সারা দেশ যখন ঈদের আনন্দে ভাসছে, সবাই পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদ্‌যাপন করছেন, তখনো দায়িত্বের ডোরে বাঁধা একদল মানুষ। তাঁরা পরিবারের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নিতে পারেন না, বাড়ির সবার সঙ্গে বসে ঈদের সেমাই খাওয়ারও সুযোগ হয় না। এমন মানুষের দলে আছেন সুন্দরবন রক্ষায় নিয়োজিত বন বিভাগের কর্মীরা। সুন্দরবনকে ভালো রাখতে তাঁরা নীরবে নিজেদের ঈদ উৎসর্গ করেন।

সুন্দরবনের বজবজা টহল ফাঁড়ির বনকর্মী মো.

মফিজুল ইসলাম মুঠোফোনে বলেন, ‘ভাই, মনটা পড়ে আছে পরিবারের লোকজনের কাছে আর দেহটা সুন্দরবনে। সবার ঈদ কাটে পরিবারে, আমাদের কাটে বনে-বাদাড়ে। আসলে চাকরির জন্য সবকিছু মেনে নিতে হয়। আজ ঈদের দিনেও টহল করছি। আমরা স্টাফরা মিলে একটি মুরগি জবাই করেছি। আর একটু সেমাই রান্না করে নিজেদের মতো করে ঈদ উদ্‌যাপন করছি।’

বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, প্রতিবছর ঈদের সময় চোরা শিকারি চক্র সুন্দরবনে হরিণসহ বন্য প্রাণী শিকারের অপতৎপরতা চালায়। তাই ঈদের সময় সুন্দরবনে বন বিভাগে কর্মরত সব কর্মকর্তা ও বনরক্ষীর ছুটি সীমিত করে কর্মস্থলে থেকে সার্বক্ষণিক টহলের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

সোমবার ঈদের দিন সকালে সুন্দরবনের বিভিন্ন ফরেস্ট স্টেশন ও টহল ফাঁড়ির কয়েকজন কর্মকর্তা ও বনরক্ষীর সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেন, তাঁদের ঈদ হচ্ছে সুন্দরবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। তা ছাড়া সবাই একসঙ্গে ছুটিতে গেলে বনে নজরদারি করবে কে? পরিবারের সঙ্গে না থাকতে পারলেও বনের নিরাপত্তায় কাজ করছেন, এটাই তাঁদের জন্য বড় পাওয়া।

পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য গহিন সুন্দরবনের নীলকমল এলাকায় আছেন ফরেস্ট কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম। লোকালয় থেকে সেখানে পৌঁছাতে নৌযানে সাত থেকে আট ঘণ্টা লাগে। আটজন সহকর্মী নিয়ে সেখানেই ঈদ উদ্‌যাপন করছেন তিনি। বলেন, ‘আমার বাড়ি জামালপুরে। মা-বাবাসহ পরিবার সেখানেই থাকেন। আমার জঙ্গলে চাকরির গত পাঁচ বছরের অধিকাংশ ঈদ পরিবার ছাড়া জঙ্গলেই কেটেছে।’

ফরেস্ট কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম মুঠোফোনে বলেন, ঈদের সময়ে সুন্দরবনে অপরাধীদের তৎপরতা বেড়ে যায়। এ কারণে ঈদের সময়টায় যাতে কেউ সুন্দরবনের ক্ষতি করতে না পারে, সে জন্য সারাক্ষণ টহলে থাকতে হয়। গতকাল রোববার সারা রাত টহল দিয়েছেন। সুন্দরবনের গহিনে হলেও এখানে মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান টেলিটকের নেটওয়ার্ক আছে। এ জন্য আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারছি। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও কথা বলেছি।’

সুন্দরবনের শাকবাড়িয়া টহল ফাঁড়ির বনকর্মী মো. জুয়েল রানা বলেন, আজ পরিবার-প্রিয়জন নিয়ে সবাই যখন ঈদ আনন্দ উপভোগ করছেন, ঠিক তখন পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে তাঁরা নির্জন বনে অবস্থান করছেন। জঙ্গলের মধ্যে বসে সেমাই খেয়েছেন। এখন আবার টহলে বের হতে হবে। পরিবার ছাড়া ঈদ করা খুবই কষ্টের। তবে মানিয়ে নিতে হয়। পরিবারের সদস্যরাও এখন বিষয়টি মেনে নিয়েছেন।

জুয়েল রানা আরও বলেন, ‘দুর্গম ও ভয়ংকর বনাঞ্চলে আমাদের সব সময় জীবন বাজি রেখে দায়িত্ব পালন করতে হয়। তবে বেতন ছাড়া অন্য তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। রেশন–সুবিধাও পাই না আমরা।’

সুন্দরবনের কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশনের দায়িত্বরত কর্মকর্তা মো. আল-আমীন বলেন, তাঁর স্টেশনটি লোকালয়ের কাছাকাছি হওয়ায় ঈদের নামাজ পড়তে পেরেছেন। গহিন সুন্দরবনের মধ্যে পাতকোষ্টা, কাগাদোবেকি, গেওয়াখালী, আদাচাই, ভদ্রা, পাশাখালীসহ তাঁদের অনেক টহল ফাঁড়ি আছে। সেখানে মুঠোফোনের নেটওয়ার্কও নেই। ওই সব জায়গায় যাঁরা দায়িত্বে আছেন, তাঁরা ঈদের নামাজও পড়তে পারেন না। ঈদের কয়েক দিন আগে লোকালয়ে এসে খাবার পানি আর বাজারসদাই নিয়ে যান। পরিবার ছাড়া বনে-বাদাড়ে বসেই হয়তো তাঁরা আজ নিজেরাই সেমাই রান্না করে খাচ্ছেন।

সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ জেড এম হাছানুর রহমান বলেন, ঈদের ছুটিতে সুন্দরবনের বনরক্ষীদের অধিকাংশই বাড়িতে চলে গেলে সুন্দরবনের অধিকাংশ এলাকা অরক্ষিত হয়ে পড়ে। ফলে হরিণশিকারিরা ঈদের ছুটির কয়েকটা দিনকে নিরাপদ সময় মনে করছে। এ জন্য এবার ঈদে সুন্দরবনে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। বনরক্ষীদের ছুটি সীমিত করা হয়েছে। বিশেষ জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কাউকে ছুটি দেওয়া হয়নি। অন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পরিবারের সঙ্গে ঈদ কাটানোর সুযোগ পেলেও বন বিভাগের অধিকাংশ কর্মী বনজ সম্পদ রক্ষার তাগিদে বনের গহিনে নির্জনে পরিবারবিহীন ঈদ করছেন।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন স ন দরবন র বন ব ভ গ র ঈদ র সময় কর মকর ত বনরক ষ ফর স ট ঈদ র স ন করছ টহল ফ করছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

পিটিয়ে কুমির হত্যা বন্য প্রাণীর প্রতিও সহানুভূতি দরকার

একসময় বাংলাদেশের নদ–নদী ও খালে কুমিরের দেখা মিললেও দখল-দূষণ, খাদ্যসংকটসহ নানা কারণে মিঠাপানির কুমির বিলুপ্ত হয়ে যায়। ২০০০ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ–সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন মিঠাপানির কুমিরকে বাংলাদেশ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত ঘোষণা করে। সুন্দরবনের লবণাক্ত এলাকাতেই এখন কুমিরের বিস্তার রয়েছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ফরিদপুর, রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, মাদারীপুরের নদ–নদীতে কালেভদ্রে কুমির চলে আসার সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। কুমির নিয়ে জনমনে নানা জনশ্রুতি চালু থাকায় এসব এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে ভয়-আতঙ্ক থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তাই বলে ফাঁদ পেতে কুমির ধরে পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু সে রকমই একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটতে দেখলাম মাদারীপুরের কালকিনিতে।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, উপজেলার সাহেবরামপুর ইউনিয়নের নতুন আন্ডারচর গ্রামের একটি খালে গত শনিবার দুপুরে জেলেদের সহযোগিতায় ফাঁদ পেতে কুমিরটিকে আটকে ফেলা হয়। পরে উৎসুক জনতা কুমিরটিকে পিটিয়ে হত্যা করে। কুমিরটি প্রায় আট ফুট দৈর্ঘ্য ও দুই ফুট প্রস্থ।

বিষয়টি এমন নয় যে কুমিরটি হঠাৎ করেই জেলেদের জালে ধরা পড়েছিল। কিছুদিন ধরেই সেখানকার পালরদী নদী ও আড়িয়াল খাঁ নদে কুমিরটিকে দেখা যাচ্ছিল। বিষয়টি নিয়ে উপজেলা প্রশাসনও মাইকিং করে সাধারণ মানুষকে সচেতন করে। এরপরও কুমিরটিকে জীবিত উদ্ধার করে নিরাপদ জায়গায় পুনর্বাসন করতে না পারাটা খুবই দুঃখজনক। এ ক্ষেত্রে বন বিভাগ দায় এড়াতে পারে না। তারা কুমিরটিকে উদ্ধার করতে লোক পাঠায় ঠিকই, কিন্তু ততক্ষণে কুমিরটি মারা গেছে।

বন্য প্রাণী হত্যা আইনত অপরাধ। আমরা মনে করি, কুমিরটি হত্যার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। এ ধরনের কুমির বিচ্ছিন্নভাবে সুন্দরবন থেকে আসার সম্ভাবনা বেশি। ফলে কুমির নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই। নদ–নদীতে কুমির দেখা গেলে স্থানীয় লোকেরা যাতে আতঙ্কিত না হন, এর জন্য সচেতনতা তৈরি করা জরুরি।

ভবিষ্যতে যাতে কুমিরসহ বন্য প্রাণী হত্যা বন্ধ করা যায়, এ জন্য প্রশাসন, বন বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের একসঙ্গে কাজ করা প্রয়োজন। মাদারীপুর উপজেলা প্রশাসন ও বন বিভাগ যদি কুমিরটি উদ্ধারে আন্তরিক হতো, তাহলে এই হত্যাকাণ্ড ঠেকানো যেত। শুধু মানুষ নয়, বন্য প্রাণীর প্রতিও সহানুভূতি প্রয়োজন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পিটিয়ে কুমির হত্যা বন্য প্রাণীর প্রতিও সহানুভূতি দরকার