সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেড়েছে সরকারের ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধের চাপ। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এমন পরিস্থিতিতে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক ঝুঁকি কমানো এবং ব্যয় সাশ্রয়ে বিদ্যমান নগদ ও ঋণ ব্যবস্থাপনা কৌশল নির্ধারণে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি ঋণ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সরকারের প্রচ্ছন্ন দায় ও এর প্রভাব এবং সম্ভাব্য ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার কৌশল নির্ধারণে সুপারিশ করবে। এ ছাড়া এ সংক্রান্ত আরও একটি কমিটির আওতা ও কার্যপরিধি সম্প্রসারণ করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সরকারের নগদ ও ঋণ ব্যবস্থাপনায় কারিগরি দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়াতে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদানে সম্প্রতি ১৩ সদস্যের নগদ ও ঋণ ব্যবস্থাপনা কারিগরি কমিটি গঠন করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ বিভাগের ঋণ ব্যবস্থাপনা শাখার যুগ্ম সচিবকে এ কমিটির সভাপতি এবং একই শাখার উপসচিবকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন সামষ্টিক অর্থনীতি অনুবিভাগ, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিরা।

কমিটির কার্যপরিধিতে বলা হয়েছে, সরকারের নগদ ও ঋণ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও আদান-প্রদানের জন্য প্রযুক্তিনির্ভর, শ্রম ও অর্থ সাশ্রয়ী পদ্ধতি নির্ধারণ ও প্রবর্তনে প্রয়োজনীয় কারিগরি সুপারিশ প্রণয়ন করবে এ কমিটি। একই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক ঝুঁকি হ্রাস এবং ব্যয় সাশ্রয়ে বিদ্যমান নগদ ও ঋণ ব্যবস্থাপনা কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ঘাটতি অর্থায়ন সংক্রান্ত নীতি-পদ্ধতি প্রণয়ন করবে।

তা ছাড়া সরকারি সিকিউরিটিজের কার্যকর প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি বাজার উন্নয়নের লক্ষ্যে কার্যক্রম, কাঠামো ও পদ্ধতি সংক্রান্ত বিষয়ে কারিগরি সুপারিশ প্রণয়ন, নগদ ও ঋণ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সরকারের প্রচ্ছন্ন দায় এবং এর প্রভাব এবং সম্ভাব্য ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কারিগরি সুপারিশ প্রণয়ন, নগদ ও ঋণ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে ঋণ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সরকারের ঘাটতি অর্থায়নে প্রয়োজনীয় কারিগরি সুপারিশ প্রদান করবে কমিটি। এ কমিটি সরকারি ঋণ ব্যবস্থাপনার নীতিগত সমন্বয় এবং এ সংক্রান্ত কার্যক্রম গ্রহণে সুপারিশ পেশ করবে।

এদিকে সরকারের নগদ ও ঋণ ব্যবস্থাপনায় অধিকতর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও উৎকর্ষ আনার লক্ষ্যে নগদ ও ঋণ ব্যবস্থাপনা কমিটির (সিডিএমসি) আওতা এবং কার্যপরিধি বাড়ানো হয়েছে। সম্প্রতি পুনর্গঠিত ১৬ সদস্যের এ কমিটির সভাপতি আগের মতোই অর্থ সচিব। অর্থ বিভাগের ট্রেজারি ও ঋণ ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিবকে দেওয়া হয়েছে সদস্য সচিবের দায়িত্ব। এ ছাড়া কমিটিতে থাকছেন অর্থ বিভাগের আরও পাঁচ অতিরিক্ত সচিবসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের একজন করে অতিরিক্ত সচিব। একই সঙ্গে এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিও রয়েছেন সদস্য হিসেবে।

এ কমিটির কার্যপরিধির মধ্যে রয়েছে, সরকারের অর্থায়ন (অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক) ঝুঁকি হ্রাস করার কৌশল অনুমোদন; সরকারের ঋণের উপকরণগুলোর প্রাথমিক ও সেকেন্ডারি বাজার সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কৌশল নির্ধারণ, সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণের উপকরণগুলোর নিলামের জন্য পঞ্জিকা চূড়ান্ত করা, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের নতুন উপকরণ চালুর বিষয়ে সুপারিশ প্রদান, জাতীয় সঞ্চয়পত্রের সার্টিফিকেট ও এর সুদহার সংক্রান্ত সুপারিশ, ঋণের নানাবিধ ঝুঁকি কমানোর উদ্দেশ্যে সরকারি ঋণের (অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক) পরিশোধ শিডিউল সুষমকরণের কৌশল নির্ধারণ এবং সরকারের অর্থায়ন ও ঋণসংক্রান্ত যে কোনো বিষয়।

অর্থ বিভাগের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের জুন শেষে দেশি-বিদেশি ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩২ হাজার ২৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে দেশীয় উৎস থেকে নেওয়া হয়েছে ১০ লাখ ২০ হাজার ২০৫ কোটি টাকা। আর বিদেশি উৎস থেকে ৮ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা।
এদিকে বাজেট বাস্তবায়ন সংক্রান্ত অর্থ বিভাগের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের আওতায় মোট ব্যয় হয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজার ৮১২ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধেই গেছে ৬২ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে যা প্রায় ২৭ শতাংশ বেশি। এর সঙ্গে আসল পরিশোধ যোগ করলে অঙ্কটা আরও বেড়ে যাবে।

প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, পরিচালন বাজেটের একক খাত হিসেবে সর্বোচ্চ ৩৪ শতাংশ গেছে সুদ পরিশোধে। এর মধ্যে দেশি ঋণের সুদ পরিশোধে ৫৩ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে ৯ হাজার ২২ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় হয়েছিল ৪৯ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা। এ ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি অর্থবছর শেষে শুধু সুদ পরিশোধেই প্রয়োজন হবে প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। 

গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আগের অর্থবছরের চেয়ে সরকারের ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় বাড়ে ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ। ফলে সেবার দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ঋণের সুদ পরিশোধ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে ১ লাখ ১৪ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকায় উন্নীত হয়, যা সরকারের মোট ব্যয়ের ২৮ শতাংশ।

অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা সমকালকে জানান, পর্যাপ্ত রাজস্ব আয়ের সংস্থান করতে না পারলেও বিগত সরকারের দেড় দশকে প্রতিবছরই বড় হয়েছে বাজেটের আকার। এর সঙ্গে সঙ্গে বড় হয়েছে বাজেটের ঘাটতি। এ ঘাটতি পূরণে স্থানীয় ও বিদেশি উৎস থেকে নেওয়া ঋণের ওপর নির্ভরতা বেড়েছে। বেড়েছে ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয়ের পরিমাণও। এবার যা সর্বোচ্চ পর্যায়ে দাঁড়াবে বলে আশঙ্কা অর্থ মন্ত্রণালয়ের। ইতোমধ্যে আর্থিক ঝুঁকি কমাতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের গ্যারান্টি কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এবার সার্বিক ঋণের দায় কমাতে আরও কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হবে তা নির্ধারণে কাজ চলছে।

সাবেক অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ সমকালকে বলেন, সুদ পরিশোধে ব্যয় গতি ব্যাপক হারে বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের কৌশল নির্ধারণের উদ্যোগ ইতিবাচক। বিশেষ করে অধিক সুদের ঋণ যতদূর সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। তা ছাড়া সার্বিকভাবে সরকারকে ঋণ নেওয়া কমিয়ে রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। তবে রাজস্ব বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভ্যাটের মতো পরোক্ষ করের পরিবর্তে প্রত্যক্ষ করের ওপর বেশি জোর দিতে হবে। একই সঙ্গে অটোমেশন কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে ত্রুটি-বিচ্যুতি কাটিয়ে কর ফাঁকি রোধ করতে হবে।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ঋণ সরক র র প রণয়ন এ কম ট কম ট র সদস য

এছাড়াও পড়ুন:

বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৩.৩ শতাংশ: বিশ্বব্যাংক

চলতি অর্থবছরে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৩ শতাংশ হতে পারে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিদ্যমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্যেও জিডিপি প্রবৃদ্ধির এই পূর্বাভাস দিল সংস্থাটি।

এর আগে গত জানুয়ারি মাসে ৪ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলে জানিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। নতুন পূর্বাভাসে সংস্থাটি জানিয়েছে, আগামী অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেড়ে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ হতে পারে।

আজ বুধবার প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের দ্বি-বার্ষিক প্রতিবেদন ‘সাউথ এশিয়া ডেভেলপমেন্ট আপডেট: ট্যাক্সিং টাইমস’-এ পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। বিকেলে সংস্থাটির ঢাকা কার্যালয় থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়। এছাড়া চলতি অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ হতে পারে বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের অর্থ মন্ত্রণালয় চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ২ শতাংশ অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালে দক্ষিণ এশিয়ার গড় প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে। ২০২৬ সালে তা সামান্য বেড়ে ৬ দশমিক ১ শতাংশে দাঁড়াতে পারে। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরে ভারতে সাড়ে ৬ শতাংশ এবং পাকিস্তানে ২ দশমিক ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক।

বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন রেইজার বলেন, এখনই সময় নির্দিষ্ট কিছু সংস্কারের দিকে মনোযোগ দেওয়ার; যাতে অর্থনীতির সহনশীলতা বাড়ে, প্রবৃদ্ধি জোরদার হয় এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। বাণিজ্য আরও উন্মুক্ত করতে হবে, কৃষি খাতে আধুনিকায়ন আনতে হবে এবং বেসরকারি খাতে গতি আনতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নতুন নিরীক্ষা অধ্যাদেশ নিয়ে উদ্বেগ টিআইবির
  • নির্বাচনের সময় নিয়ে রাজনৈতিক দলের মতের অমিল হলে উত্তেজনা বাড়বে: বিশ্বব্যাংক
  • আইসিটি খাতে দুর্নীতির তদন্ত ও শ্বেতপত্র প্রণয়নে টাস্কফোর্স গঠন
  • আইসিটি খাতের দুর্নীতি তদন্ত ও শ্বেতপত্র প্রণয়নে টাস্কফোর্স গঠন
  • বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩.৩ শতাংশ হতে পারে: বিশ্বব্যাংক
  • জাবিতে মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের দাবিতে শিক্ষার্থীদের স্মারকলিপি
  • কারিগরি শিক্ষার্থীরা আন্দোলন স্থগিত থেকে সরে এল
  • রাজউকের বোর্ডে আমলা থাকলে চলবে না, বিশেষজ্ঞ রাখতে হবে: উপদেষ্টা রিজওয়ানা
  • বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৩.৩ শতাংশ: বিশ্বব্যাংক
  • কারিগরি শিক্ষার্থীরা আন্দোলন সাময়িক স্থগিত করলেন