ছোট ছেলে নাদিমের পছন্দ ছিল ফিরনি। তার জন্য প্রতি ঈদে মা শিউলি বেগম রান্না করতেন ফিরনি। রমজানের ২৮ তারিখ বড় দুই ভাই নাইমুজ্জামান শুভ (২০) ও নাহিদুজ্জামান শান্তর (১৪) সঙ্গেই মোটরসাইকেলে যাচ্ছিল আত্মীয়ের বাড়িতে। পথে বাসচাপায় প্রাণ যায় তিন ভাইয়ের। তাদের বাড়ি পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলায়। ঈদের দিন তাদের কবর দেখতে ভিড় করেন আশপাশের চার গ্রামের মানুষ। 

উপজেলার টিকিকাটা ইউনিয়নের উত্তর ভেচকি গ্রামে সন্তানদের কবরের পাশে ঈদের সারাদিন কাঁদতে কাঁদতে কাটান তাদের বাবা মো.

নাসির খান। তিনি বলছিলেন, ‘ফিরনি রান্না হলে নাদিম পেট ভরে খেত। এবার ঈদে সেই ছেলেটিসহ আমার বুকের ধন তিন ছেলেই দুনিয়ায় নাই। যতদিন বাইচা আছি, ঈদের ফিরনি আর পেটে যাইবো না।’ কেঁদে কেঁদে তিনি আরও বলেন, ‘কীসের ঈদ আর আনন্দ! মোর পোতায় বাতি দেওয়ারও তো কেউ রইল না!’

পাশেই থেমে থেমে কাঁদছিলেন নাসিরের স্ত্রী শিউলি বেগম। ২০২৩ সালের ১৮ রোজার দিন এ দম্পতির ছোট ছেলে হাসান মারা যায় পানিতে ডুবে। তখন শিশুটির বয়স ছিল মাত্র এক বছর চার মাস। এসব তথ্য জানিয়ে শিউলি আহাজারি করে ওঠেন, ‘এবার ২৮ রমজানে বাকি তিন ছেলে বাসচাপায় মইর‍্যা গেল। আমি এহন কী নিয়া বাঁচমু? আমি আল্লাহর কাছে এমন কী অপরাধ করছি যে, একে একে চার ছেলেরেই নিয়া গেল? এ জগতে আমারে মা ডাকার আর কেউ রইল না!’

স্বজন জানিয়েছেন, নিহত তিনজনের মা শিউলি বেগম দুর্ঘটনার পর থেকেই বাক্‌রুদ্ধ। মাঝেমধ্যে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বিলাপ করেন। মানুষ দেখলেই হাউমাউ করে কেঁদে সন্তানদের ফিরিয়ে দেওয়ার আকুতি জানান। শিউলি বলেন, এক মায়ের গর্ভের চার সন্তানই যদি এভাবে চলে যায়, তাঁর জীবনে কখনও কী ঈদ বা উৎসব আসবে? 

২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরে উত্তর ভেচকি গ্রামের মৃত মোশারফ খানের ছেলে মো. নাসির খানের সঙ্গে বিয়ে হয় পাশের গুলিশাখালী গ্রামের প্রাক্তন শিক্ষক নুরুজ্জামান হাওলাদারের মেয়ে শিউলি বেগমের। বিয়ের পর কয়েক বছর ভালোভাবেই কাটছিল। তবে নাসির ঠিকমতো কাজকর্ম না করায় অনেক টাকা ঋণ হয়। তিনি স্ত্রী-সন্তানদের খরচাপাতি দিতে পারছিলেন না। বাধ্য হয়ে ছয়-সাত বছর আগে সন্তানদের নিয়ে শিউলি গুলিশাখালী গ্রামের বাবার বাড়ি চলে যান। নাসিরও রংমিস্ত্রির কাজ নিয়ে চলে যান রাঙামাটিতে। তবে ঠিকমতো স্ত্রী-সন্তানের ভরণপোষণ দিতে পারতেন না তিনি।

ছোট দুই ভাইয়ের পড়াশোনা ও মায়ের সংসারের খরচ জোগাতে ঢাকার সাভারের শাশা গার্মেন্টে কাজ নেন নাইমুজ্জামান শুভ। নাহিদুজ্জামান শান্ত পড়ত অষ্টম শ্রেণিতে, তার ছোট মো. নাহিদ চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিল। 

শুভর আপন চাচা রাজা মিয়া সাভারের শাশা গার্মেন্টের ব্যবস্থাপক। তাঁর স্ত্রীর বড় ভাই সিদ্দিকুর রহমানের ছেলে রাকিবও একই কারখানার সহকারী ইলেকট্রিশিয়ান। ঈদে তিনি ছুটি পাননি। তাই রাকিব সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর জন্য মেহেদী, কসমেটিকস, বোরকাসহ পরিবারের সদস্যদের জন্য কেনা ঈদের পোশাক বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব দেন শুভকে। এসব নিয়ে শুভ ২৯ মার্চ (২৮ রমজান) ভোররাতে বাসে করে গুলিশাখালীর নানাবাড়ি পৌঁছান। সকাল সাড়ে ৬টার দিকে তিনি মামা ব্র্যাক কর্মকর্তা ওয়াহিদুজ্জামান শিপলুর মোটরসাইকেল নিয়ে রাকিবের কেনা জিনিসপত্র পৌঁছে দিতে বরগুনার পাথরঘাটার কেরাতপুর রওনা হন। একই মোটরসাইকেলে ছিল তাঁর দুই ভাই শান্ত ও নাদিম। 

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল সাড়ে ৭টার দিকে পাথরঘাটার রায়হানপুর ইউনিয়নের সোনার বাংলা এলাকায় দুর্ঘটনার শিকার হয় তিন ভাই। পাথরঘাটা থেকে ছেড়ে আসা রাজিব পরিবহনের ঢাকাগামী বাস মোটরসাইকেলটিকে চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই চালকের আসনে থাকা শুভ ও পেছনে থাকা শান্ত ও নাদিম নিহত হয়।

ওই দিন বিকেলে বরগুনার মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে তিন ভাইয়ের মরদেহ উত্তর ভেচকি গ্রামের বাড়িতে নেওয়া হয়। আসরের নামাজের পর জানাজা হয়। গভীর রাতে রাঙামাটি থেকে বাড়ি ফেরেন বাবা নাসির খান। পরে দাদার কবরের পাশে তিন ভাইয়ের লাশ দাফন করা হয়।

মামা অহিদুজ্জামান শিপলু বলেন, ভোররাতে সাহ্‌রি সেরে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। তাই ভাগনে শুভ তাঁকে না জাগিয়েই পকেট থেকে মোটরসাইকেলের চাবি নিয়ে কেরাতপুর রওনা হয়। ঘুম থেকে উঠেই দুর্ঘটনায় তিন ভাগনের মৃত্যুর সংবাদ শোনেন। 

তিনি আরও বলেন, শুভর বাবা চট্টগ্রামে (রাঙামাটি) থাকায় বোন শিউলি বেগম তাদের বাড়িতেই থাকেন। অসুস্থ মা-বাবাকে দেখাশোনা করেন। এর আগেও তাঁর ছোট সন্তান পানিতে ডুবে মারা যায়। এবার বড় তিন সন্তান হারিয়ে তারা ঠিকমতো কথা বলায় অবস্থায়ও নেই। 

উত্তর ভেচকি গ্রামটি মঠবাড়িয়া পৌর শহরের প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে। ঈদের দিন সরেজমিন দেখা যায়, ওই গ্রামসহ বাইশকুড়া, কুমিরমারা ও গুলিশাখালী গ্রামের কারও মনে আনন্দ নেই। একই পরিবারের তিনটি সন্তানের মর্মান্তিক মৃত্যু কেউ মেনে নিতে পারছেন না। 

বাইশকুড়া গ্রামের নেছার খানের (৪৮) ভাষ্য, যে ছেলেগুলো মারা গেছে, তাদের একজনের বয়সী তাঁরও ছেলে আছে। ওই তিন ছেলের শোকে ঈদে তাঁর ছেলে নতুন কেনা পোশাকও পরেনি।

উত্তর ভেচকি গ্রামের ব্যবসায়ী আ. কুদ্দুস খান (৭৫) বলেন, ‘আমার জীবনে এই প্রথম দেখলাম, এক মায়ের পেটের তিন ভাই এক দুর্ঘটনায় মারা গেল। এ ঘটনায় গোটা এলাকার মানুষ শোকাহত।’ 

একই গ্রামের কৃষক নুরুজ্জামানের ভাষ্য, এমন মৃত্যুর পর এলাকায় কোনো উৎসব ছিল না। 

ঈদের নামাজ শেষে এলাকার সাত-আটটি ঈদগাহেই ওদের জন্য দোয়া হয়েছে। সবাই আল্লাহর 

কাছে তিন ভাইয়ের জন্য কান্নাকাটি করেছেন। এমনই তথ্য জানান গুলিশাখালী গ্রামের বাসিন্দা মো. শফিকুল ইসলাম।

গুলিশাখালী গ্রামেই নানাবাড়িতে থাকেন শুভর মা শিউলি। তাঁর বাবা নুরুজ্জামান হাওলাদার (৮০) বলেন, তাঁর তিন ছেলে ও একমাত্র মেয়ে শিউলি। জামাতা নাসির ঠিকমতো সংসার চালাতে না পারায় মেয়ে ও নাতিদের নিয়ে আসেন। তিনি দরিদ্র হলেও বুড়ো বয়সে টিউশনি করে ওদের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ছোট নাতি হাসানের কবরের পাশেই তিনজনের দাফন করার ইচ্ছা ছিল তাঁর। কিন্তু জামাতার বিরোধিতায় তা হয়নি। 

নুরুজ্জামান হাওলাদারের ভাষ্য, বড় নাতি শুভ ১০-১১ মাস আগে নূপুর নামে ময়মনসিংহের এক মেয়েকে বিয়ে করেছে। স্বামী-দেবরদের দুর্ঘটনার খবর পেয়ে সে-ও অজ্ঞান অবস্থায় আছে। ওই নববধূকে কী জবাব দেবেন তিনি?

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: সড়ক দ র ঘটন ন হত দ র ঘটন র জন য ঠ কমত র কবর

এছাড়াও পড়ুন:

প্রত্যন্ত গ্রামে ক্লিনিক খুলে ‘এমবিবিএস ডাক্তার’ পরিচয়ে চিকিৎসা, এক বছরের কারাদণ্ড

বরিশালের উজিরপুর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামে ক্লিনিক খুলে এমবিবিএস ডিগ্রিধারী চিকিৎসক পরিচয় দিয়ে ১০ বছর ধরে চিকিৎসা দিয়ে আসছিলেন মো. রেজাউল করিম নামের এক ব্যক্তি। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আজ মঙ্গলবার দুপুরে ওই ক্লিনিকে অভিযান চালিয়ে তাঁকে এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। উজিরপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. মাইনুল ইসলাম খান এ দণ্ড দেন।

উজিরপুরের সাতলা ইউনিয়নের পশ্চিম সাতলা গ্রামে ‘মায়ের দোয়া ক্লিনিক অ্যান্ড ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টারে’ নামের ওই ক্লিনিক এ অভিযান চালানো হয়। সেখানে দীর্ঘদিন ধরে এমবিবিএস ডিগ্রিধারী চিকিৎসক পরিচয়ে সাধারণ মানুষকে চিকিৎসা দিয়ে আসছিলেন রেজাউল করিম। মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাস করার পর চিকিৎসার নামে গ্রামের সহজ-সরল মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিলেন তিনি।

উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ জানায়, গত রোববার ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বরিশাল জেলার সহকারী পরিচালক সুমি রানী মিত্র ওই ক্লিনিকে অভিযান চালিয়ে নানা অনিয়ম পাওয়ায় ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করেছিলেন।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, কোনো মেডিকেল ডিগ্রি ছাড়াই রেজাউল ১০ বছরের বেশি সময় ধরে এমবিবিএস চিকিৎসক পরিচয় দিয়ে রোগনির্ণয়, চিকিৎসা, এমনকি জটিল অস্ত্রোপচার পর্যন্ত করে আসছিলেন। এলাকাটি যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হওয়ায় ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের মদদ থাকায় এ নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্য করতে পারেননি।

রেজাউল করিম অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি কেবল প্রাথমিক চিকিৎসা দিই। যেগুলো আমার দ্বারা সম্ভব।’

ভ্রাম্যমাণ আদালত সূত্র জানায়, অভিযানের সময় রেজাউলের কাছে ‘চার্টার অব অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল অব ইন্ডো অ্যালোপ্যাথি অ্যান্ড কমপ্লিমেন্টারি মেডিসিন’ নামে একটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসক সনদ পাওয়া যায়। তবে অনুসন্ধানে দেখা যায়, এ নামে কোনো স্বীকৃত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ভারতে নেই। অভিযানে ক্লিনিকে কোনো রোগীর তথ্য রেজিস্টারে সংরক্ষণ করার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এমনকি চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্র বা রোগনির্ণয়ের জন্য রোগীদের কাছ থেকে অর্থ নেওয়ার প্রমাণপত্র (রসিদ) পাওয়া যায়নি।

উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, রেজাউল করিম আসলে কোনো চিকিৎসক নন। তিনি ভারতের যে মেডিকেল কলেজের সনদ দেখিয়েছেন, তদন্তে তাঁরা ওই নামে কোনো মেডিকেল কলেজের অস্তিত্ব পাননি। তাঁর ব্যাপারে তিনি দুবার অভিযোগ পেয়ে তদন্ত করেছেন এবং ভুয়া চিকিৎসক মর্মে প্রতিবেদনও দিয়েছিলাম। রাজনৈতিক প্রভাবশালী একটি মহলকে ম্যানেজ করে চলায় তাঁর বিষয়ে ব্যবস্থা নেওযা যায়নি। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) রেজিস্ট্রেশন ছাড়া কেউ নিজেকে চিকিৎসক লিখতে পারেন না এবং কোনো রোগীকে চিকিৎসা দিতে পারেন না, এটা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাইনুল ইসলাম খান বলেন, তিনি যে সনদ দেখিয়েছেন, তা যাচাই করে দেখা গেছে, সেটির কোনো বৈধতা নেই। যেহেতু তাঁর এমবিবিএস ডিগ্রি নেই, তাই তিনি ভুয়া চিকিৎসক। আইনানুযায়ী তাঁকে এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। উজিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুস সালাম বলেন, দণ্ডপ্রাপ্ত রেজাউল করিমকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ