সে অনেক আগের ঘটনা। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে জয়ী হওয়ার পর ইংরেজরা লর্ড ক্লাইভকে নিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল পরিদর্শনে যান। নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী একবার তাঁরা কলকাতা পরিদর্শনে আসেন। লর্ডের আগমন উপলক্ষে আলাদা প্যান্ডেল বানানোর পাশাপাশি উঁচু সিংহাসনের মতো কিছু চেয়ারও বসানো হয়। অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে লর্ড ক্লাইভ যখন বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, তখনই হামলা শুরু হয় তাঁর ওপর।

না! মানে বাংলার কেউ হামলা করেনি; করেছে মশা! একটি নয়, দুটি নয়, হাজার হাজার মশার অতর্কিতে আক্রমণ। এমন আক্রমণে দিশাহারা হয়ে স্ক্রিপ্টের বাইরে গিয়ে কথা বলতে শুরু করেন লর্ড ক্লাইভ।

‘আই উইল ডেস্ট্রয় বেঙ্গল, সরি, প্রোটেক্ট বেঙ্গল অ্যাট অ্যানি কস্ট। ফর গডস সেক, সামওয়ান প্লিজ ব্রিং সাম গানস অ্যান্ড শুট দিস মসকিউটোস।’

অবস্থা বেগতিক দেখে ইংরেজরা ওখানেই অনুষ্ঠান শেষ করেন। তবে ঘটনাস্থল থেকে লর্ড ক্লাইভসহ অন্যদের ওপর আক্রমণকারী তিনটি মশাকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যান তাঁরা।

ইংরেজ শাসকদের কামড়ানোর অপরাধে বন্দী করা হয় এই তিন মশাকে। পরদিন তাদের আদালতে উপস্থিত করা হলে আদালত পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

রিমান্ডে কী হয়, এ নিয়ে মশা তিনটির কোনো ধারণাই ছিল না। কারণ, এর আগে কামড়ানোর অপরাধে মানুষের চড়থাপ্পড় খেলেও কখনো রিমান্ডের খপ্পরে তারা পড়েনি। ছিদ্রহীন নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় একটা ছোট রুমে রাখা হলো তাদের।

‘দোস্ত, আমরা কাকে কামড়ালাম যে আমাদের এভাবে ধরে নিয়ে এল?’ প্রথম মশা বলল।

‘মনে হয় গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তিকে কামড়েছি। দেখিসনি, রক্তটা একটু ভিন্ন স্বাদের ছিল।’ দ্বিতীয় মশার জবাব।

‘ওটা রক্ত ছিল? ধুর শ্লা, আমি আরও ভাবছিলাম বাঙ্গির জুস খাচ্ছি। একদমই পানসে।’ তৃতীয় মশার গলায় হতাশার সুর।

পরদিন মস্ত বড় গোঁফ নিয়ে ইংরেজ জেলার আসেন মশাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে।

‘ইউ টাইনি ব্লাড সাকারস, হাউ ডেয়ার ইউ বাইট আওয়ার লর্ড?’দাঁত কটমট করে জানতে চাইলেন জেলার।

‘দুঃখিত মশাই, আমরা সবাই বাংলা মিডিয়ামের মশা। ইংরেজি বুঝি না। বাংলার ব্যবস্থা করেন।’

মশাদের উত্তর বুঝতে তাৎক্ষণিকভাবে বাংলা অনুবাদক হিসেবে ইংরেজদের প্রিয় ব্যক্তি মীর জাফরকে নিয়ে আসা হলো। মীর জাফরের মাধ্যমেই চলল জিজ্ঞাসাবাদ।

‘লর্ড ক্লাইভকে কামড়ানোর দায়ে যে তোদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড কিংবা ফাঁসি হতে পারে, সেটা তোরা জানিস?’ জানতে চাইলেন জেলার।

‘খাওয়ার মধ্যে তো শুধু একটু রক্তই খাই। আপনাদের মতো তো আর যা পাই তা-ই চিবাই না। সেই সামান্য খাবারের দায়েও ফাঁসি? এ তো দেখছি রীতিমতো অন্নপাপ! বাপরে বাপ!’ সমস্বরে দুই মশা বলে উঠল।

‘চুপ করো। তোমরা স্যারের গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যাঘাত ঘটিয়েছ। এর জন্য শাস্তি অবধারিত।’

‘আপনারা যে কয়েল জ্বালিয়ে, স্প্রে ছিটিয়ে আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটান, সেটার দায়ে আমরা কখনো কাউকে গ্রেপ্তার করেছি? এই তো সেদিন আমার গার্লফ্রেন্ড এডিসকে নিয়ে নর্দমায় বসে একটু একান্তে সময় কাটাচ্ছিলাম। কোথা থেকে কে যেন এসে স্প্রে মেরে দিল। স্প্রের আঘাতে আমার গার্লফ্রেন্ডের একটা ডানা গেল ভেঙে। কী দরকার ছিল আপনাদের ওকে ডানাকাটা পরি বানিয়ে দেওয়ার? কই, এর জন্য তো আমি আপনাদের কাউকে গ্রেপ্তার করিনি, কারও বিরুদ্ধে মামলাও করিনি।’ প্রথম মশা জবাব দিল।

আরও পড়ুনটাকাতো মারিয়াছির সঙ্গে যেভাবে আমার পরিচয় হলো২৪ আগস্ট ২০২৩

‘যত বড় হুল নয় তত বড় কথা! চুপ থাকো, বেয়াদব কোথাকার।’ রেগে গেলেন জেলার।

‘শাস্তি যদি দিতেই হয়, তাহলে আমরা যা করেছি, সেই একই কাজ লর্ডকেও করতে বলুন। বলুন আমাদের কামড় দিতে। তাহলেই সমান সমান হয়ে যায়।’ দ্বিতীয় মশা প্রস্তাব দিল।

এমন সময় লর্ড ক্লাইভের আগমন ঘটল।

‘বাহ্, এমন প্রস্তাবের তারিফ না করে আর পারছি না। সেনাপতি, এদের নিয়ে আর নাটক করা লাগবে না। এখনই আমার ছেলের কাছ থেকে স্টিলের রুলারটা নিয়ে আসো। রুলার দিয়ে চটাস করে বাড়ি দিয়ে ওদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করো। এক্ষুনি!’ আদেশ দিলেন ক্লাইভ।

‘স্যার, এত চুপচাপ, বিনে পয়সায় মশা মেরে ফেললে চলবে?’ কানের কাছে ফিসফিস করে বলেন সেনাপতি। ‘এসব কাজে বড়সড় একটা প্রকল্প হাতে না নিলে হয়? প্রকল্প হবে, কথাবার্তা হবে, হাজার হাজার স্বর্ণমুদ্রা খরচ হবে…মোট কথা আওয়াজ হতে হবে। তবেই না লোকজন জানবে, লর্ড একটা কিছু করছেন…।’

সেনাপতির কথা শুনে লর্ড ক্লাইভের বুদ্ধির বাতি জ্বলে উঠল। তুড়ি দিয়ে তিনি বললেন, ‘স্পিকিং অব আওয়াজ…আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। মশাগুলোর ওপর কামানের গোলা ছুড়লে কেমন হয়? মশা মরবে। আবার আওয়াজও হবে।’

পরদিন ঢাকঢোল পিটিয়ে কামানের মাথায় মশা দুটিকে বেঁধে কয়েক রাউন্ড গোলা ফুটিয়ে দেওয়া হলো। আশ্চর্য! একটা মশাও মরল না। বরং কামানের গোলায় বসে কোনো প্রকার ভিসা-পাসপোর্ট ছাড়াই মশাগুলো আছড়ে পড়ল এসে বাংলাদেশে!

এভাবেই এই ‘অর্ধেক পাখি, অর্ধেক পোকা’ প্রাণীটির আগমন ঘটে ঢাকায়। সেই থেকে শুরু করে আজ ২৬৭ বছর পর এক বিশাল রাজ্যের অধিকারী এরা। কামড়ানোর দায়ে একসময় যাদের জেলে পাঠানো হতো, তারাই এখন মানুষকে কামড়িয়ে হাসপাতালে পাঠায়!

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

কালোগলা দামা

সুন্দরবন থেকে পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে ফিরেছি মাত্র তিন দিন আগে। এতই ব্যথা যে সপ্তাহখানেক বিশ্রাম প্রয়োজন। কিন্তু ঢাকার অদূরে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের পলাশপুরের এক পরিত্যক্ত আবাসন প্রকল্পে বিরল একটি পাখির আগমনের কথা শুনে ব্যথা ভুলে চলে গেলাম ধলেশ্বরীর পাড়ে।

প্রায় এক যুগ আগে পরিত্যক্ত হওয়া আবাসন প্রকল্পটির ভরাট করা বেলে মাটিতে তরতর করে বেড়ে উঠেছে নানা প্রজাতির কাষ্ঠল, ফলদ ও বুনো গাছপালা, ঝোপঝাড় এবং লতাগুল্ম। যেন চমৎকার এক গ্রামীণ বন! এক পাশে বিশাল আকারের মেঘশিরীষগাছের সারি। তার খানিকটা সামনে একটি ডকইয়ার্ড। পরিত্যক্ত এই আবাসন প্রকল্প বর্তমানে বহু প্রজাতির পাখি-প্রাণীর আশ্রয়স্থল। দিনের বেলায়ও এখানে শিয়ালের আনাগোনা।

পুরো এলাকায় ছোট-বড় ৮–১০টি শিমুলগাছ। বেশির ভাগ গাছেই টকটকে লাল ফুল। ফুলের রস পানের জন্য প্রচুর পাখির আগমন ঘটেছে। কাঠশালিক, হলদে পাখি, হাঁড়িচাঁচা, দাঁড়কাক, বুলবুলি, ছাতারে, বসন্তবাউরি, কাঠঠোকরা, শ্বেতাক্ষী আরও কত-কী? কিন্তু বহুক্ষণ শিমুলগাছের তলায় দাঁড়িয়ে থেকেও বিরল পাখিটির সন্ধান মিলল না। অসুস্থ শরীরে এত কষ্ট করে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এসে খালি হাতে ফেরত যেতে চাইছি না। তাই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে শিমুল ফুলের দিকে তাকিয়ে রইলাম। প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর হঠাৎই পাখিটি এল। কিন্তু অতিচঞ্চল পাখিটির অস্থিরতার কারণে ভালো ছবি তোলা গেল না। মাত্র কয়েক সেকেন্ড সময় দিয়ে পাখিটি চলে গেল। মনটাই খারাপ হয়ে গেল।

ক্যামেরা হাতে ধীরপায়ে ধলেশ্বরীর পাড়ে ছোট একটি শিমুলগাছের কাছে গেলাম। শিমুল ফুলে কাঠশালিকের ছবি তুললাম। বেলা প্রায় তিনটার সময় নদীর দিক থেকে তিরবেগে উড়ে এসে পাখিটি শিমুল ফুলে বসল। আর যায় কোথায়? ক্যামেরায় ক্লিকের বন্যা বয়ে গেল। তবে বেশিক্ষণ এখানে থাকল না। আগের সেই বড় গাছের দিকে উড়ে গেল। নদীর পাড় থেকে খোঁড়াতে খোঁড়াতে কোনোরকমে ওখানে পৌঁছালাম। শেষ পর্যন্ত শিমুল ফুলে ওর ভালো ছবি তোলা গেল। ঘটনাটি ২০২৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারির।

বিরল পাখিটি এ দেশের শীতের পরিযায়ী কালোগলা দামা। ইংরেজি নাম ব্ল্যাক-থ্রটেড থ্রাস। গোত্র তুরডিডি। বৈজ্ঞানিক নাম Turdus atrogularis। পূর্ব ইউরোপ থেকে পশ্চিম সাইবেরিয়া হয়ে উত্তর-পশ্চিম মঙ্গোলিয়া পর্যন্ত পাখি বিস্তৃত। শীতে দক্ষিণ, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পরিযায়ী হয়। একসময় লালগলা দামার একটি উপপ্রজাতি হিসেবে কালো গলা দামা গণ্য হতো। সম্প্রতি আলাদা প্রজাতি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।

অতিচঞ্চল কালোগলা দামা

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কালোগলা দামা