ওয়ার্নার বলেছিলেন মাথা খাটিয়ে বল করতে, মোস্তাফিজ দিলেন মাথার ওপর বাউন্সার
Published: 5th, April 2025 GMT
‘আমি ফিজের জন্য গুগল ট্রান্সলেশন ব্যবহার করছিলাম। চেষ্টা করছি কীভাবে বাংলা বলতে হয়। হা হা। থোরা থোরা।’
২০১৬ সালের এপ্রিলে আইপিএলের মধ্যে ঠিক এমন টুইটই করেছিলেন ডেভিড ওয়ার্নার। ফিজ মানে বাংলাদেশের মোস্তাফিজুর রহমান, সে বছরই প্রথমবার আইপিএল খেলতে যান বাংলাদেশের এই বাঁহাতি পেসার। সানরাইজার্স হায়দরাবাদে মোস্তাফিজের অধিনায়ক ছিলেন ওয়ার্নার।
টেবিলের দুই প্রান্তে বসা ওয়ার্নার ও মোস্তাফিজ—এমন একটি ছবি ‘ভাইরাল’ হয়ে গেলে একজনের মন্তব্যের জবাবে অমন উত্তর দিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ওপেনার। যে উত্তরে রসিকতার সুর থাকলেও ওয়ার্নারের বাংলা শেখার চেষ্টা ছিল সত্যি। ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে মোস্তাফিজের সঙ্গে আলোচনা করতে বেশ বিড়ম্বনায়ই যে পড়তে হতো তাঁকে।
আইপিএলে ভাষা–বিড়ম্বনার ঘটনা অবশ্য নিয়মিতই। ক্রিকেট সাধারণত জাতীয় দলনির্ভর খেলা হওয়ায় ব্যতিক্রম বাদে একটি দলের সবাই এক ভাষায়ই কথা বলেন। সমস্যা দেখা দেয় যখন ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট টুর্নামেন্টে বিভিন্ন ভাষাভাষী এক দলে জড়ো হন। ইউরোপের ক্লাব ফুটবলেও একই চিত্র দেখা যায়।
তবে ভাষা নিয়ে বিড়ম্বনা সেখানে কম হওয়ার বড় কারণ, খেলা চলে প্রায় সারা বছর। লম্বা সময় সবাই একসঙ্গে থাকায় ভাষার প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ওঠাটা সহজ। কিন্তু আইপিএলের মতো ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট টুর্নামেন্টগুলো চলে বছরে সর্বোচ্চ দুই মাস। তার ওপর এক ভারতেই বহু ভাষার মানুষের সমাগম।
সরকারি দাপ্তরিক ভাষা হিন্দি ও ইংরেজি হলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত ভাষা ২২টি। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা ক্রিকেটার আর বিভিন্ন দেশের খেলোয়াড়েরা যখন একত্রিত হন, তখন যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভাষা নিয়ে বড় চ্যালেঞ্জেই পড়তে হয় টিম ম্যানেজমেন্টকে।
আরও পড়ুনআইপিএল: ক্রিকেট নাকি ক্রিকেট নয়৩০ মার্চ ২০২৪আইপিএলে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেটের মালিক পীযুষ চাওলাও পড়েছিলেন এমন এক বিড়ম্বনায়। ২০০৮ সালে আইপিএলের প্রথম আসরে চাওলা ছিলেন পাঞ্জাব কিংসে। সেই দলে ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার ব্রেট লি, শন মার্শ, কোচ টম মুডিরা।
উত্তর প্রদেশ থেকে উঠে আসা চাওলা ইংরেজি বলতে না পারলেও বুঝতে পারতেন। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ানদের ইংরেজি নিয়ে পড়েছিলেন ঝামেলায়, ‘ইংরেজি সমস্যা ছিল না; কিন্তু ওদের উচ্চারণ বোঝা কঠিন ছিল।’ লি–মার্শদের ইংরেজি বোঝার জন্য চাওলা তখন যুবরাজ সিংকে অনুবাদক বানিয়ে নিয়ে বলতেন ‘উনি কী বলেছেন বুঝিয়ে দাও তো’। আবার পরবর্তী সময়ে কলকাতা নাইট রাইডার্সে খেলার সময় কোচ জ্যাক ক্যালিস ও সাইমন ক্যাটিসদের কথা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য রিংকু সিংয়ের দোভাষী হয়ে ওঠেন চাওলাই।
প্রথম আসরে পাঞ্জাবে কোচিং করানো মুডি ২০১৬ আসরে ছিলেন সানরাইজার্স হায়দরাবাদে। সে বছর বাংলাদেশের মোস্তাফিজকে নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছিল তাঁর দলকে। ইএসপিএনক্রিকইনফোকে সে কথা জানাতে গিয়ে মুডি বলেন, ‘প্রথম দিকে ওকে নিয়ে সত্যিই সমস্যায় পড়েছিলাম।’
২০১৬ আইপিএলে সানরাইজার্স হায়দরাবাদে খেলেন মোস্তাফিজুর রহমান।.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
স্মৃতি ও শ্রদ্ধার অনন্য আয়োজন
তাঁর শারীরিক উপস্থিতি ছিল না অনুষ্ঠানে। তবে তাঁর উপস্থিতি ছিল আরও ব্যাপক বিপুল বিস্তারে। ‘নতুন করে পাব বলে’ নামে অনুষ্ঠান হলো তাঁকে স্মরণ করে, তাঁরই হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান ছায়ানট মিলনায়তনে। তিনি সন্জীদা খাতুন। বাংলাদেশের সংস্কৃতির অন্যতম বিনির্মাতা, সংগীতজ্ঞ, শিক্ষাবিদ, সংগঠক সন্জীদা খাতুনকে স্মরণ করে যৌথভাবে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল ছায়ানট, জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ, নালন্দা উচ্চবিদ্যালয়, কণ্ঠশীলন ও ব্রতচারী।
গতকাল শুক্রবার ছুটির দিন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল ‘কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে’ সম্মেলক কণ্ঠে গানের সঙ্গে সমবেত নৃত্যের পরিবেশনা দিয়ে। মঞ্চ সাজানো হয়েছিল অনাড়ম্বর, কিন্তু শুচিস্নিগ্ধ সজ্জায়। সবুজ গাছ আর ফুল দিয়ে। মঞ্চের নেপথ্যে বড় ডিজিটাল পর্দায় একের পর এক হচ্ছিল পরিস্ফুটিত সন্জীদা খাতুনের তারুণ্যের কাল থেকে বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের বিভিন্ন মুহূর্তের ছবির পর ছবি।
সংগীতজ্ঞের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের আয়োজনে গান তো থাকবেই। সেই সঙ্গে আরও ছিল তাঁর না থাকার শূন্যতার বোধ, তিনি যে চেতনার আলো জ্বালিয়ে গেলেন, তা প্রাণে প্রাণে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রত্যয়। তাঁর জীবনী আলোচনা, তাঁর নিজের লেখা থেকে পাঠ, তাঁর নিজের গাওয়া গান, স্মৃতিচারণা, কবিতা আবৃত্তি, গীতি-আলেখ্যর সমন্বয়ে সাজানো টানা তিন ঘণ্টার অনুপম পরিবেশনা। সন্জীদা খাতুন তাঁর জীবিতকালে ছায়ানটের অনুষ্ঠানগুলো বরাবরই ত্রুটিহীন ও আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করার রীতি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই ধারাবাহিকতা থাকল তাঁর অনুপস্থিতিতেও। অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা থেকে পরিবেশনা অবধি, যাঁরাই যে কাজে ছিলেন সবাই যেন নিজেদের উজাড় করে দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন এই অনুষ্ঠানে।
প্রথম পরিবেশনার পর ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি ডা. সারওয়ার আলী বললেন, ‘আমরা যেন এক মহিরুহের ছায়া থেকে বঞ্চিত হয়েছি। সংস্কৃতির মধ্যমে সর্বজনের মধ্যে বাঙালি জাতিসত্তার জাগরণের অক্লান্ত চেষ্টা চালিয়ে গেছেন তিনি। সেই কাজের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে হবে।’ সব বাধা প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে সবাইকে হাতে হাত মিলিয়ে সন্জীদা খাতুনের দেখিয়ে যাওয়া পথে অগ্রসর হওয়ার আহ্বান জানালেন তিনি।
এরপর সম্মেলক কণ্ঠে পরিবেশিত হলো ‘পান্থ তুমি পান্থ জনের সখা হে’। সন্জীদা খাতুনের জীবনী তুলে ধরেন জয়ন্ত রায়। এরপর মঞ্চ আঁধার করে নেপথ্যে সন্জীদা খাতুনের ছবি রেখে পরিবেশন করা হলো তাঁর রেকর্ড করা গান ‘এখনো গেল না আঁধার’। ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় পড়ে শোনালেন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের স্মৃতিচারণা করে সন্জীদা খাতুনের লেখা ‘একুশ আমাকে ভাষা দিয়েছে’।
ছায়ানটের উপদেষ্টা মফিদুল হক আলোচনা করলেন সন্জীদা খাতুনের বহুমাত্রিক জীবন ও কর্ম নিয়ে। তিনি বললেন, শিক্ষা, গবেষণা, সংগঠন পরিচালনাসহ বহুবিধ কাজে সন্জীদা খাতুন আত্মনিয়োগ করলেও গান নিয়েই মূলত তিনি পথ চলেছেন। গানের ভেতর দিয়েই সংস্কৃতিকে উপলব্ধি করেছেন। মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন মঙ্গলের চেতনা। ষাটের দশকে আইয়ুব খানের কঠিন সামরিক শাসনের ভয়ভীতি উপেক্ষা করে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন করেছেন তিন দিনের অনুষ্ঠান করে। সেই সূত্রে ছায়ানট ও পরে রমনার বটমূলে পয়লা বৈশাখে নববর্ষের অনুষ্ঠান। বাঙালি সংস্কৃতির জাগরণে তাঁর ভূমিকা অম্লান থেকে যাবে।
আলোচনার পর তানিয়া মান্নান গেয়েছেন ‘মালা হতে খসে পড়া’। কণ্ঠশীলনের জহিরুল হক আবৃত্তি করেন ‘পুরস্কার’ কবিতার অংশবিশেষ। এভাবেই একক ও সম্মেলক গান, ব্রতচারীর গান, আবৃত্তি পাঠ, স্মৃতিচারণার পরিবেশনা দিয়ে এগিয়েছে অনুষ্ঠান।
নালন্দার শিক্ষার্থীরা পরিবেশন করেছে সন্জীদা খাতুনের প্রবন্ধ অবলম্বে গীতি-আলেখ্য ‘সবারে বাস রে ভালো’। ত্রপা মজুমদার পড়েছেন মুক্তিযুদ্ধকালের স্মৃতিচারণা করে সন্জীদা খাতুনের লেখা, তাঁর সংস্কৃতি ভাবনা নিয়ে প্রবন্ধ পড়েছেন সুমনা বিশ্বাস। স্মৃতিচারণা ও গান করেছেন লিলি ইসলাম। একক গান পরিবেশন করেছেন রোকাইয়া হাসিনা নীলি, মহিউজ্জামান চৌধুরী, খায়রুল আনাম শাকিল, ইফফাত আরা দেওয়ান, শারমিন সাথী ইসলাম, প্রমীলা ভট্টাচার্য, এ টি এম জাহাঙ্গীর, বিমান চন্দ্র বিশ্বাস, বুলবুল ইসলাম ও লাইসা আহমদ লিসা।
সম্মেলক কণ্ঠে ‘শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে’ গানটির পর জাতীয় সংগীত দিয়ে শেষ হয়েছিল স্মৃতি ও শ্রদ্ধার এই অনন্য আয়োজন।