চট্টগ্রামে মূল শহর থেকে কিছুটা দূরে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত। বছরজুড়ে এই সৈকতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে ছুটে আসেন শহর ও আশপাশের এলাকার লোকজন। দর্শনার্থীদের মধ্যে থাকেন বাইরের জেলার মানুষও। বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় ঈদের ছুটিতে পর্যটকের ঢল নামে সৈকতে। ঈদের আনন্দ উদ্‌যাপনে সময় কাটাতে সমুদ্র দেখতে হাজির হন হাজারো মানুষ। সকাল থেকে বিকেল, সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত পর্যন্ত মানুষের উপস্থিতিতে মুখর সৈকত এলাকা।

আজ বুধবারও এই চিত্রের পরিবর্তন হয়নি। ঈদের দিন বিকেল থেকে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে আসতে শুরু করেন নানা শ্রেণি-পেশার বিভিন্ন বয়সের মানুষ। আজও পর্যটকের ভিড় লেগেই ছিল।

সৈকতে বেড়াতে আসা পর্যটকদের দল বেঁধে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। অনেকেই সৈকতের বালুচরে নেমে সমুদ্রে স্নান করেন। কেউ কেউ স্পিডবোটে চড়েন।

চট্টগ্রামের মিরসরাই থেকে কলেজপড়ুয়া ছয় বন্ধু আজ বিকেলে এসেছিলেন বেড়াতে। তাঁদের একজন সালেহ নকীব। তিনি বলেন, ঈদের সময় লম্বা ছুটি পাওয়া যায়। বন্ধুরাও গ্রামে আসেন। সবাই মিলে প্রতিবছর ঈদে একেক জায়গায় বেড়াতে যান। এবার অবশ্য বেশি দূরে যাননি। পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে এসেছেন।

নগরের সাগরিকা থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত আউটার রিং রোড এবং পতেঙ্গায় কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের পর এই এলাকার আগের চেনা পরিবেশ পাল্টে গেছে। বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে নির্মিত আউটার রিং রোডের পাশে এলাকাও দর্শনার্থীদের ঘুরে বেড়ানোর জায়গায় পরিণত হয়েছে।

চট্টগ্রামের হাটহাজারী থেকে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে এসেছিলেন চাকরিজীবী শাহাদাত হোসেন। তিনি বলেন, এবার ঈদে লম্বা ছুটি মিলেছে। তাই ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে এখানে বেড়াতে এসেছেন। পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত, টানেল ঘুরে দেখেছেন। তাঁদের ছোটবেলার সঙ্গে এখনকার সৈকতের পরিবেশ অনেক পাল্টে গেছে।

ঈদের দিন সোমবার থেকে বুধবার পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত এলাকায় এক লাখের বেশি মানুষ ঘুরতে এসেছেন বলে জানান পতেঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শফিকুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঈদের ছুটিতে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে মানুষের ঢল নেমেছে। পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে এসেছেন হাজার হাজার মানুষ। বিপুলসংখ্যক পর্যটক এলেও কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলার ঘটনা ঘটেনি। শুরু থেকে তাঁরা তৎপর ছিলেন।

সম্প্রতি চট্টগ্রামে তিনটি পার্ক বন্ধ হয়ে যায়। আগ্রাবাদ, কাজীর দেউড়ি ও বহদ্দারহাট এলাকার এই তিনটি পার্ক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দর্শনার্থীদের চাপ বেড়ে গেছে চালু থাকা বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে। পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতের পাশাপাশি চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা, ফয়’স লেক, কর্ণফুলী নদীর তীরেও ঘুরতে বের হওয়া মানুষের জমজমাট উপস্থিতি ছিল। চিড়িয়াখানায় তিন দিনে ৪০ হাজারের মতো মানুষ ঘুরতে এসেছিলেন। চিড়িয়াখানায় দর্শনার্থীদের বেশি আগ্রহ ছিল বাঘ, সিংহ, হরিণ, বানর নিয়ে। এসব প্রাণীর খাঁচার সামনে দর্শনার্থীদের ভিড় লেগেই ছিল। পশুপাখি দেখতে শিশু-কিশোরদের আগ্রহই বেশি চোখে পড়েছে।

চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার ডেপুটি কিউরেটর শাহাদাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এবার ঈদের দিন থেকেই দর্শনার্থীদের চাপ ছিল। তিন দিনে ৪০ হাজারের বেশি মানুষ ঘুরতে এসেছেন। ঈদের ছুটি এখনো শেষ হয়নি। আশা করছেন, আগামী দু-তিন দিন এই ভিড় থাকবে।

চিড়িয়াখানার পাশেই রয়েছে ফয়’স লেক। সেখানেও দর্শনার্থীদের ভিড় লেগে ছিল। এখানে তিনটি অংশ রয়েছে—ফয়’স লেক কনকর্ড অ্যামিউজমেন্ট, সি ওয়ার্ল্ড ও বেজক্যাম্প। সবখানে মানুষের সরব উপস্থিতি। সি ওয়ার্ল্ডের সুইমিংপুলে শত শত মানুষ আনন্দে মেতেছেন। নানা বয়সী মানুষ মেতে উঠেছেন জলকেলিতে। পার্কের রাইডগুলোতেও চড়ে বসেছে অনেক শিশু-কিশোর।

ফয়’স লেক কমপ্লেক্সের পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান কনকর্ডের ব্যবস্থাপক (বিপণন) বিশ্বজিৎ ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, এবার নতুন করে ছয়টি রাইড যুক্ত করা হয়েছে। এতে মানুষের আগ্রহ বেড়েছে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: এস ছ ন স কত র

এছাড়াও পড়ুন:

হরমোনজনিত রোগের চিকিৎসা দেশেই সম্ভব

বাংলাদেশে ডায়াবেটিস, থাইরয়েডসহ অন্যান্য হরমোনজনিত রোগের প্রকোপ অনেক বেশি। মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশের বেশি কারও না কারও হরমোনজনিত সমস্যা আছে। তবে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করলে ডায়াবেটিসসহ হরমোনজনিত রোগ প্রতিরোধ সম্ভব। বর্তমানে দেশেই এসব রোগের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
বিশ্ব হরমোন দিবস উপলক্ষে গত ১৯ এপ্রিল রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সমকাল সভাকক্ষে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে হরমোন বিশেষজ্ঞরা এসব কথা বলেন। সমকাল ও অ্যাসোসিয়েশন অব ক্লিনিক্যাল এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট অ্যান্ড ডায়াবেটোলজিস্ট অব বাংলাদেশ (এসেডবি) যৌথভাবে এর আয়োজন করে। সার্বিক সহযোগিতায় ছিল রেনাটা পিএলসি।

অধ্যাপক ডা. মো. ফরিদ উদ্দিন

বাংলাদেশে ডায়াবেটিস, থাইরয়েডসহ অন্যান্য হরমোনজনিত রোগের প্রকোপ অনেক বেশি। মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশের বেশি কারও না কারও হরমোনজনিত সমস্যা আছে। তবে তাদের বেশির ভাগই এটি জানেন না। হরমোনের চিকিৎসা তেমন জটিল নয়। বাংলাদেশেই এসব সমস্যার চিকিৎসা সম্ভব। ডায়াবেটিস, থাইরয়েড এবং অন্যান্য হরমোনজনিত সমস্যার চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমাদের অধিকাংশ মেডিকেল কলেজে এসব রোগের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু রোগীর অনুপাতে চিকিৎসকের সংখ্যা এখনও অপ্রতুল। 

হরমোনের চিকিৎসা মূলত হাসপাতালের বহির্বিভাগকেন্দ্রিক। ৮০ শতাংশ মানুষই বহির্বিভাগ থেকে চিকিৎসা নেন। ২০ শতাংশকে ভর্তি করার প্রয়োজন পড়ে। প্রতিটি হাসপাতালে এন্ডোক্রাইন কর্নার করা প্রয়োজন। তাহলে এই সেবা দেওয়া আরও সহজ হবে। এ ছাড়া এ বিভাগে চিকিৎসক পদায়নের কাজ ত্বরান্বিত করা হলে মানুষ উপকৃত হবে। এই বিভাগে ৫০ শতাংশ রোগী রয়েছে। তাই এত রোগীকে সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করতে হবে। 

প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। ডায়াবেটিস ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ প্রতিরোধযোগ্য। কেবল সঠিক জীবনযাপনের মাধ্যমেই এ ধরনের ভয়াবহ রোগকে প্রতিরোধ করা সম্ভব। এ জন্য টাকা-পয়সার প্রয়োজন নেই। নিজের জীবন পদ্ধতি ঠিক করলেই হবে। সরকারি পর্যায়েও এ বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে, প্রচার চালাতে হবে। ডায়াবেটিস হওয়ার আগেই রক্তে চিনির মাত্রা কেমন, সেটি জানার জন্য স্ক্রিনিং করতে হবে। এ জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। আগে আগে রক্তে চিনির মাত্রা চিহ্নিত করা গেলে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় আয়োডিন গ্রহণ করলে থাইরয়েডের অনেক সমস্যা চলে যাবে।

হরমোন ভালো রাখতে কিছু সুপারিশ মেনে চলতে হবে। এর মধ্যে অন্যতম স্বাস্থ্যকর জীবন পদ্ধতি মেনে চলা। নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করা, সুষম খাদ্য গ্রহণ ও পর্যাপ্ত ঘুম। এ ছাড়া এড়ানো যায় এমন হরমোনের ঘাটতি প্রতিরোধ করতে হবে। এ জন্য শরীরে পর্যাপ্ত রোদ লাগাতে হবে, আয়োডিনযুক্ত লবণ গ্রহণ করতে হবে এবং ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবার গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি হরমোনবিরোধী পদার্থের সংস্পর্শ এড়াতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে প্লাস্টিকের তৈরি পাত্র থেকে খাবার গ্রহণ না করা, বাড়ি ও তার আশপাশের বাতাস নিয়মিত বিশুদ্ধ করা, প্রসাধনসামগ্রী ব্যবহারের আগে হরমোনবিরোধী পদার্থ (থ্যালেট, প্যারাবেন, ট্রাইক্লোসান ইত্যাদি) আছে কিনা দেখে নেওয়া এবং হরমোনজাতীয় রোগের প্রাথমিক লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত হরমোন রোগ বিশেষজ্ঞকে (এন্ডোক্রিনোলজিস্ট) দেখানো।

অধ্যাপক ডা. মো. রুহুল

ও অপচিকিৎসার মধ্যে মার্জিন টানা খুব কঠিন। একসময় যেটা চিকিৎসা, পরবর্তী সময়ে সেটাই অপচিকিৎসা হিসেবে প্রমাণিত হয়। একসময় ডায়াবেটিস রোগীদের তেমন খাবার দেওয়া হতো না। ফলে পুষ্টিহীনতায় তারা মারা যেতেন। এটা অপচিকিৎসা। কিন্তু একসময় এটা ভালো চিকিৎসা ছিল। দিনে দিনে মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে নতুন ও আধুনিক চিকিৎসা এবং ঔষধ আসছে। হঠাৎ করে শোনা যায়, কোথাও কেউ একজন পানি পড়া দিচ্ছে, তাতে ডায়াবেটিসসহ সব রোগ ভালো হয়ে যাচ্ছে। কিছুদিন পর সেসব রোগীই উচ্চ রক্তচাপ কিংবা প্রচণ্ড ডায়াবেটিস নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। একইভাবে বর্তমানে মিডিয়ার নানা ধরনের ওষুধের বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষকে প্রলোভন দেখানো হয়। এই অপপ্রচারের আড়ালে তারা নিজেদের বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করে। এগুলোকে সুচিকিৎসা বলা যাবে না। আবার চিকিৎসাও অপচিকিৎসা হতে পারে, যদি উদ্দেশ্য খারাপ থাকে। ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে দামি ওষুধ ব্যবস্থাপত্রে লিখে দেওয়াও অপচিকিৎসার অংশ। 

থাইরয়েডের ক্ষেত্রে অনেক সময় যাদের অস্ত্রোপচার জরুরি, তার অস্ত্রোপচারে বিলম্ব করা হয়। আবার যাদের অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন নেই, কিছু টাকার জন্য এমন রোগীর অস্ত্রোপচার করেন অনেকে। এটাও অপচিকিৎসা। আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি অপচিকিৎসা হয় যৌন ও প্রজননক্ষেত্রে। হাটবাজার থেকে শুরু ইউটিউব-ফেসবুকে এ বিষয়ে মহাচিকিৎসকদের দেখা মেলে। এই অপপ্রচারের ফলে মানুষ প্রকৃত চিকিৎসা নিতে দেরি করে। যার ফলে রোগটা আরও জটিল হয়ে ওঠে। অপচিকিৎসা রোধে গণমাধ্যমকেও ভূমিকা রাখতে হবে। 

অধ্যাপক ডা. ইন্দ্রজিৎ প্রসাদ

স্টেরয়েড হরমোন চিকিৎসাবিজ্ঞানে এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। এটি বিভিন্ন জটিল রোগে জীবন রক্ষায় ব্যবহৃত হয়। যেমন– হাঁপানি, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, লুপাস, অ্যালার্জি, কিছু ক্যান্সার এবং অঙ্গ প্রতিস্থাপনের পর শরীরের প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে। তবে এ জীবনরক্ষাকারী হরমোনই কখনও কখনও হয়ে উঠতে পারে শরীরের নিঃশব্দ ধ্বংসকারী, যদি এটি চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া, ভুল মাত্রায় বা দীর্ঘদিন ব্যবহৃত হয়।

অতিরিক্ত স্টেরয়েড সেবনে নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে, যেমন– ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ওজন বৃদ্ধি, হাড়ক্ষয় (অস্টিওপোরোসিস), চামড়া পাতলা হয়ে যাওয়া, সংক্রমণের ঝুঁকি বৃদ্ধি, চোখের ছানি এবং মানসিক বিষণ্নতা। শিশুরা দীর্ঘ মেয়াদে ব্যবহারে স্বাভাবিক বৃদ্ধি হারাতে পারে, রয়ে যেতে পারে বেঁটে। মুখে খাওয়া, ইনজেকশন, ইনহেলার বা চর্মে ব্যবহৃত সব স্টেরয়েডেই এসব ঝুঁকি থাকতে পারে। এ কারণে স্টেরয়েড ব্যবহারে চাই যথাযথ সতর্কতা। শুধু প্রয়োজনে, নির্ধারিত ডোজে ও সময়ে এবং অভিজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে এটি গ্রহণ করতে হবে। আমাদের উচিত স্টেরয়েডকে না ভয় পেয়ে বরং সঠিকভাবে ব্যবহার করা; যাতে এটি জীবন রক্ষা করে, ক্ষতি নয়।

অধ্যাপক ডা. এ কে এম আমিনূল ইসলাম

একসময় ডায়াবেটিস ও হরমোনজনিত রোগের চিকিৎসা মূলত শাহবাগে বারডেমকেন্দ্রিক ছিল। বাংলাদেশ মেডিকেল ইউনিভার্সিটিতে (সাবেক পিজি/বিএসএমএমইউ) হরমোনবিষয়ক উচ্চতর শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা চালুর মাধ্যমে এর সম্প্রসারণ শুরু হয়। এরপর পুরোনো আটটি মেডিকেল কলেজে ডায়াবেটিস ও হরমোন বিভাগ চালুর মাধ্যমে সরকারি পর্যায়ে ডায়াবেটিস ও হরমোন স্বাস্থ্যসেবা শুরু হয়। বরিশাল শের-ই-বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় ছাড়া পুরোনো বাকি সাতটি মেডিকেল কলেজেই পূর্ণোদ্যমে ডায়াবেটিক ও হরমোন রোগীদের জন্য বহির্বিভাগ ও আন্তঃবিভাগে স্বাস্থ্যসেবা চালু রয়েছে। এর বাইরেও কুমিল্লা, খুলনা, বগুড়া, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজে বহির্বিভাগ চালু রয়েছে। বেসরকারি পর্যায়েও এখন বারডেমের পাশাপাশি বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ, উত্তরা আধুনিক, ইবনে সিনা, টিএমএসএস, ইউনিভার্সাল, মুন্নু মেডিকেল কলেজ এবং স্কয়ার, ইউনাইটেড, এভারকেয়ার, বিআরবি, আজগর আলীসহ আরও কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে ডায়াবেটিস ও হরমোনবিষয়ক স্বাস্থ্যসেবা চালু রয়েছে। এর বাইরে ডায়াবেটিক সমিতি দেশব্যাপী বিস্তৃত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে শুধু ডায়াবেটিক রোগীদের সেবা দিয়ে থাকে। অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক এই যে, সরকারি পর্যায়ে প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অসংক্রামক রোগ, যেমন– ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের জন্য এনসিডি কর্নার স্থাপন করা হয়েছে। যেখান থেকে ওই সব রোগীকে পুরো এক মাসের ওষুধ বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়, যা অসংক্রামক রোগী ব্যবস্থাপনায় গুণগত মৌলিক পরিবর্তন এনেছে। এ ছাড়া সরকারি কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোয় গ্লুকোমিটারের মাধ্যমে ডায়াবেটিক রোগীদের রক্তের গ্লুকোজ নির্ণয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। সবার চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারলে হরমোনজনিত রোগীর সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব।

অধ্যাপক ডা. মো. শাহজামাল খান

শরীরে হরমোনের স্বল্পতা ও আধিক্যের কারণে হাড়ক্ষয় হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে মেনোপজের পর ইস্ট্রোজেন হরমোনের স্বল্পতা এবং ছেলেদের ক্ষেত্রে টেস্টোস্টেরন হরমোনের স্বল্পতার কারণে হাড়ক্ষয় হয়ে থাকে, যাকে আমরা অস্টিওপোরোসিস বলি। এ ছাড়া থাইরয়েড, প্যারাথাইরয়েড, কর্টিসল হরমোনের আধিক্যের কারণেও হাড়ক্ষয় হয়ে থাকে। এসব বিষয়ে জনসচেতনতা জরুরি এবং সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে হাড়ক্ষয় রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

অধ্যাপক ডা. নুসরাত সুলতানা

মানবদেহে নানা ধরনের হরমোন গ্রন্থি আছে, যেখান থেকে হরমোন নামক এক ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য নিঃসৃত হয়, যা শরীরের নানা কাজকে সুসংহত করে। এ হরমোনের মাত্রা ওঠানামার সঙ্গে মানসিক বিষণ্নতার একটি সম্পর্ক আছে। শরীরে থাইরয়েড হরমোন কমে গেলে অস্বাভাবিক দুর্বল লাগতে পারে। কাজে মন বসে না। বিষণ্ন বোধ হয়। অপরদিকে থাইরয়েড হরমোনের আধিক্য আমাদের উৎকণ্ঠা ও বিরক্তিতে ভরিয়ে রাখে। দেখলে মনে হয় যেন বিষণ্নতায় ভুগছি। থাইরয়েডের পাশাপাশি প্যারাথাইরয়েড নামে আরেকটি হরমোন আছে, যার মাত্রা বেড়ে গেলে মন বিষণ্ন লাগে। এ সমস্যা নারীর মেনোপজের পর অনেক সময় দেখা দেয়। স্টেরয়েড হরমোন জীবনরক্ষাকারী ওষুধ হিসেবে পরিচিত। এ হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণে বিষণ্নতায় ভোগা বেশ পরিচিত একটি বিষয়। আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য, নারীর মধ্যে হরমোনের সমস্যায় ভোগা এবং বিষণ্নতা বেশ দেখা যায়। আমাদের পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমের মেয়েরা প্রায়ই বিষণ্নতায় ভোগে। এ ছাড়া মাসিকের সময় মেয়েলি হরমোন এস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টোরনের প্রভাবে মুড সুইং হয়, বিষণ্ন লাগতে পারে। পুরুষের ক্ষেত্রে টেস্টোস্টেরন হরমোন কমে গেলে দুর্বলতা ও বিষণ্নতা বোধ হয়। সবশেষে বলব ডায়াবেটিস মেলাইটাসের কথা। এটিও কিন্তু একটি হরমোনের রোগ, যা ইনসুলিনের অভাব অথবা এর কার্যকারিতা সমস্যার কারণে হয়। দেখা গেছে, ডায়াবেটিক রোগীদের মধ্যে বিষণ্নতার হার তুলনামূলকভাবে বেশি।

সুতরাং এ বিষয়টি আমাদের মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে বিষণ্নতার কারণ হিসেবে হরমোনের তারতম্য দায়ী কিনা, তা যেন রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে জেনে নিই। 

ডা. মাশফিকুল হাসান

মাতৃগর্ভে ভ্রুণের জন্ম, বেড়ে ওঠা, সন্তান প্রসব ও মাতৃদুগ্ধ দান– এসবই নির্ভর করে বিভিন্ন হরমোনের ভারসাম্যের ওপর। এর এতটুকু বিচ্যুতিও মা ও অনাগত সন্তানের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। ইনসুলিন হরমোনের অস্বাভাবিকতায় দেখা দেয় গর্ভকালীন ডায়াবেটিস, যার প্রাদুর্ভাব আমাদের দেশসহ সারাবিশ্বে আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলছে। গর্ভাবস্থার অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস হতে পারে শিশুর বিকলাঙ্গতা ও জন্মগত ত্রুটির কারণ। এ ছাড়া গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের কারণে মা ও শিশুর প্রসবকালীন জটিলতার হার বেড়ে যায়। অথচ দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডায়াবেটিস ও হরমোন বিভাগে এ সমস্যার সুচিকিৎসা পাওয়া যায়।
গর্ভকালীন থাইরয়েড হরমোনের জটিলতা আরেকটি বড় সমস্যা, যার হার উল্লেখযোগ্য। গর্ভের শিশু মায়ের থাইরয়েড হরমোনের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল থাকে। তাই মায়ের থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি শিশুর বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ বাধাগ্রস্ত করতে পারে; হতে পারে গর্ভপাতের কারণ। শিশুর জন্মগত থাইরয়েড রোগ থাকলে, জন্মের পরপরই সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে না পারলে সে আজীবন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী রয়ে যায়।

ডা. হুরজাহান বানু

হারসুটিজম ও পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS) নারীর মধ্যে ক্রমবর্ধমান একটি স্বাস্থ্য সমস্যা, যা শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে প্রভাব ফেলে। হারসুটিজম হলো এমন এক অবস্থা, যেখানে নারীর মুখ, গাল, থুতনি, বুক, পেট, পিঠ বা হাত-পায়ের ওপর অতিরিক্ত মোটা ও গাঢ় লোম গজাতে থাকে; যা সাধারণত পুরুষদের দেহে দেখা যায়। এ সমস্যাটি শরীরে অ্যানড্রোজেন নামক পুরুষ হরমোনের পরিমাণ বেশি থাকার কারণে হয়ে থাকে। হরমোনের এ ভারসাম্যহীনতা অনেক সময় পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোমের (PCOS) সঙ্গে জড়িত থাকে।

PCOS একটি হরমোনজনিত সমস্যা, যা নারীর ডিম্বাশয়ে একাধিক ছোট ছোট সিস্ট বা ফোলা ভাব তৈরি করে এবং স্বাভাবিক ঋতুচক্র বাধাগ্রস্ত করে। মাসিক অনিয়ম, গর্ভধারণে সমস্যা, ব্রণ, মাথার চুল পাতলা হয়ে যাওয়া, ওজন বেড়ে যাওয়া, ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়াও এর সঙ্গে সম্পর্কিত। হারসুটিজম অনেক সময় PCOS-এর প্রথম লক্ষণ হিসেবে দেখা দেয়। এ দুটি অবস্থাই নারীর আত্মবিশ্বাসে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে এবং মানসিক উদ্বেগ, লজ্জা ও অবসাদ তৈরি করতে পারে।

PCOS-এর নির্দিষ্ট কোনো কারণ জানা না গেলেও অতিরিক্ত ওজন, জিনগত প্রবণতা, জীবনধারার পরিবর্তন, অল্প বয়সে মাসিক শুরু হওয়া ও শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা এর পেছনে দায়ী বলে ধারণা করা হয়। তবে আশার কথা হলো, এ সমস্যা দুটি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণযোগ্য। সচেতনতা এবং সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা, যেমন– বন্ধ্যত্ব, টাইপ-২ ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকটাই কমানো সম্ভব। 

ব্যবস্থাপনার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সময়মতো সমস্যাটি চিহ্নিত করা। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী জীবনধারায় পরিবর্তন, স্বাস্থ্যকর খাবার, নিয়মিত ব্যায়াম, ওজন নিয়ন্ত্রণ, প্রয়োজনে ওষুধ সেবন এবং মানসিক সহায়তা নেওয়া– এসব মিলেই হারসুটিজম ও PCOS-এর চিকিৎসায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

ডা. জোবায়দা নাজনীন 

হরমোনজনিত সমস্যার বিভিন্ন লক্ষণ শিশুর শরীরে বিদ্যমান থাকতে পারে। যেমন– জন্মকাল থেকে দুই সপ্তাহের অধিক জন্ডিস থাকা, বুকের দুধ টেনে খেতে না পারা, কোষ্ঠকাঠিন্য, শারীরিক বৃদ্ধির মাইলফলক সময়মতো অতিক্রম না করা, বৃদ্ধির স্তব্ধতা বা অতিরিক্ত বৃদ্ধি, মানসিক বিকাশে স্থবিরতা বা স্কুলের পড়াশোনায় অবনতি। শিশুর বয়ঃসন্ধি অপরিণত বয়সে শুরু হওয়া বা বিলম্বিত হওয়া, ওজন কমা বা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি– এসব লক্ষণ এক বা একাধিক হরমোনের ঘাটতি বা আধিক্য থেকে হতে পারে। যেমন থাইরয়েড হরমোন, গ্রোথ হরমোন, যৌন হরমোন, কর্টিসল ইত্যাদি।

সবচেয়ে প্রকট জনস্বাস্থ্যগত চ্যালেঞ্জ হচ্ছে শিশু-কিশোরের ডায়াবেটিস। অধিকাংশই জানেন না যে ডায়াবেটিস একটি হরমোনজনিত রোগ এবং তা বাংলাদেশের শিশু-কিশোরের মাঝে বিপজ্জনকভাবে বেড়ে গেছে। এর কারণ যেমন বংশানুক্রমিক ও জিনগত হতে পারে, তেমনি স্থূলতা ডায়াবেটিসের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি। এর প্রতিরোধে জনসচেতনতা বাড়ানো অপরিহার্য।

গত ১০ বছরে শিশু-কিশোরদের মধ্যে প্রায় ৭ শতাংশ হারে ডায়াবেটিস বেড়েছে। স্কুল, কলেজ এবং হাসপাতালে হরমোনজনিত রোগ ও প্রতিকারবিষয়ক সচেতনতা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। যেভাবে মহামারি আকার ধারণ করছে, মানুষ সচেতন হলে সেটি প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবো।

ডা. মো. সোহেল রানা ভূইয়া

ডায়াবেটিস ও ওবেসিটি বর্তমান বিশ্বে মহামারি রূপ ধারণ করেছে। এ দুটি রোগের সমন্বয়কে ডায়াবেসিটি বলা হয়। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি যাদের ডায়াবেটিস নেই, তাদের তুলনায় দ্বিগুণ। ডায়াবেসিটি উল্লেখযোগ্যভাবে হৃদরোগের ঝুঁকিকে আরও বাড়িয়ে তোলে। ডায়াবেটিস ও অবেসিটি দুটি রোগে আক্রান্ত রোগীর অতিরিক্ত ওজন, উচ্চ রক্তচাপ, মাত্রাতিরিক্ত কোলেস্টেরল, রক্তে অস্বাভাবিক শর্করার মাত্রার হার (ব্লাড সুগার) বেশি থাকে।

ডায়াবেসিটিতে এসব সমস্যার সমন্বিত উপস্থিতি থাকায় হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ও অন্যান্য হৃদরোগ সমস্যাজনিত ঝুঁকি গুরুতরভাবে বেড়ে যায়। ডায়াবেসিটি ব্যক্তিদের হৃৎপিণ্ডে ডায়াবেটিক কার্ডিওমায়োপ্যাথি হয়ে এর সংকোচন-প্রসারণ ক্ষমতা কমে যাওয়ায় হার্ট ফেইলিউর হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়।

ডায়াবেটিসিটির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বেঁচে থাকার জন্য সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, রক্তের শর্করার মাত্রা (ব্লাড সুগার লেভেল) নিয়ন্ত্রণ এবং ডায়াবেটিস ও হরমোন বিশেষজ্ঞের (এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট) পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা গ্রহণ করা উচিত। 

ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান 

থাইরয়েড হরমোন মূলত থাইরোক্সিন (T4) ও ট্রাইআইডোথাইরোনিন (T3), যা আমাদের গলায় অবস্থিত থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে উৎপাদিত হয়। এটি আমাদের মস্তিষ্কের পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে নির্গত থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোন (TSH) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এ হরমোনগুলো আমাদের শরীরের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যার মধ্যে রয়েছে– বিপাক: থাইরয়েড হরমোন আমাদের শরীরের বিপাকীয় হার নিয়ন্ত্রণ করে। শরীর কত দ্রুত শক্তি ব্যবহার করবে, ক্যালরি খরচ করবে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে প্রভাব বিস্তার করে। বৃদ্ধি ও বিকাশ: এ হরমোন শরীরের বৃদ্ধি ও বিকাশে সহায়তা করে, বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে শারীরিক ও মানসিক বিকাশকে প্রভাবিত করে। ⁠হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা: হৃদস্পন্দন ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এ হরমোনের গুরুত্ব অপরিসীম। মানসিক স্বাস্থ্য ও জ্ঞানের বিকাশ: এ হরমোন মানুষের মেজাজ, শক্তির স্তর ও জ্ঞানীয় কার্যকারিতা প্রভাবিত করে। এর তারতম্য মানসিক ভারসাম্যহীনতা, হতাশাগ্রস্ততা ও উদ্বেগ বাড়ানো সৃষ্টি করতে পারে। ⁠প্রজনন: প্রজননে এ হরমোনের গুরুত্ব অপরিসীম, বিশেষ করে মেয়েদের প্রজনন স্বাস্থ্য ও মাসিক চক্রে এ হরমোনের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। ⁠তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ: আমাদের শরীরে তাপমাত্রা উৎপাদন ও নিয়ন্ত্রণে এ হরমোনের প্রয়োজন! সুতরাং এ হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখা খুবই জরুরি। থাইরয়েডের রোগ সম্পর্কে সচেতনতা দরকার।

ডা. মোবারক হোসেন

মানুষের শরীরে বিভিন্ন ধরনের হরমোন গ্রন্থি রয়েছে, যেমন– পিটুইটারি, থাইরয়েড, প্যারাথাইরয়েড, অ্যাড্রিনাল, প্যানক্রিয়াস, টেস্টিস, ওভারি ইত্যাদি। এ গ্রন্থিগুলো হরমোন নিঃসরণের মাধ্যমে দেহের বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। কখনও কখনও এসব গ্রন্থিতে টিউমার দেখা দিতে পারে, যা অনেককে আতঙ্কিত করে তোলে। প্রকৃতপক্ষে হরমোন গ্রন্থির টিউমার মানে তা ক্যান্সার বা প্রাণঘাতী নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলো স্নায়ু বা আশপাশের টিস্যুতে চাপ না দিলে কিংবা অতিরিক্ত বা অস্বাভাবিক হরমোন উৎপন্ন না করলে গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করে না। অনেক সময় এগুলো ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে এবং উপসর্গ না থাকায় দীর্ঘদিন ধরা পড়ে না।
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান এখন এ ধরনের টিউমার শনাক্ত ও নিয়ন্ত্রণে খুবই কার্যকর ভূমিকা রাখছে। কিছু ক্ষেত্রে শুধু নিয়মিত পর্যবেক্ষণই যথেষ্ট, আবার কখনও হরমোনথেরাপি, ওষুধ কিংবা অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হতে পারে। বিশেষ করে পিটুইটারি বা থাইরয়েড টিউমার সাধারণত ধীরে বাড়ে এবং চিকিৎসা নিলে বেশির ভাগ রোগী স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন।

তাই হরমোন গ্রন্থির টিউমার ধরা পড়লে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হওয়া জরুরি। সময়মতো পরীক্ষা, সঠিক চিকিৎসা এবং নিয়মিত ফলোআপের মাধ্যমে এ ধরনের টিউমার নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। 

ডা. ইয়াসমিন আক্তার

হরমোনের ভারসাম্যহীনতা বন্ধ্যত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। হরমোনের সঠিক ভারসাম্য ছাড়া প্রজনন প্রক্রিয়া সঠিকভাবে সম্পন্ন হতে ব্যাহত হয়। ভারসাম্যহীনতা বলতে বোঝায় হরমোনের পরিমাণ কম বা বেশি হয়ে যাওয়া, যার কারণে পুরুষ ও নারী দু’জনের ক্ষেত্রেই বিভিন্ন জটিলতা তৈরি করতে পারে। নারীর শরীরে হরমোনের ভারসাম্যহীনতায় ডিম্বাণু সঠিকভাবে প্রস্ফুটিত হতে এবং মাসিক নিয়মতান্ত্রিকভাবে হতে অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে থাইরয়েড হরমোন, প্রোলাকটিন হরমোন এবং পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম (PCOS) জাতীয় হরমোন রোগের কারণে বন্ধ্যত্বের সংখ্যা বেশি দেখা যায়। 

অন্যদিকে পুরুষদের শুক্রাণু উৎপাদনে এবং প্রজনন অঙ্গের সঠিক কার্যকারিতা হরমোনের ওপর নির্ভর করে। হরমোনের ভারসাম্যহীনতা এ প্রক্রিয়া ব্যাহত করে এবং বন্ধ্যত্ব হতে পারে।

অন্যান্য হরমোন ছাড়াও ডায়াবেটিস একটি অন্যতম কারণ বন্ধ্যত্বের। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ঠিক না রাখলে উভয় ক্ষেত্রে বন্ধ্যত্ব হতে পারে। ডায়াবেটিক রোগীদের উচিত হরমোন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিকভাবে চেষ্টা করা, অন্যথায় গর্ভধারণে অসুবিধা ছাড়াও গর্ভপাতের আশঙ্কা থাকে। 

ডা. মো. মাহমুদ হাসান

স্কুলের বাচ্চাদের মধ্যে একটা বড় অংশ ডায়াবেটিস এবং প্রি-ডায়াবেটিসে ভুগছে। স্কুলের বাচ্চাদের মাঝে সাধারণত টাইপ-১ ডায়াবেটিস, টাইপ-২ ডায়াবেটিস ও মডি নামের বিশেষ ধরনের ডায়াবেটিস দেখা যায়। সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও শিশু-কিশোরের মাঝে ডায়াবেটিসের প্রকোপ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। বাংলাদেশে প্রায় ২৭ হাজার শিশু-কিশোর টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। টাইপ-২ ডায়াবেটিস, যা সাধারণত বড়দের মাঝে দেখা যেত, তা বর্তমানে শিশু-কিশোরের মাঝে ব্যাপকভাবে দেখা যাচ্ছে। ঢাকা শহরে একটি গবেষণায় দেখা গেছে, গত ছয় বছরে স্কুলের বাচ্চাদের মাঝে টাইপ-২ ডায়াবেটিস সাত গুণ বেড়েছে। বিশেষ করে স্থূলকায় বা ওবেসিটিতে আক্রান্ত স্কুল বাচ্চাদের মাঝে প্রি-ডায়াবেটিস ও ডায়াবেটিসের হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। ঢাকা শহরের স্কুলের বাচ্চাদের মাঝে সংগঠিত একটি গবেষণায় উঠে এসেছে যে ওবিস বা স্থূলকায় শিশু-কিশোরদের শতকরা ৬০ ভাগ প্রি-ডায়াবেটিস ও ২ ভাগ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, যা রীতিমতো আতঙ্কিত হওয়ার মতো তথ্য। অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, শরীরচর্চার অভাব, ডিভাইসে আসক্তি, জেনেটিক কারণ ইত্যাদি স্কুলের বাচ্চাদের মাঝে প্রি-ডায়াবেটিস ও ডায়াবেটিসের হার বাড়ার ক্ষেত্রে দায়ী কারণগুলোর মাঝে অন্যতম। দুঃখের বিষয় স্কুলের বাচ্চা, অভিভাবক ও শিক্ষকদের মধ্যে বাচ্চাদের ডায়াবেটিস সম্পর্কে সচেতনতা খুবই কম। গবেষণায় দেখা গেছে, অর্ধেকের বেশি বাচ্চা ডায়াবেটিস কী– তা জানে না এবং ৯০ শতাংশ বাচ্চা স্কুলে ডায়াবেটিস সম্পর্কে কোনো শিক্ষা পায়নি। 

এ অবস্থা থেকে উন্নতির জন্য স্কুলের কারিকুলামে ডায়াবেটিস সম্পর্কে স্বাস্থ্যশিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা, শিক্ষক ও অভিভাবকদের ডায়াবেটিস সম্পর্কে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, স্কুলে নিয়মিত স্বাস্থ্যবিষয়ক সেমিনার ও কর্মশালার আয়োজন, নিয়মিত ঝুঁকিতে থাকা বাচ্চাদের ডায়াবেটিস স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা করা উচিত। 

মো. খায়রুল ইসলাম

আমাদের জীবনে হরমোন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৫-০৬ সালের দিকে এ দেশে থাইরয়েড হরমোনের অভাব দেখা দিয়েছিল। তখন এর ওষুধ বাংলাদেশে ওইভাবে সহজলভ্য ছিল না। এর জন্য এ দেশের মানুষ অনেক কষ্ট পেয়েছে। তখন রেনাটা পিএলসির পক্ষ থেকে হরমোনের জন্য এ দেশে একটা প্লান্ট তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। রেনাটার ম্যানেজিং ডিরেক্টরের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ২০০৬ সাল থেকেই হরমোনের বিভিন্ন প্রোডাক্ট আমরা বাংলাদেশে বাজারজাত করছি। এখন প্রত্যন্ত অঞ্চলে ‘থাইরক্স’ নামের এই পণ্য এখন পাওয়া যায়। এটি আন্তর্জাতিক মানের। আমাদের এই পণ্য বিশ্বের বাজারেও এগিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া নতুন নতুন যে হরমোন পণ্য বিশ্বে আবিষ্কার হচ্ছে, আমরা চেষ্টা করছি সেগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ দেশের বাজারে নিয়ে আসতে।

অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ শাহরিয়ার

হরমোন দিবসের প্রতিপাদ্য– হরমোনকে আমলে আনতেই হবে। আমাদের চলাফেরা, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস, অভিব্যক্তি– সবকিছুর মূলেই হরমোন। গর্ভধারণের সময় মায়েদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে তাদের প্রসবকালীন জটিলতা যেমন দেখা দিতে পারে, তেমনি অনাগত সন্তান জন্মগত নানা ধরনের গুরুতর রোগের ঝুঁকিতে থাকতে পারে। এ জন্য সচেতনতা দরকার। স্থূলতা কমাতে বা মোটা হওয়ার জন্য হরমোন ইনজেকশনের অবাধ ও অযাচিত ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। সবার মিলিত উদ্যোগ হরমোনজনিত সমস্যা থেকে উত্তরণে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।


সভাপতি

অধ্যাপক ডা. মো. ফরিদ উদ্দিন
সভাপতি, এসেডবি

শুভেচ্ছা বক্তব্য 

অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ শাহরিয়ার
বিভাগীয় প্রধান

ডাক্তারবাড়ি, সমকাল

আলোচক

অধ্যাপক ডা. মো. রুহুল আমীন
সহসভাপতি, এসেডবি

অধ্যাপক ডা. ইন্দ্রজিৎ প্রসাদ
বিভাগীয় প্রধান, এন্ডোক্রাইনোলজি ও মেটাবলিজম বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল

অধ্যাপক ডা. এ কে এম আমিনূল ইসলাম
বিভাগীয় প্রধান, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ

অধ্যাপক ডা. মো. শাহজামাল খান
বিভাগীয় প্রধান, ডায়াবেটিস ও হরমোন রোগ বিভাগ 
এনাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল

ডা. নুসরাত সুলতানা
সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

ডা. মাশফিকুল হাসান
সহকারী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

ডা. হুরজাহান বানু
সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

ডা. জোবায়দা নাজনীন
সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, 
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল 

ডা. মো. সোহেল রানা ভূঁইয়া
এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট, শহীদ সোহরাওয়ার্দী 
মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল

ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান

সহকারী অধ্যাপক, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস 

ডা. মোবারক হোসেন
কনসালট্যান্ট
ইবনে সিনা হাসপাতাল, দয়াগঞ্জ শাখা

ডা. ইয়াসমিন আক্তার
সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ
বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ

ডা. মো. মাহমুদ হাসান
এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ 
ও হাসপাতাল

মো. খায়রুল ইসলাম
হেড অব মার্কেটিং হরমোন ও ডার্মা পোর্টফোলিও
রেনাটা পিএলসি

অনুলিখন 

সাজিদা ইসলাম পারুল
স্টাফ রিপোর্টার, সমকাল

মাজহারুল ইসলাম রবিন
স্টাফ রিপোর্টার, সমকাল

স্থিরচিত্র

সাজ্জাদ হোসেন নয়ন
স্টাফ ফটো জার্নালিস্ট, সমকাল

সমন্বয়

হাসান জাকির
হেড অব ইভেন্টস, সমকাল

ব্যবস্থাপনা

ফেইথ কমিউনিকেশনস

সম্পর্কিত নিবন্ধ