ট্রাম্পের শুল্কনীতি কি মন্দা বয়ে আনবে, বাংলাদেশের কৌশলই–বা কী হবে
Published: 5th, April 2025 GMT
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক ঘোষণার পর রীতিমতো কাঁপতে শুরু করেছে বিশ্ব অর্থনীতি। আর কাউকে ছাড় দেবে না যুক্তরাষ্ট্র—আমদানি করা সব পণ্যে ১০ শতাংশ বেজলাইন ট্যারিফ বা ন্যূনতম শুল্ক আরোপ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। দেশভেদে এই হার ওঠানামা করছে; বেশ কয়েকটি দেশের ক্ষেত্রে তা ৫০ শতাংশের ওপর চলে যাচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এমন অস্থিরতা আর কখনো তৈরি হয়নি বলেই জানাচ্ছে বিশেষজ্ঞ মহল; বরং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে বহুপক্ষীয় বাণিজ্যব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, এর মধ্য দিয়ে তার অবসানের পথ প্রশস্ত হলো বলেই মনে করা হচ্ছে; সেই সঙ্গে আশঙ্কা আছে মন্দার।
যুক্তরাষ্ট্রের এই শুল্ক ঘোষণার জবাবে ইতিমধ্যে পাটকেল ছুড়তে শুরু করেছে অনেক দেশ। কেউ কেউ আবার সমঝোতার পথে হাঁটছে। চীনের পণ্যে ৩৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছিলেন ট্রাম্প। তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই বেইজিং যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে পাল্টা আরও ৩৪ শতাংশ শুল্ক আরোপের কথা ঘোষণা করেছে। ট্রাম্পের নীতির জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের ১১টি কোম্পানির বাণিজ্য চীনে বন্ধ করে দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। বেশ কিছু খনিজ পদার্থের রপ্তানিতেও রাশ টানা হয়েছে। চীনের এই পদক্ষেপে বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন করে ধাক্কা লাগবে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ট্রাম্পের শুল্কনীতির প্রতিশোধ নিতে গিয়ে অন্য দেশগুলোও যদি চীনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে, তবে সার্বিকভাবে সারা বিশ্বের অর্থনীতি আরও দুর্বল হয়ে পড়বে।
এদিকে তিনটি দেশের সঙ্গে শুল্ক নিয়ে আলোচনা চলছে যুক্তরাষ্ট্রের—মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, ওই তিন দেশের সঙ্গে শুল্কের বিষয়ে সমঝোতার আলোচনা চলছে। ট্রাম্প শুল্ক আরোপের যে সময়সীমা ধার্য করেছেন, তার আর চার দিন বাকি; অর্থাৎ ৯ এপ্রিল থেকে বিদেশি পণ্যে বর্ধিত হারে শুল্ক আরোপ করবে ওয়াশিংটন। তার আগে তিন দেশের সঙ্গে ট্রাম্পের সমঝোতা হবে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয় বলেই সংবাদে জানানো হয়েছে।
সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত, ইসরায়েল ও ভিয়েতনামের সঙ্গে সমঝোতা আলোচনা করছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর মধ্যে ভিয়েতনামের সঙ্গে আলোচনার কথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেই জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তাঁর দাবি, সমঝোতার স্বার্থে মার্কিন পণ্য থেকে শুল্ক একেবারে তুলে নিতেও রাজি ভিয়েতনাম। বাকি দুই দেশের কথা অবশ্য ট্রাম্প কিছু বলেননি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি লিখেছেন, ‘ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি তো ল্যামের সঙ্গে এইমাত্র খুব ইতিবাচক আলোচনা হলো। তিনি আমাকে বলেছেন, যদি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতা হয়, তারা মার্কিন পণ্যে শুল্কের পরিমাণ একেবারে শূন্য করে দিতে প্রস্তুত। আমাদের পক্ষ থেকে তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়েছি। বলেছি, খুব শিগগির আমাদের দেখা হবে।’
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, শুল্ক ঘোষণার পর কিছু দেশ পাল্টা ব্যবস্থা নিয়েছে, যার কারণে বাণিজ্যযুদ্ধ আরও তীব্র হতে পারে। আবার কিছু দেশ সমঝোতার চেষ্টা করছে, যার কারণে পরিস্থিতি কিছুটা প্রশমিত হতে পারে। সামগ্রিকভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়ছে এবং ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চিত।
শেয়ারবাজারে পতনকয়েক দিন ধরেই ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক নিয়ে জল্পনাকল্পনা হচ্ছিল। তার জেরে সময়-সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শেয়ারবাজারে সূচকের পতন হয়েছে। ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের পর সারা বিশ্বের শেয়ারবাজারে একযোগে ধস নামে। চীন ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে। অন্যান্য দেশ সেই পথে হাঁটলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে।
গত বুধবার বাংলাদেশের সময় গভীর রাতে শুল্ক ঘোষণার পরে গত বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রে সূচক ডাও জোনসের পতন হয় ১ হাজার ৪০০ পয়েন্টের বেশি। ২০২০ সালে করোনার পর সূচকের এত বড় পতন আর হয়নি। তার জের গতকাল শুক্রবার পড়েছে ভারতের শেয়ার সূচকে। সেদিন সেনসেক্সের পতন হয় ৯৩০ দশমিক ৬৭ পয়েন্ট; সূচকটি থামে ৭৫ হাজার ৩৬৪ দশমিক ৬৯ পয়েন্টে। একইভাবে নিফ্টিও ৩৪৫ দশমিক ৬৫ পয়েন্ট পড়ে থিতু হয় ২২ হাজার ৯০৪ দশমিক ৪৫ পয়েন্টে। বাজার মূলধন কমেছে ১০ লাখ কোটি রুপির।
পাশাপাশি পড়েছে ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশের শেয়ারবাজার। চীনসহ কিছু দেশে লেনদেন বন্ধ থাকায় প্রভাব বোঝা যায়নি। তবে বেইজিংয়ের পাল্টা শুল্কের জেরে গতকাল যুক্তরাষ্ট্রে বাজার খোলার পরে ডাও ১ হাজার ৭০০ পয়েন্ট নেমেছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, শুল্কের প্রভাব নিয়ে অন্যান্য দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রকেও লড়াই করতে হবে। তারা স্বনির্ভর নয়। এ পরিস্থিতিতে শেষমেশ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শুল্কবিষয়ক সিদ্ধান্তের কিছুটা প্রত্যাহার করবেন; কিন্তু তা না হওয়া পর্যন্ত সূচক অস্থিরই থাকবে।
ট্রাম্পের শুল্কের ঘোষণার জেরে বৃহস্পতিবার ডলার সূচক ১ দশমিক ৬ শতাংশ কমে ১০২ দশমিক শূন্য ৩–এ নেমে আসে; অক্টোবর মাস শুরুর পর যা সর্বনিম্ন। সেদিন বিশ্বের প্রায় সব কটি প্রধান মুদ্রার বিপরীতে ডলারের দরপতন হয়। তবে আজ শনিবার ডলারে সূচকের মান কিছুটা বেড়ে ১০২ দশমিক ৮৯-এ উঠেছে।
অর্থনৈতিক ক্ষতি ও মন্দামার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতির সমালোচনা করেছে জাতিসংঘ। সংস্থাটির বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার (ইউএনসিটিএডি) সেক্রেটারি জেনারেল বা মহাসচিব রেবেকা গ্রিনস্প্যান বলেন, ট্রাম্পের এই নীতি বিশ্ব উন্নয়নের পরিপন্থী; এই নীতির ফলে সবচেয়ে বিপদে পড়বেন দুর্বল ও দরিদ্র মানুষেরা। সার্বিকভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়তে চলেছে বলেও মনে করছে জাতিসংঘ।
বিবৃতিতে রেবেকা বলেন, অবাধ বাণিজ্য উন্নয়ন ও বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে। সে কারণে বাণিজ্য নিয়ে অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা উচিত নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যবসা-বাণিজ্যে যেসব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়, তা মোকাবিলায় নতুন বাণিজ্যনীতি প্রয়োজন। নতুন বাণিজ্যনীতিতে বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলোর প্রতিফলন থাকা দরকার। ভবিষ্যৎ ও উন্নয়নের বিষয়টি মাথায় রেখেই নতুন বাণিজ্যনীতি প্রণয়ন করতে হবে; দরিদ্র ও দুর্বলদের রক্ষা করতে হবে। এখন পারস্পরিক সহযোগিতার সময়; উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি করার মানে হয় না।’
মোদ্দাকথা, ট্রাম্প মূলত বাণিজ্যঘাটতি কমিয়ে আনতেই এই শুল্ক আরোপ করেছেন। শুল্ক থেকে বিপুল পরিমাণে রাজস্ব আয় হবে বলে ট্রাম্প প্রশাসন মনে করে। যুক্তরাষ্ট্রে কারখানা ফিরিয়ে আনাও তাঁর লক্ষ্য। কিন্তু বাস্তবতা হলো, চীন, ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ বা ভারতের মতো দেশে বিনিয়োগের ব্যয় যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি, সেখানে শ্রমিকের মজুরি ও উপকরণের দাম বেশি। ফলে উন্নয়নশীল দেশের জন্য সস্তায় পণ্য তৈরি করা সেখানে তেমন একটা সম্ভব হবে না বলেই অর্থনীতির সূত্রে বোঝা যায়। কাজেই যুক্তরাষ্ট্র বিনিয়োগ বাড়াতে চাইলেই যে পারবে বা খাপে খাপে সব মিলে যাবে, তা নয়। যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশি বিনিয়োগ এলে ডলারের চাহিদা বাড়বে, অর্থাৎ ডলার আরও শক্তিশালী হবে, পণ্যের দাম বাড়বে এবং পরিণামে যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা কমবে, তাতে বাণিজ্যঘাটতি আরও বাড়বে বলেই ধারণা করা যায়।
সামষ্টিক অর্থনীতিতে সেভিং ইনভেস্টমেন্ট আইডেনটিটি শীর্ষক এক তত্ত্ব আছে। সেটা হলো, বাণিজ্যঘাটতি নির্ভর করে কত পুঁজির প্রবাহ আসছে আর কত সঞ্চয় আছে তার ওপর; অর্থাৎ বিনিয়োগের জন্য যদি বিদেশ থেকে ঋণ করতে হয়, তাহলে বিনিয়োগ-সঞ্চয়ের ব্যবধান বাড়ে এবং তাতে বাণিজ্যঘাটতি আরও বেড়ে যায়।
এখন বাংলাদেশ যদি মনে করে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ালে শুল্কহার কমে আসবে এবং বাংলাদেশ সেখান থেকে লাভবান হবে, তা কতটুকু বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকে। বরং বাংলাদেশে ডলারের চাহিদা বেড়ে গেলে টাকার আরও অবমূল্যায়ন হবে এবং বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বাস্তবতা হলো, নতুন সরবরাহব্যবস্থা গড়ে তুলতে অনেক সময় লাগে। চাইলেই একটি জায়গা থেকে কারখানা গুটিয়ে আরেক জায়গায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কারখানার আয়ুষ্কাল শেষ হওয়ার আগে তা কতটা সম্ভব, তা আরও খতিয়ে দেখার বিষয়। চাইলেই বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বাজার ভারত নিতে পারবে না, বাংলাদেশ যে ধরনের পোশাক উৎপাদন করে, ভারত বা ভিয়েতনাম তা করে না। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক সরবরাহব্যবস্থায় আস্থার বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি; বরং এমন হতে পারে যে বাংলাদেশের পণ্য ভারত থেকে রপ্তানি করা হতে পারে। যেমন ২০১৮ সালের পর চীনের পণ্য ভিয়েতনাম থেকে ঘুরপথে রপ্তানি হয়েছে; যদিও তা নির্ভর করবে পারস্পরিক সম্পর্ক বা রাজনৈতিক সম্পর্কের ওপর। ফলে ভবিষ্যতে অনেক ভেবেচিন্তে পদক্ষেপ নিতে হবে, বিশেষ করে চীন ও ভারতের মতো বড় দেশগুলো কী পদক্ষেপ নেয়, তা বুঝে সিদ্ধান্ত দেওয়া দরকার।
বাণিজ্যঘাটতি থাকলেই যে একটি দেশের অর্থনীতি রসাতলে যায়, তা নয়, বরং মার্কিন অর্থনীতি গত কয়েক বছরে ভালো অবস্থানেই ছিল। বাইডেনের আমলের শুরুতে করোনার সময় যে বিপুল পরিমাণ প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে, তার কারণে উচ্চ নীতি সুদহারের প্রভাব তেমন একটা অনুভূত হয়নি। বাড়েনি বেকারত্ব, মন্দও হয়নি; তারপরও বাইডেন হেরে গেছেন। এর মূল কারণ মানুষ মনে করেছে, বাইডেন প্রশাসনের যুদ্ধংদেহী পররাষ্ট্রনীতি যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতির কারণ হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিপুলসংখ্যক মানুষ সম্ভবত আর চায় না, সেই দেশ আর বৈশ্বিক মাতব্বরির ভূমিকায় অবতীর্ণ হোক। এতে অনেক ছোট বা উন্নয়নশীল দেশের উপকার হবে সন্দেহ নেই; সে জন্য দরকার হলে মন্দার ধাক্কাও তারা সামলাতে অনেকটা রাজি। যদিও শুল্কের ঘোষণার পর ট্রাম্পের রেটিং কমেছে।
ট্রাম্পের এই শুল্কনীতির প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি নিশ্চিতভাবেই বাড়বে। কমবে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। শুল্ক বাবদ সরকারের আয় হয়তো বাড়বে; সেই অর্থ দিয়ে মানুষকেই আবার প্রণোদনা দিতে হবে, যদি মন্দা শুরু হয়।
মোদ্দাকথা, এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যের অবসানের শুরু হলো বলেই বলা যায়। এখন তারা পারস্পরিক দর-কষাকষির যুগে চলে যাবে; বহুপক্ষীয় ব্যবস্থার ধার আর বিশেষ ধারবে না।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: শ য় রব জ র পর স থ ত ব যবস থ সমঝ ত র দশম ক
এছাড়াও পড়ুন:
জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তা কীভাবে নির্ধারণ করব
২০২৪ সালের গণ–অভ্যুত্থান বাংলাদেশের জন্য জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তানীতিতে একটি স্থায়ী ঐকমত্য গড়ে তোলার ঐতিহাসিক মুহূর্ত হয়ে হাজির হয়েছে। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, রাষ্ট্রের এই মৌলিক ইস্যু আমাদের আলোচনায় আজও প্রান্তে পড়ে আছে। বিশ্ব ও আঞ্চলিক বাস্তবতায় এ বিষয়ে ঐকমত্য খুবই জরুরি। বিশ্বের সব সফল রাষ্ট্রই তার টেকসই উন্নয়ন ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য কৌশলগত সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশে এই সংস্কৃতির অভাব আমাদের উন্নয়ন পথপরিক্রমায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
স্বাধীনতার পর থেকে কমপক্ষে দুবার এ সুযোগ আমাদের হাতছাড়া হয়েছে। প্রথমবার ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠনের সময়। তখন আমরা সার্বভৌমত্ব, সমতা ও ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ গঠনের ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম। কিন্তু সংহত জাতীয় নিরাপত্তা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর কোনো স্থায়ী রূপ পায়নি। দ্বিতীয়বার ১৯৯১ সালে স্বৈরাচারের পতনের পর। তখন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সময়েও আমরা এই অসম্পূর্ণ কাজ শেষ করতে পারিনি।
সৌভাগ্যবশত এই ঐতিহাসিক ঘাটতি শুধরে নেওয়ার তৃতীয় একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। জনরাষ্ট্রের অগ্রযাত্রার জন্য দুটি ব্যাপার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি কৌশলগত স্বয়ংসম্পূর্ণতা (স্ট্র্যাটেজিক অটোনমি), আরেকটি উন্নয়নধর্মী নিবারণব্যবস্থা (ডেভেলপমেন্টাল ডেটারেন্স)। এগুলোকে মৌলিক ভিত্তি হিসেবে ধারণ করে সর্বজনগ্রাহ্য জাতীয় স্বার্থ নির্ধারণ নিঃসন্দেহে অত্যন্ত জরুরি।
এ কারণেই জুলাই সনদে জাতীয় স্বার্থ নির্ধারণ এবং জাতীয় নিরাপত্তানীতি, কাঠামো ও প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে ঐকমত্যবিষয়ক একটি প্রস্তাবনা আবশ্যক। রাজনৈতিক দলগুলোর এই অঙ্গীকার রূপান্তরের সূচনাবিন্দু হতে পারে। নির্বাচিত সংসদ এই এজেন্ডার বাস্তবায়ন করবে। জাতীয় স্বার্থের ওপর ঐকমত্য কেবল একটি বিমূর্ত ধারণা হিসেবে থাকলে চলবে না; গড়ে তুলতে হবে কৌশলগত সংস্কৃতির (স্ট্র্যাটেজিক কালচার) মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো।
আরও পড়ুনজাতীয় ঐকমত্য সমঝোতা স্মারকে যা থাকতে পারে ১১ মার্চ ২০২৫কৌশলগত সংস্কৃতিকৌশলগত সংস্কৃতি ও সংহতি আপনা-আপনি গড়ে ওঠে না। প্রায়ই তা তৈরি হয় সংঘাত বা রূপান্তরের পরিপ্রেক্ষিতে। উদাহরণস্বরূপ ১৯৬২ সালে চীনের সঙ্গে যুদ্ধের পর ভারত তার প্রতিরক্ষাকাঠামোয় মৌলিক সংস্কার আনে। গান্ধীবাদী কূটনীতির পরিবর্তে প্রতিরোধমূলক সক্ষমতা ও আত্মনির্ভরশীলতার ভিত্তিতে কৌশলগত সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে। চীনও পদ্ধতিগতভাবে দলীয় নিয়ন্ত্রণ, সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতার ভিত্তিতে ‘মৌলিক স্বার্থ’ সংজ্ঞায়িত করেছে।
মনরো (যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেমস মনরো) থেকে ট্রুমান (যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুমান) ডকট্রিনসহ একাধিক কৌশলগত নীতিমালার মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থ নির্ধারণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি কৌশলগত প্রাধান্যের সঙ্গে যুক্ত করে সময়ের প্রেক্ষাপটে আমূল পরিবর্তন এনেছে তারা।
১৯৪০ সালের লজ্জাজনক পরাজয়ের পর চার্লস ডি গল কৌশলগত স্বাধীনতার ওপর ভিত্তি করে ফরাসি জাতীয় স্বার্থ পুনর্গঠন করেন। ১৯৬৬ সালে ন্যাটোর সামরিক কমান্ড থেকে প্রত্যাহার ও পরমাণু সক্ষমতা অর্জনের মধ্য দিয়ে এটি বাস্তবায়িত হয়।
মেইজি (জাপানের সম্রাট) পুনরুদ্ধারের পর জাপান একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠন করে। শিল্পায়ন, ভূখণ্ড সংহতকরণ এবং পরবর্তীকালে সাম্রাজ্য বিস্তার ছিল তাদের জাতীয় স্বার্থের ভিত্তি। দীর্ঘ উপনিবেশ ও যুদ্ধপরবর্তী সময়ে ভিয়েতনাম পুনরেকত্রীকরণ, সার্বভৌমত্ব ও সমাজতান্ত্রিক নির্মাণকে জাতীয় স্বার্থ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে। একইভাবে ইন্দোনেশিয়ার ‘পঞ্চশীল’ দার্শনিক ভিত্তি তার জাতীয় নিরাপত্তার মূল নৈতিক ও আদর্শিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করে আসছে। বর্ণবাদের পতনের পর দক্ষিণ আফ্রিকা গণতান্ত্রিক বৈধতার ভিত্তিতে পুনর্মিলন, মর্যাদা ও মহাদেশীয় নেতৃত্বের ওপর জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করেছে।
এই উদাহরণগুলো প্রমাণ করে, পরিবর্তনের সময়গুলোয় জাতীয় স্বার্থের সংজ্ঞা স্পষ্ট হয়। আর কৌশলগত সংস্কৃতি শুধু সামরিক নীতিতেই নয়, শিক্ষানীতি, কূটনীতি ও উন্নয়ন পরিকল্পনাতেও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়।
কৌশলগত স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও উন্নয়নধর্মী নিবারণব্যবস্থাবাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তাকাঠামো নির্মাণে কৌশলগত স্বয়ংসম্পূর্ণতা (অর্থাৎ স্বাধীন ও দৃঢ়ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা) এবং উন্নয়নধর্মী নিবারণব্যবস্থার (যথা শান্তি ও অধিকার নিশ্চিত করা) মাধ্যমে নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি—এ দুই ধারণাই একটি সুসংহত নিরাপত্তাকাঠামোর ভিত্তি হতে পারে।
উন্নয়নধর্মী নিবারণব্যবস্থা প্রথাগত নিবারণব্যবস্থার চেয়ে ভিন্ন। এটি শুধু সামরিক নয়, বরং কৌশলগত। এর মাধ্যমে একটি রাষ্ট্র তার উন্নয়নকাঠামোকে নির্বিঘ্ন রাখতে পারে। উদাহরণস্বরূপ সিঙ্গাপুর দ্রুত সামরিক আধুনিকীকরণ করেছে আগ্রাসনের জন্য নয়, বরং উন্নয়ন–নিরাপত্তার জন্য। বাংলাদেশকেও একইভাবে তার জনমিতিক সম্পদ ও বঙ্গোপসাগরকে কেন্দ্র করে কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। বঙ্গোপসাগরের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রে থাকবে। প্রতিরক্ষানীতিতে থাকতে হবে দৃঢ় নিবারণ সক্ষমতা।
ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে। প্রতিবেশী মিয়ানমারে চলছে জাতিগত সংঘাত। এসবের প্রেক্ষাপটে কৌশলগত স্বয়ংসম্পূর্ণতার ভিত্তিতে যদি আমরা জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল গ্রহণ করতে পারি, তাহলে তা বাংলাদেশকে ভূকৌশলগত সক্ষমতা ও ভূরাজনৈতিক প্রাধান্য প্রদান করতে পারে। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা চালাতে হবে। সরকার, রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ বিশেষজ্ঞ এবং গণমাধ্যমের একসঙ্গে কাজ করা জরুরি।
সম্পর্কের চারটি দৃশ্যপটসম্পর্কের চারটি সম্ভাব্য দৃশ্যপট কল্পনা করা যেতে পারে। প্রতিবেশীর দিকে ঝুঁকে পড়া, কোনো এক পরাশক্তির দিকে ঝোঁক, ভারসাম্য বজায় রাখার প্রচেষ্টা এবং স্বাধীন, পারস্পরিক অন্তর্ভুক্তিমূলক কূটনীতি। এর মধ্যে চতুর্থ সম্ভাব্য দৃশ্যপট তথা স্বাধীন ও পারস্পরিক অন্তর্ভুক্তিমূলক কৌশলই কেবল দীর্ঘস্থায়ী টেকসই অগ্রসর হওয়ার পথ উন্মুক্ত করতে পারে। এই পথে রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া যাত্রা সম্ভব নয়। জাতীয় অগ্রাধিকার, নৈতিক বৈধতা এবং কৌশলগত স্বচ্ছতার ভিত্তিতে রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরি হতে হবে। জাতীয় নিরাপত্তানীতি শুধু সামরিক বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি একটি সমন্বিত কাঠামো। সেখানে অর্থনীতি, কূটনীতি, সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং পরিবেশগত নিরাপত্তা একসঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। একটি কার্যকর জাতীয় নিরাপত্তাকাঠামো গড়ে তুলতে হলে এ সব দিকই বিবেচনায় নিতে হবে।
নিরাপত্তানীতি উদ্ভূত হতে হবে অভ্যন্তরীণ চাহিদা, অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং জনগণের আকাঙ্ক্ষা থেকে। বিশেষ করে নিরাপত্তানীতিতে বহুপক্ষীয়তায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণ, উন্নয়ন অর্থায়ন, বাণিজ্য ও জলবায়ু–কূটনীতিবিষয়ক দিকনির্দেশনা থাকতে হবে। তাহলেই বিশ্বকে জানান দেওয়া যাবে যে বাংলাদেশ কেবল প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে না। সেই সঙ্গে বৈধ, সার্বভৌম কৌশলগত পরিচয় ঘোষণা করছে। নিরাপত্তানীতি সশস্ত্র বাহিনী, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ নানা সংস্থার কাজ সম্পর্কে জনগণের কাছে স্পষ্ট ও আত্মবিশ্বাস প্রদান করবে। জনগণের কাছ থেকে নৈতিক বৈধতা অর্জনের মাধ্যমে কৌশলগত সংস্কৃতি জাতীয় সংহতি গড়বে। জাতীয় সংহতিই প্রধানতম কৌশলগত স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও নিবারণব্যবস্থা।
কৌশলগত ভবিষ্যৎ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থান জাতির ক্ষমতায়নের প্রতীক। জনগণ তার সক্ষমতার কথা জানান দিয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানকে ধারণ করতে হলে সব রাজনৈতিক দলকে জুলাই চার্টারে একটি অঙ্গীকার নিশ্চিত করতে হবে। এই অঙ্গীকার হবে একটি সর্বব্যাপী জাতীয় নিরাপত্তা দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থ সংজ্ঞায়িত করা ও জাতীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের অঙ্গীকার। জাতীয় স্বার্থবিষয়ক ঐকমত্য গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। এই ব্যাপারে পথনকশা জরুরি ও অপরিহার্য। ধাপে ধাপে বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার অতীতকে সমন্বিত করতে, বর্তমানকে স্থিতিশীল করতে এবং ভবিষ্যৎকে নিশ্চিত করতে পারবে।
ইতিহাস থেকে দেখা যায়, যে রাষ্ট্র কাজ করে নির্ধারিত জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে, তারা টিকে থাকে। যারা প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করে, তারা বিকশিত হয়। গণ–অভ্যুত্থান শুধু কণ্ঠের পুনরুদ্ধার নয়, দৃষ্টিভঙ্গি ও কৌশল বদলের ভিত্তিতে সুসংহত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় নিরাপত্তা কাঠামো গঠনের অঙ্গীকারও।
● ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর, অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়