জ্ঞানতাপস সরদার ফজলুল করিম একটি কথা বলতেন– মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জীবন পূর্ণতা পায়। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত আমরা জীবনকে পুরোপুরি জানি না; জানা সম্ভব হয় না। সন্‌জীদা খাতুন গত ২৫ মার্চ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জীবনের দীর্ঘ যাত্রার ইতি টেনেছেন। আজ তাঁর ৯৩তম জন্মদিন।

সন্‌জীদা খাতুন বাঙালির ইতিহাসের কঠিনতর কালপর্বে বেড়ে উঠেছেন। উত্তর-উপনিবেশকালে বাঙালি ও মুসলমানের সাংস্কৃতিক টানাপোড়েনে আত্মপরিচয়ের সংকট উত্তরণের যে লড়াই, তা তাঁকে ঋদ্ধ করেছে। সন্‌জীদা খাতুনের শিক্ষা ও চিন্তার ভিত্তি তাঁর পরিবার। বাবা জাতীয় অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন সে সময়ের মুক্তবুদ্ধির আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। সন্‌জীদা খাতুনের ভিত্তিভূমে মহিরুহ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। 

গত শতকের ষাটের দশকে ভাষা ও সংস্কৃতির লড়াই শুরু হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী আয়োজনের মধ্য দিয়ে এ ভূখণ্ডের মানুষ বুঝতে পারে রবীন্দ্রনাথের শক্তি ও প্রয়োজনীয়তা। তারা লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে প্রতিষ্ঠা করে; নিজেদের করে নেয়। এ লড়াই-ই বলা চলে বাঙালির ভাষা-সংস্কৃতি ফিরে পাওয়ার ভিত্তিভূমি তৈরি করেছিল। কবি সুফিয়া কামালকে সামনে রেখে সন্‌জীদা খাতুন, ওয়াহিদুল হক, মোখলেসুর রহমান, ফরিদা হাসান প্রমুখ তরুণ সংস্কৃতিকর্মী তখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু এর ব্যাপ্তি ছিল বিশাল। 

জাতীয়তাবাদকে নিয়ে সংস্কৃতির সে লড়াই গোটা ষাটের দশক জাতীয় রাজনীতির শিকড়ে পুষ্টি জুগিয়েছে। ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, পরে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এসে সে ঢেউ আছড়ে পড়েছে। কিন্তু সন্‌জীদা খাতুন রাজনীতি করতে চাননি; শুধু সংস্কৃতির সঙ্গেই থাকতে চেয়েছেন। তাঁর আত্মজীবনী ‘সহজ কঠিন দ্বন্দ্বে ছন্দে’ বইয়ে তিনি লিখেছেন, ‘রাজনীতি আমার ক্ষেত্র নয়, সাংস্কৃতিক আন্দোলনই আমার আসল কাজের ক্ষেত্র। বিশেষ করে বাংলাদেশ বা বাঙালি সাংস্কৃতিক স্বাধিকার সংরক্ষণ আমার উপযুক্ত কাজের ক্ষেত্র।’ তারপরও তাঁর লড়াইয়ে সব সময় তিনি সহযোগিতা পেয়েছেন দেশের বামপন্থি বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মী ও ছাত্রদের। সন্‌জীদা খাতুন তাঁর কর্মপরিধি বিস্তৃত করেছেন ছায়ানট, জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ, নালন্দা, কণ্ঠশীলন, ব্রতচারী সমিতিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। তিনি সৃজন কর্ম, জ্ঞান সাধনায় ছিলেন অনন্য। জীবনের দীর্ঘ সময় এটাকেই ব্রত হিসেবে শিরোধার্য করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। একাত্তরে কলকাতায় সব শিল্পীকে সংগঠিত করে গড়ে তুলেছিলেন শিল্পী সংস্থা।  

সন্‌জীদা খাতুন নিজস্ব একটি দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন। তা হচ্ছে সংস্কৃতির জাগরণের মধ্য দিয়ে বাঙালি মুসলমানের চিন্তা ও বিবেকের মুক্তি এবং স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা; বাঙালিকে বিশ্বমানব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু কখনও কোনো সরকারের তোষামোদি করেননি। ২০০১ সালে রমনা বটমূলে বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমার আঘাতে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটলে সন্‌জীদা খাতুন রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে সেদিন দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমরা ভয় পাইনি।’ সেদিন তাঁর সে কথা অনেককেই সাহস জুগিয়েছিল।    

সন্‌জীদা খাতুন দেশ-বিদেশে বহু পুরস্কার পেয়েছেন। একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার (ভারত), দেশিকোত্তম পুরস্কার (ভারত), রবীন্দ্র তত্ত্বাচার্য (ভারত), পদ্মশ্রী (ভারত) ইত্যাদি। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ স্বাধীনতা পদক তিনি পাননি। বিগত শেখ হাসিনার শাসনামলে রাষ্ট্রীয় প্রায় সব পুরস্কারই দেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনা থেকে। সরকার বদলালেও সে ধারায় এখনও উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। সন্‌জীদা খাতুনের মৃত্যুতে রাষ্ট্র সম্মান জানাতে পারেনি। রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো– না জানানোতে সন্‌জীদা খাতুনের কিছু যায় আসে না। কিন্তু আমরা আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের এ-পক্ষ, ও-পক্ষ বলে যেভাবে বিভক্ত করে ফেলছি, তা জাতি হিসেবে আমাদের মাথা নত করে দেয়। আজকে যারা ক্ষমতায় তাদের হয়তো এতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু এটি এই সরকারের একটি খারাপ নজির হয়ে রইল। আমাদের সরকারগুলো কখনোই যেন ‘বামন কাঠামো’ ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারে না। কাউকে ইচ্ছা করলেই টেনে ওপরে তোলা যায় না বা কাউকে জোর করেও নিচে টেনে রাখা যায় না– ইতিহাসের এই অমোঘ সত্য শেখ হাসিনার বিগত শাসনামলে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। ইতিহাসে যার যেখানে জায়গা, তা নড়ানো যায় না। এর পরও শিক্ষা না হলে আরও কঠিন মূল্য দেওয়ার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। 

সন্‌জীদা খাতুন আমাদের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমাদের সংস্কৃতির লড়াইয়ের দীর্ঘ যাত্রায় তাঁকে কখনও আলাদা করা যাবে না।     

রফিউর রাব্বি: লেখক, সংস্কৃতিকর্মী

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: মত মত প রস ক র রব ন দ র আম দ র র জন ত ক ত কর সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

দুর্লভ হীরা চুরি, প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতার খেলা

রেহান একজন সাধারণ মানুষ; যার জীবনে কোনো নিয়ম নেই। আছে কেবল লক্ষ্য আর প্রতারণার কৌশল। তাঁর চোখে-মুখে যেমন স্মার্টনেস, তেমনি ভয়ংকর ঠান্ডা হিসেবি হিমশীতলতা। ভারতের অপরাধ জগতের এক নীরব শাসক রাজন আউলাখ তাঁকে একটি অসম্ভব মিশনের জন্য নিয়োগ করেন। তা হলো ‘আফ্রিকান রেড সান’ নামে এক দুর্লভ হীরা চুরি করতে হবে। এটি করলেই রেহান পাবেন প্রায় আড়াইশ কোটি টাকা। রেহান বিভিন্ন ছদ্মবেশে হীরা চুরির পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী না হওয়ায় শুরু হয় প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতার খেলা। 

এমনই গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছে বলিউডের নতুন সিনেমা ‘জুয়েল থিফ: দ্য হাইয়েস্ট বিগিন্স’। নেটফ্লিক্সের এ সিনেমার মাধ্যমে বেশ কয়েক মাসের বিরতি শেষে ফিরছেন বলিউডের ছোট নবাব সাইফ আলি খান। এবার তাঁকে দেখা যাবে একদম ভিন্ন ধরনের এক চোরের ভূমিকায়।

সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে সাইফ আলি খান বলেন, ‘‘রেহান চরিত্রটি আমার কাছে শুধু এক চোর নয়; সে এক দার্শনিক। সে জানে কীভাবে মানুষকে পড়তে হয়, আর নিজের অস্তিত্বকে প্রতারণার চাদরে মুড়িয়ে ফেলতে হয়। ‘জুয়েল থিফ: দ্য হাইয়েস্ট বিগিন্স’ শুধু একটি সিনেমা নয়, এটি এক অভিজ্ঞতা। চোরের চোখ দিয়ে বিশ্ব দেখার এক সুযোগ। যেখানে নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ, এবং বিশ্বাস একটি খেলনা মাত্র।’’

সিনেমাটির শুটিং হয়েছিল মুম্বাই ও বুদাপেস্ট শহরে। পরিচালক কুকি গুলাটি ও রব্বি গ্রেওয়াল গল্প বলার ধরনে আধুনিকতা এনেছেন। টানটান থ্রিলার ফর্মুলাটিকে হারাননি। প্রযোজক সিদ্ধার্থ আনন্দ জানিয়েছেন, ‘এই সিনেমা শুধু হীরার চুরির গল্প না, এটি একজন মানুষের নিজেকে খুঁজে পাওয়ারও গল্প।’
এ সিনেমার মাধ্যমে ১৭ বছর পর আবারও একসঙ্গে কাজ করলেন সাইফ আলি খান ও সিদ্ধার্থ আনন্দ।

আবারও তাঁর সঙ্গে কাজ প্রসঙ্গে সাইফ আলি খান বলেন, ‘সিদ্ধার্থ আনন্দের সঙ্গে পুনরায় কাজ করার ক্ষেত্রে সবসময় ঘরে ফিরে আসার মতো অনুভূত হয়। সিদ্ধার্থ যেভাবে অ্যাকশন, স্টাইল ও গল্প বলার ক্ষেত্রে একটা সুন্দর সংযোগ তৈরি করে তা সত্যিই বিশেষ। জুয়েল থিফ-এ আমরা সমস্ত সীমা অতিক্রম করেছি এবং কাজ করে অনেক আনন্দ পেয়েছি। জয়দীপ আহলাওয়াতের সঙ্গে পর্দা ভাগ করে নেওয়ার অভিজ্ঞতাও দারুণ। তাঁর অভিনয়ে অনেক গভীরতা রয়েছে। এটি সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতাটিকে আরও উত্তেজনাপূর্ণ করে তুলেছে।’

অন্যদিকে, জয়দীপ আহলাওয়াত জানান, ‘রাজন এমন এক চরিত্র, যে সব নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। যখন সে রেহানের মতো কাউকে পায়, তখন সংঘর্ষটা হয় ব্যক্তিত্ব আর বুদ্ধির। সেটিই দর্শকের সবচেয়ে বড় উপভোগ হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এটি এমন এক নতুন মহাবিশ্বে প্রবেশের অভিজ্ঞতা, যেখানে অনেক মানুষ আপনার মতোই উত্তম কিছু উপহার দেওয়ার জন্য উৎসাহিত। এটি এমন একটা ছবি যেমনটা আমি সবসময় করতে চেয়েছিলাম। সাইফ ও সিদ্ধার্থের মতো সেরা সহ-অভিনেতা ও নির্মাতাদের সঙ্গে কাজ করার চেয়ে ভালো আর কিছু হতে পারে না।’

গত ১৪ এপ্রিল প্রকাশ হয় সিনেমার ট্রেলার। বুদাপেস্ট থেকে মুম্বাই, হেলিকপ্টার থেকে আন্ডারগ্রাউন্ড ভল্ট–যেখানে যেখানে ট্রেলার ছুটে গিয়েছে, সেখানে ছড়িয়েছে রোমাঞ্চ। পেছনে বাজছে রহস্যময় সাউন্ডট্র্যাক, ক্যামেরার খেলায় ধরা পড়ে দুর্দান্ত অ্যাকশন, রোমাঞ্চ আর ভয়ের গল্পগুলো। এ থ্রিলারে শুধু পাঞ্চ আর প্ল্যানিং নেই, আছে আবেগও। কিছুদিন আগে সিনেমার প্রথম গান ‘জাদু’ প্রকাশ হয়েছে। সেখানে রেহান ও ফারাহর (নিকিতা দত্ত) সম্পর্কের সূক্ষ্ম ছায়া দেখা যায়। এরপর প্রকাশ হয় ‘ইলজাম’ শিরোনামের আরও একটি গান। যেখানে দেখা যায় রেহানের অতীতের আক্ষেপের কাহিনি। 

‘জুয়েল থিফ: দ্য হাইয়েস্ট বিগিন্স’ সিনেমায় আরও অভিনয় করেছেন রহস্যময় ফারাহ (নিকিতা দত্ত), প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ আবিদ (কুনাল কাপুর) এবং প্রবীণ অপরাধবিশারদ ব্রিজ মোহন সিংহ (কুলভূষণ খারবান্দা)। প্রতিটি চরিত্রই যেমন রহস্যে মোড়া, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ গল্পের বাঁকে। অভিনয়ের পাশাপাশি প্রতিটি শিল্পী নিজেকে ভেঙে আবার গড়েছেন। প্রকাশ হওয়া ট্রেলারে দেখা যায় চোখ ধাঁধানো লোকেশন, একের পর এক ধোঁয়াশা আর অ্যাকশন দৃশ্য মিলিয়ে এটি যেন ভারতীয় হাইয়েস্ট ঘরানার এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা; যা দেখে একজন দর্শক লিখেছেন, ‘‘এটি যেন ইন্ডিয়ার ‘মানি হায়েস্ট’ কিন্তু অনেক বেশি স্টাইলিশ আর সাসপেন্স ভরা।”

ফলে বলা যায় ২ ঘণ্টা ২০ মিনিটের এই সিনেমায় শুধু থ্রিল নয় ধরা দেবে একটি অনুভবের গল্প। বলা যায়, যারা থ্রিলার ভালোবাসেন, তাদের জন্য এটি হতে পারে বছরের সবচেয়ে প্রতীক্ষিত উপহার। আগামীকাল নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাবে সিনেমাটি। এই সিনেমার হাত ধরে নির্মাতা সিদ্ধার্থ আনন্দ ও তাঁর স্ত্রী মমতা আনন্দের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ম্যাটরিক্স পিকচার্সের ওটিটি অভিষেক হচ্ছে। 
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নৈঃশব্দ্যের টংকার
  • মোহ কাঠের নৌকা: বাস্তবতার এক প্রতিচ্ছবি
  • বৈচিত্র্যময় প্রতিভার মরিস ল্যাংলো ওয়েস্ট
  • জবি রেজিস্ট্রারের পদত্যাগ দাবিতে কুশপুত্তলিকা দাহ, ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম
  • রিয়ালের আগ্রহ নিয়ে মুখ খুললেন অ্যালিস্টার 
  • ‘কিছু লোকজনের অনুরোধে’ ঠিকাদারি লাইসেন্স নিয়ে ‘বিব্রত’ উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের বাবা
  • সরকার বাংলাদেশকে উৎপাদন ও অর্থনৈতিক কেন্দ্রে রূপান্তর করতে চায়: বিনিয়োগকারীদের প্রধান উপদেষ্টা
  • দুর্লভ হীরা চুরি, প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতার খেলা
  • নিজের যত্ন নিন
  • জনসমর্থন নেই-এমন কাজ করলে ব্যবস্থা: নেতাকর্মীকে তারেক রহমান