ইসলামি দিনারের উদ্ভব এবং ইতিহাসের প্রথম মুদ্রাযুদ্ধ
Published: 2nd, April 2025 GMT
আরব অঞ্চলে মুদ্রা ব্যবহারের ইতিহাস বেশ দীর্ঘ এবং তা একাধিক পর্যায়ে বিকশিত হয়েছে। শুরু হয়েছিল বিনিময় প্রথা থেকে। পরে ধাতু ও কাগজের মুদ্রার মাধ্যমে তা বিকশিত হয়। ইসলামের আগমনের পর, মুদ্রা ব্যবহারের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লব ঘটে, যা নতুন আরবি-ইসলামি পরিচয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের প্রতিফলন হয়ে ওঠে।
মক্কা ছিল গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র। তখনকার বাইজান্টাইন ও পারস্য সভ্যতার মতো বহু রাষ্ট্র ও সভ্যতার সঙ্গে শহরটি যোগাযোগ স্থাপন করেছিল। এই যোগাযোগের কারণে আরবরা প্রথমে পারস্য ও বাইজান্টাইন মুদ্রার মাধ্যমে লেনদেন করতে শুরু করে। পরে আরবরা তাদের নিজেদের প্রাথমিক মুদ্রা তৈরি করে। আবদুল হক আল-আইফা তাঁর ইসলামি ইতিহাসে মুদ্রার উন্নয়ন গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, প্রথম দিকে যে-সকল আরব রাষ্ট্র নিজেদের মুদ্রা তৈরি করেছিল, তারা হলো, সাবা ও হাদরামাউত (ইয়েমেন) এবং নাবাতীয় রাজ্য (জর্দান)।
ইসলামের প্রথম যুগে মুদ্রা
বাইজান্টাইন ও পারস্য তখন দুই বৃহত্তম সাম্রাজ্য। বাইজান্টাইনের মূল মুদ্রা ছিল দিনার ও পারস্যের সাসানীয়দের ছিল দিরহাম। এই দুই মুদ্রাই ইসলামের আগমনের পূর্বে আরব উপদ্বীপে ব্যবহার করা হয় এবং ইসলামি শাসনামলের প্রথম কয়েক বছরে বিশেষ করে উমাইয়া আমল পর্যন্ত তা চালু থাকে। বাইজান্টাইন দিনার ছিল স্বর্ণ নির্মিত এবং পারস্যের দিরহাম ছিল রৌপ্য নির্মিত।
ইতিহাসবিদদের গবেষণা অনুযায়ী রাসুল (সা.
ওমর (রা.) পারস্যের দিরহামের অনুসরণে আরবি মুদ্রা প্রস্তুত করেছিলেন, যার ওপর নির্দিষ্ট বাক্যাংশ যেমন ‘আলহামদুলিল্লাহ’ ও ‘মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ’ খোদাই করা ছিল। এর পর খলিফা ওসমানের (রা.) শাসনামলেও একই মুদ্রা ব্যবহার হতে থাকে। সে-মুদ্রায় কুফি লিপিতে লেখা ছিল ‘বিসমিল্লাহ রাব্বি’।
আলির (রা.) শাসনামলে বসরা শহরে মুদ্রা প্রস্তুত করা হলেও তেমন কোনো মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়নি। তবে পরবর্তী সময়ে উমাইয়া আমল থেকে ইসলামি মুদ্রাব্যবস্থায় এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে, যা ইসলামি অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বিরাট বিপ্লবের সূচনা করে।
ইসলামি দিনারের উদ্ভব
ইসলামি দিনার কেবল একটি অর্থনৈতিক পদক্ষেপ ছিল না, বরং এটি ছিল ইসলামি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার একটি প্রতীক। এর মাধ্যমে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের সঙ্গে সংঘর্ষের সূচনা ঘটে।
যুদ্ধের কারণে উমাইয়া শাসক আবদুল মালিক ইবন মারওয়ানকে বাইজান্টাইন সম্রাট জাস্টিনিয়ান দ্বিতীয়ের সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করতে হয়েছিল। চুক্তি অনুযায়ী শান্তি রক্ষা করতে তিনি সপ্তাহে ১,০০০ দিনার পরিশোধ করতে বাধ্য ছিলেন, যাতে শাম (সিরিয়া) অঞ্চলের সীমান্তে তারান আক্রমণ না করে।
আরও পড়ুনবান্দার ডাকে আল্লাহর সাড়া ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫কিন্তু যখন আবদুল মালিক নতুন মুদ্রা উদ্ভাবনের করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন জাস্টিনিয়ান ক্ষুব্ধ হন এবং তিনি হুমকি দেন যে, তিনি মুদ্রায় এমন কিছু শব্দ খোদাই করবেন যা রাসুল (সা.)-এর অবমাননা করবে। তবে আবদুল মালিক ইসলামি স্বর্ণমুদ্রা দিনার চালু করার সিদ্ধান্ত নেন এবং বাইজান্টাইন মুদ্রার ব্যবহার নিষিদ্ধ করেন। ফলে শান্তিচুক্তি ভঙ্গ হয়ে যায় এবং একটি নতুন যুদ্ধ শুরু হয়।
যুদ্ধে ইসলামি রাষ্ট্র বিজয়ী হয় এবং ইসলামি দিনার সরকারি মুদ্রা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যসহ এর অর্থনৈতিক প্রভাব পুরো ইসলামি বিশ্বে বিস্তৃত হয়। পরে দিনার পশ্চিমা ভাষায় ‘ম্যানকাস’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
স্থানীয় ও বৈশ্বিক অর্থনীতিতে প্রভাব
৭৭ হিজরিতে প্রথম স্বতন্ত্র ইসলামি মুদ্রা চালু হওয়ার ফলে ইসলামি রাষ্ট্র বাইজান্টাইনদের অর্থনৈতিক দাসত্ব থেকে মুক্তি পায়। জগতে একটি একক মুদ্রা ব্যবস্থা তৈরি করে, যা মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যবহার হতে শুরু করে। এর ফলে অন্তর্দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সহজতর হয় এবং বিভিন্ন মুসলিম জাতির মধ্যে অর্থনৈতিক সংযোগ স্থাপন করে।
এ ছাড়াও ইসলামি মুদ্রা গুণগত মান, সঠিক ওজন এবং বিশুদ্ধতার জন্য পরিচিতি লাভ করে এবং বিশ্বব্যাপী মুদ্রা বাজারে এ আন্তর্জাতিক মর্যাদা অর্জন করে। ইউরোপ, ভারত ও চীনের মতো বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চালু করতে করতে সাহায্য করে।
আরও পড়ুনযে সাহাবির কোরআন তিলাওয়াতে মুগ্ধ হন ফেরেশতারা২৮ জানুয়ারি ২০২৫ইসলামি অর্থনীতিও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। কর ও জিজিয়া ইসলামি মুদ্রায় পরিশোধ করা বাধ্যতামূলক হলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং বাজারের উন্নয়ন সাধিত হয়। এই মুদ্রা ব্যাপকভাবে বিদেশি ব্যবসায়ী এবং বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করে। একই সঙ্গে ইসলামি মুদ্রায় শুধু আরবি লেখা থাকায় তা আরবি ভাষার প্রসার এবং ইসলামি সাংস্কৃতিক স্বাধীনতাকে আরও শক্তিশালী করে। এতে থাকা ‘লা ইলাহা ইল্লা আল্লাহ মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ’ ইসলামি সমাজের অর্থনীতির সঙ্গে সংস্কৃতির অঙ্গীভূত হওয়ার প্রমাণ হিসেবে কাজ করে।
সূত্র: আলজাজিরা ডট নেট
আরও পড়ুন সুন্দর বিচার৩০ জানুয়ারি ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব যবহ র প রস য ব যবস ইসল ম প রথম আবদ ল
এছাড়াও পড়ুন:
ইবলিস জিন না ফেরেশতা
মানুষ সৃষ্টির আগে আল্লাহর সৃষ্টিতে ছিল ফেরেশতা ও জিন। ইবলিস আগুনের তৈরি। থাকত ফেরেশতাদের সঙ্গে। একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি করত। ফলে ইবলিস জিন নাকি ফেরেশতা—এ নিয়ে অনেকেই দ্বিধায় পড়ে যান। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি যখন ফেরেশতাদের বললাম, আদমকে সিজদা করো; তখন ইবলিস ছাড়া সবাই সেজদা করল। সে অমান্য করল ও অহংকার করল । তাই সে অবিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হলো।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ৩৪)
ইবলিসকে সেজদা করতে বলার কারণ
ইবলিসকে কেন ফেরেশতাদের সঙ্গে সেজদা করতে আদেশ করা হলো, সে কি ফেরেশতা? আল্লাহতায়ালা আদমকে সৃষ্টির আগেই ফেরেশতাদের আদেশ দিয়ে রেখেছিলেন।
আল্লাহ বলেন, ‘সুতরাং আমি যখন আদমের সৃষ্টি সম্পন্ন করব এবং তার মধ্যে রুহ ফুঁকে দেব, তখন তোমরা তার সামনে সেজদায় পড়ে যেও’ (সুরা সাদ, আয়াত: ৭২)। তখন ইবলিস সেই মজলিশেই উপস্থিত ছিল। তাই ইবলিস ফেরেশতা না হলেও সে ওই আদেশের অন্তর্ভুক্ত হবে।
আরও পড়ুনএকদল জিন পবিত্র কোরআন শুনে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন২০ নভেম্বর ২০২৩ইবলিস জিন হওয়ার প্রমাণ
ইমাম রাজি (রহ.) বলেন, ইবলিস জিনদের একজন, তার মৌলিক উপাদান আগুন। এ জন্য তিনি তিনটি দলিল উপস্থাপন করেছেন।
এক. ইবলিসের সৃষ্টি আগুন থেকে। কোরআনে এসেছে, ইবলিস বলেছে, ‘তুমি আমাকে আগুন দিয়ে সৃষ্টি করেছ আর তাকে (আদমকে) সৃষ্টি করেছ কাদা মাটি দিয়ে।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ১২)
দুই. ইবলিসের ছেলেমেয়ে আছে, সে বংশবিস্তার করে। ফেরেশতারা এর থেকে মুক্ত। তাদের স্ত্রী-সন্তান নেই। তাদের মধ্যে নেই নারী-পুরুষের বিভাজনও। অথচ আল্লাহ ইবলিস সম্পর্কে বলেছেন, ‘তবে কি তোমরা আমার পরিবর্তে ওকে ও ওর বংশধরকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করছ?’ (সুরা কাহফ, আয়াত: ৫০)
তিন. ফেরেশতারা আল্লাহর সব আদেশ মেনে চলে। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘আল্লাহ তাদের (ফেরেশতাদের) যা আদেশ করেন তা অমান্য করে না এবং যা আদেশ করা হয় তা-ই করে।’ (সুরা তাহরিম, আয়াত: ৬) আল্লাহ কোরআনে অধিকাংশ স্থানে ইবলিসকে ‘শয়তান’ বলে সম্বোধন করেছেন। শয়তান শব্দটি দিয়ে কট্টরভাবে অবাধ্য হওয়াকে বোঝায়। (আত-তাফসিরুল কাবির, ফখরুদ্দিন রাজি, ২/৪২৯-৩০)
আরও পড়ুনসুরা আর রাহমানে জিন ও মানবজাতি উভয়কে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে১০ নভেম্বর ২০২৩তা ছাড়া ‘আল্লাহতায়ালা জিনকে সৃষ্টি করেছেন ধোঁয়াহীন আগুন থেকে’ (সুরা রহমান, আয়াত: ১৫), আর ফেরেশতাদের সৃষ্টি করা হয়েছে নুর বা আলো থেকে (মুসলিম, হাদিস: ২,৯৯৬)।
ইবলিস কোন শ্রেণির জিন
ইবনে আব্দিল বার (রহ.) বলেছেন, জিনদের বিভিন্ন শ্রেণি রয়েছে, ১. সাধারণ জিনদের বলা হয় জিন্নি। ২. যেসব জিন মানুষের সঙ্গে বাসাবাড়িতে অবস্থান করে, তাদের বলা হয় আমির। ৩. যেসব জিন বাচ্চাদের সামনে আবির্ভূত হয়, তারা আরওয়াহ। এটি রুহ শব্দের বহু বচন। ৪. যেসব জিন খারাপ হয়ে যায় এবং মানুষের ক্ষতি করতে চায়, তারা শয়তান। ৫. যেসব শয়তানের দুষ্কৃতি খুব বেড়ে যায়, তাদের বলে মারিদ। ৬. যারা শক্তিশালী ও দুশ্চরিত্র হয়ে ওঠে, তাদের বলা হয় ইফরিত। (আত-তামহিদ, ইবনে আবদিল বার, ১১/১১৭-১১৮)
আরও পড়ুনইবলিসের কাহিনি১২ মে ২০২৪