পঁচিশ ক্যাডার বনাম এক ক্যাডার: সরকার কোন পক্ষে
Published: 1st, April 2025 GMT
একই বিসিএসের মাধ্যমে যোগদান করে প্রশাসন ক্যাডারের কোনো কর্মকর্তা সিনিয়র সচিব কিংবা মন্ত্রিপরিষদ সচিব হন; আর কেউ তাঁদের চেয়ে পাঁচ-ছয় ধাপ নিচের পদ থেকে অবসরে যান। কোনো ক্যাডার কর্মকর্তারা সরকারি গাড়ি-বাড়ি-চালক সুবিধা পান; আর কেউ অফিস চালানোর ন্যূনতম আবর্তন ব্যয়টুকুও পান না, নিজের টাকায় অফিস চালান। কেউ গাড়ি কেনার ব্যাপক সুবিধা পান, কেউ পান না।
অতীতে যে ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তারা রাষ্ট্রের যত বেশি ক্ষতি করেছেন, তাঁরাই সুবিধাও পেয়েছেন তত বেশি। যাঁরা ক্ষতি করেননি, তাঁদের কোনো সুবিধাও নেই। বর্তমানে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে মোট ক্যাডারের সংখ্যা ২৬। এর মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে অন্যান্য ক্যাডারের বৈষম্যের চিত্র চূড়ান্ত পর্যায়ের। এই বৈষম্য থেকে সৃষ্ট বিরোধ চরমে পৌঁছেছে।
ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তার মধ্যকার বৈষম্য দূর করার জন্য ২৫ ক্যাডারের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে ‘আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’। এই সংগঠনের স্লোগান ‘ক্যাডার যার, মন্ত্রণালয় তার’। নিজেদের দাবি আদায়ে তাঁরা বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালন করেছেন। এ পরিষদের আয়োজনে ‘জন-আকাঙ্ক্ষা পূরণে প্রত্যাশিত সিভিল সার্ভিস’ শীর্ষক একটি সেমিনার ২০২৫ সালের ১৮ জানুয়ারি ঢাকায় কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত হয়। আমাকে সেখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেই সেমিনারে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন পরিষদের সমন্বয়ক ড.
সেমিনারে লিখিত বক্তব্যে সমস্যার কথা যেমন তুলে ধরা হয়েছে তেমনি সমাধানের পথও দেখানো হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, সব ক্যাডারের পদোন্নতি প্রশাসন ক্যাডারের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা নিজেদের পদোন্নতির ব্যবস্থা করেন। অন্যেরগুলোর সঙ্গে সমতা বিধান করেন না। সমস্যা নিরসনে পিএসসির অধীনে পদোন্নতি দেওয়ার ক্ষমতা অর্পণের দাবি তোলা হয়েছে। প্রশাসনসহ সব ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি পিএসসি দেবে।
উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের যেকোনো কাজ প্রশাসন ক্যাডারের অধীনে থাকায় সেই কাজ বিঘ্নিত হচ্ছে ও অন্তঃকোন্দল সৃষ্টি হচ্ছে। সে জন্য প্রশাসন ক্যাডারের অধীনতা থেকে এসব কাজ মুক্ত করার দাবি জানানো হয়। মন্ত্রীদের খুব কাছে থাকার সুবাদে চাকরির অনেক সুবিধা কেবল প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা পান বলেও উল্লেখ করা হয়। সব ক্যাডারের জন্য সমসংখ্যক পদসোপান সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে, যাতে একই সময়ে একই বিসিএসের সবার পদোন্নতি নিশ্চিত করা যায়।
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষেই সহজেই সম্ভব এই বৈষম্যমূলক পদ্ধতির মূলোৎপাটন করা। বৈষম্যবিরোধী সরকারের হাত ধরে আন্তক্যাডার বৈষম্য দূর হোক। এটি বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিসের যুগ যুগ ধরে চলে আসা জটিলতা দূর করবে। ২৫টি ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তাদের দাবি আমলে নেওয়া হোক। দেশটা আমাদের সবার। এমনও আছে, পরিবারের একেকজন একেক ক্যাডারের কর্মকর্তা। আমরা চাই, সবার যৌথ প্রচেষ্টায় দেশ এগিয়ে যাক।উল্লিখিত সেমিনারপত্রে ওই সময়ের প্রশাসন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, পুলিশ ও পশু সম্পদ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতির তুলনামূলক একটি চিত্র হাজির করা হয়েছে। সেমিনারপত্র অনুযায়ী, ওই সময়ে Ñপ্রশাসন ক্যাডারে মোট কর্মকর্তা ৭ হাজার ৭৬ জনের মধ্যে ১০৪ জন ছিলেন প্রথম গ্রেডে, ৪৬১ জন ছিলেন দ্বিতীয় গ্রেডে, ৮৫১ জন তৃতীয় গ্রেডে। এ ছাড়া কয়েকজন সিনিয়র সচিব ও মন্ত্রিপরিষদের সচিব ছিলেন।
পুলিশের ৩ হাজার ১০০ কর্মকর্তার মধ্যে প্রথম গ্রেডে ছিলেন ২ জন, দ্বিতীয় গ্রেডে ছিলেন ৮, তৃতীয় গ্রেডে ছিলেন ১৩৫ জন। কৃষি ক্যাডারের ৩ হাজার ২০০ জনের মধ্যে প্রথম গ্রেডে কেউ নেই, দ্বিতীয় গ্রেডে ছিলেন ৫, তৃতীয় গ্রেডে ছিলেন ৪৯ জন। শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা ১৫ হাজার ৫০০ জন। তাঁদের মধ্যে একজনও প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় গ্রেডে নেই। স্বাস্থ্য ক্যাডারে ৩২ হাজার জনের মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় গ্রেডে একজনও নেই। তৃতীয় গ্রেডে ছিলেন ৬৫৭ জন। পশু সম্পদ ক্যাডারে ২ হাজার ৯৩ জনের মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় গ্রেডে কেউ নেই। তৃতীয় গ্রেডে ছিলেন ৩৩ জন। ওই সময়ের সঙ্গে বর্তমান অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি, বরং বৈষম্য আরও বেড়েছে বলে মনে হয়।
শিক্ষা ক্যাডারের সাড়ে ১৫ হাজার কর্মকর্তার মধ্যে একজনও প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় গ্রেডে নেই। অবিশ্বাস্য বৈষম্য! কেন চতুর্থ গ্রেডের ওপরে কেউ নেই—এর কোনো সদুত্তর আছে কি? তাঁরা এক নম্বর গ্রেডে গেলে শিক্ষাব্যবস্থার ওপর কি ভীষণ নেতিবাচক প্রভাব পড়বে? বরং চার নম্বর গ্রেডে গিয়ে থেমে যাওয়ার কারণে তাঁরা মানসিকভাবে আহত হচ্ছেন। রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার ওপর সৃষ্ট বিরক্তি হতাশাগ্রস্ত করে তুলছে। যার প্রভাব পড়ছে পাঠদানে।
প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা প্রায় সবাই পর্যায়ক্রমে দ্বিতীয় গ্রেডে উন্নীত হবেন। প্রথম গ্রেডেও যাবেন অনেকে। কেবল তা–ই নয়, সুপার গ্রেডে সিনিয়র সচিব মন্ত্রিপরিষদ সচিব হবেন অনেকেই। সিনিয়র সচিব ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব—দুটি গ্রেড এক নম্বর গ্রেডেরও ওপরে। স্পেশাল গ্রেডের পদ। আপাতদৃষ্টে বেতন স্কেলে ২০টি ধাপ মনে করা হলেও প্রশাসন ক্যাডারের জন্য ২২টি। ওপরের দুটি সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করা যায় না, এতটাই ওপরে তাঁরা।
আনুপাতিক হারে চিকিৎসকদের প্রথম কিংবা দ্বিতীয় গ্রেডে যাওয়ার সুযোগ দিলে কি স্বাস্থ্যব্যবস্থার চরম সর্বনাশ হতো? চিকিৎসকেরা প্রথম–দ্বিতীয় গ্রেডে গেলে কি তাঁদের সেবার মান খারাপ হয়ে যেত? অন্য যেকোনো ক্যাডারের চেয়ে একাডেমিক অনেক বেশি যোগ্যতা নিয়েও কেন তাঁরা ওই দুই গ্রেডে যেতে পারবেন না, এ প্রশ্নের উত্তর জানা নেই। স্বাস্থ্য ক্যাডারের অনেক পদ শূন্য থাকা সত্ত্বেও বছরের পর বছর ধরে সেগুলোয় পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে না। কোনো কোনো বিভাগে গত ছয় বছরে একবারও পদোন্নতি দেওয়া হয়নি।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা ভেবেছিলেন, বৈষম্য দূর হবে। বাস্তবে সেই বৈষম্য আরও বাড়ছে। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি পাচ্ছেন। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের মাসখানেকের মধ্যে একেকজন কর্মকর্তা কয়েকবার পদোন্নতিও নিয়েছেন। মৃত কর্মকর্তাদেরও পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি নেই।
এখন বিসিএসের ব্যাচ ধরেই পদোন্নতি হয়েছে ও হচ্ছে। স্বাস্থ্য ক্যাডারেও সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এর ভিন্নতা হলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বৈষম্য সৃষ্টিতে নতুন নজির স্থাপিত হবে। বৈষম্য দূরীকরণের চেষ্টায় যেন নতুন বৈষম্য সৃষ্টি না হয়। স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা কতটা দুর্ভাগা যে তাঁদের পদোন্নতির জন্য কর্মবিরতি পালনের মতো কর্মসূচিও দিতে হচ্ছে।
পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তারা দুজন ছাড়া কেন অন্যরা এক নম্বর গ্রেডে যেতে পারছেন না? এক নম্বর গ্রেডে বেশিসংখ্যক গেলে কি তাঁরা আইনশৃঙ্খলার সামাল দিতে পারবেন না? সিনিয়র সচিব পদমর্যাদায় পুলিশসহ অন্যান্য ক্যাডারের কেউ কেন হতে পারবেন না? কৃষি ক্যাডারের কর্মকর্তাদের কেউ কেন এক নম্বর গ্রেডে যেতে পারবেন না? পশু সম্পদ ক্যাডারের কর্মকর্তা তো তৃতীয় গ্রেডে চাকরির ইতি টানতে হয়। কেন এত বৈষম্য, সেই প্রশ্ন এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
কেবল উল্লিখিত কয়েকটি ক্যাডার নয়, দুজন পুলিশ এবং প্রশাসন ছাড়া অন্য সব ক্যাডারের কর্মকর্তাদের এক নম্বরে রাখা হয়নি কী কারণে? প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা সবার ভাগ্য নির্ধারণ করার দায়িত্ব পেয়েছেন বলে কি তাঁদের সবার ওপরের আসনে বসে থাকতে হবে? এখানে একটি বিষয় বলে রাখা ভালো, পদোন্নতির সঙ্গে খুব বেশি আর্থিক লাভালাভ থাকে না। এর কারণ, বার্ষিক বৃদ্ধিতে বেতন এমনতিই স্কেলের উচ্চতায় চলে যায়।
একই সঙ্গে একই প্রশ্নের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ২৬ ক্যাডারের কর্মকর্তারা চাকরিতে যোগদান করেন। কেবল তা–ই নয়, চাকরি স্থায়ীকরণ ও সিনিয়র স্কেল পরীক্ষাও হয় একই প্রশ্নে। এখানে মেধার প্রশ্ন নয়। সবাই অভিন্ন প্রশ্নপত্রে প্রতিযোগিতা করে এসেছেন। কেউ যদি বিশেষ সুবিধা পান, তাহলে তা হওয়া উচিত বিশেষায়িত বিষয়ের ক্যাডার কর্মকর্তারা। স্বাস্থ্য, প্রকৌশল, কৃষি কিংবা পশু সম্পদ।
প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা নাকি বেশি মেধাবী, তাই তাঁদের বেশি সুবিধা পাওয়া উচিত—এমন একটি পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন আদালত। ওই বিচারক হয়তো জানেন না, সম্মিলিত মেধার পেছনে থাকা কতজন প্রশাসন ক্যাডারে চাকরি করেন। ‘জন-আকাঙ্ক্ষা পূরণে প্রত্যাশিত সিভিল সার্ভিস’ শীর্ষক সেমিনারপত্রে দেখানো হয়েছে, ২৫তম বিসিএস পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধার দিক থেকে শেষ ৫০ জনের মধ্যে ৩০ জন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা হয়েছেন।
বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যাঁরা চাকরিতে যোগদান করেন, তাঁরা প্রত্যেকে সেবকমাত্র। এসব সেবকের মধ্যে একটি ক্যাডারের নামকরণ যখন হয়, প্রশাসন তখন আর সেবকচরিত্রে তাঁদের মধ্যে থাকে না। এ জন্য এই ক্যাডারের নামও পরিবর্তন করা প্রয়োজন। আন্তক্যাডার বৈষম্য দূরীকরণ এখন দেশের স্বার্থে জরুরি হয়ে পড়েছে।
বিশেষ একটি ক্যাডারের প্রতি অন্তর্বতী সরকারের যে বিশেষ দরদ, তা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। অথচ বিগত দিনগুলোতে জনস্বার্থ বিসর্জন দেওয়ার ক্ষেত্রে এই ক্যাডারের কর্মকর্তাদের তুলনা নেই।
ভোটের অধিকার থেকে অনেক অধিকার ক্ষুণ্ন করার ক্ষেত্রে এই ক্যাডার সর্বাগ্রে ছিল। ভবিষ্যতে যাতে কোনো রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে যোগসাজশ করে দেশকে নিলামে তুলতে না পারে, সেই ব্যবস্থাও রাখতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষেই সহজেই সম্ভব এই বৈষম্যমূলক পদ্ধতির মূলোৎপাটন করা। বৈষম্যবিরোধী সরকারের হাত ধরে আন্তক্যাডার বৈষম্য দূর হোক। এটি বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিসের যুগ যুগ ধরে চলে আসা জটিলতা দূর করবে। ২৫টি ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তাদের দাবি আমলে নেওয়া হোক। দেশটা আমাদের সবার। এমনও আছে, পরিবারের একেকজন একেক ক্যাডারের কর্মকর্তা। আমরা চাই, সবার যৌথ প্রচেষ্টায় দেশ এগিয়ে যাক।
তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক য ড র র কর মকর ত দ র সব ক য ড র র প রথম গ র ড প রব ন ন সরক র র ব যবস থ ন কর ন পর ক ষ র সব র ব স এস র জন য দ র কর র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
জাতীয় ঐক্য যে কারণে জরুরি
ভারতের বাংলাদেশবিরোধী অপতৎপরতা, নেতিবাচক প্রচার-প্রপাগান্ডা এবং মাঝেমধ্যেই সামরিক হুমকি-ধমকি, বিশ্বসভায় বাংলাদেশকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার আগ্রাসী প্রবণতা এবং বাংলাদেশবিরোধী একটি রাজনৈতিক দলের হাজার হাজার কর্মীকে অবৈধভাবে ভারতে আশ্রয় এবং প্রশিক্ষণ দেওয়া, এসব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করার সামর্থ্য কোনো একক রাজনৈতিক দলের নেই। কোনো একক রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করলেও সর্বগ্রাসী এই সুনামি রুখে দেওয়া কঠিন হবে। হয় তারা ভারতের হাতের পুতুল হয়ে আগের সরকারের মতো আত্মঘাতী চুক্তি সই করবে, বাংলাদেশকে ভারতের একচেটিয়া বাজারে পরিণত করবে অথবা কঠোর হতে গিয়ে ব্যর্থ সরকারে পর্যবসিত হবে। এমন শক্তি মোকাবিলা করার জন্য দরকার সুদৃঢ় দেশপ্রেম, জাতীয় ঐক্য এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য বিশ্ববরেণ্য কোনো ব্যক্তির নেতৃত্ব।
আজ বাংলাদেশের নির্বাহী প্রধানের দায়িত্বে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তি না থেকে অন্য যে কেউ থাকলে বাংলাদেশকে উগ্র মৌলবাদী দেশের তালিকায় ফেলে দেওয়া হতো। এই লক্ষ্যে ভারতের মদদে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ব্যাপক প্রচার-প্রপাগান্ডা চালাচ্ছেন, কিন্তু ড. ইউনূসের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা এবং সততার কাছে সব খড়কুটোর মতো ভেসে যাচ্ছে। বিশ্বনেতারা ড. ইউনূসের কথা কখনোই অবিশ্বাস করেন না। তিনি যা বলেন তা-ই তারা গ্রহণ করেন। এটি আমাদের বড় সৌভাগ্য।
এবার রমজানে সম্ভবত গত ৫৪ বছরের বাংলাদেশে এই প্রথম নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য কমেছে, মানুষ স্বস্তিতে আছে। এখানেও আওয়ামী লীগের কর্মীরা সরকারের সততা ও আন্তরিকতার প্রশংসা না করে সমালোচনা করছেন। বলছেন, এত দাম কমে গেলে কৃষক মারা যাবে। কেউ বলছেন, এ বছর মার্চে রোজা হওয়ায় শীতের সবজি এখনও বাজারে আছে, উৎপাদনের মৌসুমে রোজা হয়েছে বলেই কৃষিপণ্যের দাম কম। কিন্তু মার্চ মাসে তো রোজা আরও হয়েছে, প্রতি ৩৫-৩৬ বছরে একবার রোজা পুরো বছর ঘুরে আবার আগের জায়গায় আসে। কই আর কখনও তো এমন হয়নি।
দাম কমার কারণ দুটি। প্রথমত, কৃত্রিমভাবে দাম বাড়াত যেসব মধ্যস্বত্বভোগী অসাধু ব্যাবসায়ী-সিন্ডিকেট, সেটা ভেঙে পড়েছে। সরকারের সততা এবং সদিচ্ছার কারণেই সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব হয়েছে। দ্বিতীয় কারণটি খুব ইন্টারেস্টিং, এটা কেউ ভেবে দেখেননি। রাজনৈতিক দলগুলো যখন ক্ষমতায় থাকে, বিশেষ করে শেখ হাসিনার শাসনামলে দুর্নীতি ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ে, মানুষের হাতে ছিল মাত্রাতিরিক্ত অবৈধ অর্থ। এই অবৈধ অর্থের একটা আগ্রাসী ক্রয়ক্ষমতা প্রতিফলিত হতো বাজারে। দুর্নীতি কমে আসায় কৃত্রিম চাহিদা এখন বাজারে অনুপস্থিত। কৃষিপণ্যের দাম কমে গেছে, কৃষক মরে যাচ্ছে– এই হা-হুতাশ যারা করেন, তাদের জন্য বলি, আগেও আমরা দেখেছি কৃষক মাথায় করে বাজারে এক টুকরি টমেটো এনেছে, বিক্রি করতে না পেরে বাজারেই ঢেলে ফেলে দিয়ে গেছে, কারণ দাম এত কম যে বোঝা বয়ে বাড়ি ফিরিয়ে নিতেও চায়নি তারা। তখনও কিন্তু শহরের বাজারগুলোতে টমেটোর দাম কমেনি। কারণ মধ্যস্বত্বভোগী সিন্ডিকেটের দাপট ছিল তীব্র।
আওয়ামী লীগ দাবি করে তাদের ও অঙ্গসংগঠনের কর্মী সংখ্যা কোটির ওপরে। হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যরাসহ প্রায় ৪৫ হাজার নেতাকর্মী দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। অধিকাংশই ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। এই ৪৫ হাজারের সঙ্গে আরও অনেকেই অদূর ভবিষ্যতে যুক্ত হবেন। তাদের ভারত প্রশিক্ষণ দিয়ে এমনভাবে তৈরি করবে, যাতে তারা আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতায় বসাতে পারে। দেশের ভেতরে থাকা আওয়ামী লীগের কর্মীরা ক্রমাগত দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর চেষ্টা করবেন। অতীতের মতো কখনও বাসে পেট্রোল বোমা ছুড়বেন, কখনও লগি-বৈঠার তাণ্ডব চালাবেন, শাহবাগী গ্রুপ, ব্লগার গ্রুপ তৈরি করবেন, কখনও ভবনে আগুন দেবেন। এসব নাশকতামূলক কাজ তারা করতেই থাকবেন। এই দ্বিমুখী অরাজকতা এবং দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড মোকাবিলা করা কোনো একক রাজনৈতিক দলের সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে না।
ঠিক এ রকম এক সময়ে আমাদের দুটি কাজ করতে হবে। সব দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক শক্তির একটি ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি চীন এবং অন্যান্য বৃহৎ শক্তির সঙ্গে কৌশলগত কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করে আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হবে।
বৃহৎ ঐক্য টেকসই হবে তখনই যখন ঐক্যবদ্ধ শক্তির সমন্বয়ে একটি জাতীয় সরকার গঠিত হবে। এই মুহূর্তে যদি নির্বাচন হয় এবং নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যদি একটি রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে তাহলে ঐক্য ধরে রাখা যাবে না। এমনকি কোনো জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করার পরেও এই ঐক্য টিকবে না। টেকসই ঐক্য গড়তে হবে একটি জাতীয় সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে।
আমার প্রস্তাব হলো, সব দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল এক হয়ে আগামী পাঁচ বছরের জন্য একটি জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠন করা হোক। সেই সরকারের রাষ্ট্রপতি থাকবেন প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিএনপি থেকে প্রধানমন্ত্রীসহ ১৫ জন, জামায়াতে ইসলামী থেকে ১০ জন, এনসিপি থেকে ১০ জন, অন্যান্য দল থেকে ১৫ জন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং উপমন্ত্রী থাকবেন। এই ৫০ জনের ক্যাবিনেট আগামী পাঁচ বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করবে এবং সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশের ভিত্তিতে রাষ্ট্র ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ সংস্কার করবে। মন্ত্রিপরিষদের ওপরে একটি সুপ্রিম কাউন্সিল থাকবে। প্রতিটি জেলা থেকে দু’জন প্রতিনিধি, সব রাজনৈতিক দল থেকে মন্ত্রিপরিষদের আনুপাতিক হারে প্রতিনিধি, সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, তিন বাহিনীর প্রধান, পুলিশপ্রধানকে নিয়ে গঠিত হবে সুপ্রিম কাউন্সিল। এই কাউন্সিল জাতীয় সরকারে পার্লামেন্টের ভূমিকা পালন করবে। তবে শুধু রুটিন কাজের বাইরে রাষ্ট্রীয় বড় ইস্যুগুলোতে সুপ্রিম কাউন্সিল মিটিংয়ে বসবে এবং সিদ্ধান্ত নেবে।
এই পাঁচ বছরের মধ্যে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে হত্যকাণ্ড ঘটানোসহ তিনটি ভোটারবিহীন নির্বাচন করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করা এবং খুন, গুম, দুর্নীতি, অর্থ পাচারসহ সব অপরাধের বিচার করাও সম্ভব হবে। এরপর একটি দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করে বাংলাদেশে পুনরায় পার্টি পলিটিকস শুরু করা যাবে।
এই পাঁচ বছরে দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করে একটি নৈতিক কাঠামোর ওপর দাঁড় করানো যাবে, বিদেশ নীতিও একটি সুস্পষ্ট ভিত্তির ওপর দাঁড়াবে। ড. ইউনূসের গ্রহণযোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ বহির্বিশ্বে এক অনন্য উচ্চতায় উঠে যাবে।
কাজী জহিরুল ইসলাম: কবি ও জাতিসংঘ কর্মকর্তা