বসন্তবাতাসে ‘কিশোরীর এলানো খোঁপার মতো’ দুলছে তমালের ফুল
Published: 6th, April 2025 GMT
সমতলের কাছাকাছি একটি ছোট পাহাড়ি বন। সেই বনের ভেতর কোথাও ঘন, কোথাও হালকা ছোট-বড় গাছের সমাবেশ, ঝোপঝাড়, লতাগুল্ম। সেদিন ছিল চৈত্রের গড়িয়ে পড়া একটা দুপুর। দুপুরটা ঝলমলে হয়ে আছে গাছের চূড়ায়, পাতায় পাতায়। গাছের ফাঁকফোকর গলে কিছুটা রোদ পড়েছে নিচে। বনতলে প্রচুর ঝরা পাতা। তবে কোথাও পোড়া পাতা, পোড়া ঘাস, ঝোপঝাড়ে পোড়া ছাই ও চিহ্ন লেগে আছে।
এই বনের ভেতর দিয়ে সরু একটা পথ গেছে। দুই পাশের শালবীথির ছায়া পড়েছে সেই পথে। এই পথ একটি স্থানে গিয়ে দুই ভাগ হয়েছে। একটি দক্ষিণে ও একটি পশ্চিম দিকে চলে গেছে। পশ্চিম দিকের সেই উঁচু–নিচু পথ ধরে অনেকটা এগিয়ে গেলে একটা সময় দেখা মেলে কিছু বাড়িঘরের। বাড়িগুলো তখন নির্জনতায় চুপচাপ স্থির। কোথাও কোনো কোলাহল নেই, হইচই নেই।
এই স্থানের একটি নাম আছে, গোয়ালাবাড়ি। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বর্ষিজোড়া ইকোপার্কের পশ্চিম-দক্ষিণ দিকে পড়েছে স্থানটি। ওখানের বাড়ি থেকে কিছুটা আলগা, পরিত্যক্ত ভিটার মতো একটি টিলাতে দেখা পাওয়া যায় ছোট-বড় দুটি তমালগাছের। বসন্তবাতাসে সেই গাছের ডালপালারা তখন নেচে চলছে, ছলকে পড়া রোদকে নিয়ে খেলা করছে। এখন তমালগাছে ফুল ফোটার সময়। ডালে ডালে সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে ফুটে আছে সাদা রঙের ছোট ছোট ফুল। ফুলগুলো পাশাপাশি পাড়াপড়শি হয়ে ঝুলে আছে। চৈত্রের দাপিয়ে বেড়ানো বাতাসে তখন গাছের শাখাগুলো দুলছে, কিশোরীর এলানো খোঁপার মতো দুলছে ফুলেরাও।
গ্রাম-জনপদে তমালগাছ এখন অনেকটাই দুষ্প্রাপ্য। সচরাচর তমালগাছের দেখা পাওয়া যায় না। সুন্দর, ঐতিহ্যলগ্ন এই গাছ এখন প্রাচীন বিলুপ্তপ্রায় গাছের দলে। প্রয়াত নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মা তাঁর শ্যামলী নিসর্গ গ্রন্থে তমাল নিয়ে লিখেছেন, ‘তমালের সঙ্গে অপরিচিত কাব্যপ্রিয় বাঙালি দুষ্প্রাপ্য। বৈষ্ণব কবিতা, লোকগীতি, এমনকি সংস্কৃত কাব্যেও তমাল মর্যাদাসীন। তাল-তমালের বনরাজি নীল এ দেশের নিসর্গ আমাদের কাব্যের অনুষঙ্গ। অথচ বাংলাদেশে, বিশেষত পূর্ব বাংলায় তমাল বস্তুতই দুষ্প্রাপ্য।’ তিনি লিখেছেন, ‘গাছটি যেমন সুন্দর, তেমনি আমাদের ঐতিহ্যলগ্ন। আধুনিকতার মোহে প্রাচীন ঐতিহ্যের সঙ্গে যে বিচ্ছেদ ক্রমেই প্রসারিত হচ্ছে। তাতে অতীতের বহু ঐশ্বর্যের সঙ্গে হয়তো একদিন লুপ্ত হবে প্রাচীন তরুকুলের স্মৃতিও।’
দ্বিজেন শর্মার এই বক্তব্যের সংযোগ গোয়ালাবাড়িতেও পাওয়া গেছে। স্থানীয় বাসিন্দা সুনীতা মালাকারের কথাতেই সেই সংযোগটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি জানালেন, তাঁরা ওই তমালগাছের নিচে পূজা দিয়ে থাকেন। বোঝাই যায়, স্থানীয়দের কাছে এই জোড়া তমালগাছটি ভক্তির, অনেক শ্রদ্ধার।
বয়োজ্যেষ্ঠ ফনী মালাকার বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থাকি (থেকে) গাছরে একরকম দেখরাম (দেখছি)। শুনছি আমার বাপ-দাদারাও এ রকমই গাছটিরে দেখছইন (দেখেছেন)। গাছর বয়স ১০০ বছরের কম অইতো নায় (হবে না)।’
স্থানীয়দের ধারণা, বনের নির্জন প্রাকৃতিক পরিবেশে কোনো এক সময় গাছটি এখানে জন্ম নিয়েছে। সবার চোখের আড়ালেই ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে। একসময় এখানে মানুষের বসতি গড়ে উঠেছে। অন্য গাছ কাটা পড়েছে। কিন্তু এর সঙ্গে পূজা-অর্চনার সম্পর্ক থাকায় হয়তো গাছ দুটি টিকে গেছে। বনের আড়ালে থাকায় বাইরের কারোরই চোখে পড়েনি। গাছটি এখন ঝোপালো পাতায় ঠাসা। ডালে ডালে অনেক ফুল ফুটেছে। ফুলগুলো ছোট ও পাতার ফাঁকে ফাঁকে ফুটে আছে। কাছাকাছি না হলে সহজে চোখে পড়ে না।
বাংলাদেশের গ্রাম-জনপদে তমালগাছ এখন অনেকটাই দুষ্প্রাপ্য.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
বসন্তবাতাসে ‘কিশোরীর এলানো খোঁপার মতো’ দুলছে তমালের ফুল
সমতলের কাছাকাছি একটি ছোট পাহাড়ি বন। সেই বনের ভেতর কোথাও ঘন, কোথাও হালকা ছোট-বড় গাছের সমাবেশ, ঝোপঝাড়, লতাগুল্ম। সেদিন ছিল চৈত্রের গড়িয়ে পড়া একটা দুপুর। দুপুরটা ঝলমলে হয়ে আছে গাছের চূড়ায়, পাতায় পাতায়। গাছের ফাঁকফোকর গলে কিছুটা রোদ পড়েছে নিচে। বনতলে প্রচুর ঝরা পাতা। তবে কোথাও পোড়া পাতা, পোড়া ঘাস, ঝোপঝাড়ে পোড়া ছাই ও চিহ্ন লেগে আছে।
এই বনের ভেতর দিয়ে সরু একটা পথ গেছে। দুই পাশের শালবীথির ছায়া পড়েছে সেই পথে। এই পথ একটি স্থানে গিয়ে দুই ভাগ হয়েছে। একটি দক্ষিণে ও একটি পশ্চিম দিকে চলে গেছে। পশ্চিম দিকের সেই উঁচু–নিচু পথ ধরে অনেকটা এগিয়ে গেলে একটা সময় দেখা মেলে কিছু বাড়িঘরের। বাড়িগুলো তখন নির্জনতায় চুপচাপ স্থির। কোথাও কোনো কোলাহল নেই, হইচই নেই।
এই স্থানের একটি নাম আছে, গোয়ালাবাড়ি। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বর্ষিজোড়া ইকোপার্কের পশ্চিম-দক্ষিণ দিকে পড়েছে স্থানটি। ওখানের বাড়ি থেকে কিছুটা আলগা, পরিত্যক্ত ভিটার মতো একটি টিলাতে দেখা পাওয়া যায় ছোট-বড় দুটি তমালগাছের। বসন্তবাতাসে সেই গাছের ডালপালারা তখন নেচে চলছে, ছলকে পড়া রোদকে নিয়ে খেলা করছে। এখন তমালগাছে ফুল ফোটার সময়। ডালে ডালে সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে ফুটে আছে সাদা রঙের ছোট ছোট ফুল। ফুলগুলো পাশাপাশি পাড়াপড়শি হয়ে ঝুলে আছে। চৈত্রের দাপিয়ে বেড়ানো বাতাসে তখন গাছের শাখাগুলো দুলছে, কিশোরীর এলানো খোঁপার মতো দুলছে ফুলেরাও।
গ্রাম-জনপদে তমালগাছ এখন অনেকটাই দুষ্প্রাপ্য। সচরাচর তমালগাছের দেখা পাওয়া যায় না। সুন্দর, ঐতিহ্যলগ্ন এই গাছ এখন প্রাচীন বিলুপ্তপ্রায় গাছের দলে। প্রয়াত নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মা তাঁর শ্যামলী নিসর্গ গ্রন্থে তমাল নিয়ে লিখেছেন, ‘তমালের সঙ্গে অপরিচিত কাব্যপ্রিয় বাঙালি দুষ্প্রাপ্য। বৈষ্ণব কবিতা, লোকগীতি, এমনকি সংস্কৃত কাব্যেও তমাল মর্যাদাসীন। তাল-তমালের বনরাজি নীল এ দেশের নিসর্গ আমাদের কাব্যের অনুষঙ্গ। অথচ বাংলাদেশে, বিশেষত পূর্ব বাংলায় তমাল বস্তুতই দুষ্প্রাপ্য।’ তিনি লিখেছেন, ‘গাছটি যেমন সুন্দর, তেমনি আমাদের ঐতিহ্যলগ্ন। আধুনিকতার মোহে প্রাচীন ঐতিহ্যের সঙ্গে যে বিচ্ছেদ ক্রমেই প্রসারিত হচ্ছে। তাতে অতীতের বহু ঐশ্বর্যের সঙ্গে হয়তো একদিন লুপ্ত হবে প্রাচীন তরুকুলের স্মৃতিও।’
দ্বিজেন শর্মার এই বক্তব্যের সংযোগ গোয়ালাবাড়িতেও পাওয়া গেছে। স্থানীয় বাসিন্দা সুনীতা মালাকারের কথাতেই সেই সংযোগটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি জানালেন, তাঁরা ওই তমালগাছের নিচে পূজা দিয়ে থাকেন। বোঝাই যায়, স্থানীয়দের কাছে এই জোড়া তমালগাছটি ভক্তির, অনেক শ্রদ্ধার।
বয়োজ্যেষ্ঠ ফনী মালাকার বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থাকি (থেকে) গাছরে একরকম দেখরাম (দেখছি)। শুনছি আমার বাপ-দাদারাও এ রকমই গাছটিরে দেখছইন (দেখেছেন)। গাছর বয়স ১০০ বছরের কম অইতো নায় (হবে না)।’
স্থানীয়দের ধারণা, বনের নির্জন প্রাকৃতিক পরিবেশে কোনো এক সময় গাছটি এখানে জন্ম নিয়েছে। সবার চোখের আড়ালেই ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে। একসময় এখানে মানুষের বসতি গড়ে উঠেছে। অন্য গাছ কাটা পড়েছে। কিন্তু এর সঙ্গে পূজা-অর্চনার সম্পর্ক থাকায় হয়তো গাছ দুটি টিকে গেছে। বনের আড়ালে থাকায় বাইরের কারোরই চোখে পড়েনি। গাছটি এখন ঝোপালো পাতায় ঠাসা। ডালে ডালে অনেক ফুল ফুটেছে। ফুলগুলো ছোট ও পাতার ফাঁকে ফাঁকে ফুটে আছে। কাছাকাছি না হলে সহজে চোখে পড়ে না।
বাংলাদেশের গ্রাম-জনপদে তমালগাছ এখন অনেকটাই দুষ্প্রাপ্য