দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্ররাজনীতি থাকবে কি না, এ নিয়ে কথা হয়। কথা হয় ছাত্ররাজনীতির ধরন কী হতে পারে, তা নিয়েও। অথচ প্রাসঙ্গিক হলেও এই আলাপে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিষয়টি তোলা হয় না। ক্যাম্পাসগুলোয় দেখা যায়, ক্ষমতাসীন দলের অনুসারী ছাত্রসংগঠন একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে রাখে। তারা নিজেদের স্বার্থেই ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে আগ্রহী হয় না। অন্যদিকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে গতানুগতিক ধারার রাজনীতির পরিবর্তন চায়। এ ক্ষেত্রে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়মিত করার বিকল্প নেই। এটি করা গেলে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতিরও মীমাংসা হতে পারত।

১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশে চলা দেশের চারটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচন বন্ধ রয়েছে। ১৯৯০ সালের পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছে মাত্র একবার, ২০১৯ সালে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও তিন দশকের বেশি সময় ধরে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচন হয় না। অথচ এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক প্রতিনিধি কিংবা কর্মকর্তা-কর্মচারী সমিতির নির্বাচন প্রায় নিয়মিতভাবেই হচ্ছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, সেসব নির্বাচনের একেকজন প্রার্থী থাকেন দলীয় রাজনীতির ধ্বজাধারী হয়ে। ফলে তাঁরা ব্যক্তিস্বার্থেই ছাত্ররাজনীতির কদর্য ও অসুস্থ ধারার বিপরীতে মুখে কুলুপ এঁটে রাখেন।

অস্বীকার করার উপায় নেই, শিক্ষা ও শিক্ষাসহায়ক কার্যক্রম ছাত্র সংসদের মাধ্যমে সফল ও গতিশীল করা সম্ভব। এককভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষে যে কাজগুলো করা কঠিন, ছাত্র সংসদের সহায়তায় সেসব কাজ সহজেই বাস্তবায়ন করা যায়

গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রতিবছর ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে এবং আবাসিক হল থেকে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচিত করার বিধান রয়েছে। নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধিদের মধ্যে পাঁচজন সিনেট সদস্য হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারণী ব্যাপারে সরাসরি অংশ নিতে পারেন। ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ার কারণে বেশির ভাগ সময়ে সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধি ছিল না। থাকলে তাঁদের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে শিক্ষার্থীদের সুবিধা-অসুবিধা তুলে ধরার সুযোগ তৈরি হতো। প্রশাসনও শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আরও আন্তরিক হতে পারতেন।

২০১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বশেষ যে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়, সেটি নানা কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। বর্তমানে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগ নির্বাচনের ফলাফল নিজেদের পক্ষে নেওয়ার জন্য নানা রকম কৌশল ও কারচুপির আশ্রয় নেয়। কোনো কোনো আবাসিক হলে আগের রাতেই ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স ভরে রাখার প্রমাণ পাওয়া যায়। তা ছাড়া ভোটারের সারিগুলোয় দাঁড়িয়ে ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা কৃত্রিম ভিড় তৈরি করেন, যাতে হলের বাইরে থাকা শিক্ষার্থীরা ভোট দিতে না পারেন। এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় ও হল প্রশাসনকে একরকম নির্লিপ্ত থাকতে দেখা যায়।

ক্ষমতাসীন দল এবং তাদের অনুসারী ছাত্রসংগঠন ক্যাম্পাসে নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখার জন্য ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে আগ্রহী হয় না। তারা বেশ জানে, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তাদের নির্বাচিত হওয়া অসম্ভবপ্রায়। ছাত্র সংসদ না থাকার কারণে ক্যাম্পাসগুলোয় নির্দিষ্ট ছাত্রসংগঠনের সন্ত্রাস ও দখলদারত্ব যেমন বেড়েছে, তেমনি শিক্ষার পরিবেশও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে চলা নেতিবাচক রাজনীতির ধারা ছাত্ররাজনীতির ব্যাপারেও বিরূপ মনোভাব তৈরি করেছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের বড় অংশ ছাত্ররাজনীতির ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। এ প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা রাজনীতি-সচেতন নন, তাই এমন কথাও শোনা যায়।

ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচন নিয়মিত হলে শিক্ষার্থীদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চর্চায় গুণগত পরিবর্তন আসত। ছাত্র সংসদের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নিজেদের দাবি ও অধিকারের কথা তুলতে পারতেন। ছাত্র সংসদ না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাজে সম্মিলিতভাবে অংশ নিতে দেখা যায় না। বিচ্ছিন্নভাবে সাংস্কৃতিক দল ও ছাত্রসংগঠনগুলো নানা রকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। এসব অনুষ্ঠান দল ও গোষ্ঠীকেন্দ্রিক হওয়ায় সেখানে সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ থাকে না। তা ছাড়া ছাত্র সংসদ না থাকায় শিক্ষার্থীরা তাঁদের দাবিদাওয়া পেশ করার যথাযথ প্রক্রিয়াও ভুলতে বসেছেন।

অস্বীকার করার উপায় নেই, শিক্ষা ও শিক্ষাসহায়ক কার্যক্রম ছাত্র সংসদের মাধ্যমে সফল ও গতিশীল করা সম্ভব। এককভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষে যে কাজগুলো করা কঠিন, ছাত্র সংসদের সহায়তায় সেসব কাজ সহজেই বাস্তবায়ন করা যায়। যেমন পরিচ্ছন্ন ও সবুজ ক্যাম্পাস গড়ে তুলতে হলে শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি। এ ক্ষেত্রে ছাত্র সংসদ মূল ভূমিকা রাখতে পারে। আবার অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া উৎসব এবং কেন্দ্রীয়ভাবে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ছাত্র সংসদের অংশগ্রহণে তা সর্বজনীন মাত্রা পেতে পারে।

ছাত্র সংসদের বিভিন্ন উদ্যোগ ও কার্যক্রম প্রকারান্তরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাজ ও চিন্তায়ও পরিবর্তন আনতে পারে। যেমন শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে বিভিন্ন প্রশিক্ষণমূলক কর্মসূচি হাতে নেওয়া যায়। ছাত্র সংসদের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বাইরের প্রতিষ্ঠানের সংযোগ বাড়ানোর সুযোগ তৈরি করা যায়। অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের খণ্ডকালীন কাজের সহায়তা করতে পারে ছাত্র সংসদ। ছাত্র সংসদের বিভিন্ন কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে সরাসরি ভূমিকা রাখতে পারে। আবার আবাসিক হলগুলোর ডাইনিং ও ক্যানটিন পরিচালনায় অংশ নিয়ে হল প্রতিনিধিরা শিক্ষার্থীদের সুবিধা নিশ্চিত করতে পারেন।

কোনো কোনো মহল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ক্যালেন্ডারে ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে যুক্ত করার দাবি উত্থাপিত হয়ে আসছে। এই নির্বাচন শেষ পর্যন্ত যেন গত কয়েকটি জাতীয় নির্বাচনের মতো প্রহসনে পরিণত না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনের কাজটি পুরোপুরি অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। এমন ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়মিত ও পরীক্ষায় একাধিকবার অকৃতকার্য শিক্ষার্থী কোনোভাবেই নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন। প্রয়োজনে নির্বাচনের বিধিমালা ও গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন আনতে হবে। নির্বাচনী আচরণ ও ভোটদানের পদ্ধতির ব্যাপারেও নতুন করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। কারণ, বিদ্যমান ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীন দলের অনুসারী ছাত্রসংগঠন নির্বাচনকে প্রভাবিত করার সুযোগ পেয়ে যায়।

ছাত্র সংসদ নির্বাচন কেন অনিয়মিত হয়ে গেল এবং এই নির্বাচন নিয়মিত ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য কী করা যেতে পারে, সে ব্যাপারে অভিমত ও সিদ্ধান্ত দেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পরামর্শক কমিটি গঠন করা দরকার। এই কমিটির সদস্য হবেন অধ্যাপক থেকে প্রভাষক পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের অরাজনৈতিক শিক্ষকেরা। তাঁরা বিভিন্ন বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিয়ে বসবেন এবং ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনের বিদ্যমান ধারা ও পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করবেন। দেশে নতুন রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠার আগেই ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়মিত করার ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

● তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন ত র ত কর র র জন য স গঠন

এছাড়াও পড়ুন:

গুগলের কুইক শেয়ার অ্যাপে ত্রুটি, ঝুঁকিতে যে সংস্করণের ব্যবহারকারীরা

গুগলের কুইক শেয়ার অ্যাপ ব্যবহার করে তারের সংযোগ ছাড়াই আশপাশে থাকা নির্দিষ্ট স্মার্টফোন, ল্যাপটপ বা কম্পিউটারে দ্রুত ফাইল আদান-প্রদান করা যায়। তাই অনেকেই নিয়মিত অ্যাপটির মাধ্যমে তথ্য আদান-প্রদান করেন। ব্যবহারকারীদের কাছে জনপ্রিয়তা পেলেও অ্যাপটির উইন্ডোজ সংস্করণে ভয়ংকর এক নিরাপত্তাত্রুটির সন্ধান পেয়েছেন সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান সেফব্রিচ ল্যাবসের গবেষকেরা।

সেফব্রিচ ল্যাবসের তথ্যমতে, কুইক শেয়ার অ্যাপের উইন্ডোজ সংস্করণে ‘সিভিই-২০২৪-১০৬৬৮’ নামের ত্রুটি শনাক্ত হয়েছে। এই ত্রুটির কারণে ব্যবহারকারীদের সম্মতি ছাড়াই যেকোনো ল্যাপটপ বা কম্পিউটারে ফাইল পাঠানো যায়। এর ফলে ম্যালওয়্যারযুক্ত ফাইল পাঠিয়ে দূর থেকে নির্দিষ্ট ল্যাপটপ বা কম্পিউটার অকার্যকর করার পাশাপাশি সেগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে সাইবার অপরাধীরা।

আরও পড়ুনফোন থেকে কম্পিউটারে ছবি নেবেন যেভাবে০১ জানুয়ারি ২০২৩

কুইক শেয়ার অ্যাপে যখন কোনো ফাইলের নাম একটি ইউটিএফ-৮ বাইট দিয়ে শুরু হয়, তখন ডিনায়েল অব সার্ভিস বা ডিওএস ঘরানার ত্রুটিটি সক্রিয় হয়। ত্রুটিটির বিষয়ে সেফব্রিচের গবেষক ওর ইয়ার বলেন, 'এ গবেষণা শুধু কুইক শেয়ার অ্যাপের ওপর করা হলেও এর প্রভাব পুরো সফটওয়্যার খাতের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। সফটওয়্যার যত জটিলই হোক, মূল কারণ চিহ্নিত করে দ্রুত সমাধান করা জরুরি।’

আরও পড়ুনফোন থেকে ফোনে নম্বর স্থানান্তর করবেন যেভাবে২৫ জুন ২০২৩

প্রসঙ্গত, সেফব্রিচ ল্যাবস গত বছরের আগস্টে গুগলকে কুইক শেয়ার অ্যাপে ‘কুইকশেল’ নামের একটি ত্রুটিসহ ১০টি নিরাপত্তা–দুর্বলতা থাকার বিষয়ে সতর্ক করেছিল। এরপর গুগল নিরাপত্তাত্রুটিগুলোর সমাধান করে কুইক শেয়ার ফর উইন্ডোজের হালনাগাদ সংস্করণ উন্মুক্ত করে। তবে সেফব্রিচের সাম্প্রতিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আগে শনাক্ত হওয়া দুটি ত্রুটি পুরোপুরি সমাধান হয়নি।

সূত্র: দ্য হ্যাকার নিউজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ