নতুন নির্বাচিত সংসদই সংবিধানের সংশোধন করবে বলে গণপরিষদ নির্বাচনের দরকার নেই– এই কথা বলে প্রথাগত রাজনীতিবিদরা প্রকারান্তরে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করছেন। সংসদই মাতৃপ্রতিষ্ঠান; গণপরিষদ নয়– এসব বলার কারণ দেশে ’৯১ সাল থেকে সংসদীয় ব্যবস্থার নামে সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র চালু ছিল। সংসদীয় প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র আসলে জনগণের সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করে। কারণ সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ আসনের জোরে সংবিধান পরিবর্তন বা সংশোধন করে ফেলা যায়; সেখানে গণভোটের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদের সার্বভৌমত্বের বদলে জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা হবে। বিরোধটা এখানেই।

সংবিধান প্রণয়ন ও সংশোধনে গণভোটের ব্যবস্থা না রেখে এবং জনগণের সঙ্গে সংলাপ ছাড়াই একটা রাজনৈতিক কাঠামো চাপিয়ে দিয়ে তাকেই দেশের শাসনতন্ত্র বলা অগণতান্ত্রিক। সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধিত্বের কথা বলে জনগণকে শোষণ করার জন্যই নানা আইন পাসের সংসদীয় কাঠামো বাস্তবে জনগণের মৌলিক অধিকার ও রাজনৈতিক অধিকার রক্ষায় কাজ করে না। তাই দরকার গণসার্বভৌমত্বকেন্দ্রিক রাজনৈতিক কাঠামো, যেখানে জনগণ প্রতিনিধি (সংসদ সদস্য) নির্বাচনের পরও জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে গণভোট দিয়ে সংসদকে জবাবদিহি রাখবে। আবার এখন যেহেতু ডিজিটাল পদ্ধতি, স্মার্ট ফোন আছে, জনগণ অনলাইন ভোটের মাধ্যমেও মতামত প্রকাশ করে রাষ্ট্র পরিচালনায় সরাসরি অংশ নিতে পারে। রাষ্ট্রপতিও নির্বাচিত হবেন জনগণের সরাসরি ভোটে। এভাবেই জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই আমূল পরিবর্তনের জন্য দরকার গণপরিষদ নির্বাচন বা সংবিধান সভা নির্বাচন। এই পরিষদ বা সভার কাজ হবে দেশের সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা এবং জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সংলাপের মাধ্যমে জনতার মতামত নিয়ে নতুন গঠনতন্ত্রের খসড়া তৈরি করা। 

এ ক্ষেত্রে কিছু মূলনীতি যেমন রাজনৈতিক কাঠামো কীভাবে একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক হবে; আবার জনগণের মর্যাদা, অধিকার, বিকাশ ত্বরান্বিত করবে; সরকার পদ্ধতি কেমন হবে; সব ধরনের বৈষম্য কীভাবে কমিয়ে আনা যাবে; রাষ্ট্রের তিন বিভাগের মাঝে ক্ষমতার বণ্টন ও ভারসাম্য; রাজনৈতিক দল গঠন ও নিবন্ধন নীতিমালা কেমন হলে সবার রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যাবে; প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার কীভাবে প্রতিষ্ঠা করা যাবে– এসব বিষয়ে আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের ভিত্তিতেই গঠনতন্ত্র বা সংবিধানের খসড়া তৈরি হবে। তারপর গণভোটে এই খসড়া পাস হলেই তাকে নতুন সংবিধান হিসেবে গ্রহণ করে এর ভিত্তিতে সংসদীয় নির্বাচন দিতে হবে। 

কারণ সংসদের ভিত্তিতে সরকার গঠনের নির্বাচন আর গণপরিষদ নির্বাচন সম্পূর্ণ আলাদা। সংসদ গঠিত হয় সংবিধানের ভিত্তিতে এবং সংসদ সেই গঠনতন্ত্রকে রক্ষার শপথ নিয়েই কাজ শুরু করে। সংসদ নির্বাচনের আইন, আসনের সীমানা, সংসদ নির্বাচনের পদ্ধতি এসবও সংবিধানের ভিত্তিতেই ঠিক হয়। গণপরিষদ নির্বাচন হয় সেই সংবিধান প্রণয়নের জন্য। ফলে সংসদ নির্বাচনের আগে দরকার গণপরিষদ নির্বাচন।

অনেকেই মনে করেন, আমাদের নতুন সংবিধান দরকার নেই। বিদ্যমান সংবিধানে কিছু ঘষামাজা করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। সরাসরি সংসদ নির্বাচন দিয়ে সরকার গঠন করলেই আমাদের এখনকার সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এটা আসলে রাজনীতি বিজ্ঞান এবং আধুনিক বুর্জোয়া গণতন্ত্র ও রাষ্ট্র সম্পর্কে কম বোঝাপড়ার কারণে হতে পারে। সংসদ নির্বাচন হচ্ছে সরকার গঠনের মামলা; তারও আগে রাষ্ট্র গঠন করতে হবে। আধুনিক বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন না করে সরকার গঠন করলে লাভ নেই। পুলিশ, প্রশাসনসহ রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক সব প্রতিষ্ঠানের আমূল সংস্কার দরকার। সে ক্ষেত্রে নতুন সংবিধানের বিকল্প নেই। আর নতুন সংবিধানের জন্য প্রয়োজন গণপরিষদ নির্বাচন। 

বুর্জোয়া গণতন্ত্রের মূল কথা গণমালিকানা প্রতিষ্ঠা এবং ব্যক্তির বিকাশকে কীভাবে আইনে, সংবিধানে, প্রশাসনিক কাঠামোতে এবং রাজনীতিতে রূপান্তর করা হবেম তা এই অন্তর্বর্তী সময়েই সুরাহা করতে হবে। ঔপনিবেশিক আইনসহ নানা নিবর্তনমূলক গণঅধিকার হরণকারী আইন ও সিস্টেম চালু রেখে সংবিধান ও রাষ্ট্র কাঠামোতে অনন্তকালীন জরুরি অবস্থা জারি রাখার যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু আছে, তা নতুন গঠনতন্ত্র ছাড়া দূর করা সম্ভব নয়। এসব আইন ও ব্যবস্থাই বারবার বাকশাল, সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র, সংসদীয় ফ্যাসিবাদের দিকে নিয়ে যায়। আমাদের রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়নি বলেই রাষ্ট্র, সরকার, রাজনৈতিক দল, প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয় সামন্তবাদী কাঠামোতে ভরা। বুর্জোয়া রাষ্ট্র গঠনে যে নতুন সংবিধান বা গঠনতন্ত্র প্রণয়ন প্রয়োজন, সে জন্যই প্রথমে গণপরিষদ নির্বাচন দিতে হবে। সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়ে গঠিত সংসদ সংবিধানের আমূল পরিবর্তন করতে পারবে না; এটা আইনি ও রাষ্ট্রনৈতিকভাবে সম্ভবও নয়। ফলে সংসদ নির্বাচন করে সংবিধান সংশোধনের আলাপ আসলে নতুন ফাঁদ। 
অনেকেই বলছেন, গণপরিষদ নির্বাচন বা নতুন সংবিধান প্রণয়নের দরকার হয় রাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণ অথবা বিপ্লবী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অথবা স্বাধীনতা যুদ্ধের পর। তাদের মতে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর যে সংবিধান রচিত হয়েছে তাই যথেষ্ট। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন সংবিধানের জন্য তাই গণপরিষদ নির্বাচনের উপযোগিতা নেই। কিন্তু ঔপনিবেশিক ও ফ্যাসিবাদী কাঠামোর ভিত্তিতে রাজনৈতিক বন্দোবস্তকে তো ‘রাষ্ট্র’ বলা যায় না! এই রাষ্ট্রে গণসার্বভৌমত্ব নেই। অথচ চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের দাবিই হচ্ছে জননিপীড়নমূলক কাঠামোর খোলনলচে পাল্টে ফেলে নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন। এই কাজ গত ৫৩ বছরে হয়নি; এখন আমাদেরই করতে হবে। গণঅভ্যুত্থানের পর গণপরিষদ নির্বাচনের বিকল্প নেই।

বিশ্বজুড়ে দেখা গেছে, যে কোনো ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরে নতুন সংবিধান প্রয়োজন হয়। ইতালিতে তাই ১৯৪৬ সালে গণপরিষদ নির্বাচন হয় এবং নির্বাচিত সংবিধান সভা গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নের পরই সরকার গঠনের নির্বাচন দেয়। চিলিতে ২০১৮ সালের গণআন্দোলনের সব অংশীদার একমত হন– বিদ্যমান সংবিধান সমাজ ও রাষ্ট্রে বৈষম্য ও অধিকার হরণ ঠেকাতে পারছে না; তা বাতিল করে নতুন সংবিধান তৈরি করতে হবে। ফলে ২০২১ সালে সেখানে গণপরিষদ নির্বাচন হয় এবং সংবিধান সভা নতুন সংবিধানের খসড়া তৈরি করে। চিলি যদি নতুন সংবিধান প্রণয়নে গণপরিষদ নির্বাচন দিতে পারে, আমরা পারব না কেন?

ড.

যোবায়ের আল মাহমুদ: সহযোগী অধ্যাপক, ফার্মাসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন ত স ব ধ ন প রণয়ন নত ন স ব ধ ন র র ষ ট র গঠন গণত ন ত র ক গঠনতন ত র সরক র গঠন গণতন ত র জনগণ র স ন র জন য র জন ত ক ন র পর আম দ র গণভ ট দরক র

এছাড়াও পড়ুন:

কারিগরি শিক্ষার্থীরা আন্দোলন সাময়িক স্থগিত করলেন

৬ দফা দাবি পূরণে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আশ্বাস পেয়ে চলমান আন্দোলন সাময়িক স্থগিত করেছেন কারিগরি শিক্ষার্থীরা। আজ মঙ্গলবার রাত আটটার দিকে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানায় আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সংগঠন কারিগরি ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ।

সংগঠনটি সংবাদ সম্মেলনে জানায়, আন্দোলনের যৌক্তিকতা বিবেচনায় নিয়ে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ, শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্প্রতি সচিবালয়ে এক অফিস আদেশের মাধ্যমে একটি কমিটি গঠন করেছে, যা শিক্ষার্থীদের ৬ দফা বাস্তবায়নের রূপরেখা প্রণয়নের লক্ষ্যে কাজ করবে। একই সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করেছে ও রূপরেখা প্রণয়নে ৩ সপ্তাহ সময় চেয়েছে।

আরও পড়ুনকারিগরি শিক্ষার্থীদের দাবি কী, পূরণে বাধা কোথায়, কী চিন্তা করছে সরকার২১ এপ্রিল ২০২৫

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি সমর্থন জানিয়ে শিক্ষার্থীরা সাময়িকভাবে আন্দোলন স্থগিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন বলে সংগঠনটি জানায়। তবে তাঁদের ৬ দফা দাবির বাস্তবায়ন ও কারিগরি সংস্কার কমিশন গঠনে গড়িমসি দেখা গেলে পুনরায় বিক্ষোভ ও আন্দোলন করা হবে।

পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের ছয় দফা দাবির মধ্যে প্রথমটি হলো, জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর পদে ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টরদের ৩০ শতাংশ পদোন্নতি কোটা বাতিল করতে হবে। এ ছাড়া জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর পদে ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টরদের পদোন্নতির রায় বাতিল, ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টরদের পদবি পরিবর্তন, মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চাকরিচ্যুত, ২০২১ সালে নিয়োগ পাওয়া ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টরদের নিয়োগ বাতিল এবং সেই বিতর্কিত নিয়োগবিধি অবিলম্বে সংশোধন করতে হবে।

এসব দাবিতে বেশ কিছুদিন ধরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় কারিগরি শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করে আসছিলেন। এর ফলে জনদুর্ভোগ তৈরি হয়।

আরও পড়ুনপলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের ৬ দফা দাবি বাস্তবায়নে ৮ সদস্যের কমিটি৩ ঘণ্টা আগে

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নতুন নিরীক্ষা অধ্যাদেশ নিয়ে উদ্বেগ টিআইবির
  • গাজীপুরে এনসিপির বিক্ষোভে আ.লীগের নিষিদ্ধ করার দাবি
  • গণপরিবহনে যৌন হয়রানি দেখলে চুপ না থেকে প্রতিবাদ করুন: শেখ মইনউদ্দিন
  • আইসিটি খাতে দুর্নীতির তদন্ত ও শ্বেতপত্র প্রণয়নে টাস্কফোর্স গঠন
  • আইসিটি খাতের দুর্নীতি তদন্ত ও শ্বেতপত্র প্রণয়নে টাস্কফোর্স গঠন
  • কারিগরি শিক্ষার্থীরা আন্দোলন স্থগিত থেকে সরে এল
  • রাজউকের বোর্ডে আমলা থাকলে চলবে না, বিশেষজ্ঞ রাখতে হবে: উপদেষ্টা রিজওয়ানা
  • কেন্দ্রীয় দুই নেতার জেলা কমিটিতে প্রার্থী ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক
  • আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে এনসিপির বিক্ষোভ
  • কারিগরি শিক্ষার্থীরা আন্দোলন সাময়িক স্থগিত করলেন