ফেব্রুয়ারিতে এক সামরিক বিমানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফেরত পাঠানো ভারতীয়দের শিকল পরানো ছবিগুলো ভারতের টেলিভিশনে ছড়িয়ে পড়ে। সেই দৃশ্য ছিল ভয়ংকর। ট্রাম্পের অভিবাসনবিরোধী কঠোর নীতির কারণে হাজারো ভারতীয় চরম দুর্দশায় পড়ছেন। এই মানুষগুলো আমেরিকায় যাওয়ার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন।

এ ঘটনার পর ভারতের বিরোধী দলগুলোর নেতারা প্রতিবাদে সরব হন। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীসহ অনেকে হাতে হাতকড়া পরে দিল্লির পার্লামেন্টের সামনে বিক্ষোভ করেন। মোদি যখন যুক্তরাষ্ট্র সফরের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন বিরোধীরা দাবি জানায়, তিনি যেন ট্রাম্পের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করেন।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে সংবাদ সম্মেলনে মোদি বলেন, তাঁর সরকার যুক্তরাষ্ট্রে থাকা অবৈধ অভিবাসীদের ফিরিয়ে আনতে পুরোপুরি প্রস্তুত। তিনি আরও বলেন, ‘ভারতের তরুণ, দরিদ্র জনগোষ্ঠী বড় স্বপ্নের ফাঁদে পড়ে বিদেশে পাড়ি জমায়। তাদের অনেকে জানেই না কেন তাদের নেওয়া হচ্ছে। মানব পাচারের মাধ্যমেও অনেককে নিয়ে যাওয়া হয়।’

কিন্তু মোদি একজন প্রবল জাতীয়তাবাদী নেতা। তিনি ভারতীয়দের মানসম্মান নিয়ে পঞ্চমুখ থাকেন সব সময়। সেই মোদি তাঁর দেশের নাগরিকদের পায়ে–হাতে শিকল পরিয়ে ফেরত পাঠানো হচ্ছে দেখেও এমন নরম সুরে কথা বলছেন কেন? কারণ, অভিবাসন নীতির ক্ষেত্রে মোদি ও ট্রাম্পের মধ্যে কোনো তফাত নেই।

ট্রাম্পের মতো মোদিও দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ও উন্নয়নের বড় বড় প্রতিশ্রুতি দেন। তাঁর দল বিজেপি ভারতের অর্থনৈতিক সাফল্যের কথা বড় করে প্রচার করে।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, ভারতের অর্থনীতি এখন মন্দার মুখে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো আয়বৈষম্য। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশটিতে জাতীয় সম্পদের ৪০ শতাংশের মালিক মাত্র ১ শতাংশ ধনী। ২০২৪ সালের শেষে ভারতে ১৯১ জন বিলিয়নিয়ার ছিলেন। এ সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পর সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে ভারতে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মানুষ চরম দারিদ্রের মধ্যে বাস করে। এ সংখ্যা ২৩ দশমিক ৪ কোটি।

ভারতের ভেতরের এই কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক আকারে অবৈধ ভারতীয় অভিবাসী আগমনের সম্পর্ক আছে। তবে এদের সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। ২০২২ সালের শেষ নাগাদ পিউ রিসার্চ সেন্টার অনুমান করেছিল, যুক্তরাষ্ট্রে সাত লাখ অবৈধ ভারতীয় অভিবাসী আছে। এ সংখ্যা অনুযায়ী, মেক্সিকো ও এল সালভাদরের পর ভারতের স্থান তৃতীয়। অন্যদিকে মার্কিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাবে এ সংখ্যা ২ লাখ ২০ হাজার।

সংখ্যা যা-ই হোক, মোদি ভারতের যে উজ্জ্বল অর্থনৈতিক ভাবমূর্তি হাজির করেন, এই অবৈধ অভিবাসীদের উপস্থিতি তার সঙ্গে মানানসই নয়। তাই মোদি চান, এই ‘অবৈধ অভিবাসনের’ বিষয়টি নিয়ে বেশি আলোচনা না হোক। কোনোমতে দ্রুত ও শান্তিপূর্ণভাবে তা শেষ করতে পারলেই তিনি বেঁচে যান। তিনি চান না যে ট্রাম্পের সঙ্গে এ নিয়ে কোনো বিরোধ হোক। তাহলে তা ভারতীয় অর্থনৈতিক সাফল্যের গল্পকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।

তবে হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতের জন্য অভিবাসনবিরোধী মনোভাব নতুন কিছু নয়। বছরের পর বছর ধরে ডানপন্থীরা বাংলাদেশ থেকে আসা কথিত অবৈধ অভিবাসীদের নিয়ে অভিযোগ তুলে আসছেন।

২০১৬ সালে ভারতের তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেন রিজিজু বলেছিলেন, ভারতে প্রায় দুই কোটি ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ আছে। ২০১৮ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এ সংখ্যা ৪ কোটির বেশি বলে দাবি করেন। ২০২৩ সালে কিছু ডানপন্থী রাজনীতিবিদ বলছেন, এখন সেই সংখ্যা প্রায় পাঁচ কোটি।

তবে এ দাবির কোনো প্রমাণ নেই।

মোদি হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হলেও তিনি যুক্তরাষ্ট্রে থাকা অবৈধ ভারতীয়দের স্বার্থ রক্ষার জন্য ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করতে রাজি নন। অভিবাসন প্রশ্নে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ট্রাম্পের মতোই।

কিন্তু হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের জন্য এই কথিত ‘অবৈধ মুসলিম অভিবাসী’ ইস্যু রাজনৈতিকভাবে বেশ কার্যকর। এটি ভারতীয় জনসাধারণের মনে এমন এক ভীতি সৃষ্টি করতে কাজে লাগে। তখন প্রচার করা যায়, ভারতে হিন্দু জাতি অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়েছে।

এই ভিত্তিহীন অভিযোগ ভারতের ডানপন্থী রাজনীতিবিদেরা খুব সফলভাবে ব্যবহার করেতে পারেন। ভারতে দরিদ্র মানুষের দুর্দশার জন্য নিজেদের ব্যর্থতা ঢেকে ‘অবৈধ বহিরাগতদের’ দায়ী করা যায়।

একবার অমিত শাহ বলেছিলেন, ‘তারা (বাংলাদেশি অভিবাসীরা) ভারতের গরিব মানুষের খাবার খেয়ে ফেলছে।’ তিনি অবৈধ অভিবাসীদের ‘উইপোকা’ ও ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তাঁদের ভারত থেকে বিতাড়িত করতে হবে। ২০১৯ সালের নির্বাচনী প্রচারে শাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বিজেপি সরকার ‘একজন একজন করে অনুপ্রবেশকারীকে তুলে বঙ্গোপসাগরে ছুড়ে ফেলবে’।

এ ধরনের মনগড়া অভিযোগ হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের পক্ষে ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে ভীতি ছড়ানোর সুযোগ করে দেয়। যেমন দিল্লি বিজেপির নেতা অশ্বিনী উপাধ্যায় এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ভারতের ‘হিন্দু জাতি’ ধ্বংসের মুখে পড়েছে এবং ‘অবৈধ অভিবাসী, (মুসলিম) রোহিঙ্গা ও (মুসলিম) ধর্মান্তরিতরা’ ভারতের হিন্দু পরিচয়কে দুর্বল করে দিচ্ছে।

ভারতের উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড় দাবি করেছেন, ‘অবৈধ অভিবাসন’ দেশের জনসংখ্যাগত ভারসাম্য নষ্ট করছে। তাঁর মতে, এসব অভিবাসী ভারতের স্বাস্থ্য ও শিক্ষাব্যবস্থার ওপর চাপ সৃষ্টি করছে, নাগরিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ কমিয়ে দিচ্ছে এবং ভোটের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে গণতন্ত্রকে দুর্বল করছে। তিনি আরও সতর্ক করে বলেন, এই ‘জনসংখ্যাগত আগ্রাসন’ অব্যাহত থাকলে হিন্দুদের জাতিগত পরিচয় হুমকির মুখে পড়বে।

ভারতের ডানপন্থীরা প্রায়ই বলেন যে ‘অবৈধ অভিবাসন’ মানেই অপরাধ। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সংসদে বলেন, ‘অবৈধ অভিবাসনের সঙ্গে আরও অনেক বেআইনি কর্মকাণ্ড জড়িত।’ যদিও তিনি এ কথা বলেছিলেন আমেরিকায় থাকা ভারতীয় অভিবাসীদের প্রসঙ্গে। তবে ভারত সরকারও একইভাবে দাবি করে যে একটি সুসংগঠিত অপরাধী চক্র অবৈধ অভিবাসীদের বসবাস, চাকরি, জাল জন্মসনদ, এমনকি ভোটাধিকার পর্যন্ত নিশ্চিত করতে সাহায্য করছে।

এ কারণেই ভারতেও ট্রাম্পের মতোই পুলিশি অভিযান ও বিতাড়ন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এসবের মূল লক্ষ্য বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গারা। কিন্তু এসব অভিযানে ধরা পড়ে বহু বাংলাভাষী মুসলিম ভারতীয় নাগরিকও। কয়েক বছর আগে এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রবেশের চেয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার প্রবণতাই বেশি। কিন্তু দক্ষিণপন্থী রাজনীতির উত্থানের যুগে এসব তথ্যের কোনো গুরুত্ব নেই।

ট্রাম্পের আমেরিকা হোক বা হোক মোদির ভারত, সব সময় দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যার জন্য দোষ এসে পড়ে ‘বাইরের ষড়যন্ত্রকারী’দের ওপর।

এই মনোভাবই ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশের অভিবাসনবিরোধী অবস্থানের ভিত্তি। ভারতে এর ফলাফল হয়েছে ২০১৯ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ)। এ আইনে প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা মুসলিমদের ভারতীয় নাগরিকত্বের সুযোগ নেই।

মোদি হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হলেও তিনি যুক্তরাষ্ট্রে থাকা অবৈধ ভারতীয়দের স্বার্থ রক্ষার জন্য ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করতে রাজি নন। অভিবাসন প্রশ্নে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ট্রাম্পের মতোই। মোদি অবৈধ অভিবাসীদের প্রতি কোনো সহানুভূতি দেখান না, এমনকি তাঁরা ভারতীয় হলেও।

সোমদীপ সেন রকসাইড ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক

আল–জাজিরার ইংরেজি থেকে অনূদিত

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ট র ম প র মত বল ছ ল ন ড নপন থ র জন ত মন ত র র জন য সবচ য় সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

ফ্রান্সজুড়ে ডানপন্থীদের বিক্ষোভের ডাক

ফ্রান্সের ডানপন্থী পার্টি ন্যাশনাল র‍্যালি (আরএন) নেতা জর্ডান বারডেলা দেশজুড়ে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছেন। দলটির প্রধান মারিন লো পেনের বিরুদ্ধে আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে এ সপ্তাহে বড় বিক্ষোভ করার ডাক দেন তিনি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে মারিন লো পেনকে সাজা দিয়েছেন ফ্রান্সের একটি আদালত।

আদালত লোর ওপর সরকারি দায়িত্ব পালনে পাঁচ বছরের নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি তাঁকে চার বছরের কারাদণ্ড এবং এক লাখ ইউরো জরিমানা করেছেন। গত সোমবার প্যারিসের একটি আদালত এ রায় দেন। এর ফলে তিনি ২০২৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়তে পারবেন না। তবে আদালতে আপিল করে জিতে গেলে তাঁর জন্য নির্বাচনে দাঁড়ানোর সুযোগ তৈরি হবে।

মাইকেল বি জর্ডান

সম্পর্কিত নিবন্ধ