২৬ মার্চ ২০২৫, ভোরবেলা উঠেই দৌড়াতে হলো পিজি হাসপাতালে নানুকে (সন্জীদা খাতুন) গোসল করানোর জন্য। অনেক বছর আগে নানু বলে গেছিল তার মৃত্যুর পর যেন আমি আর তিন্নি (নানুর সবচেয়ে বড় বোনের নাতনি) তাকে গোসল করাই। বিষয়টাকে আমি বিশেষ গুরুত্ব দিইনি। কারণ, নানুর মৃত্যু যে আসতে পারে, সেই চিন্তাটাই আমার ছোট, দুর্বল মস্তিষ্ক কখনো ধারণ করতে পারেনি। কিন্তু দিনটি এল এবং পুরোটা সময় আমি হতবিহ্বল হয়ে থাকলাম।
গোসলের পর নানুকে পরানো হলো একটা লাল পাড়ের সাদা শাড়ি, কপালে লাল টিপ। এরপর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হলো ছায়ানটে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। পালিয়ে পালিয়ে থাকার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু প্রকৃতি (নানুর আরেক নাতনি, পার্থ তানভীরের মেয়ে) টেনেটুনে সামনে নিয়ে গেল। তারপর লিসা (নানুর পুত্রবধূ) ঠেলে দিল একেবারে নানুর কাছে; কারণ, আমার সঙ্গে আছে তুলা, যে তুলা দিয়ে একটু পরপর নানুর মুখ মুছে দিতে হবে আর তাড়াতে হবে মাছি। আমার সারা শরীর ভেঙে কান্না আসছিল, কিন্তু শত শত মানুষের ভিড়ে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতেও পারছিলাম না। এর মধ্যে একের পর এক গান হয়েই যাচ্ছে, ‘এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’, ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা…’। ‘আগুনের পরশমণি’ যখন শুরু হলো, তখন আর কান্না চেপে রাখতে পারলাম না। চেষ্টা করলাম মাথা নিচু করে যতটুকু মানুষের চোখ এড়িয়ে কাঁদা যায়। এরপরই জাতীয় সংগীত। মনে হচ্ছিল আমার সুন্দর করে সাজানো–গোছানো পৃথিবীটা কেউ হাতুড়ি ঠুকে ঠুকে ভেঙে দিচ্ছে। এত দুঃখ কেন আসে জীবনে?
আমি নানু বা মায়ের মতো শক্ত মনের মানুষ নই। কেউ একটু চোখ রাঙিয়ে তাকালেই বুক ভেঙে কান্না পায়। যখনই মন খারাপ হতো, তখনই চলে যেতাম নানুর কাছে নালিশ করতে। নানু সব সময় উৎসাহ দিত আমাকে, যেন মনের কথাগুলো লিখে ফেলি। লিখে ফেললে মনটা হালকা লাগবে। এই কৌশল যে কতবার আমার জীবনে কাজে এসেছে, তা গুণে শেষ করতে পারব না।
জীবনের চাপে, সমাজের চাপে, মানুষের চাপে অনেকবারই মন ভেঙে গেছে। যখনই ভগ্ন হৃদয়ে নানুর কাছে যেতাম, নানু বলত গান করতে। অবশ্যই আমি নানুর কথা শুনতাম না। সুতরাং আমাকে ধরেবেঁধে নতুন গান শেখাতে শুরু করত নানু।
এভাবেই জীবনের বড় দুটো দুঃসময়ে নানুর কাছে শিখেছিলাম ‘বেলা গেল তোমার
পথ চেয়ে/ শূন্য ঘাটে একা আমি, পার ক’রে লও খেয়ার নেয়ে’ আর ‘মধুর মধুর
ধ্বনি বাজে হৃদয়কমলবনমাঝে’—এই দুটি গান।
যেহেতু আমি নাচ শিখেছি জীবনের বড় একটা সময়, নাচটা ভালোই দখলে ছিল। নানু ছোটবেলা থেকেই বলত নাচতে। নিজের মতো করে নিজের জন্য নাচতে। আমি বুঝেই পেতাম না কেন আমি নিজের জন্য নাচব! নাচ তো একটা পারফর্মিং আর্ট। এর মানেই হলো নাচতে হবে মানুষকে দেখানোর জন্য, মানুষের সামনে পারফর্ম করার জন্য। একা একা কেউ নাচে নাকি? নানু বলেছিল, নাচ এমন একটা জিনিস, যেটা সুদিনে মন আরও ভালো করে দেয় আর দুর্দিনে মনের ভার কমায়। ছোটবেলায় বেশি পাত্তা দিইনি কথাগুলো। তবে যত বড় হয়েছি, যত জীবনের ভারে জর্জরিত হয়েছি, ততই বুঝতে পেরেছি নানু আসলে কী বোঝাতে চেয়েছিল। মন খারাপ থাকলে বিছানা থেকেও উঠতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু একটু কষ্ট করে বিছানা থেকে উঠে আধা ঘণ্টা নেচে ফেলতে পারলে মনে যে প্রশান্তি আসে, তা অতুলনীয়।
মা মারা যাওয়ার পর কিছুই ভালো লাগত না, খেতে পারতাম না, ঘুমাতে পারতাম না, হাসতে পারতাম না। জগৎ–সংসারের সবকিছুর ওপর জেগে উঠেছিল পরম অভিমান আর চরম রাগ। নানু তখন কোথা থেকে যেন ৩৬ হাজার টাকার অল-ইনক্লুসিভ ট্রাভেল প্যাকেজ জোগাড় করল ভুটান যাওয়ার জন্য। একরকম নিমরাজি হয়েই নানুর সঙ্গে রওনা দিলাম ভুটানের উদ্দেশে। অনেক বছর লেগেছিল বুঝতে যে সেটা কোনো আনন্দভ্রমণ ছিল না, সেটা ছিল বিষাদভ্রমণ।
ভুটানের রাজধানী থিম্পু হিমালয়ে ঘেরা একটা উপত্যকা, আর হিমালয়ের পারো নদীর তীরে পারো শহর—এই দুই জায়গায় আমরা ঘুরেছিলাম সেবার। হিমালয়ের বিশালতার মধ্যে বারবার নিজেকে হারিয়ে ফেলছিলাম আবার খুঁজেও পাচ্ছিলাম অন্য এক আমাকে। সেখান থেকেই মায়ের মৃত্যুর শোক পরিক্রম করার প্রক্রিয়া শুরু হয় আমার। তখন থেকেই জানি, মন খারাপ হলেই চলে যেতে হয় দূর কোন পাহাড়ে বা হ্রদের ধারে। পৃথিবীর বিশালতার কাছে উজাড় করে দিতে হয় মনের যত দুঃখ, আর সেখান থেকেই শুরু হয় বিষাদ থেকে উত্তরণের পথযাত্রা।
নানু আর আমি ছিলাম বিপরীত মেরুর দুটি মানুষ। আমার সঙ্গে তার এমন বন্ধুত্ব হওয়াটা খুবই রহস্যজনক। একেই কি বলে ‘বিপরীত মেরুর প্রতি আকর্ষণ’?
নানুর প্রায় কোনো গুণই পাইনি আমি। কিন্তু যা পেয়েছি তা হলো, স্বাধীনভাবে নিজের মতো করে বাঁচার অসীম স্পৃহা, নির্ভয়ে অকপটে নিজের মতটা প্রকাশ করতে পারার, আর ভিন্ন মতটা যৌক্তিক ও বস্তুনিষ্ঠভাবে শোনার চেষ্টা এবং মানুষকে গভীরভাবে ভালোবাসার শক্তি।
নানু ছিল আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু, নিরাপদ আশ্রয়। এই আশ্রয় ছাড়া বেঁচে থাকাই মুশকিল হয়ে ওঠার কথা ছিল। কিন্তু এখন বুঝতে পারি, নানু আসলে জীবনের কঠিন মুহূর্তগুলোর জন্যই সারা জীবন ধরে আমাকে প্রস্তুত করেছে। নানুর মৃত্যু আমার জন্য ছিল কঠিনতম পরীক্ষা এবং এ পরীক্ষা পার হওয়ার পথও সে-ই দেখিয়ে দিয়ে গেছে।
যত্ন করে তুলে রাখলাম দুঃখগুলো। কোনো একদিন চলে যাব কোনো এক পাহাড়চূড়ায়, সেখানে একলা বসে নানুর শেখানো গানগুলো গুনগুন করব, একটু হয়তো নাচব বা লেখার চেষ্টা করব নানুকে না বলা কথাগুলো আর মুখোমুখি হব দুঃখগুলোর।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আম র স র জন য জ বন র
এছাড়াও পড়ুন:
কীভাবে দরুদ পড়বেন
আবু হোরায়রা (রা.)-এর বর্ণনায় একটি হাদিস আছে, যাতে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের ঘর গুলিকে কবরস্থান বানিয়ো না। আমার কবরকে বানিয়ো না উৎসব-স্থান। আমার ওপর দরুদ পড়ো। তোমরা যেখানেই থাকো, তোমাদের দরুদ আমার কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ২,০৪২)
দরুদ পাঠের এই নির্দেশের পর পর সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহর রাসুলকে জিজ্ঞেস করেছেন, কীভাবে তারা দরুদ পড়বেন। আল্লাহর রাসুল (সা.) একেক সময় একেক জনকে ভিন্ন ভিন্ন রকমের দরুদ শিখিয়েছেন। কাউকে সংক্ষেপে, কাউকে বা একটু বিস্তারিত। আমরা এখানে কয়েকটি দরুদ উল্লেখ করছি।
আবদুর রহমান ইবনে আবু লাইলা (রা.) বলেন, একবার আমার সঙ্গে কা’ব ইবনে উজরার (রা.) সাক্ষাৎ হলো। তিনি বললেন, ‘আমি কি তোমাকে একটি উপহার দেব না, যা রাসুল (সা.) থেকে আমি পেয়েছি?’ আমি বললাম, ‘অবশ্যই দিন।’ তিনি বললেন, ‘আমরা রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আল্লাহর রাসুল, আপনার, আপনার পরিবারবর্গের প্রতি দরুদ কীভাবে পড়ব? আল্লাহ তো শুধু আমাদের সালাম পাঠানোর ধরন শিখিয়েছেন। তিনি বললেন, তোমরা বলো: আল্লাহুম্মা সাল্লি ‘আলা মুহাম্মাদিন্, ওয়া ‘আলা আ-লি মুহাম্মাদিন্, কামা সাল্লাইতা ‘আলা ইব্রা-হীম, ইন্নাকা হামিদুম্ মাজীদ। ওয়া বারিক ‘আলা মুহাম্মাদিন্, ওয়া ‘আলা আ-লি মুহাম্মাদিন্, কামা বারাক্তা ‘আলা আ-লি ইব্রা-হীম, ইন্নাকা হামিদুম্ মাজীদ। (অর্থ: ‘আল্লাহ, আপনি মুহাম্মদ এবং মুহাম্মদের পরিবার-পরিজনের প্রতি রহমত বর্ষণ করুন, যেমন আপনি ইব্রাহিমের প্রতি রহমত বর্ষণ করেছেন। নিশ্চয়ই আপনি প্রশংসিত, মহান। আল্লাহ, আপনি মুহাম্মদ(সা.) এবং তাঁর পরিবার-পরিজনের ওপর বরকত দিন, যেমন আপনি ইবরাহিমের পরিবার-পরিজনের ওপর বরকত দিয়েছিলেন। নিশ্চয়ই আপনি প্রশংসিত, মহান।) (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩,৩৮০)
আরও পড়ুনকেন দরুদ পাঠ করব১৫ মার্চ ২০২৫আবু হামিদ সায়িদি (রা.) বর্ণিত একটি হাদিসে আছে, লোকেরা বলল, আল্লাহর রাসুল(সা.), আপনার প্রতি কীভাবে দরুদ পড়ব? রাসুল (সা.) বললেন, তোমরা বলো: আল্লাহুম্মা সাল্লি ‘আলা মুহাম্মাদিন্, ওয়া আযওয়াজিহী ওয়া জুররিয়্যাতিহী, কামা সাল্লাইতা ‘আলা আ-লি ইব্রাহীম। ওয়া বারিক ‘আলা মুহাম্মাদিন্, ওয়া আযওয়াজিহী ওয়া জুররিয়্যাতিহী, কামা বারাক্তা ‘আলা আ-লি ইব্রাহীম। ইন্নাকা হামিদুম্ মাজীদ। (অর্থ: আল্লাহ, আপনি মুহাম্মাদ, তাঁর স্ত্রীগণ এবং তাঁর সন্তানসন্ততির ওপর রহমত বর্ষণ করুন, যেমন আপনি ইবরাহিমের পরিবার-পরিজনের ওপর রহমত বর্ষণ করেছেন। আর মুহাম্মাদ, তাঁর স্ত্রীগণ এবং সন্তানসন্ততির ওপর বরকত দিন, যেমন আপনি ইবরাহিমের পরিবার-পরিজনের ওপর বরকত দিয়েছেন। নিশ্চয়ই আপনি প্রশংসিত, মহান।) (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৪০৭)
আবু সায়িদ খুদরি (রা.) বলেন, আমরা বললাম, আল্লাহর রাসুল(সা.), আপনাকে সালাম দেওয়ার পদ্ধতি তো আমরা জেনেছি। আপনার প্রতি দরুদ কীভাবে পড়ব? তিনি বললেন, তোমরা বলো: আল্লাহুম্মা সাল্লি ‘আলা মুহাম্মাদিন্ ‘আবদিকা ওয়া রাসূলিকা, কামা সাল্লাইতা ‘আলা ইব্রাহীম। ওয়া বারিক ‘আলা মুহাম্মাদিন্ ওয়া আ-লি মুহাম্মাদ, কামা বারাক্তা ‘আলা ইব্রাহীম। (অর্থ: আল্লাহ, আপনি আপনার বান্দা ও রাসুল মুহাম্মদের ওপর রহমত বর্ষণ করুন, যেমন আপনি ইবরাহিমের ওপর রহমত বর্ষণ করেছেন। আর মুহাম্মাদ ও তাঁর পরিবারবর্গের ওপর বরকত দিন, যেমন আপনি ইবরাহিমের ওপর বরকত দান করেছেন।) (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৩৫৮)
আরও পড়ুননামাজের ভেতরে দরুদ পড়ার নিয়ম০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫আবু মাসউদ আনসারি (রা.) বর্ণিত হাদিসে রয়েছে, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, তোমরা বলো: আল্লাহুম্মা সাল্লি ‘আলা মুহাম্মাদিন্ ওয়া ‘আলা আ-লি মুহাম্মাদ, কামা সাল্লাইতা ‘আলা আ-লি ইব্রাহীম। ওয়া বারিক ‘আলা মুহাম্মাদিন্ ওয়া ‘আলা আ-লি মুহাম্মাদ, কামা বারাক্তা ‘আলা আ-লি ইবরাহীম ফিল ‘আলামীন। ইন্নাকা হামীদুম্ মজীদ। (অর্থ: আল্লাহ, মুহাম্মদ ও মুহাম্মদের পরিবারবর্গের প্রতি রহমত বর্ষণ করুন, যেমন আপনি ইবরাহিমের পরিবারবর্গের প্রতি রহমত বর্ষণ করেছেন। আর মুহাম্মাদ ও তাঁর পরিবারবর্গের ওপর বরকত দিন, যেমন আপনি ইবরাহিমের পরিবারবর্গের ওপর দুনিয়ার সকল জাতির মধ্যে বরকত দান করেছিলেন। নিশ্চয়ই আপনি প্রশংসিত ও মহিমান্বিত। আর সালাম তেমনই, যেমন তোমাদের জানা আছে।) (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৪০৫)
নবীজির (সা.) এই শেষবাক্য ‘সালাম তেমনই, যেমন তোমাদের জানা আছে’, এর মানে হলো, ‘আত্তাহিয়্যাতু’র মধ্যে যে-সালামের কথা আছে। অর্থাৎ, ‘আস্সালামু ‘আলাইকা আইয়ুহান্ নবীয়্যু, ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকা তুহু (আপনার প্রতি সালাম, হে নবী, আল্লাহর রহমত ও তাঁর বরকত আপনার প্রতি বর্ষিত হোক)। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৮৩৫; মুসলিম, হাদিস: ৪০২)
জায়েদ ইবনে খারেজা (রা.) বর্ণিত হাদিসে আছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, আমার ওপর দরুদ পড়ো, বেশি বেশি দোয়া করো এবং বলো: ‘আল্লাহুম্মা সাল্লি ‘আলা মুহাম্মাদিন্ ওয়া ‘আলা আ-লি মুহাম্মাদ (আল্লাহ, মুহাম্মদ ও মুহাম্মদের পরিবারবর্গের প্রতি রহমত বর্ষণ করুন)।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস: ১,২৯১)
নবীজির (সা.) প্রতি দরুদ পাঠের নির্দেশনা ব্যাপক। বিভিন্ন গ্রন্থে বহু দুরুদের বর্ণনা আছে। তবে বিশুদ্ধ হাদিসে যেসব শব্দে দরুদ বর্ণিত রয়েছে, সেগুলোর মাধ্যমে দরুদ পড়াই উত্তম।
আরও পড়ুনদরুদ শরিফ পড়ার ফজিলত২৩ নভেম্বর ২০২৪