ইতিহাসকে অতীতে রেখে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে চায় জার্মানি
Published: 4th, April 2025 GMT
বাতাসে ধুলোর মেঘ তৈরি করে মাঠের ভেতর দিয়ে ফায়ারিং লাইনের দিকে ছুটে যায় ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপক। কিছুক্ষণ পর একজন সৈনিক পাঁচ গুনতে শুরু করেন। তিনি ‘ফায়ার’ বলার সঙ্গে সঙ্গে গর্জন করে আকাশে ছুটে যায় রকেট।
এ ধরনের সামরিক প্রশিক্ষণ মহড়ার বিস্ফোরণ কিংবা বিকট শব্দ এতটাই নিয়মিত হয়ে পড়েছে যে কাছের মুন শহরের বাসিন্দারা সেটা প্রায় লক্ষই করেন না। শব্দগুলো কানে সয়ে গেছে।
জীবন সেখানে আরও সশব্দ হয়ে উঠতে যাচ্ছে।
তবে ভবিষ্যতে সেখানকার জনজীবন আরও প্রকট শব্দের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে।
আইনসভা প্রতিরক্ষা ব্যয়ের ক্ষেত্রে ঋণের কঠোর বিধিনিষেধ উঠিয়ে নেওয়ার পর সম্প্রতি জার্মানির সামরিক বাহিনী বিপুল বিনিয়োগের ছাড়পত্র পেয়েছে।
দেশটির শীর্ষ জেনারেল কার্স্টেন ব্রুয়ার বিবিসিকে বলেন, যত দ্রুত সম্ভব (প্রতিরক্ষা খাতে) টাকা ঢালা দরকার, কারণ, তাঁর বিশ্বাস রাশিয়ার আগ্রাসন ইউক্রেনেই সীমাবদ্ধ থাকবে না।
জেনারেল কার্স্টেন ব্রুয়ার বলেন, ‘আমরা রাশিয়ার হুমকির সম্মুখীন। আমরা পুতিনের হুমকির সম্মুখীন। এটি মোকাবিলা করার জন্য আমাদের যা কিছু করা দরকার, তা–ই করতে হবে।’ তিনি সাবধান করে বলেন, মাত্র চার বছরের মধ্যেই এমন একটি আক্রমণের সম্ভাবনা মাথায় রেখে ন্যাটোকে তৈরি থাকতে হবে।
জার্মানির প্রতিরক্ষা প্রধান স্পষ্টভাবে বলেন, ‘আমাদের কত সময় প্রয়োজন, তা মূল বিষয় নয়, পুতিন আমাদের প্রস্তুত হওয়ার জন্য কতটা সময় দেন, সেটাই হচ্ছে দেখার বিষয়। আর আমরা যত দ্রুত প্রস্তুত হতে পারব, ততই ভালো।’
মোড় ঘোরানো
ইউক্রেনে রাশিয়ার সর্বাত্মক আক্রমণ জার্মানির চিন্তাভাবনাকে গভীরভাবে বদলে দিয়েছে।
কয়েক দশক ধরে দেশটির মানুষ সামরিক শক্তি প্রত্যাখ্যানের শিক্ষা নিয়ে বেড়ে উঠেছে। অতীতে ইউরোপীয় আগ্রাসনকারী হিসেবে জার্মানির ভূমিকার ব্যাপারেও তারা অতি সচেতন।
বার্লিনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান জার্মান মার্শাল ফান্ডের বিশেষজ্ঞ মার্কাস জিনার বলেন, ‘আমরা দুটি বিশ্বযুদ্ধ শুরু করেছি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার ৮০ বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু “জার্মানদের সংঘাত থেকে দূরে থাকা উচিত”—এই ধারণা এখনো অনেক মানুষের ডিএনএতে রয়ে গেছে।’
সামরিকবাদ বলে মনে হতে পারে, এমন যেকোনো বিষয় থেকে এখনো কেউ কেউ দশ হাত দূরে থাকতে চান। লাগাতার সশস্ত্র বাহিনী ক্রমাগতভাবে তহবিল সংকটের শিকার হয়ে আসছে।
কেউ কেউ সতর্ক করে বলেন, ‘আমরা কি সত্যিই সঠিক পথে আছি? হুমকি সম্পর্কে আমাদের ধারণা কি সঠিক?’
রাশিয়ার ক্ষেত্রে জার্মানির নির্দিষ্ট কৌশল কিংবা নীতি রয়েছে।
বাল্টিক অঞ্চল ও পোল্যান্ডের মতো দেশগুলো মস্কোর খুব বেশি কাছাকাছি ঘেঁষার ব্যাপার যখন সতর্ক করেছিল এবং নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়িয়েছিল, তখন জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের অধীন বার্লিন দেশটির সঙ্গে বাণিজ্যের ওপর জোর দিয়েছিল।
জার্মানি ভেবেছিল, গণতন্ত্রীকরণকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু রাশিয়া টাকাটা পকেটে ভরে ঠিকই ইউক্রেনে আক্রমণ করেছে।
রাশিয়ার এমন আচরণে হতবাক হয়ে জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় অগ্রাধিকারের মোড় ঘোরানোর ঘোষণা দেন।
সে সময় তিনি দেশের সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করতে এবং ‘পুতিনের মতো যুদ্ধবাজদের’ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ১০ হাজার কোটি ইউরোর বিশাল এক বরাদ্দের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তবে জেনারেল ব্রুয়ার বলেন, এটি যথেষ্ট ছিল না।
জেনারেল ব্রুয়ার বলেন, ‘আমরা আমাদের ঘাটতিগুলোর অল্পই মেটাতে পেরেছি। কিন্তু পরিস্থিতি সত্যিই খারাপ।’ অন্যদিকে রাশিয়া মজুত করা এবং ইউক্রেনের রণাঙ্গনে পাঠানোর জন্য অস্ত্রশস্ত্র-সরঞ্জামের পেছনে মোটা টাকা ঢালছে, বলেন তিনি।
রাশিয়ার শংকর (হাইব্রিড) যুদ্ধনীতির কথা উল্লেখ করে জেনারেল ব্রুয়ার বলেন, সাইবার আক্রমণ থেকে শুরু করে নাশকতা ও জার্মান সামরিক স্থাপনায় অজ্ঞাত ড্রোন পাঠানোর মতো কাজ করছে রাশিয়া। এর সঙ্গে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের আক্রমণাত্মক বক্তব্য যোগ করলে ‘সত্যিকার অর্থে একটি বিপজ্জনক মিশ্রণ’ দেখতে পান তিনি।
ব্রুয়ার বলেন, রাশিয়া পশ্চিমা বিশ্বের মতো ছকবাঁধা চিন্তা করে না। শান্তিকাল আর যুদ্ধ—এভাবে ভাবার সুযোগ নেই। এটা একটা অবিরত প্রক্রিয়া। তিনি বলেন, এ কারণেই তাঁর মনে হয় তাঁরা ব্যাপক ঝুঁকিতে আছেন।
এমন পরিস্থিতিতে জার্মানিকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে বলে জোর দেন ব্রুয়ার।
প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম
সম্প্রতি জার্মানির সংসদে পাঠানো একটি প্রতিবেদনের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে প্রতিরক্ষা প্রধানের তিক্ত মূল্যায়নের মিল পাওয়া যায়। সংসদে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামরিক বাহিনীর সবকিছুই প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম আছে।
সংসদে পাঠানো ওই প্রতিবেদনের লেখক সশস্ত্র বাহিনীর কমিশনার ইভা হোগল গোলাবারুদ থেকে শুরু করে সৈন্য, এমনকি জরাজীর্ণ ব্যারাক পর্যন্ত সবকিছুতে ভয়াবহ ঘাটতির তথ্য প্রকাশ করেছেন। তিনি অনুমান করেছেন, কেবল সংস্কারকাজের জন্য প্রায় ৬ হাজার ৭০০ কোটি ইউরোর বাজেট দরকার।
জেনারেল ব্রুয়ার বলেন, জার্মান সরকার সামরিক বাহিনীর জন্য ঋণের সীমা তুলে নিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে প্রতিরক্ষা খাত বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধানে উদ্যোগ নিতে পারবে।
ইতিহাসকে অতীতে রেখে
বার্লিনে সামরিক বাহিনীসংক্রান্ত জার্মানদের দীর্ঘদিনের সতর্ক অবস্থান দ্রুত মিলিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
১৮ বছর বয়সী শার্লট ক্রেফট বলেন, তাঁর নিজের শান্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন এসেছে। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে আমরা ভেবেছিলাম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমরা যে নৃশংসতা দেখিয়েছি, তার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার একমাত্র উপায় হলো, এটি যাতে আর কখনো না ঘটে, তা নিশ্চিত করা। আমরা ভেবেছিলাম আমাদের সামরিকীকরণ থেকে বেরিয়ে আসা দরকার।’ কিন্তু এখনকার পরিস্থিতিতে নিজেদের মূল্যবোধ, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা বাঁচিয়ে রাখতে লড়াই করতে হবে, বলেন শার্লট।
শার্লটের সঙ্গে লুডভিগ স্টেইনও একমত। তিনি বলেন, ‘অনেক জার্মান আছেন, যাঁরা এখনো আমাদের সামরিক বাহিনীতে বড় বিনিয়োগের ব্যাপারটা সহজভাবে নিতে পারেন না। অদ্ভুত বলে মনে করছেন। কিন্তু আমি মনে করি, গত কয়েক বছরে যা ঘটেছে, তা বিবেচনা করলে আসলে অন্য কোনো বাস্তব বিকল্প নেই।’
সোফি নামের এক তরুণী মা মনে করেন, আমরা যে পৃথিবীতে বাস করি, সেখানে এখন প্রতিরক্ষা খাতে বিনিয়োগ ‘জরুরি’। কিন্তু অস্ত্রশস্ত্রের পাশাপাশি জার্মানির সৈন্যসামন্তও প্রয়োজন। আর নিজের ছেলেকে সৈন্যদলে পাঠানোর আগ্রহ সোফির অনেকটাই কম।
‘আপনি কি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত?’
জার্মান সামরিক বাহিনীর কেবল একটি স্থায়ী নিয়োগ কেন্দ্র রয়েছে। এটি বার্লিনের ফ্রিড্রিখস্ট্রাস স্টেশনের পাশে একটি ফার্মেসি এবং জুতার দোকানের মধ্যে অবস্থিত একটি ছোট কেন্দ্র।
জানালায় সামরিক পরিচয়-ঢাকা সাজপোশাকে (কামুফ্লাজ করা) ডামি এবং আকর্ষণীয় স্লোগান নিয়ে এটি নারী-পুরুষদের সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করছে। তবে তাঁদের কাছে প্রতিদিন মাত্র অল্প কয়েকটি কল আসে।
জার্মানি ইতিমধ্যেই সৈন্যের সংখ্যা ২০ হাজার বাড়িয়ে ২ লাখ ৩ হাজার করার এবং সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার গড় বয়সসীমা ৩৪ থেকে কমিয়ে আনার লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে।
কিন্তু এ ব্যাপারে জেনারেল ব্রুয়ারের উচ্চাকাঙ্ক্ষা অনেক বেশি। তিনি বলেন, জার্মানির আত্মরক্ষা ও ন্যাটোর পূর্বাঞ্চলীয় সীমা সম্পূর্ণভাবে রক্ষার জন্য অতিরিক্ত আরও এক লাখ সৈন্য প্রয়োজন। বাধ্যতামূলক নিয়োগ ছাড়া এই এক লাখ সেনা পাওয়া সম্ভব নয় বলে মনে করছেন এই জেনারেল। তবে তিনি বলেন, তাঁদের কীভাবে নিয়োগ দেওয়া হবে, তা বড় কথা নয়। বড় কথা হলো পর্যাপ্তসংখ্যক সেনা নিয়োগ নিশ্চিত করা।
জার্মানিতে সেনা নিয়োগসংক্রান্ত বিতর্কটি শুরু হয়েছে মাত্র।
জার্মানির মোড় ঘোরাকে দ্রুত ও বিস্তৃত করার চেষ্টার সামনের সারিতে আছেন জেনারেল ব্রুয়ার। আঞ্চলিক টাউন হলগুলোতে গিয়ে সমবেত মানুষদের তিনি তাঁর স্বচ্ছন্দ মিশুক ঢঙে প্রশ্ন করতে ভালোবাসেন, ‘আপনি কি যুদ্ধের জন্য তৈরি?’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জ ন র ল ব র য় র বল ন প রস ত ত ইউক র ন আম দ র র জন য দরক র
এছাড়াও পড়ুন:
খুলনা জেলার ১৪৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ
খুলনা জেলার ১৪৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ। ১৮৮১ সালের ২৫ এপ্রিল খুলনাকে জেলার মর্যাদা দেওয়া হয়। ঢাকা ও চট্টগ্রামের পরে বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম শিল্প ও বন্দরনগরী ঐতিহ্যবাহী খুলনা। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে রূপসা ও ভৈরব নদীর তীরে এর অবস্থান।
নদ-নদী বিধৌত হযরত খানজাহান আলীর (রহ.) স্মৃতি বিজড়িত সুন্দরবনের কোল ঘেঁষা অপরূপ এ জেলাটি লম্বা আকৃতির ও চৌকা ধরনের। দেশের প্রাচীনতম নদী বন্দরগুলোর মধ্যে খুলনা অন্যতম।
শুক্রবার (২৫ এপ্রিল) খুলনা জেলা প্রতিষ্ঠার ১৪৪তম বার্ষিকী উপলক্ষে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রাসহ দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করেছে বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে বর্নাঢ্য শোভাযাত্রা, স্মরণিকা প্রকাশ, খুলনা মেজবানী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা আজ শিববাড়ির মোড়ে আয়োজিত সমাবেশ উদ্বোধনের পর নগরীতে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের হবে।
খুলনার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস থেকে জানা যায়, ৪ হাজার ৬৩০ বর্গমাইল এলাকা, ৪৩ হাজার ৫০০ জনসংখ্যা অধ্যুষিত খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরাকে নিয়ে ১৮৮২ সালের ২৫ এপ্রিল গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে খুলনা জেলা প্রতিষ্ঠিত হয়। এর আগে খুলনা ছিল যশোর জেলার মহকুমা।
ঢাকা/নুরুজ্জামান/টিপু