সংসদ সদস্যদের নিজ দলের বিরুদ্ধে গিয়ে অনাস্থা প্রস্তাবে ভোট দেওয়ার স্বাধীনতা দিতে চায় না প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো। অর্থবিল ছাড়া অন্য যেকোনো বিষয়ে সংসদের নিম্নকক্ষের সদস্যদের নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে—সংবিধান সংস্কার কমিশনের এই সুপারিশের সঙ্গে পুরোপুরি একমত নয় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি। এ তিনটি দলই চায় অর্থবিলের মতো আস্থা ভোটের ক্ষেত্রেও সংসদ সদস্যরা (এমপি) স্বাধীন থাকবেন না। এ ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যদের নিজ দলের অবস্থানের পক্ষেই থাকতে হবে।

বিদ্যমান সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সংসদ সদস্যরা নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারেন না। তাতে বলা আছে, কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হিসেবে কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি যদি ওই দল থেকে পদত্যাগ করেন বা সংসদে ওই দলের বিপক্ষে ভোট দেন, তাহলে সংসদে তাঁর আসন শূন্য হবে।

আরও পড়ুনমুক্ত পরিবেশ, রাজনীতির মাঠে নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী৩০ মার্চ ২০২৫

এই বিধানের ফলে সরকারের চাওয়ার বাইরে কোনো আইন বা প্রস্তাব সংসদে পাস হওয়ার সুযোগ নেই। প্রধানমন্ত্রী বা অন্য কারও বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাস হওয়ারও সুযোগ নেই।

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের। ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের সময় থেকেই অনুচ্ছেদটি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। যাঁরা এর বিপক্ষে তাঁরা বলছেন, এই অনুচ্ছেদ সংসদ সদস্যদের স্বাধীনতা খর্ব করে এবং প্রধানমন্ত্রীকে একচ্ছত্রভাবে ক্ষমতা দেয়। অন্যদিকে এটা রাখার পক্ষে যাঁরা, তাঁদের যুক্তি—এই বিধান বাদ দিলে সরকারের স্থিতিশীলতা থাকবে না। কিছুদিন পরপর সরকার ও সংসদ ভেঙে যেতে পারে। সরকারকে অস্থিতিশীল করতে বড় ধরনের অর্থের অবৈধ লেনদেনও হতে পারে।

অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বাধীন সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধানের এই অনুচ্ছেদে পরিবর্তন আনার প্রস্তাব করেছে। তাতে বলা হয়েছে, আইনসভা হবে দুই কক্ষবিশিষ্ট। দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার বিষয়ে তাদের সুপারিশ হলো অর্থবিল ছাড়া নিম্নকক্ষের সদস্যদের তাঁদের মনোনয়নকারী দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে।

এই সুপারিশসহ পাঁচটি সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। ইতিমধ্যে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) অনেকগুলো দল তাদের মতামত জানিয়েছে। শিগগিরই এই তিন দলের সঙ্গে আলাদাভাবে আলোচনা করবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।

আরও পড়ুনঈদের পর সংস্কার নিয়ে আলোচনার চিন্তা এনসিপির৩১ মার্চ ২০২৫

কমিশনের সুপারিশের যৌক্তিকতা

সংসদ সদস্যদের দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার ক্ষমতা বাড়ানোর সুপারিশ করার পেছনে যৌক্তিকতা নিজেদের প্রতিবেদনে তুলে ধরেছিল সংবিধান সংস্কার কমিশন। সেখানে বলা হয়েছে, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংসদ সদস্যদের নিজ দলের প্রস্তাবিত যেকোনো নীতি বা সিদ্ধান্ত অকপটে মেনে নিতে বাধ্য করে। যদিও তাঁদের মতামত দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে; কিন্তু দলের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার স্বাধীনতা দেওয়া হয়নি। সংবিধান দলের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্যের নামে সংসদ সদস্যদের নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকার প্রতিনিধিত্ব করতে বাধা দেয়।

কমিশন বলেছে, যদিও দলত্যাগ (ফ্লোর ক্রসিং) আটকানো ছিল এই অনুচ্ছেদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য, কার্যত এর প্রভাব এই উদ্দেশ্য ছাপিয়ে গেছে। ৭০ অনুচ্ছেদে ফ্লোর ক্রসিংয়ের বিরুদ্ধে যে বিধান, তা গণতান্ত্রিক চেতনার পরিপন্থী। স্থিতিশীলতার উদ্দেশ্যে এ বিধান রাখা হলেও এটি রাজনৈতিক আলোচনা এবং দলীয় জবাবদিহিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এটি সংসদ সদস্যদের তাঁদের নির্বাচনী এলাকার স্বার্থ প্রতিনিধিত্ব করা ও স্বাধীন ইচ্ছা প্রয়োগের ক্ষমতাকে সীমিত করে ফেলে।

আরও পড়ুননির্বাচনের পরের সরকার সংস্কারপ্রক্রিয়া চলমান রাখবে, সে নিশ্চয়তা নেই: নাহিদ ইসলাম২৮ মার্চ ২০২৫

ভিন্ন অবস্থান দলগুলোর

 সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার ক্ষমতা প্রশ্নে ঐকমত্য কমিশনে দেওয়া লিখিত মতামতে বিএনপি বলেছে, সংসদে আস্থা ভোট, অর্থবিল, সংবিধান সংশোধনী বিল এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত, এমন সব বিষয়ে দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়া যাবে না। এসবের বাইরে অন্যান্য বিষয়ে সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে মতামত দিতে পারবেন।

আস্থা ভোটে স্বাধীনতা দেওয়ার বিপক্ষে যুক্তি কী—তার ব্যাখ্যায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ সৃষ্টির আগে ১৯৫৪ সালের পর প্রায় প্রতিদিন সরকার পরিবর্তন হতো। উপমহাদেশের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও ইতিহাস পর্যালোচনা এবং অনেক বিচার–বিশ্লেষণ করে বিএনপি এই প্রস্তাব বা মতামত দিয়েছে। যাতে সরকারের একটি স্থিতিশীলতা থাকে। তাঁরা মনে করেন, দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখনো আস্থা ভোটের স্বাধীনতা দেওয়ার মতো উচ্চতায় পৌঁছাতে পারেনি, আস্থা ভোটে স্বাধীনতা দেওয়া হলে কোনো সরকার এক থেকে দুই মাসের বেশি টিকবে না। সরকারে স্থিতিশীলতা থাকবে না।

আরও পড়ুনরাষ্ট্রের নাম বদলে আপত্তি এনসিপির, মূলনীতি পরিবর্তনে একমত ২৮ মার্চ ২০২৫

সংবিধান সংস্কার কমিশন যখন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে মতামত চেয়েছিল, তখন জামায়াতে ইসলামী কমিশনকে দেওয়া প্রস্তাবে বলেছিল, ফ্লোর ক্রসিং এখন বন্ধ করা উচিত নয়। এটি সংসদীয় সরকারব্যবস্থা স্থিতিশীল করতে যুক্ত করা হয়েছিল। তারা এটি আরও দুই মেয়াদ পর্যন্ত রাখার পক্ষে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে দেওয়া মতামতেও অনেকটা একই বক্তব্য তুলে ধরেছে জামায়াতে ইসলামী। দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা ঐকমত্য কমিশনে যে মতামত দিয়েছেন, সেখানে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। অর্থবিল, আস্থাভোটসহ কয়েকটি ক্ষেত্রে শর্ত দেওয়ার কথা তাঁরা বলেছেন। তিনি বলেন, আস্থা ভোট দলের পলিসির (নীতি) বিষয়। একজন সংসদ সদস্য দলকে প্রতিনিধিত্ব করেন। দলের পলিসির সঙ্গে সংসদ সদস্যদের একই অবস্থান থাকতে হবে। সংসদ সদস্যরা যদি প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির প্রতি অনাস্থা প্রস্তাবে দলীয় পলিসির অনুসরণ না করেন, তাহলে শৃঙ্খলা থাকবে না।

জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারীদের দল এনসিপিও অর্থবিলের পাশাপাশি দলের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোটের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ থাকা প্রয়োজন বলে মত দিয়েছে। এ বিষয়ে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সংস্কার সমন্বয় কমিটির কো-অর্ডিনেটর সারোয়ার তুষার প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের বিধান না থাকলে সংসদ সদস্যদের কেনাবেচা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সংসদ ও সরকারের স্থিতিশীলতার জন্য তাঁরা অর্থবিল ও আস্থা ভোট ছাড়া অন্য যেকোনো ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে মত দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলেছেন।

আরও পড়ুনসংসদের মেয়াদ ও জরুরি অবস্থা ঘোষণার সুপারিশ বিষয়ে দ্বিমত বিএনপির২৫ মার্চ ২০২৫

যেভাবে যুক্ত হয় ৭০ অনুচ্ছেদ

১৯৭২ সালে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ কীভাবে যুক্ত হয়েছিল, তার বর্ণনা পাওয়া যায় প্রয়াত অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের বিপুলা পৃথিবী বইয়ে। ১৯৭২ সালের সংবিধানের বাংলা অনুবাদ করার দায়িত্ব ছিল অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের। তিনি লিখেছেন, ‘সংবিধানের বিষয়ে পরামর্শ দিতে বঙ্গবন্ধু দুই বার ডেকে পাঠিয়েছিলেন কামালকে—সঙ্গে আমিও ছিলাম। .

..তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তান আমলে সরকার অস্থিতিশীল হয়েছিল মূলত পরিষদ-সদস্যদের দল বদলের ফলে কিংবা দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে দলের বিপক্ষে ভোটদানের ফলে। এটা বন্ধ করা দরকার। নির্বাচিত সদস্য যদি দলের কোনো সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত না হন কিংবা কোনো ক্ষেত্রে দলের বিরুদ্ধে ভোট দেন, তাহলে তাঁর পদত্যাগ করা উচিত হবে কিংবা তাঁর সদস্যপদ চলে যাবে—এমন একটা নিয়ম করা দরকার। তবে এমন ক্ষেত্রে তিনি উপনির্বাচন বা পরবর্তী কোনো নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য হবেন না, সে ব্যবস্থাও থাকতে হবে। এই অভিপ্রায়ই সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে প্রকাশ পেয়েছিল।’

তবে গণপরিষদেই ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। আনিসুজ্জামান তাঁর বইয়ে এ বিষয়ে উল্লেখ করেছেন, (গণপরিষদ সদস্য) আ ক ম মোশাররফ হোসেন আকন্দ, আছাদুজ্জামান খান, আবদুল মুন্তাকীম চৌধুরী, হাফেজ হাবিবুর রহমান এই অনুচ্ছেদের বিরোধিতা করেছিলেন। আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘৭০ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে সবচেয়ে কড়া ভাষায় আপত্তি জানান হাফেজ হাবিবুর রহমান—তাঁর মতে, এতে দলীয় একনায়কত্বের ও দলীয় নেতার একনায়কত্বের সৃষ্টি হবে।’

আরও পড়ুনকমিশনের প্রস্তাব গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করবে২৪ মার্চ ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: দল র ব র দ ধ র স ব ধ নত ন জ দল র ব র প রস ত ব দল র প র সরক র র র সদস য র ক ষমত মত মত দ অন স থ ত ব কর হয় ছ ল ব এনপ এনস প ইসল ম দলগ ল হওয় র অবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

ঐক্য-অনৈক্যের রাজনীতি ও ক্ষমতার ভারসাম্য

চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা সর্বাত্মক প্রতিরোধে ছাত্র-জনতার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে শীর্ষ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনে সম্মুখসারিতে না থাকলেও গত দেড় দশকে সরকারের দমনপীড়নের বিরুদ্ধে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দলের অবদান নিঃসন্দেহে প্রণিধানযোগ্য; দীর্ঘ আন্দোলনে ত্যাগ-তিতিক্ষা ও নিপীড়নের অভিজ্ঞতায় বিরোধী দলগুলো পরস্পরের মিত্র হয়ে ওঠে। ইতোমধ্যে গণঅভ্যুত্থানের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ ছাত্রনেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দল এনসিপি কম সময়ের মধ্যেই গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে হাজির হয়েছে। নির্বাচন ও সংবিধান প্রশ্নে গড়ে ওঠা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে সম্প্রতি রাজনৈতিক দলগুলো যার যার অবস্থান স্পষ্ট করতে শুরু করেছে। আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়েই শুধু নয়; দেশের শাসন কাঠামো সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান ও প্রবণতা সুস্পষ্ট হতে শুরু করেছে।

ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দু’দফা বৈঠকে নির্বাচন সংক্রান্ত সংস্কার কমিশনের প্রধান সুপারিশগুলোর বিষয়ে সরাসরি আপত্তি জানিয়েছে বিএনপি। সমকাল জানাচ্ছে, ‘সাধারণ নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন, সংবিধান সংশোধনে সংসদের উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন ও গণভোট এবং জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল বা এনসিসি গঠনে শক্ত আপত্তি আছে বিএনপির। তারা এ বিষয়ে কোনো আপসও করবে না (২০.০৪.২৫)। দল ও সরকারপ্রধান এক ব্যক্তি এবং এক ব্যক্তি দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না– এই দুটি বিষয়েও একমত নয় বিএনপি। জানা গেছে, ঐকমত্য কমিশনের পক্ষে নতুন প্রস্তাব আসে– এক ব্যক্তি মাঝখানে বিরতি দিয়ে সর্বোচ্চ তিনবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন। প্রস্তাবটি নিয়ে পরে মতামত দিতে চেয়েছে বিএনপি।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপির মতের সরাসরি বিপরীত অবস্থান গ্রহণ করেছে এনসিপি। তাদের বিবেচনায় বর্তমান ক্ষমতা কাঠামো এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক। শেখ হাসিনা সরকারের ফ্যাসিবাদী হয়ে ওঠার এটি অন্যতম কারণ। মৌলিক পরিবর্তন ছাড়া নির্বাচন দিলে সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। মৌলিক সংস্কার বলতে এনসিপি সংস্কার কমিশনের প্রধান প্রস্তাবগুলোই সামনে নিয়ে এসেছে।

২.
বিএনপির সঙ্গে বৈঠকে সরকার আবারও জানিয়েছে, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এতে অসন্তুষ্টির কথা জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে সংস্কার কমিটির প্রস্তাবিত প্রধান কোনো সংস্কার প্রস্তাবনাতেই তারা একমত নন। বোঝাই যাচ্ছে, ক্ষমতার ভারসাম্য আনার প্রশ্নে বিএনপি রাজি নয়; বরং আইন ও শৃঙ্খলাজনিত কিছু নিয়মতান্ত্রিক সংস্কারের পরপরই নির্বাচন আয়োজনে আগ্রহী। লক্ষণীয়, নবগঠিত এনসিপি ছাড়া পুরোনো রাজনৈতিক দলের প্রায় সবাই ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরিতে মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে উচ্চকিত নয়। ন্যূনতম সংস্কার শেষে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবির ব্যাপারে ইতোমধ্যে জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামী দল, শীর্ষ বাম দলগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করতে শুরু করেছে বিএনপি। এ ব্যাপারে সব দলের মধ্যে ঐকমত্য তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে।

৩.
স্পষ্টতই সংস্কারের প্রশ্নে বিএনপি নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করতে চাইছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে নির্বাচন হলে বিএনপির জয়লাভের সম্ভাবনা বেশি বলেই তাদের এই ভূমিকা। অন্যদিকে প্রস্তাবিত প্রধান সংস্কারগুলোর লক্ষ্য ক্ষমতাসীন দলের ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রীকরণ করে একব্যক্তিকেন্দ্রিকতা থেকে দূরে রাখা। এই চেক অ্যান্ড ব্যালান্স বিএনপির পছন্দ হচ্ছে না। তাহলে কি আমরা বলতে পারি– বিএনপি আগের শাসন পদ্ধতির কোনো গুণগত পরিবর্তন চাইছে না? চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের মূল চেতনা কর্তৃত্ববাদের অবসান। ক্ষমতার ভারসাম্য না আনলে তা আদৌ সম্ভবপর নয়।
লক্ষণীয় আরেকটি বিষয় হচ্ছে, মৌলিক সংস্কার বা ক্ষমতার ভারসাম্য নিয়ে সকল রাজনৈতিক দল সরব না হলেও আওয়ামী লীগ প্রশ্নে সকলে উচ্চকিত এবং তাদের পুনর্বাসনের তীব্র বিরোধী। এটি একদিক থেকে যথার্থ বটে। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব যে দম্ভ ও অগণতান্ত্রিক আচরণ দেখিয়েছেন, তার খেসারত দিতে হয়েছে জাতিকে বহু প্রাণের বিনিময়ে। এর জন্য দায়ী আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে অবশ্যই শাস্তির আওতায় আসতে হবে; তার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া সঠিক হবে? ২০০১ ও ২০০৮ সালের সর্বশেষ স্বীকৃত দুই নির্বাচনে মোটামুটি ৪০ শতাংশ করে ভোট পেয়ে যথাক্রমে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেয়ে বিজয়ী হয়। ২০১৪ সালের নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ দেশে একদলীয় শাসন কায়েম করলেও তাদের কর্মী-ভোটার সংখ্যা এখনও প্রচুর। এদের সবাই অপরাধের সঙ্গে জড়িতও নন। কাজেই তাদেরকে নির্বাচনের বাইরে রাখা সংগত হবে না। এই বাস্তবতার পরও সব কয়টি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ চাইছে নিশ্চিতভাবে এই বিবেচনায়– ভোটের বাজারে আওয়ামী ভোটের ভাগ গোলায় তোলার জন্য।

এই চিন্তা ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরির সংস্কার প্রস্তাবনার বিরুদ্ধাচারের মতোই এক প্রকারের কূটচাল। দেশের প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। দল দুটির একটি নির্বাচনে অনুপস্থিত থাকলে ফলাফল একদিকে অতি ঝুঁকে যাবার আশঙ্কা থাকে। এই যুক্তি উত্থাপন করলেই তাঁকে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ আখ্যা না দিয়ে শান্তভাবে ভেবে দেখা যেতে পারে। আওয়ামী লীগ যে দেশকে নরক করে তুলেছিল, জাতিই তা নির্বাচনে ভোটের মাধ্যমে জানিয়ে দিক। তার জন্য দলটিকে নির্বাচনে আসতে দিতে হবে। অপরাধী নেতৃত্বকে বিচারের হাতে ছেড়ে দিয়েই নির্বাচনে আসতে হবে আওয়ামী লীগকে।
আর বিএনপি? জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে যেমন বোঝা যাচ্ছে, ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরিতে বিএনপি প্রস্তুত নয় এখনও। সে ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে চাপ তৈরি করা যেতে পারে। পাল্টা যুক্তি আসতে পারে, সরকার বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের ওপর চাপ তৈরি করতে পারে কিনা? মানতেই হবে, বর্তমান সরকার এক বিশেষ প্রেক্ষাপটে ক্ষমতায় এসেছে। সব ক্ষমতা এক ব্যক্তির হাতে ন্যস্ত করে রাষ্ট্রের সকল স্তম্ভ তার উপাসনায় ব্যস্ত থাকে– এই চিরপুরাতন রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে এ দেশের মানুষের মুক্তি প্রয়োজন। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের মূল প্রেরণা তা-ই। আর এ জন্য অনিবার্য ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি এবং এ লক্ষ্যে প্রয়োজন মৌলিক সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন।

বিএনপি স্পষ্টভাবেই জানাচ্ছে, নির্বাচিত রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় গিয়ে সংস্কারকাজ করবে। তারা এটি বলছে, কারণ অধিকাংশ রাজনীতিবিদের ধারণা, গণতন্ত্র মানে শুধুই নির্বাচন। না, সুষ্ঠু নির্বাচন মানেই গণতন্ত্র নয়; একটি ধাপ মাত্র। মানুষের সব ধরনের অধিকার নিশ্চিত করবার জন্য শাসন কাঠামোকে গণতান্ত্রিক করে গড়ে তোলা জরুরি। এই কাজ দুই/চার মাসে নিশ্চিত হবে না। যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক দলগুলোতে পূর্ণ গণতন্ত্রায়ন ঘটাতে শত বছরেরও বেশি সময় লেগেছে। আমাদের দেশেও অবশ্যই সময় লাগবে; তবে প্রযুক্তি ও পূর্বজদের অভিজ্ঞতার কল্যাণে আজ আর শত বছর প্রয়োজন হবে না। প্রয়োজন ন্যায়বোধ ও নীতি চর্চার। আইন সবার জন্যই প্রযোজ্য; ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করতে পারলে তা প্রত্যেকের জন্যই প্রয়োজনীয় ও বিবেচ্য হয়ে উঠবে। আর এটি যত দ্রুত সম্ভবপর হয়ে উঠবে, জাতির জন্য ততই তা হবে যথার্থ ও উপকারী।  

মাহবুব আজীজ: উপসম্পাদক, সমকাল; সাহিত্যিক
mahbubaziz01@gmail.com

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সংস্কার প্রশ্নে আমজনতার সঙ্গে বৈঠকে বসছে ঐকমত্য কমিশন
  • সুস্থ শিল্প-সম্পর্ক স্থাপনে প্রয়োজন জাতীয় ঐকমত্য
  • বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে: আলী রীয়াজ
  • ঐক্যমত কমিশনের সঙ্গে তৃতীয় দফায় বিএনপির বৈঠক চলছে
  • ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বিএনপির তৃতীয় দফার বৈঠক শুরু
  • বিদেশে পলাতক আওয়ামী লীগ নেতাদের ফিরিয়ে আইনের আওতায় আনা হবে: প্রেস সচিব
  • ঐক্য-অনৈক্যের রাজনীতি ও ক্ষমতার ভারসাম্য
  • ডিসেম্বরের পরে তো প্রশ্নই আসে না
  • ডিসেম্বরের পরে তো প্রশ্নই আসে না বরং নির্বাচন আগে সম্ভব: আমীর খসরু
  • ডিসেম্বরের পরে তো প্রশ্নই আসে না; বরং নির্বাচন আগে সম্ভব: আমীর খসরু