ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড কালচার বিভাগের শিক্ষার্থী পত্র নন্দিতাকে। এ ছাড়া ইসমাঈল নাহিদ যুগ্ম আহ্বায়ক আর রুকাইয়া রচনা যুগ্ম সদস্যসচিব হয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ক্যাম্পাসে দীর্ঘদিন ধরে গণরুম, গেস্টরুম সংস্কৃতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে আর কখনো এই সংস্কৃতি যেন ফেরত না আসে, সেই লক্ষ্যে কাজ করবে সংগঠনটি।
সংগঠনের আহ্বায়ক তাহমিদ সাকিব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ, সংখ্যালঘু অধিকারও জাতিগত সম্প্রীতি রক্ষা, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সহায়তা ও প্রয়োজনে আইনি পরামর্শ প্রদানসহ ক্যাম্পাসে মানবাধিকার বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে সচেতনতা তৈরিতে কাজ করবে ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি হিউম্যান রাইটস অ্যাসোসিয়েশন’। ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো ঘটনা ঘটলে সংগঠনটি শিক্ষার্থীদের পক্ষে কাজ করবে বলেও জানান তিনি।
তাহমিদ সাকিব বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে শিক্ষার্থী নিপীড়নের ঘটনাগুলো আমরা দেখেছি। বিভিন্ন সময় যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছে কিছু শিক্ষকের বিরুদ্ধে। কিন্তু সেগুলোর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের জোরালো ভূমিকা আমরা দেখিনি। নারী শিক্ষার্থীরা এখনো ক্যাম্পাসে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। অসংখ্য নারী নিপীড়নের ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্তের ঘটনা আমরা দেখি না। এই সংগঠনটি এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করবে।’
সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের সদস্যসচিব পত্র নন্দিতা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা কম নয়, বরং অহরহ ঘটে। বিশেষ করে রাজনৈতিক পরিসরে। এর বাইরে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতেও এটা বিদ্যমান। এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি, ডকুমেন্টেশন এবং অধিকার আদায়ে কাজ করবে তাঁদের এই সংগঠন।
আহ্বায়ক কমিটির সদস্য হিসেবে আরও আছেন তাপসী রাবেয়া, হুরে জান্নাত, তাজফিহা উখরোজ, সামিয়া মাসুদ, সুরমি চাকমা, নাফিসা নুজহাত, ইসরাত জাহান, আবদুল্লাহ আজিমসহ আরও অনেকে।