প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গতকাল শুক্রবার বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনে দেওয়া ভাষণে জানিয়েছেন, যত দ্রুত সম্ভব জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা তাঁর সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।
এদিন থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে সম্মেলনের ফাঁকে তিনি দেশটির প্রধানমন্ত্রী পায়েতংতার্ন সিনাওয়াত্রা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী হরিণী আমারাসুরিয়া ও ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। পরে ব্যাংককের একটি হোটেলে তিনি প্রাতঃরাশ বৈঠক করেন থাই বিশিষ্টজনের সঙ্গে। এ সময় ড.
সম্মেলন শেষে আগামী দুই বছরের জন্য বিমসটেক চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেয়েছে বাংলাদেশ। দায়িত্ব গ্রহণের পর ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন সংস্থার মহাসচিব ইন্দ্র মণি পাণ্ডে। এ সময় ড. ইউনূস বিমসটেক সচিবালয়কে সদস্য দেশগুলোর তরুণ-তরুণীদের মধ্যে সম্পৃক্ততা বাড়াতে ‘বিমসটেক যুব উৎসব’ আয়োজনের উদ্যোগ নিতে তাঁকে নির্দেশ দেন।
প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচন
সম্মেলনে ড. ইউনূস বলেন, জনগণকে আমি আশ্বস্ত করেছি, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ হলে আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব অনুযায়ী দ্রুত অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করব।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, গত ১৫ বছরে আমাদের জনগণ বিশেষ করে যুবসমাজ ক্রমাগত তাদের অধিকার ও স্বাধীনতা সংকুচিত হতে দেখেছে। তারা প্রত্যক্ষ করেছে রাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের অবক্ষয় ও নাগরিক অধিকারের অবমাননা। সাধারণ জনগণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নৃশংস স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটিয়েছে। এ লড়াইয়ে প্রায় ২ হাজার নিরীহ মানুষ, যাদের বেশির ভাগ তরুণ ও ১১৮ শিশু প্রাণ হারিয়েছে। ১৯৭১ সালেও লাখ লাখ সাধারণ নারী-পুরুষ, শিশু ও যুবক একটি নৃশংস সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ৯ মাসব্যাপী গণহত্যায় সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছিল।
সরকারপ্রধান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, টেকসই প্রবৃদ্ধি পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য বলিষ্ঠ ও সুদূরপ্রসারী সংস্কারে দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি বলেন, আমরা বাংলাদেশকে পুনর্গঠন করছি। দেশের প্রতিটি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিতে অবিচলভাবে কাজ চালিয়ে যাব।
সবার কল্যাণে একযোগে কাজ করুন
সম্মেলনে বিমসটেক সদস্য দেশগুলোকে পারস্পরিক স্বার্থ ও সবার কল্যাণে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে উন্মুক্ত আঞ্চলিকতাবাদের স্বপ্ন লালন করছে। আমরা এমন একটি অঞ্চলের স্বপ্ন দেখি, যেখানে সব দেশ ও জনগোষ্ঠী ন্যায্যতা, পারস্পরিক সম্মান, স্বার্থ ও যৌথ কল্যাণের ভিত্তিতে সম্পৃক্ত হতে পারে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বিমসটেক অঞ্চল বিশ্ব জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশের আবাসস্থল, যেখানে বহু চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। এ চ্যালেঞ্জগুলোকে সম্ভাবনায় হিসেবে রূপান্তর করা গেলে সব দেশের জন্য বিশাল সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। বিমসটেক সচিবালয় হোস্টিং করার মাধ্যমে বাংলাদেশ এ সংস্থার বিশাল সম্ভাবনাকে অর্থবহ উপায়ে কাজে লাগাতে প্রস্তুত।
তিনি বলেন, বিমসটেক অঞ্চলের টেকসই উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য জ্বালানি নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের যৌথভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি, সীমান্ত পেরিয়ে বিদ্যুৎ বাণিজ্য এবং জ্বালানি দক্ষতা ব্যবহারে এগিয়ে আসতে হবে। ২০১৮ সালে স্বাক্ষরিত ‘বিমসটেক গ্রিড ইন্টারকানেকশন চুক্তি’ জ্বালানি খাতে সহযোগিতার সূচনা পর্ব হতে পারে। ড. ইউনূস বলেন, কিছু দেশ দ্বিপক্ষীয়ভাবে অনেক কিছু অর্জন করেছে। তবে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক একত্রীকরণ ও উন্নয়নের সুফল পেতে হলে যৌথ আঞ্চলিক উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে।
তিনি বলেন, বিমসটেক ২৮ বছরের সংস্থা। সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে এর প্রভাব এখনও সব সদস্য দেশে স্পষ্টভাবে অনুভূত হয়নি। এ সময় ড. ইউনূস জানান, বৃহস্পতিবার স্বাক্ষরিত ‘বিমসটেক সামুদ্রিক পরিবহন সহযোগিতা চুক্তি’ বিমসটেক অঞ্চলে বিশেষ করে ভূমিবেষ্টিত দেশ ও ভারতের সাত রাজ্যের সঙ্গে কানেক্টিভিটি বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
তিনি আরও বলেন, দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের প্রেক্ষাপটে বহু পুরোনো নীতি ও নিয়মাবলি আজ ভেঙে পড়ছে। আমি দেখতে পাচ্ছি, প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায়ই মানুষের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে যুগোপযোগী করতে আমি আর্থিক ব্যবস্থা সংস্কার এবং এমন সামাজিক ব্যবসা উদ্যোগ চালুর পক্ষে, যা শুধু সম্পদ বৃদ্ধির পরিবর্তে মানুষের মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
বিমসটেকের জন্য চার এজেন্ডা
ড. ইউনূস শীর্ষ সম্মেলনে বিমসটেকের জন্য চার এজেন্ডা প্রস্তাব করেন। তিনি যুবসমাজের শক্তিকে কাজে লাগানোর পরামর্শ দিয়েছেন। বলেছেন, বাংলাদেশি তরুণরা সামনে থেকে এতটা ইচ্ছা এবং কর্মপ্রচেষ্টা দেখাচ্ছে, এমনকি শাসন ব্যবস্থায় দীর্ঘস্থায়ী কিছু ধারণা সংস্কার করার জন্যও প্রস্তাব করেছে।
ড. ইউনূস কৃষিকাজ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিশেষ
করে এ অঞ্চলের বিশাল ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং সম্পর্কিত ‘৪ আইআর’ সরঞ্জাম ও অ্যাপ্লিকেশনগুলোকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তাব করেছেন।
তিনি বিমসটেক দেশ এবং সম্প্রদায়ের জন্য জ্ঞানের ক্ষেত্রে জোরালোভাবে জড়িত হওয়ার জন্য তাদের সম্পদ তৈরি, উদ্ভাবন ও ভাগ করে নেওয়ার জন্য সব উপায় উন্মুক্ত করার সুপারিশ করেন। সরকারপ্রধান এমন একটি ইকো-সিস্টেম প্রতিষ্ঠারও প্রস্তাব করেন, যেখানে সরকার ছাড়াও অন্যান্য সংস্থা জনস্বাস্থ্য বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা জলবায়ু অভিযোজন– জরুরি অবস্থা এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিমসটেকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করতে পারে।
দুর্নীতি দমনে সমঝোতা স্মারক
দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যৌথভাবে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও থাইল্যান্ডের জাতীয় দুর্নীতি দমন কমিশনের (এনএসিসি) মধ্যে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়েছে।
গতকাল সম্মেলনের ফাঁকে দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল মোমেন এবং এনএসিসির সভাপতি সুচার্ট ট্রাকুলকাসেমসুক নিজ নিজ দেশের পক্ষে সমঝোতা স্মারকে সই করেন। এ সময় প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস এবং থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পায়েতংতার্ন সিনাওয়াত্রা উপস্থিত ছিলেন।
দুদক চেয়ারম্যান বলেছেন, বাংলাদেশি দুর্নীতিবাজদের অনেকেই প্রতিবেশী কয়েকটি দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। আমরা বিশ্বাস করি, এ সমঝোতা স্মারক তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনতে সহায়ক হবে।
এদিকে সম্মেলন শেষে গতকাল রাত পৌনে ৯টায় ঢাকার উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা ও তাঁর সফরসঙ্গীদের নিয়ে বিমানের ফ্লাইটি রওনা দেয়।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব মসট ক ড ইউন স ব মসট ক স র জন য সরক র ইউন স সমঝ ত
এছাড়াও পড়ুন:
সোনাইমুড়ীতে চাঁদা চেয়ে চিঠি, না পেয়ে প্রতিষ্ঠানে তালা
নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীর আমিশাপাড়া বাজারে চাঁদার দাবিতে একটি দোকানে তালা লাগিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। চাঁদা না দেওয়ায় এ কাজ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী আবুল বাশার পাটোয়ারী। তিনি জানান, পরিবার নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল) নোয়াখালী প্রেস ক্লাবে আয়োজিত সাংবাদ সম্মেলনে এ অভিযোগ করেন ব্যবসায়ী আবুল বাশার পাটোয়ারী।
আবুল বাশার পাটোয়ারী জানান, দীর্ঘদিন ধরে তিনি আমিশাড়া বাজারে ফার্নিচার ও হার্ডওয়ার সামগ্রির ব্যবসা করছেন। রমজান মাস শুরুর চার-পাঁচদিন আগে দোকানের সার্টার খুলে দেখেন ভেতরে একটি চিঠি। খুলে দেখেন, নাম-পরিচয় না দেওয়া এক ব্যক্তি তার কাছে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছেন। চিঠি পাওয়ার পর তিনি বাজারের অন্যান্য ব্যবসায়ীদের বিষয়টি অবহিত করেন।
আরো পড়ুন:
ছিনতাইয়ের ছক এক মাস আগে, রিকশাচালককে নিয়ে হয়েছিল মহড়া
মাদক প্রতিবেদন: ফেনীর সেই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা
গত ১৬ এপ্রিল রাতে নাম না জানা ব্যক্তি তার দোকানে তালা লাগিয়ে দেন। পরদিন সকালে তিনি দোকানে গিয়ে তালা দেখে এ বিষয়ে সোনাইমুড়ী থানায় লিখিত অভিযোগ করেন।
আবুল বাশার পাটোয়ারী জানান, পুলিশ তদন্ত করতে গিয়ে সিসিটিভির ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করে দেখে, আমিশাপাড়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মো. কামাল তার সহযোগীদের নিয়ে দোকানে তালা দিয়েছেন। পরে পুলিশ কামালকে থানায় ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি তালা দেওয়ার ঘটনা স্বীকার করেন। তবে, পুলিশ তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়নি।
তিনি আরো জানান, এরপর থেকে কামাল হোসেন নানাভাবে হুমকি দিয়ে বেড়াচ্ছেন। বর্তমানে তিনি পরিবার পরিজন নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তিনি এ বিষয়ে জেলা পুলিশ সুপারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
চাঁদা দাবির বিষয়টি অস্বীকার করে মো. কামাল জানান, তিনি দোকানে তালা দিয়েছেন এটা যেহেতু তারা সিসিটিভির ফুটেজে দেখেছে এ বিষয়ে তিনি কিছু বলবেন না। তবে, আবুল বাশার পাটোয়ারীদের সঙ্গে পারিবরিক বিষয় নিয়ে পূর্বের বিরোধ রয়েছে। তাদের দায়ের করা একটি মামলায় ২০০৯ সালে তিনি কারাগারে ছিলেন। ওই বিরোধের জেরে ক্ষোভ থেকে তিনি দোকানে তালা দিয়েছেন বলেও জানান।
তিনি আরো জানান, তিনি স্থানীয়ভাবে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। আগামীতে তিনি আমিশাপাড়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হওয়ার চেষ্টা করছেন। তাকে সামাজিকভাবে হেয় করার জন্য মিথ্যা অভিযোগ করা হচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি।
সোনাইমুড়ী থানার ওসি মো. মোরশেদ আলম বলেন, “প্রাথমিক তদন্তে দোকানে তালা দেওয়ার ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে। অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে আবুল বাশারের পূর্ব বিরোধ ও মামলা রয়েছে। আবুল বাশার থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন। অভিযোগের বর্ণনায় একটি অংশ নিয়ে তার আপত্তি থাকায় সেটি আর মামলা হিসেবে রুজু করা হয়নি। পরে ওই ব্যক্তিকে আদালতে মামলা করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।”
ঢাকা/সুজন/মাসুদ