একসময় দেশের উত্তরাঞ্চল ছিল মঙ্গাপীড়িত ও দারিদ্র্যকবলিত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, উত্তরের চেয়ে দক্ষিণের মানুষই বেশি দারিদ্যপীড়িত। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনেকেই জীবিকা হারিয়ে দেশের অন্য এলাকায় কিংবা বিদেশে যান ভাগ্যান্বেষণে।

একশ্রেণির দালাল ওত পেতে থাকেন এটাকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে। বিদেশে যেতে চাওয়া তরুণদের জানানো হয় যে সেখানে যেতে পারলেই তাঁরা আকর্ষণীয় চাকরি পাবেন। কিন্তু বাস্তবে ঘটে তার উল্টোটাই। জমিজমা বিক্রি করে বা মোটা অঙ্কের ঋণ করে তাঁরা বিদেশে গিয়েও কাজ পান না। অনেকেই ভ্রমণ ভিসায় সেখানে গিয়ে ‘অবৈধ’ হয়ে যান। লুকিয়ে কোনো কাজ পেলেও তা দিয়ে নিজের চলাই দায়, বাড়িতে টাকা পাঠাবেন কীভাবে। এ কারণে শূন্য হাতেই দেশে ফিরতে হয়।

তৃণমূল অভিবাসীদের সংগঠন অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম (ওকাপ) এবং আন্তর্জাতিক পরিবেশ ও উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (আইআইইডি) জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দুই জেলা পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার ১০টি এবং সিলেটের গোয়াইনঘাটের ৯টি ইউনিয়নের মোট ৩৩টি গ্রামে জরিপ করে। জরিপে অংশ নেওয়া ৬৪৮টি পরিবারের মধ্যে ৭০ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশে অভিবাসী পাওয়া গেছে।

কেবল ওই দুই জেলাই নয়, অন্য জেলায়ও প্রতিবছর নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের কবলে পড়ে জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছে বিশাল জনগোষ্ঠী। যাঁরা ঋণ করে বিদেশে যান, তাঁরা সেই ঋণ ফেরত দেওয়ার জন্য যেকোনো কাজ করতে বাধ্য হন। এ ধরনের শ্রমিকেরা আধুনিক দাসত্বের শিকার বলে জানিয়েছেন ওই গবেষকেরা। এই দাসত্বের মধ্যে আছে শ্রমিকদের বেতন কম দেওয়া, বেতন বন্ধ রাখা, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা, চলাফেরায় বিধিনিষেধ দিয়ে রাখা ইত্যাদি। এর যেকোনো একটির শিকার হন ৯৯ শতাংশ শ্রমিক; আর ৫টির বেশি আচরণ মোকাবিলা করেছেন ৮১ শতাংশ শ্রমিক।

ওকাপ ও আইআইইডির প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিদেশে অভিবাসনের ক্ষেত্রে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার মানুষ গড়ে খরচ করেছেন ৪ লাখ ৬১ হাজার ২২০ টাকা। এর মধ্যে ২৫ শতাংশ টাকা সংগ্রহ করেছেন জমি বিক্রি করে আর ১৮ শতাংশ নিয়েছেন চড়া সুদের ঋণ। নানা কারণে অবৈধ হয়ে পড়া এসব প্রবাসী কর্মীর কাছে পাসপোর্ট থাকে না। পুলিশের হাতে আটক হয়ে খালি হাতে ফিরে আসেন তাঁরা। গত বছর এভাবে দেশে ফিরে এসেছেন প্রায় ৮৯ হাজার কর্মী। আগের বছর একইভাবে ফিরেছেন ৮০ হাজারের বেশি কর্মী।

দেশে ফেরত আসা প্রবাসী কর্মীদের বিভিন্ন সেবা দিতে সরকারি সংস্থার পাশাপাশি কাজ করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচি। এ সংস্থার কর্মকর্তারা জানান, দিনে ২৫০ থেকে ৩০০ প্রবাসী কর্মী খালি হাতে ফিরে আসছেন। তাঁদের বাড়িতে ফেরার জন্য এক হাজার টাকা করে যাতায়াত খরচ দেওয়া হয় ব্র্যাকের পক্ষ থেকে।

জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বিদেশে যাওয়া শ্রমিকদের একাংশ যে প্রতারিত হচ্ছেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু এই প্রতারণা রহিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর উদ্যোগ আছে বলে মনে হয় না। দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা কেবল সদুপদেশ দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেন। এমনকি যেই দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে শ্রমিকেরা সর্বস্বান্ত হন, তাঁদের বিরুদ্ধেও শক্ত কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। মামলা হলেও অভিযুক্ত ব্যক্তিরা শাস্তি পান না। অন্তর্বর্তী সরকার প্রবাসী শ্রমিকদের কল্যাণে অনেক পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলছে। কিন্তু এই প্রতারণার জাল ছিন্ন না করতে পারলে কোনো পদক্ষেপই কাজে লাগবে না। প্রবাসী কর্মীদের আর যাতে শূন্য হাতে ফিরে আসতে না হয়, সে জন্য এখনই কার্যকর ও টেকসই পদক্ষেপ নেওয়া হোক।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: পদক ষ প প রব স সরক র জলব য়

এছাড়াও পড়ুন:

প্রবাসীদের শূন্য হাতে ফেরা প্রতারণা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিন

একসময় দেশের উত্তরাঞ্চল ছিল মঙ্গাপীড়িত ও দারিদ্র্যকবলিত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, উত্তরের চেয়ে দক্ষিণের মানুষই বেশি দারিদ্যপীড়িত। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনেকেই জীবিকা হারিয়ে দেশের অন্য এলাকায় কিংবা বিদেশে যান ভাগ্যান্বেষণে।

একশ্রেণির দালাল ওত পেতে থাকেন এটাকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে। বিদেশে যেতে চাওয়া তরুণদের জানানো হয় যে সেখানে যেতে পারলেই তাঁরা আকর্ষণীয় চাকরি পাবেন। কিন্তু বাস্তবে ঘটে তার উল্টোটাই। জমিজমা বিক্রি করে বা মোটা অঙ্কের ঋণ করে তাঁরা বিদেশে গিয়েও কাজ পান না। অনেকেই ভ্রমণ ভিসায় সেখানে গিয়ে ‘অবৈধ’ হয়ে যান। লুকিয়ে কোনো কাজ পেলেও তা দিয়ে নিজের চলাই দায়, বাড়িতে টাকা পাঠাবেন কীভাবে। এ কারণে শূন্য হাতেই দেশে ফিরতে হয়।

তৃণমূল অভিবাসীদের সংগঠন অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম (ওকাপ) এবং আন্তর্জাতিক পরিবেশ ও উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (আইআইইডি) জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দুই জেলা পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার ১০টি এবং সিলেটের গোয়াইনঘাটের ৯টি ইউনিয়নের মোট ৩৩টি গ্রামে জরিপ করে। জরিপে অংশ নেওয়া ৬৪৮টি পরিবারের মধ্যে ৭০ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশে অভিবাসী পাওয়া গেছে।

কেবল ওই দুই জেলাই নয়, অন্য জেলায়ও প্রতিবছর নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের কবলে পড়ে জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছে বিশাল জনগোষ্ঠী। যাঁরা ঋণ করে বিদেশে যান, তাঁরা সেই ঋণ ফেরত দেওয়ার জন্য যেকোনো কাজ করতে বাধ্য হন। এ ধরনের শ্রমিকেরা আধুনিক দাসত্বের শিকার বলে জানিয়েছেন ওই গবেষকেরা। এই দাসত্বের মধ্যে আছে শ্রমিকদের বেতন কম দেওয়া, বেতন বন্ধ রাখা, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা, চলাফেরায় বিধিনিষেধ দিয়ে রাখা ইত্যাদি। এর যেকোনো একটির শিকার হন ৯৯ শতাংশ শ্রমিক; আর ৫টির বেশি আচরণ মোকাবিলা করেছেন ৮১ শতাংশ শ্রমিক।

ওকাপ ও আইআইইডির প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিদেশে অভিবাসনের ক্ষেত্রে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার মানুষ গড়ে খরচ করেছেন ৪ লাখ ৬১ হাজার ২২০ টাকা। এর মধ্যে ২৫ শতাংশ টাকা সংগ্রহ করেছেন জমি বিক্রি করে আর ১৮ শতাংশ নিয়েছেন চড়া সুদের ঋণ। নানা কারণে অবৈধ হয়ে পড়া এসব প্রবাসী কর্মীর কাছে পাসপোর্ট থাকে না। পুলিশের হাতে আটক হয়ে খালি হাতে ফিরে আসেন তাঁরা। গত বছর এভাবে দেশে ফিরে এসেছেন প্রায় ৮৯ হাজার কর্মী। আগের বছর একইভাবে ফিরেছেন ৮০ হাজারের বেশি কর্মী।

দেশে ফেরত আসা প্রবাসী কর্মীদের বিভিন্ন সেবা দিতে সরকারি সংস্থার পাশাপাশি কাজ করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচি। এ সংস্থার কর্মকর্তারা জানান, দিনে ২৫০ থেকে ৩০০ প্রবাসী কর্মী খালি হাতে ফিরে আসছেন। তাঁদের বাড়িতে ফেরার জন্য এক হাজার টাকা করে যাতায়াত খরচ দেওয়া হয় ব্র্যাকের পক্ষ থেকে।

জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বিদেশে যাওয়া শ্রমিকদের একাংশ যে প্রতারিত হচ্ছেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু এই প্রতারণা রহিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর উদ্যোগ আছে বলে মনে হয় না। দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা কেবল সদুপদেশ দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেন। এমনকি যেই দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে শ্রমিকেরা সর্বস্বান্ত হন, তাঁদের বিরুদ্ধেও শক্ত কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। মামলা হলেও অভিযুক্ত ব্যক্তিরা শাস্তি পান না। অন্তর্বর্তী সরকার প্রবাসী শ্রমিকদের কল্যাণে অনেক পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলছে। কিন্তু এই প্রতারণার জাল ছিন্ন না করতে পারলে কোনো পদক্ষেপই কাজে লাগবে না। প্রবাসী কর্মীদের আর যাতে শূন্য হাতে ফিরে আসতে না হয়, সে জন্য এখনই কার্যকর ও টেকসই পদক্ষেপ নেওয়া হোক।

সম্পর্কিত নিবন্ধ