পরিবেশকে খারাপ করে এমন বক্তব্য এড়িয়ে চলাই সর্বোত্তম
Published: 4th, April 2025 GMT
ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক খারাপ হয়, এমন বক্তব্য পরিহার করার আহ্বান জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। পরিবেশকে খারাপ করে এমন বক্তব্য এড়িয়ে চলাই সর্বোত্তম। শুক্রবার দুপুরে ব্যাংককের সাংরিলা হোটেলে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদি বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি এ কথা জানান।
থাইল্যান্ডের রাজধানীতে ষষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন শেষে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে বিক্রম মিশ্রি বক্তব্য দেন। এরপর তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে প্রথমবারের মতো বৈঠকে তিনি এ আহ্বান জানান। নরেন্দ্র মোদি আশা প্রকাশ বলেন, ভবিষ্যতে ভারত এমন এক গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্থিতিশীল বাংলাদেশ দেখতে চায়, যেখানে নির্বাচনের একটি ভূমিকা রয়েছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, নয়াদিল্লি সবসময় ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ককে ‘সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার’ দিয়েছে। দুই প্রতিবেশীর ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত, বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে সম্পর্কিত। ভারত সর্বদা একটি প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশকে সমর্থন করে। ভারত বাংলাদেশের কোনো নির্দিষ্ট দলকে সমর্থন করে না। আমাদের সম্পর্ক জনগণের সঙ্গে জনগণের।
বিক্রম মিশ্রি জানান, সীমান্তে আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং অবৈধ সীমান্ত অতিক্রম প্রতিরোধ, বিশেষ করে রাতে সীমান্ত অতিক্রম ঠেকানো সীমান্ত নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় বলে উল্লেখ করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক পর্যালোচনা এবং এগিয়ে নেওয়ার জন্য দুই দেশের প্রতিনিধিরা বৈঠক করতে পারেন বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রত্যপর্ণের বিষয়ে অধ্যাপক ইউনূস অনুরোধ করেছেন কিনা জানতে চাইলে বিক্রম মিশ্রি বলেন, শেখ হাসিনার যে বিষয়টি আর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যে অনুরোধ এসেছে, সে বিষয় নিয়ে কথাবার্তা হয়েছিল। আর আমাদের যে মুখপাত্র, তিনি এই বিষয়ে আপনাদের অবগত করেছেন। আমাদের কাছে এ বিষয়ে একটি আবেদন এসেছিল। তা নিয়ে আর কিছু বলা আমার এখন সমীচীন হবে না।
বিক্রম মিশ্রি বলেন, বাংলাদেশে হিন্দুসহ সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিয়ে ভারতের উদ্বেগের কথা তুলে ধরেছেন নরেন্দ্র মোদি। এছাড়া বাংলাদেশে নির্বাচনের বিষয়ে আলোচনা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বিক্রম মিশ্রি বলেন, ‘যেকোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিয়মিত অন্তর্ভক্তিমূলক নির্বাচন খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার। আমাদের প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়েও অধ্যাপক ইউনূসকে অবগত করেছেন। জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে আমরা একটি গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্থিতিশীল বাংলাদেশ দেখতে পাব। এ ব্যাপারে নির্বাচনের একটি ভূমিকা আছে, তা সবাই জানেন।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স ম ন ত হত য গণত ন ত র ক আম দ র কর ছ ন ইউন স
এছাড়াও পড়ুন:
ভবদহের জলাবদ্ধতা সমস্যার স্থায়ী সমাধান কী
পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান আরও দুজন উপদেষ্টাসহ সম্প্রতি যশোরের ভবদহ এলাকা পরিদর্শন করেছেন এবং এই এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে গৃহীত কিছু দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের কথা জানিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে আমডাঙ্গা খালের পুনঃখনন, যার ফলে জলাবদ্ধ এলাকার কিছু অংশের পানি নদীতে সরে যাওয়ায় সেই এলাকায় ধান চাষ সম্ভব হচ্ছে। উপদেষ্টা আরও জানান যে এই এলাকার জলাবদ্ধতার ‘চিরস্থায়ী’ সমাধানের জন্য সরকার একটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা (ফিজিবিলিটি স্টাডি) শুরু করেছে।
এটা ভালো উদ্যোগ। তবে অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে যে শুধু পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ওপর নির্ভর করে ভবদহের জলাবব্ধতা সমস্যার সঠিক সমাধান নির্ণয় করা সম্ভব নয়। কারণ, এ সমস্যার সৃষ্টিই হয়েছে পাউবো কর্তৃক অতীতে বাস্তবায়িত ‘উপকূলীয় বাঁধ প্রকল্প’ দ্বারা।
২.নদ–নদী ও পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে পাউবো যেসব ভ্রান্ত চিন্তাভাবনা দ্বারা এযাবৎ পরিচালিত হয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে ভবদহের জলাবদ্ধতার বিষয়ে নতুন প্রকল্প প্রণয়নের উদ্যোগ সফল হবে না। প্রয়োজন সব অংশীজনকে অন্তর্ভুক্ত করে উন্মুক্ত আলোচনার মাধ্যমে সমাধান নির্ণয়ের চেষ্টা করা।
নদ–নদী শুধু প্রকৌশলীদের বিষয় নয়, বরং এটি একটি বহুমাত্রিক বিষয়। এ বিষয়ে বিভিন্ন শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞদের এবং সর্বোপরি জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রয়োজন। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই পাউবো বিদেশি সংস্থা ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ দ্বারা পরিচালিত হয়েছে এবং বিদেশিদের ভ্রান্ত পরামর্শের বিরুদ্ধে স্বাধীন, দেশজ চিন্তা এবং দেশপ্রেমিক অবস্থান নিয়ে দাঁড়ানোর সক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারেনি।
পঞ্চাশের দশকেই খাদ্য এবং কৃষি সংস্থার (এফএও) উদ্যোগে এবং বিশ্বব্যাংকের সমর্থনে ‘উপকূলীয় বাঁধ প্রকল্প’ গৃহীত হয়। উদ্দেশ্য ছিল উপকূলীয় অঞ্চলে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করা। সেই লক্ষ্যে তাদের ধারণা হয় যে বাংলাদেশকে রাইন নদীর বদ্বীপে অবস্থিত নেদারল্যান্ডসের পথ-পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। সে জন্য নেদারল্যান্ডসের এক অধ্যাপককে স্থায়ী পরামর্শক হিসেবে নিয়ে আসা হয় এবং বাংলাদেশের ওপর নেদারল্যান্ডসের মতো পোল্ডার কর্মসূচি চাপিয়ে দেওয়া হয়।
মধ্যযুগ থেকেই নেদারল্যান্ডসের জনগণ রাইন নদীর মোহনায় পিট কয়লা আহরণের জন্য অগভীর সমুদ্রে পোল্ডার নির্মাণ শুরু করে। কয়লা উত্তোলিত হওয়ার পর তারা এসব পোল্ডারে বসতি স্থাপন করে, যে কারণে এখন নেদারল্যান্ডসের এক-চতুর্থাংশের বেশি ভূমি সমুদ্রসীমার নিচে এবং তাতে সে দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নাগরিক বসবাস করেন।
৩.ভূমি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে বাংলাদেশে পোল্ডারের কোনো প্রয়োজন ছিল না। বাংলাদেশে বরং নদীবাহিত পলিবালুর কারণে প্রতিবছর প্রায় ১৯ বর্গকিলোমিটার ভূমি বঙ্গোপসাগরের গর্ভ থেকে ওপরে উঠে আসছে।
বাংলাদেশে পোল্ডারের পক্ষে একটি যুক্তি দেওয়া হয়েছিল যে এর ফলে জোয়ারের লোনাপানি জমিতে ঢুকতে পারবে না এবং তার ফলে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। তবে বাংলাদেশের জনগণ এ সমস্যার সমাধান বহু আগেই উদ্ভাবন করেছিলেন।
■ নদ-নদী ও পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে পাউবো যেসব ভ্রান্ত চিন্তাভাবনা দ্বারা এযাবৎ পরিচালিত হয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে ভবদহের জলাবদ্ধতার বিষয়ে নতুন প্রকল্প প্রণয়নের উদ্যোগ সফল হবে না। ■ বাংলাদেশের বিশেষ পরিস্থিতির জন্য উপযোগী অষ্টমাসী বাঁধনির্ভর দেশজ সমাধান সম্পর্কে নেদারল্যান্ডসের বিশেষজ্ঞদের বিশেষ কোনো জ্ঞান ছিল না। তাদের পক্ষে এই সমাধানের মূল্য হৃদয়ঙ্গম করাও কঠিন ছিল। ■ বাংলাদেশের জন্য উপযোগী হলো উন্মুক্ত পন্থা, যাতে প্লাবনভূমি এবং জোয়ারভূমি নদ-নদীর প্রতি সাধারণভাবে উন্মুক্ত থাকে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী অস্থায়ী অষ্টমাসী বাঁধ ব্যবহার করা হয়।এর নাম হলো ‘অষ্টমাসী বাঁধ’। তাঁরা শুষ্ক মৌসুমের আট মাসের জন্য নদ–নদীর মুখে অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করতেন, যাতে জোয়ারের লোনাপানি জমিতে ঢুকতে না পারে। বর্ষার চার মাসের সময় তাঁরা এসব বাঁধ সরিয়ে ফেলতেন। এ সময় নদীর প্রবল প্রবাহের কারণে জোয়ারের লোনাপানি ঢুকতে পারত না; বরং নদীর পানি পলিবালুসহ ঢুকে উপকূলের জমির উচ্চতা বৃদ্ধি করত।
অষ্টমাসী বাঁধনির্ভর পানি ও পলি ব্যবস্থাপনার এই পদ্ধতির জন্য যৌথ প্রয়াসের প্রয়োজন হতো। ব্রিটিশ-পূর্ব বাংলাদেশের জমিদারেরা এ বিষয়ে যত্নবান ছিলেন। তা ছাড়া পঞ্চায়েতভিত্তিক গ্রামের যে স্বশাসনব্যবস্থা বাংলাদেশে প্রচলিত ছিল, তার মাধ্যমে গ্রামের জনগণ এসব যৌথ প্রয়াস সংগঠিত করতে পারতেন।
ব্রিটিশ আমলে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের’ মাধ্যমে যে নতুন বেনিয়া জমিদার শ্রেণির উদ্ভব ঘটে, তাদের বেশির ভাগই কলকাতা শহরে অবস্থান করত। ফলে স্থানীয় সমস্যাগুলোর প্রতি তাঁদের তেমন মনোযোগ ছিল না। অন্যদিকে ব্রিটিশ আমলে পঞ্চায়েত ব্যবস্থারও অবক্ষয় ঘটে। এর ফলে যৌথ প্রয়াস সংগঠনের জন্য গ্রামের অভ্যন্তরের স্বশাসন কাঠামোও হারিয়ে যায়।
বাংলাদেশের বিশেষ পরিস্থিতির জন্য উপযোগী অষ্টমাসী বাঁধনির্ভর দেশজ সমাধান সম্পর্কে নেদারল্যান্ডসের বিশেষজ্ঞদের বিশেষ কোনো জ্ঞান ছিল না। তাঁদের পক্ষে এই সমাধানের মূল্য হৃদয়ঙ্গম করাও কঠিন ছিল। কারণ, তাঁদের রাইন নদীতে কোনো পলিবালু নেই এবং রাইন নদীর পানিপ্রবাহের কোনো ঋতুভেদও নেই।
এর ফলে এটা আশ্চর্যের বিষয় নয় যে নেদারল্যান্ডসের বিশেষজ্ঞরা অষ্টমাসী বাঁধের পুনরুজ্জীবনের পরিবর্তে বাংলাদেশের ওপর স্থায়ী বাঁধনির্ভর পোল্ডার পদ্ধতি চাপিয়ে দেন। বাংলাদেশের দেশীয় বিশেষজ্ঞ এবং কর্মকর্তারাও সোৎসাহে সেই পথে অগ্রসর হন।
যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রানসিসকো শহরে অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি প্রণীত ১৯৬৪ সালের মাস্টার প্ল্যানে ৭৩টি পোল্ডারের প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। ক্রমান্বয়ে এর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১৩৯। শুধু তা–ই নয়, এই পোল্ডার পদ্ধতি উপকূলের জন্য সীমাবদ্ধ না রেখে সারা দেশের জন্য গৃহীত ও বাস্তবায়িত হয়। এভাবে ‘পোল্ডার ব্যাধি’ ক্যানসারের মতো সারা দেশে ক্রমেই বিস্তৃত হতে থাকে।
শুরুর দিকে পোল্ডার পদ্ধতিকে সফল বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এগুলোর নেতিবাচক ফল ক্রমেই স্পষ্ট হতে থাকে। একদিকে পোল্ডারের ভেতরে পলিবালু ঢুকতে না পারায় এগুলোর ভূমি-উচ্চতা কমতে থাকে; অন্যদিকে পোল্ডারের ভেতরে ঢুকতে না পেরে পলিবালু বেশি হারে নদী খাতে পড়ে নদী খাত ভরাট করে ফেলে। ফলে নিষ্কাশনের জন্য পোল্ডারের বাঁধগুলোয় যেসব স্লুইসগেট ও ফ্ল্যাপগেট নির্মিত হয়েছিল, সেগুলো বদ্ধ হয়ে যায় এবং জলাবদ্ধতার উদ্ভব ঘটে।
এভাবেই ২৪ নম্বর পোল্ডারে অবস্থিত ভবদহ এলাকায় জলাবদ্ধতা চরম রূপ নেয়। এ এলাকায় হরি নদের ওপর নির্মিত ৯ এবং ২১ কপাটবিশিষ্ট দুটি রেগুলেটর সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে যায় এবং হরি নদের তলদেশ ভরাট হয়ে রাস্তার সমান হয়ে যায়। রেগুলেটর দুটি অপসারণ করে হরি নদকে অবমুক্ত করা হয়নি। এর পরিবর্তে স্থানীয় জনগণ যাতে নিজেরাই এসব রেগুলেটর অপসারণ না করে, সে জন্য এগুলোর পাশে বিশেষ পুলিশ ফাঁড়ি বসানো হয়েছে। এভাবেই জলাবদ্ধতাকে স্থায়ী করা হয়েছে!
জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এলাকার জনগণ বিভিন্ন স্থানে নিজ উদ্যোগে পোল্ডারের বাঁধ কেটে দেন। কয়েকটি স্থানে তাঁরা দেখান যে বাঁধ কেটে জোয়ারের পানি ভেতরের বিলে প্রবেশ করতে দিলে বিলে পলিপতন ঘটে এবং ভাটার সময় এই পলিবিহীন পানি সমুদ্রে ফিরে যাওয়ার পথে নদীবক্ষের পলি অপসারণ করে এবং তার ফলে জলাবদ্ধতা দূর হয়।
কিন্তু পাউবোর প্রকৌশলীরা জনগণের কাছ থেকে কিছু শিখতে তেমন আগ্রহী ছিলেন না। তবে পরে যখন বিদেশি পরামর্শকেরা এই পদ্ধতির বিষয়ে উৎসাহিত হন, তখন তাঁরা এর ভিত্তিতে ‘জোয়ার নদী ব্যবস্থাপনা’ (ইংরেজিতে টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট, সংক্ষেপে টিআরএম) নাম দিয়ে কয়েকটি প্রকল্প গ্রহণ করেন।
কিন্তু টিআরএম পোল্ডার-সৃষ্ট জলাবদ্ধতার সামগ্রিক ও স্থায়ী সমাধান দিতে পারে না। কারণ, এই সমাধান নির্ভর করে এলাকায় বিলের উপস্থিতির ওপর। যেসব এলাকায় বিল নেই, সেখানে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায় না। দ্বিতীয়ত, বিলসম্পন্ন এলাকায়ও এই পদ্ধতি দীর্ঘকাল কাজ করতে পারে না। কারণ, অচিরেই বিল ভরাট হয়ে যায়।
৪.যশোর ও খুলনার জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধানের জন্য প্রয়োজন পোল্ডার পদ্ধতি পরিত্যাগ করা। এই পদ্ধতি নদ–নদীর প্রতি বেষ্টনী পন্থার একটি চরম রূপ যখন একটি এলাকার চারদিকে বেষ্টনী (বেড়িবাঁধ) নির্মিত হয়। বাংলাদেশের জন্য উপযোগী হলো উন্মুক্ত পন্থা, যাতে প্লাবনভূমি এবং জোয়ারভূমি নদ–নদীর প্রতি সাধারণভাবে উন্মুক্ত থাকে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী অস্থায়ী অষ্টমাসী বাঁধ ব্যবহার করা হয়।
জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধানের জন্য দুটি পরস্পর–সম্পর্কিত পরিবর্তন আনতে হবে:
প্রথমত, পোল্ডারের ভেতরের পুরো এলাকাকে বর্ষাকালে নদীর পানির বিস্তৃত হওয়ার জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে। এর জন্য আবাসন ও জমিবিন্যাসের পরিবর্তন প্রয়োজন হবে এবং নিজেদের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের বিবেচনা করে জনগণকে এ ধরনের পরিবর্তনে সম্মত হতে হবে।
দ্বিতীয়ত, এ এলাকায় প্রবাহিত ভৈরব, মাথাভাঙ্গা, নবগঙ্গা, কপোতাক্ষ, বেতনা, কুমার, চিত্রা, গড়াই, মধুমতী, ফালকি,ইত্যাদি ছোট-বড় সব নদী খনন করতে হবে, যাতে গঙ্গার বর্ষাকালীন প্রবাহ এসব নদীতে পৌঁছায়।
বর্তমানে নদী খননের সাফল্যের পথে একটি বড় বাধা হলো খননকৃত মাটি নিক্ষেপের জন্য উপযুক্ত স্থান খুঁজে পাওয়া। ঠিকাদারেরা সাধারণত নদীর পাড়েই মাটি ফেলেন এবং তা বৃষ্টিতে দ্রুতই আবার নদীবক্ষে ফিরে গিয়ে খননকে অকার্যকর করে দেয়। সুতরাং খনন করা মাটির উপযোগী ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
এর সহজ উপায় হলো নদী অববাহিকার সব গ্রামের ভিটি এবং কৃষিজমির পাটাতন ক্রমাগতভাবে উঁচু করার জন্য খননসৃষ্ট মাটি ব্যবহার করা। লক্ষণীয়, নদী খননকাজ প্রায় সাংবাৎসরিকভাবে করতে হবে এবং সে কারণে বসতভিটা ও কৃষিজমির উচ্চতা বৃদ্ধিকেও একটি অব্যাহত করণীয় হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।
এই বিশাল কর্মযজ্ঞ শুধু ওপর থেকে সরকারের পক্ষে করা সম্ভব নয়। নিচ থেকে জনগণকে পরিপূরক ভূমিকা পালন করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন হবে গ্রামের সব প্রাপ্তবয়স্কের ভোটে নির্বাচিত ‘অরাজনৈতিক’ গ্রাম পরিষদ। এই পরিষদের করণীয় হবে গ্রামের কল্যাণের জন্য সব ধরনের যৌথ প্রয়াস সংগঠিত করা, যার অন্যতম হবে নদ–নদীর পানি এবং পলি ব্যবস্থাপনা।
নদীবাহিত পলিবালু জলবায়ু পরিবর্তনসৃষ্ট নিমজ্জনের বিরুদ্ধে টিকে থাকার জন্য বাংলাদেশের সবচেয়ে কার্যকর বর্ম হিসেবে কাজ করতে পারে। বাংলাদেশের সবাইকে এই ‘বর্ম’ ব্যবহারের নিরন্তর সংগ্রামে শরিক হতে হবে। নদী খননসৃষ্ট মাটি ব্যবহার করে গ্রামের বসতভিটা ও কৃষিজমির উচ্চতা বৃদ্ধি বাংলাদেশের জন্য একটি ‘দুই দিক থেকেই উপকারী’ (ইংরেজিতে যাকে বলে ‘উইন-উইন’) সমাধান দিতে পারে।
সবশেষে ভারতের কাছ থেকে গঙ্গার ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে হবে। ১৯৯৬ সালের চুক্তিতে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের প্রাপ্য ন্যূনতম প্রবাহসংক্রান্ত কোনো ‘গ্যারান্টি ক্লজ’ না থাকায় ভারত এই প্রবাহের পরিমাণ প্রায় শূন্যে নিয়ে এসেছে। এই এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসন, নদী ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবন এবং সুন্দরবন রক্ষার জন্য আগামী বছর গঙ্গার পানিচুক্তি নবায়নের সময় গঙ্গার ওপর বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায়ও জোর দিতে হবে।
যশোরের জলাবদ্ধতা কিংবা খুলনা বিভাগের নিমজ্জনের সমস্যার সমাধান শুধু পাউবোর ড্রয়িং বোর্ডে পাওয়া যাবে না। এ সমাধান খুঁজতে হবে গণ-আলোচনা এবং জন-উদ্যোগের মধ্যে। এর জন্য আরও প্রয়োজন হবে ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি থেকে গণকল্যাণ অভিমুখী রাজনীতিতে উত্তরণ।
[এসব বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনার জন্য উৎসাহীরা দেখুন লেখকের সম্প্রতি প্রকাশিত গ্রন্থ ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ: পাস্ট প্রেজেন্ট অ্যান্ড ফিউচার (২০২২) এবং বাংলাদেশে পানি উন্নয়ন: বিদ্যমান ধারার সংকট এবং বিকল্প পথের প্রস্তাব]
●ড. নজরুলইসলাম এশীয় প্রবৃদ্ধি গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও জাতিসংঘের উন্নয়ন গবেষণার সাবেক প্রধান