ঈদের ফিরনি গলা দিয়ে আর নামবে না মা-বাবার
Published: 4th, April 2025 GMT
ছোট ছেলে নাদিমের পছন্দ ছিল ফিরনি। তার জন্য প্রতি ঈদে মা শিউলি বেগম রান্না করতেন ফিরনি। রমজানের ২৮ তারিখ বড় দুই ভাই নাইমুজ্জামান শুভ (২০) ও নাহিদুজ্জামান শান্তর (১৪) সঙ্গেই মোটরসাইকেলে যাচ্ছিল আত্মীয়ের বাড়িতে। পথে বাসচাপায় প্রাণ যায় তিন ভাইয়ের। তাদের বাড়ি পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলায়। ঈদের দিন তাদের কবর দেখতে ভিড় করেন আশপাশের চার গ্রামের মানুষ।
উপজেলার টিকিকাটা ইউনিয়নের উত্তর ভেচকি গ্রামে সন্তানদের কবরের পাশে ঈদের সারাদিন কাঁদতে কাঁদতে কাটান তাদের বাবা মো.
পাশেই থেমে থেমে কাঁদছিলেন নাসিরের স্ত্রী শিউলি বেগম। ২০২৩ সালের ১৮ রোজার দিন এ দম্পতির ছোট ছেলে হাসান মারা যায় পানিতে ডুবে। তখন শিশুটির বয়স ছিল মাত্র এক বছর চার মাস। এসব তথ্য জানিয়ে শিউলি আহাজারি করে ওঠেন, ‘এবার ২৮ রমজানে বাকি তিন ছেলে বাসচাপায় মইর্যা গেল। আমি এহন কী নিয়া বাঁচমু? আমি আল্লাহর কাছে এমন কী অপরাধ করছি যে, একে একে চার ছেলেরেই নিয়া গেল? এ জগতে আমারে মা ডাকার আর কেউ রইল না!’
স্বজন জানিয়েছেন, নিহত তিনজনের মা শিউলি বেগম দুর্ঘটনার পর থেকেই বাক্রুদ্ধ। মাঝেমধ্যে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বিলাপ করেন। মানুষ দেখলেই হাউমাউ করে কেঁদে সন্তানদের ফিরিয়ে দেওয়ার আকুতি জানান। শিউলি বলেন, এক মায়ের গর্ভের চার সন্তানই যদি এভাবে চলে যায়, তাঁর জীবনে কখনও কী ঈদ বা উৎসব আসবে?
২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরে উত্তর ভেচকি গ্রামের মৃত মোশারফ খানের ছেলে মো. নাসির খানের সঙ্গে বিয়ে হয় পাশের গুলিশাখালী গ্রামের প্রাক্তন শিক্ষক নুরুজ্জামান হাওলাদারের মেয়ে শিউলি বেগমের। বিয়ের পর কয়েক বছর ভালোভাবেই কাটছিল। তবে নাসির ঠিকমতো কাজকর্ম না করায় অনেক টাকা ঋণ হয়। তিনি স্ত্রী-সন্তানদের খরচাপাতি দিতে পারছিলেন না। বাধ্য হয়ে ছয়-সাত বছর আগে সন্তানদের নিয়ে শিউলি গুলিশাখালী গ্রামের বাবার বাড়ি চলে যান। নাসিরও রংমিস্ত্রির কাজ নিয়ে চলে যান রাঙামাটিতে। তবে ঠিকমতো স্ত্রী-সন্তানের ভরণপোষণ দিতে পারতেন না তিনি।
ছোট দুই ভাইয়ের পড়াশোনা ও মায়ের সংসারের খরচ জোগাতে ঢাকার সাভারের শাশা গার্মেন্টে কাজ নেন নাইমুজ্জামান শুভ। নাহিদুজ্জামান শান্ত পড়ত অষ্টম শ্রেণিতে, তার ছোট মো. নাহিদ চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিল।
শুভর আপন চাচা রাজা মিয়া সাভারের শাশা গার্মেন্টের ব্যবস্থাপক। তাঁর স্ত্রীর বড় ভাই সিদ্দিকুর রহমানের ছেলে রাকিবও একই কারখানার সহকারী ইলেকট্রিশিয়ান। ঈদে তিনি ছুটি পাননি। তাই রাকিব সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর জন্য মেহেদী, কসমেটিকস, বোরকাসহ পরিবারের সদস্যদের জন্য কেনা ঈদের পোশাক বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব দেন শুভকে। এসব নিয়ে শুভ ২৯ মার্চ (২৮ রমজান) ভোররাতে বাসে করে গুলিশাখালীর নানাবাড়ি পৌঁছান। সকাল সাড়ে ৬টার দিকে তিনি মামা ব্র্যাক কর্মকর্তা ওয়াহিদুজ্জামান শিপলুর মোটরসাইকেল নিয়ে রাকিবের কেনা জিনিসপত্র পৌঁছে দিতে বরগুনার পাথরঘাটার কেরাতপুর রওনা হন। একই মোটরসাইকেলে ছিল তাঁর দুই ভাই শান্ত ও নাদিম।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল সাড়ে ৭টার দিকে পাথরঘাটার রায়হানপুর ইউনিয়নের সোনার বাংলা এলাকায় দুর্ঘটনার শিকার হয় তিন ভাই। পাথরঘাটা থেকে ছেড়ে আসা রাজিব পরিবহনের ঢাকাগামী বাস মোটরসাইকেলটিকে চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই চালকের আসনে থাকা শুভ ও পেছনে থাকা শান্ত ও নাদিম নিহত হয়।
ওই দিন বিকেলে বরগুনার মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে তিন ভাইয়ের মরদেহ উত্তর ভেচকি গ্রামের বাড়িতে নেওয়া হয়। আসরের নামাজের পর জানাজা হয়। গভীর রাতে রাঙামাটি থেকে বাড়ি ফেরেন বাবা নাসির খান। পরে দাদার কবরের পাশে তিন ভাইয়ের লাশ দাফন করা হয়।
মামা অহিদুজ্জামান শিপলু বলেন, ভোররাতে সাহ্রি সেরে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। তাই ভাগনে শুভ তাঁকে না জাগিয়েই পকেট থেকে মোটরসাইকেলের চাবি নিয়ে কেরাতপুর রওনা হয়। ঘুম থেকে উঠেই দুর্ঘটনায় তিন ভাগনের মৃত্যুর সংবাদ শোনেন।
তিনি আরও বলেন, শুভর বাবা চট্টগ্রামে (রাঙামাটি) থাকায় বোন শিউলি বেগম তাদের বাড়িতেই থাকেন। অসুস্থ মা-বাবাকে দেখাশোনা করেন। এর আগেও তাঁর ছোট সন্তান পানিতে ডুবে মারা যায়। এবার বড় তিন সন্তান হারিয়ে তারা ঠিকমতো কথা বলায় অবস্থায়ও নেই।
উত্তর ভেচকি গ্রামটি মঠবাড়িয়া পৌর শহরের প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে। ঈদের দিন সরেজমিন দেখা যায়, ওই গ্রামসহ বাইশকুড়া, কুমিরমারা ও গুলিশাখালী গ্রামের কারও মনে আনন্দ নেই। একই পরিবারের তিনটি সন্তানের মর্মান্তিক মৃত্যু কেউ মেনে নিতে পারছেন না।
বাইশকুড়া গ্রামের নেছার খানের (৪৮) ভাষ্য, যে ছেলেগুলো মারা গেছে, তাদের একজনের বয়সী তাঁরও ছেলে আছে। ওই তিন ছেলের শোকে ঈদে তাঁর ছেলে নতুন কেনা পোশাকও পরেনি।
উত্তর ভেচকি গ্রামের ব্যবসায়ী আ. কুদ্দুস খান (৭৫) বলেন, ‘আমার জীবনে এই প্রথম দেখলাম, এক মায়ের পেটের তিন ভাই এক দুর্ঘটনায় মারা গেল। এ ঘটনায় গোটা এলাকার মানুষ শোকাহত।’
একই গ্রামের কৃষক নুরুজ্জামানের ভাষ্য, এমন মৃত্যুর পর এলাকায় কোনো উৎসব ছিল না।
ঈদের নামাজ শেষে এলাকার সাত-আটটি ঈদগাহেই ওদের জন্য দোয়া হয়েছে। সবাই আল্লাহর
কাছে তিন ভাইয়ের জন্য কান্নাকাটি করেছেন। এমনই তথ্য জানান গুলিশাখালী গ্রামের বাসিন্দা মো. শফিকুল ইসলাম।
গুলিশাখালী গ্রামেই নানাবাড়িতে থাকেন শুভর মা শিউলি। তাঁর বাবা নুরুজ্জামান হাওলাদার (৮০) বলেন, তাঁর তিন ছেলে ও একমাত্র মেয়ে শিউলি। জামাতা নাসির ঠিকমতো সংসার চালাতে না পারায় মেয়ে ও নাতিদের নিয়ে আসেন। তিনি দরিদ্র হলেও বুড়ো বয়সে টিউশনি করে ওদের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ছোট নাতি হাসানের কবরের পাশেই তিনজনের দাফন করার ইচ্ছা ছিল তাঁর। কিন্তু জামাতার বিরোধিতায় তা হয়নি।
নুরুজ্জামান হাওলাদারের ভাষ্য, বড় নাতি শুভ ১০-১১ মাস আগে নূপুর নামে ময়মনসিংহের এক মেয়েকে বিয়ে করেছে। স্বামী-দেবরদের দুর্ঘটনার খবর পেয়ে সে-ও অজ্ঞান অবস্থায় আছে। ওই নববধূকে কী জবাব দেবেন তিনি?
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সড়ক দ র ঘটন ন হত দ র ঘটন র জন য ঠ কমত র কবর
এছাড়াও পড়ুন:
নোয়াখালীতে ১২ বছরের শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ
নোয়াখালীতে ১২ বছরের এক মেয়েশিশুকে (১২) ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। গতকাল মঙ্গলবার রাত আটটার দিকে বেগমগঞ্জ উপজেলায় এ ঘটনা ঘটে। অসুস্থ অবস্থায় শিশুটিকে গতকাল দিবাগত রাত ১২টার দিকে নোয়াখালীর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম আহসানুল কবির (৪০)। তাঁর বাড়ি রংপুর। একটি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের বিপণনকর্মী হিসেবে কাজের সূত্রে তিনি বেগমগঞ্জের একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করে আসছেন।
শিশুটির বাবা প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ও তাঁর স্ত্রী দুজনই চাকরি করেন। গতকাল রাতে ঈদের ছুটি কাটিয়ে গ্রাম থেকে বেগমগঞ্জের বাসাটিতে ফেরেন। রাতে কর্মস্থলে যেতে হয় তাঁর স্ত্রীকে। তিনিও বাসার বাইরে ছিলেন। মেয়েশিশুটি খালার সঙ্গে ঘরে ছিল। তিনি বলেন, বাসায় ঘর ঝাড়ু দেওয়ার সময় মুখ চেপে ধরে শিশুটিকে নিজের ঘরে নিয়ে যান পাশের ভাড়াটিয়া। এরপর তার মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে ও দড়ি দিয়ে হাত বেঁধে ধর্ষণ করা হয়। চিৎকার শুনে খালা সেখানে ছুটে যান। স্থানীয় বাসিন্দারাও এগিয়ে এসে শিশুটিকে উদ্ধার করেন।
নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) রাজীব আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, শিশুটির শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তাঁর স্বাস্থ্যের কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন। সেগুলো করা হচ্ছে।
বেগমগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লিটন দেওয়ান আজ বুধবার দুপুর সোয়া ১২টায় প্রথম আলোকে বলেন, শিশুটির পরিবার থানায় অবস্থান করছে। তাদের এজাহার পেলে ঘটনার বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে। অভিযোগের আলোকে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তি পিটুনিতে আহত হওয়ায় তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।