জাতীয় সংসদে নারীর জন্য ৩০০ আসন সংরক্ষিত রেখে সেসব আসনে সরাসরি নির্বাচনের সুপারিশ করতে যাচ্ছে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন। সে ক্ষেত্রে মোট আসনসংখ্যা ৬০০ করার সুপারিশ করা হচ্ছে। নারীর প্রতি বৈষম্য রয়েছে—এমন সব আইনে পরিবর্তন চাওয়া হয়েছে সুপারিশে।

সবচেয়ে আলোচিত সুপারিশ থাকছে পারিবারিক আইনে। আইনটি পরিবর্তনের মাধ্যমে সম্পদ-সম্পত্তি, সন্তানের অভিভাবকত্ব ও হেফাজত, বিয়ে-বিয়েবিচ্ছেদে সব ধর্মের নারীর সমান অধিকার নিশ্চিত করার প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। রাজনৈতিক দলের কমিটিতে নির্বাচনের মাধ্যমে নারী-পুরুষ প্রতিনিধি রাখা এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুসারে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে (২০৩০ সাল) রাজনৈতিক দলের প্রতিটি

স্তরের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত না হলে ওই দলকে যেন নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়, সেই সুপারিশও রাখা হচ্ছে।

এসব বিষয় প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভীন হক।

অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত মোট ১১টি সংস্কার কমিশনের একটি হচ্ছে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন। ৩০ মার্চ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা ছিল এই কমিশনের। তবে গত বৃহস্পতিবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পৃথক প্রজ্ঞাপনে এই কমিশনসহ পাঁচটি কমিশনের (অন্য চারটি কমিশন হচ্ছে স্বাস্থ্য, শ্রম, স্থানীয় সরকার এবং গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন) মেয়াদ আরও এক মাস অর্থাৎ ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। যদিও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদন ইতিমধ্যে জমা দিয়েছে। স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ জমা দিয়েছে। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনে এ মাসের তৃতীয় সপ্তাহের দিকে প্রতিবেদন জমা দিতে পারে বলে জানা গেছে।

সুপারিশের বিষয়ে জানতে চাইলে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভীন হক গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, আশু, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি এই তিন ধাপে সুপারিশ করা হবে। আশু সুপারিশগুলো থাকবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য। মধ্যমেয়াদি সুপারিশ নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের জন্য আর দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশগুলো থাকবে অধিকার ও ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে নারী আন্দোলনের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে।

এক প্রশ্নের জবাবে শিরীন হক বলেন, দেশে এত জনসংখ্যার জন্য জাতীয় সংসদে ৩০০ আসন যথেষ্ট নয়। জনসংখ্যার অনুপাতে জাতীয় সংসদে আসনসংখ্যা ৬০০ করার সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩০০ আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রেখে সেসব আসনে সরাসরি নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুপারিশ করা হচ্ছে। অর্থাৎ একটি আসনের বিপরীতে নারীদের জন্য একটি সংরক্ষিত আসন এবং সেই আসনে সরাসরি নির্বাচনের সুপারিশ করা হবে।

আসনসংখ্যা বাড়ানোর সুপারিশ থাকলেও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের কোনো সুপারিশ করছে না কমিশন। রাজনৈতিক দলে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার আলাদা কোনো সুপারিশ না থাকলেও এটা নিশ্চিত করতে কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ থাকছে। এ বিষয়ে শিরীন হক বলেন, ‘আরপিওতে রাজনৈতিক দলগুলোর কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার কথা বলা আছে। আমরা চাইব, দলগুলো তা পালন করবে। এ বিষয়ে আলাদা কোনো সুপারিশ করা হচ্ছে না। তবে এ আদেশ পালন না করা হলে আরপিওতে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেই। আমরা চাই, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এই আদেশ প্রতিপালন না হলে দলকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার মতো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হোক। দলের কমিটিতে নারী-পুরুষ প্রত্যেকে যেন নির্বাচিত হয়ে আসেন, সেই সুপারিশ থাকছে।’

নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিটি স্তরের কমিটিতে ২০২০ সালের মধ্যে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্য ছিল আরপিওতে। ২০০৮ সালে নিবন্ধন নেওয়ার সময় দলগুলো তা পূরণের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তা পূরণ করতে পারেনি নিবন্ধিত দলগুলো। এখন ২০৩০ সালের মধ্যে সেই লক্ষ্য পূরণের জন্য আরপিও সংশোধন হয়েছে।

নারী অধিকারকর্মীদের দীর্ঘদিনের দাবি অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সব ধর্মের নারীদের সম্পদ-সম্পত্তি, সন্তানের অভিভাবকত্ব ও হেফাজত, বিয়ে-বিয়েবিচ্ছেদে নারীকে সমান অধিকার দেওয়া। তাঁরা চান, মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১, উত্তরাধিকার আইন ১৯২৫, অভিভাবকত্ব ও প্রতিপাল্য আইন ১৮৯০ ও নাগরিকত্ব আইন-১৯৫১ সংস্কার করে নারীর পারিবারিক ও জনজীবনে সম-অধিকার নিশ্চিত করা।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ১৯৯৭ গ্রহণ করে। ওই নীতিতে সম্পত্তিসহ সব ক্ষেত্রে নারীর সমান অধিকারের কথা বলা ছিল। তবে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এলে ওই নীতিতে কোরআন-সুন্নাহর বিরুদ্ধে কিছু করা যাবে না বলে যোগ করে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০২৪ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগপর্যন্ত পারিবারিক আইনের অসমতার বিষয়গুলোতে কোনো পরিবর্তন আনতে আগ্রহ দেখায়নি।

রাজনৈতিক সরকারগুলোর এই অনাগ্রহের প্রভাব পড়েছে সিডও সনদের ওপরও। বাংলাদেশ চার দশক আগে ১৯৮৪ সালে আন্তর্জাতিক সনদ ‘নারীর বিরুদ্ধে সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণ (সিডও)’ অনুমোদন করলেও ২ ও ১৬.

১(গ) ধারার ওপর সংরক্ষণ রেখেছে। সনদের ২ নম্বর ধারায় বলা আছে, নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য নিরসনে শরিক দেশগুলো আইনগত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেবে এবং আইনের সংস্কার করবে। ১৬.১(গ) ধারায় বিবাহ এবং বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে। কোনো সরকার এ দুটি ধারার ওপর সংরক্ষণ প্রত্যাহার করেনি।

শিরীন হক বলেন, পারিবারিক আইনে যেসব বৈষম্য রয়েছে, সেসব পরিবর্তনের সুপারিশ করা হচ্ছে। সিডও সনদের দুটি ধারার ওপর সংরক্ষণ প্রত্যাহার করারও সুপারিশ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘এসব ক্ষেত্রে আমরা যেসব পরিবর্তন চাইছি, তা অন্তর্বর্তী সরকার বাস্তবায়ন করতে পারবে। কারণ, এ সরকার ভোটের ওপর নির্ভরশীল নয়।’

কমিশনের সুপারিশে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও পোশাকশ্রমিকসহ সব পেশাজীবী ও শ্রমজীবী নারীর জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস করার সুপারিশ করা হচ্ছে। এখন ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নারীরা পেয়ে থাকেন। তবে কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও তাদের নারী কর্মীদের এই সুবিধা দিয়ে থাকে।

সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন, নারী অধিকার কমিশন গঠন, বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে বিশেষ বিধানের মাধ্যমে অপ্রাপ্তবয়স্ক (১৮ বছরের নিচে) মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার সুযোগ বাতিলের মতো গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশও থাকছে।

১০ সদস্যের নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠনে প্রজ্ঞাপন জারি হয় গত ১৮ নভেম্বর। কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের জ্যেষ্ঠ ফেলো মাহীন সুলতান, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ফৌজিয়া করিম ফিরোজ, বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি কল্পনা আক্তার, নারী স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ হালিদা হানুম আখতার, বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরুপা দেওয়ান, নারীপক্ষের পরিচালক কামরুন নাহার, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ সামাজিক উন্নয়ন উপদেষ্টা ফেরদৌসী সুলতানা ও শিক্ষার্থী প্রতিনিধি নিশিতা জামান নিহা।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন র স প র শ কর প র ব র ক আইন ন শ চ ত কর র র কম ট ত র র জন য ব যবস থ ক ষমত য় র ওপর আরপ ও সরক র দলগ ল

এছাড়াও পড়ুন:

পায়ে তেল মালিশে দূর হবে ঘুমের সমস্যা

ব্যস্ত জীবন এবং নানামুখী চাপের কারণে অনেকেরই রাতে ভালোভাবে ঘুম হয় না। এর ফলে সারাদিন ঝিমঝিম লাগে, কাজে মনোযোগের ঘাটতি হয়। কেউ কেউ ঘুম না আসায় গভীর রাত পর্যন্ত মোবাইল স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকেন। 

সুস্থ জীবনযাপনের জন্য মানসিক চাপ কমানো এবং শান্তিপূর্ণ ঘুম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও পর্যাপ্ত ঘুমানোর পরামর্শ দেন। যারা ক্লান্তি, পায়ে ব্যথা, অনিদ্রা এবং মানসিক চাপের সমস্যায় ভুগছেন রাতে ঘুমানোর আগে তারা পায়ের তলায় ভালোভাবে ম্যাসাজ করতে পারেন। এই পদ্ধতি ভালো ঘুমের সহায়ক হবে।  

বিশেষজ্ঞদের মতে, রাতে পর্যাপ্ত ঘুম না হলেও, পায়ের তলায় তেল মালিশ করলে ভালো ঘুম হয়। পা মালিশ করলে শরীরে রক্ত ​​সঞ্চালন উন্নত হয়, যার ফলে শরীর আরাম বোধ করে। তবে কোন তেল পা মালিশের জন্য সবচেয়ে ভালো তা নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন আছে।

তিলের তেল

মানসিক চাপ এবং অনিদ্রা দূর করতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে প্রতিদিন এই তেল দিয়ে পায়ের তলায় ম্যাসাজ করুন। এতে থাকা টাইরোসিন অ্যামিনো অ্যাসিড সেরোটোনিন হরমোন বাড়ায়, যা এক ধরনের সুখ হরমোন। এই তেল দিয়ে পা মালিশ করলে মুড ভালো হয়। এর ফলে ঘুমও ভালো হয়। 

সরিষার তেল
আয়ুর্বেদে সরিষার তেল স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী বলেও বলা হয়েছে। এই তেল দিয়ে পায়ে মালিশ করলে পেশি শিথিল হয় এবং রক্ত ​​সঞ্চালনের গতি উন্নত হয়। যারা অনিদ্রার সমস্যায় ভুগছেন পায়ে হালকা গরম সরিষার তেল দিয়ে ম্যাসাজ করলে আরাম বোধ করবেন। এই পদ্ধতি উদ্বেগ এবং মানসিক চাপ দূর করতেও সহায়ক বলে বিবেচিত হয়।

ল্যাভেন্ডার তেল
এই তেলে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টিসেপটিক এবং অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এটি পায়ের ম্যাসাজের জন্য ব্যবহার করলে বেশ আরাম পাওয়া যাবে। এই পদ্ধতি উদ্বেগ, মানসিক চাপ এবং ক্লান্তি কমাতে সাহায্য করে। অনিদ্রা দূর করার জন্য এটি অন্যতম সেরা প্রাকৃতিক চিকিৎসা। এর পাশাপাশি, যারা অতিরিক্ত চুল পড়ার সমস্যায় ভুগছেন তাদের জন্য এটি একটি প্রতিকার হিসেবেও বিবেচিত। এই পদ্ধতি রক্ত ​​সঞ্চালন উন্নত করে।

নারকেল তেল
নারকেল তেল দিয়ে পায়ের ম্যাসাজ করলে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হয় এবং উদ্বেগ, বিষণ্ণতা এবং মাসনিক চাপের মতো সমস্যা থেকে মুক্তি পায়। এর পাশাপাশি, পেশি বা পায়ে ব্যথা থাকলে এই তেল লাগালে অনেক আরাম পাওয়া যাবে।

বাদাম তেল
বাদাম তেল দিয়ে পায়ের ম্যাসাজ করলে মানসিক চাপ দূর হয় এবং বিষণ্ণতা কাটিয়ে ওঠা যায়। মানসিক শান্তির জন্য, প্রতিদিন এই তেল দিয়ে আপনার পায়ের তলায় ম্যাসাজ করুন। এতে উপকার পাবেন।
সূত্র: ইন্ডিয়া টিভি

সম্পর্কিত নিবন্ধ