ঢাকা বন বিভাগের উচ্ছেদ অভিযানে ঘরবাড়ি ভেঙে দেওয়ায় খোলা আকাশের নিচে মশারি টানিয়ে ঘুমিয়ে রাত পার করছেন গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার বাঘাম্বর গ্রামের বাসিন্দা জরিনা বেগম। মঙ্গলবার সকালে আলাপকালে কান্নাজড়িত কণ্ঠে জরিনা বলেন, ‘ঈদের আগের দিন ঘরবাড়ি ভাইঙ্গা দেওনে আমাগো বাইত্তে (বাড়িতে) কোনো ঈদ নাই। রান্নার চুলাটাও ভাইঙ্গা দিছে, হের লাইগা রান্দন-বান্ধনও (রান্নাবান্না) করবার পারি নাই। এর-ওর বাড়িত থাইক্যা কিছু খাওনদাওন দিছে, হেগিলা খাইয়াই আছি। এটা কোনো মানুষের জীবন অইল। আমাগো দেহার (দেখার) যেন কেউ নাই।’
একই এলাকার বাসিন্দা আসমা খাতুন জানান, রাতে মশারি টানিয়ে খোলা জায়গায় ঘুমিয়ে ছিলেন। মধ্যরাতে হঠাৎ শিয়াল ঢুকে শরীরে কামড়ে দিয়েছে।
ঈদের আগের দিন (রোববার) ঢাকার বন বিভাগ হঠাৎ অভিযান চালিয়ে এক্সকাভেটর (মাটি কাটার যন্ত্র) দিয়ে কালিয়াকৈর উপজেলার সিনাবহ ও বাঘাম্বর এলাকার ঘরবাড়িসহ আড়াই শতাধিক স্থাপনা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। এতে অনেকে গৃহহীন হয়ে পড়েন। খোলা আকাশের নিচে মশারি টানিয়ে রাতযাপন করছেন তাঁরা। ঘরবাড়ি ও রান্নাঘর ভেঙে ফেলায় ঈদের দিনও অনেকের খাবার জোটেনি।
মঙ্গলবার দুপুরে বিপদগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ত্রাণসহায়তা দিয়েছেন কালিয়াকৈর পৌর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাইজুদ্দিন আহাম্মেদ। তিনি বলেন, ‘যে পরিমাণ ত্রাণসহায়তা দেওয়া হয়েছে, আশা করছি, আগামী ১৫-১৬ দিন তাঁরা ভালোভাবে কাটিয়ে দিতে পারবেন। প্রয়োজনে আরও সহায়তা দেওয়া হবে।’
বাগাম্বর গ্রামের গৃহহীন বাসিন্দারা জানান, ঘরবাড়ি হারিয়ে সবাই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। যে কোনোভাবেই হোক, তাঁদের মাথার ওপর ছাদের ব্যবস্থা চান তাঁরা। গতকাল সকালে ওই দুই এলাকা ঘুরে ঘরবাড়ি ভাঙা দেখা যায়, যেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি বাড়ির খাট ও আলমারি ঘরের ভেতরেই পড়ে আছে। টিনের ও আধা পাকা মেঝেগুলো ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া রয়েছে। ভাঙা বাড়ির ঘরের ভেতরে মশারি টাঙানো। যেখানে শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিরা রাতযাপন করেছেন। কারও বাড়িতেই রান্না করতে দেখা যায়নি। অভিযানে শুধু বাড়িঘর নয়, দীর্ঘদিনের বড় বড় কাঁঠালগাছসহ বিভিন্ন ফলের গাছের শিকড় থেকে তুলে ফেলা হয়েছে।
ভাঙা ঘরের মেঝেতে বসে ছিলেন কবির হোসেন নামের এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, ‘আমাগো কী অপরাধ ছিল। আমরা ভূমিহীন। আমরা প্রায় ৩০-৪০ বছর ধরে এই এলাকায় বসবাস করছি। হঠাৎ অভিযান চালিয়ে আমাদের ঘরবাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন কোনো রকমে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছি।’
বন বিভাগ ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, কালিয়াকৈরসহ বিভিন্ন এলাকায় গত ৫ আগস্টের পর অসাধু কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় বন বিভাগের জমি দখল করে হাজার হাজার ঘরবাড়ি ও অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। এঁদের মধ্যে অনেকেই দোতলা ভবন, কেউ টিনশেড, আবার কেউ আধা পাকা ঘর নির্মাণ করেছেন। স্থানীয় অসাধু ব্যক্তিরা অবৈধভাবে ঘর নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছেন। কয়েক মাস ধরেই বনের লোকজন মাইকিং করে এসব অবৈধ স্থাপনা ভেঙে সরিয়ে নেওয়ার জন্য বলেছেন; কিন্তু কেউ এ বিষয়ে কর্ণপাত করেননি। অবশেষে গত রোববার সকালে যৌথ বাহিনীর সহযোগিতায় চারটি এক্সকাভেটর দিয়ে উপজেলার সিনাবহ ও বাঘাম্বর এলাকায় ঘরবাড়ি ভাঙা শুরু করা হয়। এ সময় স্থানীয় লোকজন সংঘবদ্ধ হয়ে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের ওপর ইটপাটকেল ছোড়েন। এতে দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ায় অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন। বেলা সাড়ে তিনটা পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে আড়াই শতাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে।
আরও পড়ুনবন বিভাগের অভিযানে গাজীপুরে ঘরবাড়িসহ আড়াই শতাধিক স্থাপনা উচ্ছেদ৩০ মার্চ ২০২৫বাঘাম্বর গ্রামের বাসিন্দা মাহমুদা বেগম বলেন, ‘আমাগো দেশে যদি ১৬ লাখ রোহিঙ্গা থাকতে পারে। সরকার যদি তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারে, তাইলে আমারা এই দেশের নাগরিক হয়ে কী দোষ করলাম? আমাদের ঘরবাড়ি কেন ভেঙে দেওয়া হলো? আমরা তো ভোটার আমরা তো ভোট দেই। রোহিঙ্গারা সুবিধা পাইলে আমরা কেন পাব না?’
সিনাবাহ বাজারের ব্যবসায়ী আবদুস সালাম বলেন, প্রায় ৪০ বছর ধরে এখানে দোকান নির্মাণ করে ব্যবসা করে আসছেন। নিয়মিত সরকারকে ভ্যাট-ট্যাক্স দিচ্ছেন। দোকানে ১৫ থেকে ১৬ লাখ টাকার মালামাল ছিল। সেই মালামাল বের করার সময়ও দেয়নি। অপর ব্যবসায়ী আবু হানিফ বলেন, ‘মালামালসহ দোকানঘর ভেঙে দিয়েছে। এখন একেবারে পথে বসে গেছি।’
গত রোববার ঢাকা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) বশিরুল আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় ব্যক্তিরা বনের জমি দখল করে স্থাপনা তৈরি করছিলেন। বিশেষ করে ৫ আগস্টের পর দখলের পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। তাঁদের এসব অবৈধ স্থাপনা সরিয়ে নিতে বলা হয়েছিল; কিন্তু সরাননি। বাধ্য হয়ে অভিযান চালিয়ে আড়াই শতাধিক স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, দখলদারদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং বনভূমি পুনরুদ্ধারে নিয়মিত অভিযান চালানো হবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: বন ব ভ গ র ন র ম ণ কর ব ঘ ম বর র ঘরব ড় র ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
সমকালে সংবাদ প্রকাশের পর লম্বাশিয়া পাহাড়ে বালু উত্তোলন বন্ধ করল প্রশাসন
চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের লম্বাশিয়া পাহাড় ধ্বংস করছে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল। লম্বাশিয়া পাহাড়টি বালু প্রকৃতির, যার ফলে এ পাহাড় ঘেঁষে যাওয়া সাতগরিয়া ছড়ার পানির পথ পরিবর্তন করে দেয় বালুখেকোরা। আস্তে আস্তে ভেঙে পড়ে পাহাড়। শ্যালো মেশিন দিয়ে উত্তোলন করা হয় বালু। এভাবেই চলছে দেড় যুগ ধরে।
এ ছড়ায় শ্যালো মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলনের কারণে এক কিলোমিটারজুড়ে পাহাড়ের ক্ষতচিহ্ন দেখা গেছে। রোববার দৈনিক সমকালে ‘লম্বাশিয়া পাহাড়ে ধ্বংসযজ্ঞ চলছেই’ শিরোনাম সংবাদ প্রকাশ হয়। এ সংবাদ প্রকাশের এক দিন পর রোববার দুপুরে লোহাগাড়া উপজেলা প্রশাসন ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগ যৌথ অভিযান পরিচালনা করে। এ সময় অবৈধভাবে উত্তোলিত বালুর ঢিবি নষ্ট করে দেওয়া হয়। বালু উত্তোলনের জন্য ব্যবহৃত অবৈধভাবে মজুদ করা পানি কেটে বের করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বালু পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত রাস্তা কেটে গর্ত তৈরি করে দেওয়া হয়, রাস্তার মাঝে পিলার পুঁতে কাঁটা তারের বেড়া দেওয়া হয়।
লোহাগাড়া উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) নাজমুন লায়েল ও সহকারী বন সংরক্ষক মো. দেলোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে এ অভিযান পরিচালিত হয়। সঙ্গে ছিলেন চুনতির রেঞ্জ অফিসার মো. আবীর হাসান, সাতগড় বিটের বিট অফিসার মহসিন আলী ইমরানসহ থানা পুলিশ ও বনবিভাগের সদস্যরা।
২০২৩ সলের ২৪ ডিসেম্বর দৈনিক সমকালে ‘অবৈধ বালু উত্তোলন চলছেই, কিলোমিটার জুড়ে ক্ষতচিহৃ’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ হয়। ওই সংবাদ প্রকাশের পরও বনবিভাগ ও প্রশাসন রাস্তায় কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ করে দেয়। তখনই বন্ধ হয়ে যায় অবৈধ বালু উত্তোলন। কিন্তু ৫ আগস্টের পর আরেক দল দূর্বৃত্ত কাঁটাতার তুলে আবারও অবৈধ বালু উত্তোলন করে।