বিএনপির অবস্থান কি গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাবিরোধী?
Published: 5th, April 2025 GMT
রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের কমিশনগুলোর প্রস্তাবাবলি নিয়ে বিএনপির মতামত বিভক্ত। কিছু প্রস্তাবের সঙ্গে তারা পুরোপুরি ঐকমত্য পোষণ করেছে এবং কিছুর সঙ্গে আংশিক। অন্যদিকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে দলটি অবস্থান নিয়েছে। ফলে অনেকে মনে করছেন, বিএনপি জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের দাবির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, যা গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে বেইমানির নামান্তর বলে গণ্য হচ্ছে।
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণের মূল কারণ ছিল শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকারকে উৎখাত। এ উদ্দেশ্যে সব দল-মত-গোষ্ঠীর মানুষ একত্রিত হয়েছিল। আগস্টের ৩ তারিখে শহীদ মিনারে আয়োজিত সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ‘ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা’ বিলোপের কথা তুলে ধরলেও এ জন্য কোনো কর্মপরিকল্পনা ছিল না। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি এখন দাবি করতে পারে– তারা বর্তমান প্রস্তাবিত উপায়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছে। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবগুলো ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ সাধনের একটি উপায় বটে, তবে একমাত্র নয়। তাই কমিশনের কিছু সংস্কার প্রস্তাবের সঙ্গে বিএনপি দ্বিমত প্রকাশ করায় দলটিকে গণঅভ্যুত্থানের বিপক্ষ শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করা যায় না।
সব সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার জায়গা এটি নয়। সব ধরনের বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞ জ্ঞানও লেখকের নেই। আমি এ আলোচনায় শুধু সংবিধান সংশোধনের জন্য প্রস্তাবিত গণভোট এবং সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লিখিত মূলনীতির সংশোধন সংক্রান্ত প্রস্তাব নিয়ে কথা বলব।
বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, এক কক্ষবিশিষ্ট সংসদে সংবিধান সংশোধনের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থনের পর গণভোট আয়োজনের কথা বলা হয়েছে। বিএনপি দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধনের বিরোধিতা করেনি, তবে গণভোটের শর্তের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে।
অনেকে মনে করেন, বর্তমান পদ্ধতি অনুযায়ী সংবিধান পরিবর্তন সহজ হওয়ার কারণে আওয়ামী লীগ যেনতেনভাবে নির্বাচন পরিচালনা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করেছে, যা দেশকে গভীর রাজনৈতিক সংকটে ফেলেছে। প্রশ্ন হলো, কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী সাধারণ নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার জন্য নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার রয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক সরকারের অধীনে আয়োজিত গণভোটের নিরপেক্ষতা কে নিশ্চিত করবে? সুতরাং বিএনপির গণভোটের বিরোধিতাকে গণঅভ্যুত্থানের দাবির বিরোধিতা হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। এটি বরং বাংলাদেশের বাস্তবতা বুঝে একটি বড় দলের উচিত আচরণ প্রদর্শন।
যারা বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানকে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার রক্ষক মনে করেন, তারা আসলে যে সংবিধানকে তাক করে গুলি ছোড়েন, তা পঞ্চম সংশোধনীর পূর্ববর্তী এবং পঞ্চদশ সংশোধনীর পরের সংবিধান। পঞ্চম সংশোধনীর পরে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার যে অর্থ দাঁড়ায়, তা বাংলাদেশের সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত মূলনীতিগুলোর সঙ্গে অনেকাংশে মিলে যায়। ‘জাতীয়তাবাদ’ প্রত্যয়টি এখানে শুধু বাঙালি জাতীয়তাবাদকে নির্দেশ না করে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কথা বলার কারণে তা বহুত্ববাদী মূল্যবোধকেও লালন করে। এ ছাড়া ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত স্বাধীনতার চেতনাকে সমর্থন করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত মূলনীতি অনুসরণে বিএনপির অনিচ্ছা মানে এই নয়, তারা জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে বেইমানি করছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে সংস্কারের সুপারিশ নিয়ে লিখিতভাবে দলীয় মতামত জমা দিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, সংবিধানের মূলনীতি নিয়ে প্রস্তাবনায় যে ধরনের পরিবর্তনের প্রস্তাব সংবিধান সংস্কার কমিশন দিয়েছে, তাতে তাদের কাছে মনে হয়েছে, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানকে এক কাতারে নিয়ে আসা হয়েছে। এটি জরুরি বলে দলটি মনে করে না। অন্যদিকে কারও কারও মত, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান সমগোত্রীয় না হলেও ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতা হিসেবে ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানকে দেখা যায়। তারা বলেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি শোষণ-নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে যে লড়াই হয়েছিল, তা ২০২৪ সালে দিল্লির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সঙ্গে তুলনীয়।
তাদের উদ্দেশে বলা যায়, ১৯৭৯ সালে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে জিয়াউর রহমান সংবিধানে যুক্ত করেন– ‘রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ ও জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবেন।’ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এই অনুচ্ছেদ অন্তর্ভুক্তির পেছনে মূল কারণ ছিল দিল্লির ক্ষমতা বলয় থেকে বাংলাদেশকে বের করে আনার বিষয়কে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া। এদিক থেকে ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানকে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতার বদলে বরং ১৯৭৫-এ জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণের ধারাবাহিকতা হিসেবে দেখা যায়। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতা হিসেবে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানকে উপস্থাপন করার চেষ্টাকে বিএনপি ঐতিহাসিক ভুল বলে মনে করলে সেটাকে গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার বিরোধী শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা যৌক্তিক হবে না।
সংস্কার সম্পর্কিত আলোচনায় বিএনপিকে অন্তর্বর্তী সরকারকে আস্থায় নেওয়া আবশ্যক। এই আস্থা অর্জনের লক্ষ্যে দলটিকে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদসীমাসহ তাদের অন্যান্য সংস্কার প্রস্তাব কেন সংস্কার কমিটির প্রস্তাবের চেয়ে উত্তম বা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপে অধিকতর সহায়ক– তা স্পষ্ট করতে হবে।
বিএনপি এবং অন্যান্য ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলের জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় অংশগ্রহণ এবং আগামীতে আরও অংশ নেওয়ার আশ্বাস আমাদের আশাবাদী করে তুলেছে। এর ফলে একটি ঐক্যবদ্ধ সমঝোতায় পৌঁছানোর সম্ভাবনা জেগেছে, যা থেকে সবার মালিকানাধীন একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার ভিত্তি তৈরি হবে। এই সময়ে বাংলাদেশের জনগণের রাষ্ট্রের মালিকানার অনুভূতি তীব্রভাবে প্রয়োজন, যা তাদের রাষ্ট্র গড়ার কাজে আরও সক্রিয় করবে।
ড.
কাজী এ এস এম নুরুল হুদা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক
[email protected]
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র গণঅভ য ত থ ন র ধ র ব হ কত প রস ত ব র প রস ত ব ত ব এনপ র ব যবস থ র জন য গণভ ট সরক র আগস ট
এছাড়াও পড়ুন:
চূড়ান্ত পরাজয়ের আগে বুদ্ধিজীবী হত্যা
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর শিক্ষাবিদ ও নাট্যকার মুনীর চৌধুরীকে দুপুরে খেতে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তাঁর মা আফিয়া বেগম। দরজার কাছে একদল লোক এসে বলল, ‘আমাদের সঙ্গে একটু যেতে হবে।’ তিনি আর ফিরে আসেননি। একই দিনে আড়াই মাসের সন্তান কোলে নিয়ে বসে ছিলেন তরুণ বিজ্ঞানী মো. আমিনউদ্দিন। তিনি বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (সায়েন্স ল্যাবরেটরি) ঊর্ধ্বতন গবেষণা কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁকে নেওয়া হলো তাঁরই গামছা দিয়ে চোখ বেঁধে। আমিনউদ্দিনও আর ফেরেননি। সাংবাদিক নিজামুদ্দীন আহমদকেও এভাবেই তুলে নেওয়া হয়েছিল সন্তানদের সামনে থেকে। রশীদ হায়দার সম্পাদিত এবং বাংলা একাডেমি প্রকাশিত স্মৃতি: ১৯৭১ বইয়ে জানা যায় তাঁদের মতো আরও বহু শহীদ বুদ্ধিজীবীর শেষ সময়ের ঘটনার স্মৃতি। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্বজনদের লেখায় মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত
বিজয়ের সঙ্গে একাকার হয়ে যায় বেদনাময় স্মৃতির আরেক ইতিহাস।
বুদ্ধিজীবীদের যে বেছে বেছে ঘর থেকে তুলে নিয়ে পাকিস্তানিরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে, তা জানা গিয়েছিল বিজয় অর্জনের পরপরই। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকায় ছিলেন মার্কিন সাংবাদিক পিটার আর কান। তাঁর সে সময়ের দিনপঞ্জি পরে ছাপা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল পত্রিকায়। তাতে ১৮ ডিসেম্বর পিটার লিখেছিলেন, ‘আজকের দিনের প্রথম ভাগে মুক্তিরা বিখ্যাত বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের গণকবর খুঁজে পান, যাঁদের স্থানীয় সামরিক বাহিনীর সদস্যরা জিম্মি করেছিল এবং গত দিনের আগের রাতে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ঐতিহ্যগতভাবে এটি একটি রক্তরঞ্জিত সমাজ, যেটি সদ্যই ৯ মাসের রক্তগঙ্গার মধ্য দিয়ে গেছে।’
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহর থেকে বিজয়ের আগমুহূর্ত পর্যন্ত বহু বরেণ্য বুদ্ধিজীবীকে এভাবে আমরা হারিয়েছি। বহুল পরিচিতদের মধ্যে আছেন গোবিন্দচন্দ্র দেব, মুনীর চৌধুরী, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, রাশীদুল হাসান, আবুল খায়ের, আনোয়ার পাশা, সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সার, আলতাফ মাহমুদ, নিজামুদ্দীন আহমদ, গিয়াসউদ্দিন আহমদ, ফজলে রাব্বী, আলীম চৌধুরী, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, সেলিনা পারভীন প্রমুখ। তাঁদের বাইরেও আছেন অনেকে। বুদ্ধিজীবীদের এই হত্যাযজ্ঞে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করে আলবদর বাহিনীসহ বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী একটি গোষ্ঠী।
ডিসেম্বরে বাংলাদেশের বিজয় যখন আসন্ন, তখন অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। তবে মুক্তিযুদ্ধের পুরো ৯ মাস ধরেই দেশের প্রতিটি অঞ্চলে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়।
দেশজুড়ে হত্যাযজ্ঞপিরোজপুরে সাঈফ মীজানুর রহমানকে জিপের পেছনে বেঁধে গোটা পিরোজপুর শহর ঘুরিয়েছিল পাকিস্তানি সেনারা। পরে তাঁকে গুলি করে বলেশ্বর নদে ফেলে দেওয়া হয়। ম্যাজিস্ট্রেট ও ট্রেজারি কর্মকর্তা সাঈফ ট্রেজারি থেকে টাকা আর অস্ত্র তুলে দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। ছাত্র অবস্থায় ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফজলুল হক ছাত্র সংসদের সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক।
সিলেটের লাক্কাতুরা চা-বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপক ছিলেন সৈয়দ সিরাজুল আব্দাল। তাঁর শরীর থেকে রক্ত টেনে বের করে নেওয়া হয়েছিল। এর সাক্ষী ছিলেন সিলেটের পুরোনো পত্রিকা যুগভেরীর সম্পাদক আমিনূর রশীদ চৌধুরী। সিরাজুল আব্দালের পরিবার ফেরত পেয়েছিল একটি কঙ্কাল। আবদাল পাকিস্তানি সেনাদের কাছে প্রথম রোষে পড়েছিলেন বাংলা বর্ণমালার ছোট্ট একটা বই ছাপার সূত্র ধরে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মীর আবদুল কাইয়্যুমের বাড়িতে কিছু লোক এসে বলেছিল, ‘স্যার, একটু বাইরে আসবেন?’ স্ত্রী মাসতুরা খানমের নিষেধ অমান্য করে তিনি দরজার বাইরে গিয়েছিলেন। আর ফিরে আসেননি।
এভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনা ঘটেছে মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাসজুড়ে। প্রথমা প্রকাশনের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী: স্মৃতি জীবন যুদ্ধ বইয়ে সংকলিত হয়েছে ৩৫৪ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর পরিচিতি ও মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের অবদানের কথা। এই সংকলন থেকে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় যে ঢাকার বাইরেও সমানভাবে চলেছে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। মানিকগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁসহ আরও কয়েকটি জেলায় প্রাণহারানো বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা অনেক।
দেশব্যাপী পরিচালিত ৯ মাসের গণহত্যায় অগণিত মানুষের প্রাণদানের সীমাহীন ট্র্যাজেডিতে ভয়াবহ মাত্রা যোগ করেছিল বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড। এর কোনো সামরিক কার্যকারণ ছিল না, ছিল বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে প্রবল আক্রোশ। যাঁরা স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাঁদের হত্যা করে দেশটির ভবিষ্যৎকে মেধাশূন্য করে দিতে চেয়েছিল পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা।
তাঁরা কতজনমুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত চার পর্বে ৫৬০ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম প্রকাশ করেছে। প্রথম দফায় ১৯১, দ্বিতীয় তালিকায় ১৪৩, তৃতীয় দফায় ১০৮ জন এবং চতুর্থ দফায় ১১৮ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নামের গেজেট প্রকাশ করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। তবে গবেষকেরা বলেন, এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি। গত বছরের মার্চে চতুর্থ দফার পর আর কোনো তালিকা প্রকাশিত হয়নি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের মধ্যে কতজন বুদ্ধিজীবী ছিলেন, তার সঠিক সংখ্যা এখনো পাওয়া যায় না। তালিকায় যাঁদের নাম জানা যায়, তাঁদের অধিকাংশই শহরকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী শ্রেণির মানুষ।
২০১৩ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের মামলায় জবানবন্দিতে জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সাক্ষ্য দিয়ে বলেছিলেন, ‘একাত্তরের আগস্টে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। ডিসেম্বরে আলবদর বাহিনী এই পরিকল্পনা কার্যকর করতে শুরু করে। প্রকাশিত তথ্যমতে, মঈনুদ্দীন এই হত্যাকাণ্ড পরিচালনার দায়িত্বে এবং আশরাফুজ্জামান এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন।’
এ প্রসঙ্গে বারবার উঠে আসে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের প্রধান জেনারেল রাও ফরমান আলীর একটি তালিকার কথা। স্বাধীনতার পর বঙ্গভবন থেকে রাও ফরমান আলীর যে ডায়েরি পাওয়া যায়, তাতে নিহত ও জীবিত বুদ্ধিজীবীদের একটি তালিকা ছিল। স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ওয়েবসাইট ‘সংগ্রামের নোটবুক’-এর একটি অনলাইন পেজের ছবিতে দেখা যায়, রাও ফরমান আলীর হাতে লেখা বুদ্ধিজীবীদের নামের তালিকায় আছে মুনীর চৌধুরীসহ আরও বহু বুদ্ধিজীবীর নাম।
তাঁদের অবদানআনোয়ার পাশার রাইফেল রোটি আওরাত উপন্যাস, মুনীর চৌধুরীর কবর নাটক কিংবা আলতাফ মাহমুদের ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানের সুর বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্রটির সঙ্গে মিলেমিশে আছে।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী: স্মৃতি জীবন যুদ্ধ বইয়ের ভূমিকায় লেখা হয়েছে, ‘আমাদের বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন মেধাবী। মেধার চেয়েও বড় আরেকটা বিপজ্জনক অস্ত্র তাঁদের ছিল: বিবেক। বিবেকের ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন তাঁরা। নিজেরাই হয়ে উঠেছিলেন জাতির বিবেকের কণ্ঠস্বর। তাঁরা অসাম্প্রদায়িক বৈষম্যমুক্ত আধুনিক প্রগতিশীল দেশ চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন মানুষের অধিকারের প্রতিষ্ঠা।’
সেই যে আমাদের শ্রেষ্ঠ মানুষদের আমরা হারালাম, সেই ক্ষতি আজও পোহাতে হচ্ছে জাতিকে। এ ক্ষতি কোনো দিন পূরণ হবে না, হবেও না।
তথ্যসূত্র
১. স্মৃতি: ১৯৭১ (প্রথম খণ্ড), সম্পাদক: রশীদ হায়দার, বাংলা একাডেমি, ২০১৭
২. ‘মার্কিন সাংবাদিকের মুক্তিযুদ্ধের ঢাকা ডায়েরি’, প্রথম আলো, ১৬ ডিসেম্বর ২০২১
৩. মুক্তিযুদ্ধের ১০টি তারিখ, সম্পাদক: সাজ্জাদ শরিফ, প্রথমা প্রকাশন, ২০২০
৪. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী: স্মৃতি জীবন যুদ্ধ, সম্পাদক: আনিসুল হক, প্রথমা প্রকাশন, ২০২৪
৫. ‘বাবাকে ওরা তুলে নিয়ে গেল’, মেজর (অব.) সৈয়দ জামিল আব্দাল, প্রথম আলো, ১৫ এপ্রিল ২০২৩
৬. ‘স্যার, একটু বাইরে আসবেন’, মাহবুবা কানিজ, দ্য ডেইলি স্টার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২০